“মালবিকা! এই মালবিকা!”
মালবিকা পিছন ফিরে দেখে বীণাপাণি তাকে ডাকছে, বীণাপাণি চৌধুরী গত বছরের ছাত্রী, ক্লাস প্রোমোশন পায়নি।
এবছর ও পাস না করতে পারলে এই স্কুল ছেড়ে চলে যেতে হবে, এই স্কুলে এটাই নিয়ম।
বীণাপাণি র চোখ দুটো বেশ বড় বড় সুন্দর। কোমর ছাড়ানো ওর দুই বেণী, সামান্য কোলকুজো মতো, মালবিকা র থেকে অনেকটাই লম্বা। তবে বয়সে ও হয়তো মালবিকার থেকে বড় ই হবে, কারণ প্রায় প্রত্যেক ক্লাসে ওকে একবছর করে থাকতে হয়েছে।
বর্তমানে ইউনিভার্সিটিতে পাঠরত মালবিকা এখন চলে গেছে ওর ক্লাস এইটে র ক্লাস রুমে – হাতে ধরে আছে দামী বিদেশী কলম, কোন একটা রহস্যের কূল-কিনারা করে উঠতে পারছে না যেন।
ওরা ক্লাস এইটে র ছাত্রী। মালবিকা পড়াশোনায় ভালো, সব পরীক্ষায় বরাবর ওপরের দিকে মার্কস থাকে। বীণাপাণির সাথে ওর ক'দিন হয় বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। বীণাপাণিই ডেকে কথা বলেছে। ক্লাসের কেউই বীণা র সাথে সেরকম মেশে না, অবশ্য সবার কাছেই ও নতুন তো! ও নিজেও মালবিকা ছাড়া অন্য কারো সাথে কথা বলতে তেমন আগ্রহ দেখায় নি। মালবিকাকে কেন জানি না বেশ আপন মনে হয়েছে ওর। এই কদিনেই বীণা অনেক কথা বলেছে মালবিকা কে - নিজের ব্যাপারে, পরিবারের ব্যাপারে - যে কথা হয়তো অন্য কেউ জানেনা, বা খুব কম লোকই জানে। আগের বছরের সহপাঠীরা ও কেউ ওর সাথে কথা বলতে আসেনা, খোঁজ নেয় না, মেয়েটা সারা দিন চুপচাপ একাই বসে থাকে।
🍂
মালবিকা ওর পাশে গিয়ে বসলো, জিজ্ঞাসা করলো: “এখন তো টিফিন -টাইম, তোর খাওয়া হয়ে গেছে?” বীণাপাণি চুপ করে থাকে, তার পর বলে "দু'টো ভাত খেয়ে আসতে পেরেছি, এই না কত, আবার টিফিন ?"
মালবিকা ওকে নিজের টিফিনের ভাগ দেয়, বীণা কিছু তে নিতে চায় না, কিন্তু বন্ধু র সাথে পেরে ওঠে না, খেতে খেতে বলে "খুব খিদে পায় জানিস, কি করবো বল? আমরা সাত ভাই বোন তো? বাবা সব সময় রেগে থাকে, বলে: রাবণের গুষ্টি। আমরা কি নিজের ইচ্ছে য় পৃথিবীতে এসেছি, বল্ ? বুঝতে পারি, বাবার সামান্য মাইনে, তাই দিয়ে সবদিক সামলাতে পারছে না; মা ও এজন্য মরমে মরে থাকে জানিস?”
মালবিকা চুপ করে ওর কথা শোনে, ভাবে ও নিজেও তো খুব অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে নয়, তবে বীণা দের মতো ওদের আর্থিক অবস্থা অতটা খারাপ না। ওরা দুই বোন, বাবা সরকারী চাকুরে, মা গৃহিণী, মোটামুটি সচ্ছল পরিবার।
"জানিস, আমার আর পড়া হবে না, এবারও ফেল করবো - পড়ার অনেক কিছুই বুঝতে পারিনা, কেউ দেখিয়ে দেওয়ারও নেই। বাবা বলেছে এবার স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলে ঘরে বসিয়ে রাখবে, ঘরের কাজ করাবে।
কেউ যদি বিনা পয়সায় বিয়ে করে, তবে বিয়ে দিয়ে দেবে"।
মালবিকা বলে, "তুই টিফিনের সময় আমার কাছে কিছু কিছু পড়া দেখে নিতে পারিস "
"ঠিক আছে, দেখিয়ে দিস, তবে তোরও তো নিজের পড়া আছে?"
