সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক - দীপক দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম
সুন্দরপুর নামে একটি গ্ৰামে বিনি ও মিনি নামে দুই বোন বাস করত। বিনি ছিল বড়ো আর মিনি ছোটো। তারা ছিল খুবই গরীব। তাদের বাবা অসুস্থ থাকায় তারা খুবই দুঃচিন্তার মধ্যে ছিল। দুই বোনই বাবাকে খুব ভালোবাসত। বাবা মাকে তারা ভগবানের আসনে বসিয়েছিল। তাই বাবাকে সুস্থ করার জন্য দুই বোন নানাভাবে চেষ্টা করত। কিন্তু ছোটো হওয়ার জন্য তারা তেমন কিছুই করতে পারত না। তাই ছোটো ছোটো বিষয়গুলো তারা খেয়াল রাখত। তাদের বাবা মা যা খেতে পছন্দ করত তা তারা এনে দেওয়ার চেষ্টা করত। অসুস্থ মানুষ যা যা খেলে সুস্থ হয়, তারা তাদের বাবাকে তাই খাওয়ানোর চেষ্টা করত।
একদিন দুই বোন গ্ৰামের এক ডোবাতে মাছ ধরতে যায়, তাদের বাবাকে খাওয়াবে বলে। বিনি মাছ ধরছে আর মিনি বৃষ্টি হওয়ার দরুন দিদির মাথায় কচুপাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
মিনি তার দিদিকে বলে-“এই দিদি বৃষ্টি তো খুব জোরে শুরু হয়ে গেল এখন তাহলে বাড়ি যাব চল। তা নাহলে মা কিন্তু খুব বকবে।”
তখন বিনি বলে-“কিছু হবে না, বাবা বলেছে বর্ষাকালে কখনো বৃষ্টি কম কখনো, বেশি হয়। তুই কচুপাতাটা ভালো করে ধর।”
সেইসময় মিনি বলে-“ওই দেখ দিদি, ওই দূরে
একটা কত বড়ো মাছ।”
বিনি বলে-“কোথায়! ও….. ওটা, ওটা তো সাপ। অনেকক্ষণ ধরে ঘোরাঘুরি করছে।”
মিনি বলে-“কী সাপ? ওরে দিদি বাড়ি চল। আমার খুব ভয় করছে।”
বিনি বলে-“ওটা জলঢোঁড়া, ও কিছু করবে না।”
তখন মিনি বলে-“তোর কিছুতেই ভয় করে না, তাই না রে দিদি। মা ঠিক বলে ‘গেছো মেয়ে’ একটা। তাড়াতাড়ি চল দিদি, তা নাহলে মা আজ খুব বকবে।”
বিনি বলে-“দাঁড়া, একটা শিঙি মাছ পেলেই চলে যাব। ডাক্তারবাবু বলেছে বাবাকে জ্যান্ত মাছের তরকারি খেতে।”
মিনি বলে-“বাবা কবে ঠিক হবে রে দিদি।”
🍂
তখন বিনি বলে-“কী জানি? মাকে জিজ্ঞাসা করলে তো মা শুধু কাঁদতে থাকে।”
মিনি বলে-“,বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে না তো রে দিদি।”
তখন বিনি বলে-“দূর বোকা, ওসব কথা বলতে নেই। দেখবি আমি একদিন শহরে কোনো বড়ো এক ডাক্তারবাবুর কাছে বাবাকে নিয়ে যাব। আর সেখানে গিয়ে বাবাকে সুস্থ করে আনব।”
মিনি বলে-“হ্যাঁ রে দিদি! সবাই বলে গ্ৰামের ডাক্তারবাবু নাকি সত্যিকারের ডাক্তারবাবু নয়, এমনই ওষুধ দেয়?”
বিনি তখন বলে-“হ্যাঁ রে বোন, মা তো বাবাকে বলেছে সে কথা। কিন্তু বাবা বলেছে আমরা গরীব মানুষ, তাই শহরে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতে পারব না।”
মিনি বলে-“আমরা গরীব কেন দিদি?”
