জ্বলদর্চি

সেকেন্ড ম্যারেজ /পুলককান্তি কর


সেকেন্ড ম্যারেজ 

পুলককান্তি কর


অনেকক্ষণ ধরেই ছেলেটিকে খেয়াল করছিলেন মহারাজ। ভবনের পোষাক দেখে মনে হচ্ছে ক্লাশ সিক্স এর ছেলে, কিন্তু মুখটা কেন অচেনা লাগছে? চুলের ছাঁট তো এখানকার ধারা মেনেই। সবার নাম মনে না থাকলেও সবার মুখটা তো মনে থাকে তাঁর। ছেলেটিও যেন কেমনধারা। এক কোণে চুপটি করে বসে আছে। অন্যান্য ছেলেরা দল বেঁধে খেলছে, দৌড়োচ্ছে, বল নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করছে আর এই ছেলেটি মাঝে মাঝে চোখে হাত দিচ্ছে। একটা ছেলেকে দিয়ে ওকে ডেকে পাঠালেন মহারাজ।

  -- তোর নাম কী?

--  অভ্রদীপ মন্ডল।

--  তোর কি শরীর খারাপ?

 -- না মহারাজ!

--  তবে খেলছিস না কেন?

--  এমনি।

--  নে সামনের টুলটায় বোস।

     অভ্রদীপ সন্তপর্ণে বসল মহারাজের সামনে। মহারাজ একদৃষ্টে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'কী হয়েছে?' মহারাজের এই দৃষ্টিটুকু যথেষ্ট।

     অভ্রদীপ মাথা নীচু করে বলল, 'আজ আমার জননীর শুভ বিবাহ মহারাজ মহারাজ।'

  মহারাজ এই সাধুভাষার প্রয়োগটি খেয়াল করলেন, মুখে কিছু বললেন না। এই মিশন আশ্রমের আবাসিক ছাত্ররা মহারাজের সামনে যেতে ভয় পায়। মহারাজের ডাক মানে সাধারণত বড় কিছু ঘটনা। যদিও মহারাজ যথেষ্টই ছাত্র বৎসল, তবু এটা এখানকার পরম্পরা। তাঁর সামনের ছেলেটি এইরকম ব্যঙ্গ বাক্য প্রয়োগ করছে মানে বিষয়টি খুবই গুরুতর। বললেন, 'তুই জানলি কী করে?'

--  গতবারের গার্জেন মিট এ এসে মা বলে গেছে।

--  তোকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেননি?

--  না। বলল, এমন ঘটনায় নাকি এখান থেকে ছুটি অ্যালাউ করা হয় না।

--  তোর কি বিয়েটা নিয়ে কোনও খারাপ লাগা কাজ করছে?

অভ্রদীপ চুপ করে রইল। মহারাজ বললেন, 'তোর খারাপ লাগছে বুঝতে পারছি। কিন্তু বিষয়টা তো একটু পজিটিভ অ্যাঙ্গেলে দেখতে পারিস।

--  এতে পজিটিভ কী আছে মহারাজ? 

-- তুই একজন বাবা পাবি। গার্জেন মিটে সবার বাবা-মা আসে; তোর শুধু মা। এবার দুজনে আসবেন, তোকে ভালোবাসবেন।

--  আমার ভালবাসার দরকার নেই!' বলেই কেঁদে ফেলল অভ্র।

   মহারাজ বললেন, ছেলেদের বড় হওয়ার সময় বাবার প্রয়োজন।

--  ওটা তো মহারাজ যারা বাড়ীতে থাকে সেই সব বাচ্চাদের জন্য। মিশনের হোস্টেলে আমাদের আর বাবা কী কাজে লাগে?

--  তবুও! বছরের মধ্যে তিনমাস তো তোরা বাড়ীতে থাকিস, তখন দেখবি বাবা তোর কত কাজে আসবে।

--  স্টেপ ফাদার। বকুনি দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও কাজে আসবে না মহারাজ। 

🍂

অভ্রদীপের এই তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করলে মহারাজ। যুগের ধর্ম। বিষয়টা তো উড়িয়ে দেওয়ারও নয়। সমাজে থাকলে এসব জ্ঞান সবারই টনটনে হয়ে যায়। এরা তো সমাজেরই ফসল। তবু উপদেশের ছলে বললেন, মানুষের উপর ভরসা হারানো পাপ অভ্র। সব মানুষই তো খারাপ হয় না; সব 'সৎ বাবারা' অসৎও হয় না!