"আমি তো আর টিফিনের সময় পড়িনা, টিফিন খাওয়া হয়ে গেলে তোকে সেদিনের পড়াগুলো বুঝিয়ে দেব- আমারও পড়া হয়ে যাবে।"
যখন যে টিচার ক্লাসে আসেন, শ্যামলীদি, অনিতাদি, যোগমায়াদি , বীণাকে পড়া জিজ্ঞাসা করলে সে চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, বকুনি খায়, কোন উত্তর দেয় না - পুরো পিরিয়ডটাই দাঁড়িয়ে থেকে পার করে দেয়। টিচাররাও আর ওর কাছ থেকে কোন উত্তর আশা করেন না।
ইদানীং অবশ্য একটু অন্যরকম দৃশ্য দেখা যাচ্ছে: বীণা ক্লাসে উত্তর দেবার চেষ্টা করছে এবং মাঝে মাঝে ঠিকঠাক উত্তরও দিচ্ছে। টিচাররা এবং অন্যান্য ছাত্রীরা একটু অবাক হলেও ভাবছে বীণা এবার পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে।
"মালবিকা, তুই আমাকে আগের দিনের পড়াটা বুঝিয়ে দিয়েছিলি, তারপর বাড়ি গিয়ে একটু দেখে নিয়েছিলাম - তাই আজ ক্লাসে পড়া পারলাম!" বীণা উচ্ছ্বসিত। মালবিকা বলে, "ঠিক, বাড়ি গিয়ে একবার পড়াগুলো অবশ্যই দেখে নিবি, তাহলেই তোর পড়া তৈরি হয়ে যাবে।"
"সময় কোথায় পাই বল্ ? বাড়ির এত কাজ মা তো একা হাতে পেরে ওঠে না, তাছাড়া মায়ের শরীরও প্রায়ই ভালো থাকে না, আমাকে অনেকটাই সামলে দিতে হয়।"
মালবিকা বোঝে, একটু সময় আর সাহায্য পেলে বীণাপাণি ঠিক পাস করে যাবে। মালবিকা পড়ার বই ছাড়া ও অনেক অন্যান্য বই পড়ে, বাড়ির পরিবেশে নিজস্ব মুক্ত চিন্তার সুযোগ আছে, তাই ওর চিন্তা, ভাবনা অনেক পরিণত।
বীণা যেন ক্রমশঃ আঁকড়ে ধরতে থাকে মালবিকাকে; শুধু তো পড়াশোনা নয়, অন্য অনেক বিষয়, বাড়ির ব্যাপারেও ওর পরামর্শ চায়।
বিনীতা, স্নেহা, সুদক্ষিণাদের সাথে টিফিনের সময় কথা বলার সুযোগ পায় না মালবিকা এখন। ওরা ঠাট্টা করে, বলে মালবিকার বেস্ট ফ্রেন্ড বীণাপাণি।
সঙ্গীতার বাড়ি বীণাপাণি র বাড়ির কাছাকাছি, সঙ্গীতা একদিন বলছিল,"জানিস মালবিকা, বীণার মামারা খুব পড়াশোনা জানা, অবস্থাপন্ন, বেশী আসা - যাওয়া নেই ওদের বাড়িতে, কিন্তু যখনই আসেন, তখনই ওদের জন্য ভালো ভালো জিনিস নিয়ে আসেন।
মালবিকা কিছু বললো না, ভাবলো ওঁরা তো বীণাকে পড়াশোনার ব্যাপারে একটু সাহায্য করতে পারেন ?
বীণাপাণি মাঝে মাঝেই লম্বা স্কুল কামাই দেয়, বলে, "ঘরের কাজ করতে গিয়ে দেরী হয়ে গেছে, দেরী হলে তো আর স্কুলে ঢুকতে দেয় না, তাই আসিনি।"
তবে সত্যি কথা বলতে কি, মাঝে মাঝে বীণার কামাই করার দিন গুলোতে আজকাল মালবিকা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, সেই দিনগুলোতে ও অন্য বন্ধুদের সাথে গল্প করতে পারে। বীণা এলে তো হয় পুরো টিফিন পিরিয়ডে ওকে পড়া বোঝাও, নয় ওর নিজের কথা, বাড়ির কথা শোনো।
ও যে মালবিকা কে কেন এত ভরসা করে মালবিকা বুঝতে পারে না; আসলে কেউই বীণার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয়, আর পড়া দেখিয়ে দেওয়া? এতগুলো বছরের মধ্যে একমাত্র এই বছরেই এই বন্ধু মালবিকা ওকে পড়ার ব্যাপারে সাহায্য করছে - সহপাঠী হয়ে ও। তাই তো বীণা র মনে হয় মালবিকা অনেক বেশি দরদী, আন্তরিক বন্ধু। এই ক্লাস এইট পর্যন্ত পর্যন্ত স্কুল জীবনে (ফাইভ থেকে এক বছর করে বেশী ) ওর এমন বন্ধু আর হয়নি, হবেও না।
মালবিকা উঁচু ক্লাসে উঠে যাবে - বীণিপাণি যে কোন ক্লাসে স্কুল থেকেই বেরিয়ে যাবে, আর কোনদিন হয়তো দেখাই হবে না দু'জনের। ক্লাস এইটে এই বন্ধুত্বের শুরু , ক্লাস এইটেই শেষ।
মালবিকা মাঝে মাঝে ভাবে বীণা কে এড়িয়ে চলবে, কিন্তু পারে না। ঠিক ডাক আসে –"মালবিকা, শোন না রে, খুব দরকার" হয় ওকে পড়া বুঝিয়ে দাও, নয় শোনো, কীভাবে আজ সকাল থেকেই ওদের বাড়িতে অশান্তি চলছে অথবা ওদের পাড়ার ওর কোনো পছন্দের ছেলে ঠিক কিভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু ও তাকাতে পারেনি, কারণ ও নিজে র অযোগ্যতা জানে – মালবিকা কে এই সবই বসে বসে শুনতে হয়।
তবে আজ প্রায় এক সপ্তাহ পর বীণা স্কুলে এসেছে। মালবিকা লক্ষ্য করে বীণা কিন্তু ওকে দেখে অন্য দিনের মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো না।
কেমন যেন একটু "চুপিচুপি" ভাব। মাঝে মাঝে শুধু তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভাবে হাসছিলো।
মালবিকাই জিজ্ঞাসা করে "এতদিন আসিসনি কেন?"