বিনি বলে-“জানি না রে বোন। ভগবান যেমন দিয়েছেন তেমনভাবেই আমরা আছি।”
মিনি বলে-“এবার চল দিদি, আমার নাকটা কেমন জানি সূড়সূড় করছে। মনে হয় ঠান্ডা লাগবে।”
তখন বিনি বলে-“ঠিক আছে চল। এই যে কয়টা পুঁটি আর পাকাল মাছ ধরেছি এতেই হয়ে যাবে।”
এইবলে দুজনে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
এদিকে তাদের মা তাদের বাবাকে বলে-“কী গো, আজ একটু ভালো লাগছে তোমার?”
তখন বিনি ও মিনির বাবা বলে-“আর ভালো, আমি আর কোনোদিন ভালো হব না। মাঝখান থেকে আমার জন্য খরচ করতে গিয়ে সংসারটাই ভেসে যাবে গো। ভেবেছিলাম মেয়ে দুটোকে মানুষের মতো মানুষ করব। কিন্তু তার আর হলো না গো।”
ওদের মা তখন বলে-“তুমি ওসব কথা বলো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সেইসময় মিনি ও বিনি বাড়িতে আসে।
ওদের মা বলে-“কী রে এতক্ষণ কোথায় ছিলি তোরা। এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস।”
তখন বিনি বলে-“মা, ডাক্তারবাবু বাবাকে জ্যান্ত মাছের তরকারি খেতে বলেছে। তাই আমরা দুজনে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম।”
ওদের বাবা তখন বলে-“কী দরকার মা এতসব করার। আমার তো কিছুই খেতে ভালো লাগে না।”
বিনি বলে -“মা আমি মাছগুলো পরিষ্কার করে দি।”
তার মা বলে-“পারবি!”
বিনি তখন বলে-“হ্যাঁ মা, পারব। তুমি কোনো চিন্তা করো না।”
এই বলে বিনি মাছ কাটতে চলে যায়। মিনিও দিদির পেছন পেছন যায়।
ওদের বাবা তখন ওদের মাকে বলে-“বিনিটা আমাদের হঠাৎ করেই কত বড়ো হয়ে গেল বলো।”
ওদের মা বলে-“গরীবের মেয়েরা হঠাৎ করেই বড় হয়ে যায়।”
এদিকে বিনির মাছ কাটার দেখে মিনি বলে-“বাঃ! দিদি। তুই কত সুন্দর মাছ কাটতে পারিস। কোথায় শিখলি রে দিদি?”
বিনি বলে-“কোথার আর, মায়ের কাছে।”
মিনি বলে-“আমি তো পারি না, আমার তো প্রচুর ভয় লাগে।”
বিনি বলে-“জানিস বোন আজ না আমি ওই পেয়ারা বাগানে যাব।”
মিনি তখন বলে-“একা যাবি দিদি! মা বলেছিল ওখানে ভূত আছে।”
বিনি বলে-“ওসব বাজে কথা। ভূত বলে কিছু হয় না। আজ আমি ওখান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসব। বাবা খুব পছন্দ করে পেয়ারা মাখা খেতে। আর একজনকেও খাওয়াবো, সেও খুব ভালোবাসে পেয়ারা মাখা খেতে।”
মিনি বলে-“কে রে দিদি? মা নাকি।”
বিনি বলে-“হুঁ হুঁ মা না অন্য একজন।”
মিনি তখন বলে-“ ও বুঝেছি…মাস্টারদাদু তো!”
বিনি বলে-“হ্যাঁ রে বোন।”
এরপর বিনি মাছ কাটা শেষ করে পেয়ারা বাগানের দিকে যায়। সেখান থেকে পেয়ারা এনে মাখা করে মাস্টারদাদুর জন্য নিয়ে যায়।
মাস্টারদাদুর বাড়ি গিয়ে জোরে জোরে ডাকতে থাকে-“দিদা ও দিদা…. কোথায় গেলে।”
মাস্টারদাদুর স্ত্রী বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসেন। আর বলেন-“কী হয়েছে রে বিনি, এত ডাকছিস কেন? এতদিন পর তোর আমাদের কথা মনে পড়ল। হ্যাঁ রে বিনি তোর বাবা এখন কেমন আছে?”