  অভ্র খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, 'মহারাজ আমার বাবার সব প্রপার্টি কি আমার স্টেপ ব্রাদাররাও লিগালি হায়ার করবে?

    মহারাজ এবার সত্যি সত্যি চমকালেন। এখনকার ছেলেরা অনেক অ্যাডভান্স উনি জানেন, কিন্তু একটি বারো তেরো বছরের ছেলে উত্তরাধিকার নিয়ে এত চিন্তিত – তা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল মায়ের স্নেহের অধিকার ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বুঝি ছেলেটি কাতর ছিল, এখন মনে হচ্ছে বিষয়টি এত সরল নয়। সম্পত্তির অধিকারও বড় একটা কারণ। জড়বাদ আজ কীভাবে সবাইকে গ্রাস করে নিচ্ছে! এ সমাজে তো আর মানুষজন ত্যাগ করার কথা ভাবছেই না! সেদিন প্রেসিডেন্ট মহারাজ বলছিলেন, আশ্রমে এখন সন্ন্যাসীর খুব অভাব। আগের মত এখন লোকে সন্ন্যাস নিচ্ছে না। মহারাজ বললেন, ‘তোমার বাবা বুঝি অনেক সম্পত্তি রেখে গেছেন?’

--  হ্যাঁ।

--  তুমি কী করে জানলে?

--  মা বলেছে। আমি মিশনে ভর্তি হবার সময় আমাকে আলমারি খুলে সব দেখিয়ে দিয়েছে। বলা তো যায় না যদি মায়ের হঠাৎ কিছু হয়ে যায় – সেই জন্য। 

-- তোমার মা যাঁকে বিবাহ করছেন, তাঁর ছেলেমেয়ে? 

-- একটি মেয়ে দুটি ছেলে।

  দ্যাখো অভ্র, তোমার মায়েরও তো একজন সঙ্গী দরকার। রাতে ভিতে কোনও বিপদে আপদে পড়লে একজন লোক তো দরকার যে হাসপাতালে নিয়ে যাবে!

--  তাহলে মহারাজ আমাকে মিশনে দেওয়ার তো কোনও দরকার ছিল না। আমি মাকে দেখে শুনে রাখতে পারতাম।

--  এটা তো তোমার ভালোর জন্য অভ্রদীপ! এতে তোমার কেরিয়ার সিকিওরড হবে, তুমি বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে – এটা তো তোমার মা চাইবেনই।

--  না মহারাজ। শুধু এটাই নয়, এটা মায়ের পরিকল্পনাই ছিল। আমি থাকলে বিয়ে করতে অসুবিধা হত, তাই কায়দা করে সরিয়ে দিয়েছে। 

    হয়তো এটাও কারণ। বেশীরভাগ মানুষ পরিকল্পনা করেই পা ফেলে। সুতরাং অভ্রদীপের এই যুক্তি একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। তবে কিনা এই ধরনের সিদ্ধান্তের পিছনে মায়ের সন্তানের প্রতি কল্যাণ কামনা একেবারেই নেই – এটা ভাবতে মহারাজের কষ্ট হল। তিনি বললেন, 'সব কিছুর মধ্যে ভালোটা দেখতে শেখ বাবা!' বলেই তাঁর মনে হল এত জটিল যাদের চিন্তাভাবনা, তাদের কাছে এসব কথা অরণ্যে রোদন। এসব নিয়ে অকারণ কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বললেন ‘বিয়েটা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হচ্ছে না কি সোশ্যাল অনুষ্ঠান করে হচ্ছে বলতে পারবি?’

--  অনুষ্ঠান করেই হচ্ছে!

--  তুই কি বাড়ী যেতে চাস?