"পরে বলবো, টিফিনের সময় আমার বেঞ্চে এসে বসবি তো ?"
"হ্যাঁ, বসবো"।
"তখন বলবো"।
একটা র পর একটা ক্লাস চলে, শেষ হয় – টিফিনের ঘন্টা বাজে; মালবিকা নিজের টিফিন বক্স নিয়ে বীণার পাশে গিয়ে বসে।
"তুই একটু নে ?"
"না রে, রোজ রোজ আমার ভালো লাগে না "।
"তুই যে বলিস, আমিই তোর একমাত্র বন্ধু – তাহলে আমার টিফিন থেকে নিবি না কেন?"
"আজ ভালো লাগছে না, খেতে ইচ্ছে করছে না, তুই তাড়াতাড়ি খা, তারপর দরকারী কথা আছে।"
মালবিকা র মনে হয় বীণা কোনো কারণে খুব উত্তেজিত হয়ে আছে, ও তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে।
"এবার বল্, কি বলবি।"
বীণাপাণি একবার মালবিকার দিকে তাকায়, তারপর সন্তর্পণে নিজের ব্যাগ থেকে একটা পেন বের করে – বাইরের আলোয় ঝলমল করে ওঠে গোল্ডেন কালারের দামী বিদেশী পেন। "দেখ এটা"।
"এ তো খুব দামী, বিদেশী পেন, কোথায় পেলি?"
"গতকাল ছোট মামা এসেছে অনেক দিন পর, এটা ছোট মামা র পেন"।
"তোকে দিয়েছে?"
" না, এটা তোর জন্য"
"তার মানে ? তোর ছোট মামা তো আমাকে চেনেন না, তিনি আমাকে পেন দিলেন কেন?"
ছোট মামা তো দেয়নি, আমি নিয়েছি, তোকে দেব বলে।"
মালবিকা বীণার দিকে তাকিয়ে থাকে, ওর কথা বোঝার চেষ্টা করে, বীণাও অপেক্ষা করে মালবিকা কি বলে তা শোনার জন্য, দৃষ্টি তে উদ্বেগ, আশঙ্কা, আনন্দ মেশানো।
"তুই তার মানে না বলে পেনটা নিয়ে এসেছিস, চুরি করেছিস!"
বীণা র কথা তুতলে যায়, বলার চেষ্টা করে "না, না চুরি না"
"চুরি না তো কি? তোর ছোট মামা জানেন যে তুই পেন টা নিয়েছিস?"
বীণা র মাথা নীচু, অল্প অল্প কাঁপছে, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে “না।"
"ছি:, মালবিকা উঠে দাঁড়ায় "তুই আমার বন্ধু না, আর কোনদিন আমার সাথে কথা বলবি না।"
এবার বীণাপাণি ব্যাকুল হয়ে উঠে দাঁড়ায়, " শোন, ছোটমামা র আরো অনেক ভাল ভাল পেন আছে, এটা হয়তো আমাদের কোন ভাই বোন কেই দিয়ে দিত, কিন্তু আমরা কেউ তো তোর মত পড়াশোনায় ভালো না, এই পেন দিয়ে তুই লিখবি, ভালো রেজাল্ট করবি, আমার খুব ভালো লাগবে রে। তাছাড়া, তুই আমাকে পড়াশোনায় কত সাহায্য করিস, আমার ও তো তোকে কিছু দিতে ইচ্ছে হয় বল্ ?"
"তাই বলে চুরি করবি ? ভাবলি কি করে যে ঐ চুরি করা পেন আমি নেব ? চোর কোথাকার ! আবার কারণ দেখাচ্ছিস?"
বীণাপাণির বড় বড় দুই চোখে টলটলে জল, নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে, মালবিকা আর একটাও কথা না বলে উঠে এসে নিজের জায়গায় বসলো।
এরপর খুব কম দিন স্কুল হয়েছিল, বাৎসরিক পরীক্ষা এসে গেছিল তো, সব ছাত্রীই কোনো দিন এসেছে, কোনোদিন আবার আসেনি।
তবে মালবিকাকে ওর বন্ধুরা বীণাপাণির কথা জিজ্ঞাসা করলে ও সযত্নে এড়িয়ে গেছে। এরপর আর কোনো দিন দু'জনের দেখা হয়নি।
0 Comments