বিনি বলে-“বাবা ভালো নেই গো দিদা। আগের থেকে আরও খারাপ অবস্থা। কিন্তু তুমি দেখ দিদা একদিন না একদিন আমি বাবাকে সুস্থ করবই। আচ্ছা দিদা মাস্টারদাদু কোথায় গো? আমি মাস্টারদাদুর জন্য একটা জিনিস এনেছি।”
দিদা বলেন-“তোর মাস্টারদাদু একটু বাইরে বেরিয়েছেন, এখুনি চলে আসবেন। তুই এখানে একটু বস আমি তোর জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসছি।”
বিনি বলে-“না গো দিদা, আমি কিছু খাব না। বাড়িতে বাবা একা আছে। মা মিনিকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে, তাই আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। মাস্টারদাদুকে এই জিনিসটা দিয়েই চলে যাব।”
সেইসময় সেখানে মাস্টারদাদু এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন-“কে এসেছিস রে, বিনি নাকি?”
বিনি বলে-“হ্যাঁ মাস্টারদাদু আমি। তোমার পছন্দের একটা জিনিস এনেছি।”
মাস্টারদাদু বলেন-“ও পেয়ারা মাখা।”
বিনি তখন বলে-“তুমি বুঝলে কী করে?”
মাস্টারদাদু বলেন-“কারণ আমার বিনি দিদিভাই জানে আমি পেয়ারা মাখা খুব ভালোবাসি।”
বিনি বলে-“হ্যাঁ দাদু, সেই জন্য পেয়ারা মাখিয়ে আগে তোমার জন্য নিয়ে এলাম।”
তখন দিদা বলেন-“তোমরা কথা বলো আমি এখুনি আসছি।”
মাস্টারদাদু এরপর বিনিকে বলেন-“দিয়ে বল বিনি তোর বাবা এখন কেমন আছে।”
বিনি বলে-“ভালো নেই গো দাদু। আগের থেকে আরও খারাপ অবস্থা। গ্ৰামের ডাক্তারের ওষুধে বাবা ভালো হচ্ছে না। আমরা বাবাকে শহরে নিয়ে যেতে চাই, কিন্তু আমরা অনেক গরীব। আমাদের এত টাকা কোথায় যে বাবাকে শহরের ডাক্তারের কাছে দেখাব।”
মাস্টারদাদু বলেন-“দাঁড়া, আমি তার ব্যবস্থা করছি। আমার এক ছাত্র শহরের অনেক বড়ো ডাক্তার। ও যাতে তোর বাবার চিকিৎসা করতে পারে তার ব্যবস্থা করছি।”
বিনি বলে-“সত্যি দাদু!”
এরপর মাস্টারদাদু চিঠি লিখতে বসেন। বিনি বলে-“কী করছো দাদু?”
মাস্টারদাদু চিঠি লেখা শেষ করে বলেন-“বিনি এই চিঠিটা আর এই কলমটা ধর। এটা শহরে গিয়ে আমার ওই ছাত্রকে দিবি, দিলে ও তোর বাবার চিকিৎসা ঠিক করে দেবে। ও খুব ভালো মনের মানুষ।”
বিনি তখন বলে-“তুমি সত্যি বলছো দাদু?”
মাস্টারদাদু বলেন-“হ্যাঁ রে সত্যি। আমি তোদেরকে ওর কাছে নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু কোমরের ব্যথাটা একটু বেশি হওয়ায় আমি যেতে পারব না। তুই তোর মাকে নিয়ে যেতে পারবি তো? আমি আমার ছাত্রের ঠিকানা এই কাগজে লিখে দিয়েছি। তুই পারবি তো?”
বিনি বলে-“ঠিক পারব দাদু। বাবাকে সুস্থ করার জন্য আমি সব করতে পারব।”
সেইসময় দিদা সেখানে আসেন, আর বলেন-“এই নে বিনি এই টিফিনটা নিয়ে যা। এখানে সামান্য আলুপোস্ত আর মিষ্টি আছে। বাড়িতে গিয়ে সবাই মিলে খাবি।”
বিনি বলে-“দিদা তুমি আমাদের জন্য খাবার দিলে। আমার বোন আলুপোস্ত খেতে খুব ভালোবাসে। তুমি খুব ভালো দিদা। আচ্ছা আমি তাহলে আজ আসি।”
দিদা বলেন-“ঠিক আছে। আবার আসিস কিন্তু।”
এরপর মাস্টারদাদু দিদাকে বলেন-“মেয়েটা ওর বাবাকে সুস্থ করার জন্য প্রাণও দিতে পারে।”
দিদা বলেন-“হ্যাঁ গো ঠিক বলেছ। বিনি সত্যি অনেক ভালো ও বুঝদার মেয়ে। হে ভগবান মেয়েটার দিকে মুখ তুলে তাকাও।”
এরপর বিনি বাড়িতে এসে তার মাকে সব কথা বলে। তার মা বলে-“কিন্তু বিনি আমরা খুব গরীব। শহরে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবো এত টাকা কোথায়?”