--  হ্যাঁ মহারাজ। কিন্তু আমাকে কে নিয়ে যাবে? মা তো আর নিতে আসবে না। 

    মহারাজ বলেন, 'তুই খেলতে যা। আমি দেখছি।' 

     আশ্রমের রেজিস্টার খুলে অভ্রদীপের মায়ের নম্বর বের করলে মহারাজ। দু তিনবার কল করার পর একসময় ভদ্রমহিলা ধরলেন।

--  হ্যালো।

-- আপনি কি ইন্দ্রানী মন্ডল কথা বলছেন? আমি অভ্রদীপের হোস্টেল থেকে মহারাজ কথা বলছি। 

-- নমস্কার মহারাজ। কিছু হয়েছে? 

-- ওর মুখে শুনলাম আজ নাকি আপনি বিবাহ করতে চলেছেন, কথাটি কি সত্যি?

-- হ্যাঁ মহারাজ! আসলে আমার বয়স তো এমন কিছু না, সামনে বাকী জীবনটা পড়ে আছে... 

-- সে সবে আমার কোনও সমস্যা নেই ম্যাডাম। আমার বক্তব্য হচ্ছে, এতবড় একটা ঘটনা আপনি কি অভ্রদীপের কনসেন্ট নিয়েছেন?

--  ওর কি কনসেন্ট দেওয়ার বয়স হয়েছে? নাকি আমার ওর কনসেন্ট নিয়ে চলা উচিৎ! ইন্দ্রনীর গলার স্পষ্ট বিরক্তি।

--  ছেলে বড় হয়েছে। আপনার তো বোঝা উচিৎ – এটা ওকে সাইকোলজিক্যালি কতটা হ্যাম্পার করবে।

-- এই ধরনের ঘটনা সবাইকেই অ্যাফেক্ট করে মহারাজ! কদিন থাকবে, আবার চলেও যাবে! এসব ভাবলে তো কোনও ডিভোর্স বা উইডোর আর বিয়েই হবে না।

-- আপনি বিয়ে করছেন তাতে আমার তো কিছু বলার নেই ম্যাডাম। তবে যেহেতু আপনার ছেলে আমাদের কাস্টডিতে আছে, আমার মনে হয় অভ্রদীপকে আপনার ইনভলভ করা উচিৎ ছিল, ওকে কনভিনস করানোর দরকার ছিল।

   ভদ্রমহিলা চুপ করে রইলেন। মহারাজ বললেন, ‘যা করেছেন করেছেন। বিয়েতে অন্তত ছেলেটাকে নিয়ে যান। ও মুখ শুকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে – আপনি বাড়িতে অনুষ্ঠান করেছেন – ব্যাপারটা কেমন?’

--  এখন সম্ভব নয় মহারাজ। আমার পার্লার থেকে লোক এসেছে। এখন কে আনতে যাবে?

--  আমি কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

    ভদ্রমহিলা যেন আঁতকে উঠলেন –  ‘না, না মহারাজ। ওকে পাঠাবেন না। ওর সামনে এই অনুষ্ঠান কড়া মুশকিল।’ 

-- এটা তো শুরু ম্যাডাম! সারাজীবন যাতে অকোয়ার্ড পজিশানে না পড়েন আজ থেকে সেই চেষ্টা করুন। আপনাদের জীবনে অভ্রদীপের অস্তিত্বকে স্বীকার করুন। হয়তো আপাতত তিক্ত, কিন্তু অভ্যেস করলে হয়তো এটা চলনসই হয়ে যাবে।

     মহারাজ বুঝলেন এটা পরিষ্কার ঢেঁকিগেলা কেস। ভদ্রমহিলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই অভ্রদীপকে নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু মহারাজ নিজের দায়িত্বে ওকে পাঠিয়ে দেবেন বলায় উনি কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। মহারাজ একজন স্টাফকে দিয়ে অভ্রদীপকে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন।

     অভ্রদীপ বাড়ী গিয়ে বুঝলো ভুল জায়গায় এসে পড়েছে। ও ঢুকতেই প্রচন্ড একটা চড় এবং অনেক কটু বাক্য বর্ষিত হল তার উপরে। মূল কাজটি মা-ই করলেন, মায়ের বন্ধুবান্ধবরাও তাল মেলালেন সাথে। সম্ভবত যিনি নতুন বাবা হবেন, তিনিও এখানে কোন আক্কেলের উপস্থিত ছিলেন, কে জানে। তাঁর মুখ বেশ গম্ভীর। তিনি 'আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে' বললেন বটে, তবে বোঝা গেল তিনিও বেশ বিরক্ত। অভ্রদীপ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, বড় তাকে হতেই হবে এবং বড় হয়ে এর প্রতিশোধ নেবে। তবে এই নিয়ে এক্ষুনি মাথা ঘামানো যাবে না। ওকে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। একটু বাদে ওর মায়ের সাজানো কমপ্লিট হতেই সবাই বিয়ের জন্য ভাড়া নেওয়া বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হল। অভ্রের সাথে তার সৎ ভাইবোনদের আলাপ করিয়ে দেওয়া হল। সবাই বেশ সেজেগুজে নতুন পোশাক পরে এসেছে। অপ্রদীপের পরণে  হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট। ওর মাথায় ঢুকলো না নতুন বাবার পক্ষের ছেলেমেয়েরা যদি নতুন জামাকাপড় পরে  বিয়ে বাড়ীতে অংশ নিতে পারে, আনন্দ নিতে পারে, তবে তার বেলাতেই বা মা এত কঠোর কেন! ও পরিষ্কার বুঝলো ওর মায়ের মুখে চোখে স্পষ্ট বিরক্তি এবং বিষাদ। ওর মা এমনিতেই দেখতে শুনতে খুবই ভালো; অভ্র জানে – লোকজন সবাই বলে। আজকে সবাই এসে মজা করছে, 'কি গো নতুন বউ মনমরা কেন?' কেউ কেউ আবার আড়ালে মস্করা করছে, 'দ্যাখো, পুরোনো বরের কথা মনে পড়ছে বোধ হয়। কদিনই বা আর মরেছে!’

--  ক'দিন কী গো। পাক্কা আড়াই বছর হয়ে গেল। পাশ থেকে ফোড়ন কাটলো কেউ।

--  বরটার বউ কবে মরলো গো? জানো নাকি?

--  হ্যাঁ, ওই তো নন্দিতার দেওর তো ছেলেটার বন্ধু। ও বলছিল, বছর পাঁচেক আগে নাকি লোকটার বউ মরেছে।

    এসব কথা অভ্রদীপের কানে জ্বলন্ত সীসার মতো বাজছিল। হঠাৎ হুলুস্হুলু পড়লো, রেজিস্ট্রার সাহেব এসেছেন। অভ্রদীপ উঁকি মেরে দেখলো অনুষ্ঠান বাড়ীর মধ্যে একটি ঘরে রেজিস্ট্রির আয়োজন। বরপক্ষের এবং কনে পক্ষের দু চারজন বয়স্ক আত্মীয় স্বজন আগেই উপস্থিত। অভ্রের দাদু দিদা, ঠাকুর্দা ঠাকুমা কেউই বেঁচে নেই। সুতরাং ওর মা অনেক বেশী স্বাধীন এবং তাঁকে কারও ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে হয় না। ওর সৎ বাবা কোট টাই পরে আগে থেকেই বসে আছেন। মা এলেই শুরু হবে সই সাবুদ।  অভ্র আসার আগে দু - চারজন খুব কাছের বন্ধুদের সাথে পরামর্শ সেরেই রেখেছে। সবাই বলেছে, 'এই বিয়ে তুই যে করেই হোক আটকা অভ্র। এই বিয়ে হলে তোর সর্বনাশ।' অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দিয়েছে – তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যেটি হলো ব্লেড জোগাড় করা। বাড়ীতে এসে বাবার ড্রয়ার হাতড়ে সেটি সে প্যান্টে পকেটে নিয়ে এসেছে সাথে। মা ঢোকামাত্রই তড়ি ঘড়ি সে নিজের হাতের শিরায় চালিয়ে দিল ব্লেড, ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। সবাই 'কী হল', 'কী হল' করে ছুটে এল। একটু বাদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল অভ্র।