তখন বিনি বলে-“চল না মা, একবার চেষ্টা তো করি। তুমি আর আমি গিয়ে ডাক্তারবাবুকে সব বলি। তারপর আমরা ওনাকে গ্ৰামে আসার কথাও বলবো।”
তার মা বলে-“তোর বাবাকে একা রেখে আমি শহরে যাব না।”
বিনি বলে-“কেন মা মিনি তো আছে, ও ঠিক বাবাকে দেখে রাখবে।”
তার মা বলে-“মিনি অনেক ছোটো, ও পারবে না। থাক শহরে যাওয়ার দরকার নেই। যা আছে কপালে তা হবে। কিন্তু তোর বাবাকে একা রেখে আমি কোথাও যাব না।”
কিন্তু বিনি তার জেদ ছাড়ে না। সে তার বোন মিনিকে নিয়ে পরের দিন সকালে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
মিনি বলে-“দিদি তুই পারবি ওই ডাক্তারবাবুর বাড়ি খুঁজতে। আমরা কিন্তু কোনোদিন শহরে যাইনি, যদি হারিয়ে যাই! তাহলে বাবা মার কী হবে?”
তখন বিনি বলে-“কোনো চিন্তা করিস না, আমরা ঠিক পারব। আর বাবাকে সুস্থ করতে না পারলে আমরা কেউ ভালো থাকতে পারব না। তাই আমাদের পারতেই হবে রে বোন।”
এরপর বিনি ও মিনি শহরে গিয়ে মাস্টারদাদুর দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে যায়। সেখানে গিয়ে দাদুর ওই ডাক্তার ছাত্রের সঙ্গে তাদের দেখা হয়।
বিনি ডাক্তারবাবুকে বলে-“ডাক্তারবাবু আমার বাবা খুব অসুস্থ। তুমি আমার বাবাকে ঠিক করে দেবে।”
ডাক্তারবাবু বলেন-“কে তোমরা, আর এসব কী বলছো?”
তখন বিনি মাস্টারদাদুর দেওয়া চিঠি ও কলমটা ডাক্তারবাবুর হাতে তুলে দেয়।
ডাক্তারবাবু সব দেখে বলেন-“এস এস তোমরা ভেতরে এস। এ তো আমার মাস্টারমশাইয়ের চিঠি।”
বিনি বলে-“হ্যাঁ, মাস্টারদাদুই আমাদের এখানে পাঠিয়েছে।”
তখন ডাক্তারবাবু বলেন-“এই কলমটা মাস্টারমশাই তাঁর মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এটি তিনি কখনো কাছ ছাড়া করতেন না। আমাকে বলেছিলেন - মৃন্ময় তুমি যেদিন মানুষের মতো মানুষ হবে সেদিন আমি এই কলমটা তোমাকে দেব।”
বিনি বলে-“হ্যাঁ মাস্টারদাদু আমাদের বলেছে সে কথা। বল না ডাক্তারবাবু তুমি আমার বাবাকে ঠিক করে দেবে তো? আমরা কিন্তু খুব গরীব কোনো টাকা দিতে পারব না।”
তখন ডাক্তারবাবু বলেন-“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমি তোমার বাবাকে ঠিক করে দেব। আমার মাস্টারমশাই যখন তার প্রিয় জিনিসটা আমাকে দিয়েছেন, তখন তো আমাকে আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতেই হবে।”
বিনি বলে-“তাহলে তোমাকে আমাদের সঙ্গে আমাদের গ্ৰামে যেতে হবে। তোমাকে কিন্তু একটু হাঁটতে হবে এই আর কী।”
তখন ডাক্তারবাবু বলেন-“শুধু তোমাদের নয়, ওটা আমারও গ্ৰাম। আর তোমাদের হাঁটতে হবে না। আমি আমার গাড়ি করে তোমাদের নিয়ে যাব।”
মিনি বলে-“কী মজা, আমরা গাড়িতে করে যাব।”
0 Comments