  

(২)

অভ্র হোস্টেলে ফিরে এসেছে। নার্সিংহোমে তিনদিন ছিল সে। ছুটি হওয়ার পরের দিনই ও প্রায় জোর করেই চলে এসেছে। মা বলছিল অবশ্য, একদিন থেকে যেতে – অভ্র শোনেনি। সে দিব্যি জানে ওসব কথার কথা। একদিন বাদেই নতুন বাবার সাথে হানিমুনে লাদাখ যাবে মা। আগে থেকেই বুকিং টুকিং হয়ে গেছে। সুতরাং অকারণ আদিখ্যেতার কোনও মানে হয় না। হোস্টেলে অভ্রদীপ এখন আগের মতোই খেলাধূলা করছে, ক্লাশে যাচ্ছে নিয়ম মেনে। দু চারদিন যেতে একদিন মহারাজ ডেকে পাঠালেন ওকে 'কি রে অভ্র! প্রোগ্রাম কেমন হল?

--  ভালো।

--  খাওয়া-দাওয়া করলি জমিয়ে?

  অভ্র চুপ করে রইল। মহারাজ কিছুক্ষণ চুপ করে বললেন, 'কেন তোর মা তোকে নিয়ে যেতে চাননি বুঝলি তো? মা-রা ঠিক বোঝে তার ছেলে কেমন। আমি বড় মুখ করে তোকে পাঠালাম, আর তুই ওখানে কী সব কান্ড করলি বল দেখি? তোর মা এবং বাবা এজন্য আমাকে কত কথা শোনালেন।

--  আপনি শুনলেন কেন? দু-চার কথা বলে দিতে পারলেন না?

--  সে মুখ তুই রেখেছিস বাবা?

--  স্যরি মহারাজ। আমি ভেবেছিলাম এরকম কিছু একটা ড্রামা করলে বিয়েটা হবে না, ওদের সুবুদ্ধি হবে। 

-- সেরকম কিছু হয় না বাবা। আর তুই ব্লেড নিয়ে অত্যন্ত অন্যায় করেছিস। স্বামীজী এসব অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। আত্মহত্যা করা ভয়ানক পাপ!  

-- আত্মহত্যা আমি করতে চাইনি মহারাজ। ওদের ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।

--  বড় বিপদ আপদ কিছু হয়ে যেতে পারতো।

--  কিছু হত না মহারাজ। হাত থেকে কত আর রক্ত বেরিয়ে যেতে পারতো! সবার সামনে ঘটনাটা ঘটছে যখন আধ ঘন্টার মধ্যেই চিকিৎসা শুরু হত। খুব বেশী হলে একটা কি দুটো ব্লাড চালিয়ে দিলেই...

    মহারাজ ‘থ' হয়ে গেলেন। বললেন ‘তুই কি এতসব জেনে কাজটা করেছিস?’

    অভ্রদীপ চুপ করে রইল। মহারাজ বললেন 'এসব কি তোদের ক্লাসে পড়ায়?'

--  ক্লাশে পড়াবে কেন মহারাজ? এসব তো কমন সেন্স! মহারাজ মনে মনে ভাবলেন, ছেলেটির বড় বেশী কমন সেন্স। সবকিছু ভুলে ছেলেটি যদি মন দিয়ে পড়াশুনো করে তবে হয়তো অনেক বড় হতে হবে পারবে।

    হঠাৎ অভ্র বললো, 'মহারাজ আমার কেসটা কোনওভাবে অবৈতনিক করা যায় না?'

--  এ কথা কেন?

--  আমি মায়ের টাকায় পড়তে চাই না।

--  সেটা সম্ভব নয় অভ্র!

--  আপনারা তো অনাথদের নেন মহারাজ।

--  তুমি তো অনাথ নও। আর তাছাড়া তোমার এভাবে ভাবা অন্যায়। তুমি মাকে এভাবে অস্বীকার করতে পারো না।

--  মা নিজেই তো আমাকে অস্বীকার করতে চাইছে।

--  তুমি কি তোমার নিজের জন্ম অস্বীকার করতে পারবে অভ্র? সুতরাং এই চিন্তা ছাড়ো। এটা সুস্থ চিন্তা না ।

-- যদি আমি নিজের জন্মটা অস্বীকার করতে পারতাম মহারাজ, তবে আমার চেয়ে সুখী কেউ হতো না!

--  আবার খারাপ চিন্তা? এবার কড়া ধমকই দিলেন মহারাজ।

--  আমার কি নিজের ইচ্ছার স্বপক্ষে চলার কোনও অধিকার নেই?

--  তুমি সাবালক নও। 

-- সাবালক হলে কি আমি ওদের ত্যাগ করতে পারি? আমি না তো ওদের টাকা চাই, না তো ওদের সাথে থাকতে চাই। 

    মহারাজ বললেন, ‘তুমি এসব চিন্তা করবে না অভ্র। শ্রী শ্রী মা কী বলেছেন? 'অপরের দোষ দেখো না। দোষ যদি দেখতে হয়, কেবল নিজের দোষ দেখবে।' তুমি ঠাকুর, শ্রী শ্রী মা, স্বামীজীর সন্তান হয়ে এরকম অবিবেচকের মতো কথা বলো কী করে! মনে রাখবে 'কুমাতা কখনও নয়।' তোমার মা কী পরিস্থিতিতে এই বিবাহ করতে রাজী হয়েছেন আমরা কেউ জানি না। আমরা নিজের নিজের মতো অনুমান করে নিচ্ছি। তোমার বাবার মৃত্যুর পর একা হাতে তিনি চাকরি সামলে তোমার পড়াশুনার যত্ন নিয়েছেন, কোচিং দিয়েছেন, তোমার স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেছেন – আজ তাঁর একটা সিদ্ধান্ত তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে প্রতিহিংসা পুষে রাখছো? এ কোনও কাজের কথা নয়। মানুষের মতো মানুষ হও বাবা! নিজে সাবালক হয়ে রোজগার করলে ফুড়ুৎ করে উড়ে যেও না। তখন হয়তো তোমার মায়ের তোমাকেই বেশি করে দরকার।

     অভ্র ভাবলো, ওর এই সময়ে মায়েরই তো সবচেয়ে বেশী থাকার দরকার ছিল। সে কি থেকেছে? সে শরীরের জন্য দৌড়েছে। অভ্র কি বোঝে না এসব? সে একা কেন, ওর সব বন্ধুরা এসব জানে! সবার সামনে তাকে এরকম অকওয়ার্ড পজিশানে ফেলার কি মায়ের খুব দরকার ছিল? এসব কথা কাউকে বলা যায় না। সে বলতেও চায় না। কোনও বিরুদ্ধে কথা বললে, মহারাজ আবার নানান জ্ঞান দেবেন, চুপ থাকাই ভালো। সুতরাং সে চুপ করেই  রইলো। 

    মহারাজ ভাবলেন, বিষয়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা নাকি অভিমান – সাধারণ মানুষের কাছে কোনটা বড়? যে ছেলেটি কিছুদিন আগেই মায়ের বিয়ে হলে নিজের এতবড় পৈতৃক সম্পত্তি হারানোর ভয় করছিল, সে আজ বিনা দ্বিধায় মাকে ত্যাগ করতে চাচ্ছে কেবল অভিমান বশে? আজকালকার ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট সেয়ানা।  চুপচাপ বড় হওয়া পর্যন্ত একটু তাল মিলিয়ে চললেই তো ফায়দা! এসব ভেবে মনে মনে বড় লজ্জিত হলেন তিনি। রামকৃষ্ণকে স্মরণ করে বললেন, 'হা ঠাকুর! তুমিই তো বলতে, 'টাকা মাটি, মাটি টাকা।' তোমার সন্তানের অন্তত সেই চৈতন্যটুকু দাও ঠাকুর। সেই চৈতন্যটুকু দাও।

Post a Comment

0 Comments