জ্বলদর্চি

পুজোর পাঁচকাহন (তৃতীয় পর্ব) /তনুশ্রী ভট্টাচার্য্য

পুজোর  পাঁচকাহন
 (তৃতীয় পর্ব)
তনুশ্রী ভট্টাচার্য্য 


 নীলার তৃতীয় নয়ন 

 নীলার জন্মবৃত্তান্ত পাড়ার লোকেরা ঠিক জানেনা। রুমি কাকীমা আর নাড়ু কাকু হঠাৎ করে গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন। ছোট্ট  গ্রামে  আজ থেকে তিরিশ বছর আগে সবাই সবাইয়ের খোঁজ রাখত। তাই কদিন পরে খোঁজ খবর শুরু হলে দেখা গেল ওদের বাড়ির বড় গেটে তালা  ।  নি:সন্তান রুমীকাকীমা আর নাড়ু কাকু যে কোথায় চলে গেলেন কেউ জানে না। দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। দত্তদের আটচালায় পুজো নিয়ে সবাই মাতল। দত্তরাই এ গ্রামের একমাত্র বড়লোক । তাদের দালানের পুজো মানে গোটা গ্রামেরই পুজো।  পুজোর অষ্টমীর দিনে হঠাৎ রুমী কাকীমা ফুটফুটে একটি শিশু  কন্যা কোলে  দুগ্গা দালানে প্রণাম  করতে এলো। সঙ্গে নাড়ু কাকুও আছে। সেই মুহূর্তে  সবাই মুখ চাওয়া চায়ি করলেও পুজোর আনন্দে ওসব খোঁজ খবর কেউ করল না।  পুজো মিটে গেল। সবাই ফিসফাস শুরু করল। এরকমটা ঠিক সুবিধের নয় । পূর্ব কোনো সংবাদ ছাড়াই রুমীকাকীমা একটি প্রায় একবছরের   কন্যা সন্তান নিয়ে হাজির --গ্রামের লোকের কাছে বিসদৃশ ঠেকল।  দত্তবাবুকে সবাই মানে।  দত্তবাবুর কানে কথা গেল । ফিসফাস বন্ধ করতে দত্তবাবু একদিন নিভৃতে নাড়ুকাকুকে ডেকেছিল।  জানতে চেয়েছিল ব্যাপারটা। 
নাড়ুকাকু কেঁদে কেটে একসা হয়ে স্বীকার করেছিল আর ছেলেপুলে হবে না জেনে একজনের কাছে সন্তান ভিক্ষা করতে গিয়েছিল খুব ধনী এক মানুষের কাছে কলকাতায়। এই একবছরের সন্তান তাদের। কিন্তু নেওয়ার পর জানতে পারছে মেয়েটির জন্মগত ত্রুটি আছে। সে উভলিঙ্গের।   তখনো দত্তক নেওয়া আর উভলিঙ্গের শিশুর ব্যাপারটা সাধারন মানুষের কাছে সহজ ছিল না।  মেয়েটি উভলিঙ্গের বলেই তার জন্মদাতা বাবা মা নাড়ুকাকুদের দিয়ে দিতে চেয়েছিল। তখন এটাকে পাপ বলেই মনে করত সবাই। তাই তারা পাপমুক্ত হতে চেয়ে  নাড়ুকাকু আর রুমী কাকীমাকে  দিয়েছিল। 
🍂

ব্যাপারটা পরিস্কার হতে সবাই চুপ হয়ে গেল।

  এবার কথা ফুটল মেয়ের। দুবছরের নীলার।  নীলাকে যথাসময়ে স্কুলে ভর্তি করল কাকু কাকীমা। পড়াশোনায় নীলার খুব আগ্রহ। দেখা গেল  নীলা খুব মেধাবী।  গ্রামের স্কুলের পড়া শেষ করে সে  শহরের কলেজে ভর্তি হল।  অঙ্কে অনার্স নিল। যৌবন কালে নীলার শরীরে একটু একটু করে পুরুষালি ভাব দেখা দিতে লাগল। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে  এসবের কোনো ট্রিটমেন্ট বা সুরাহা ছিল না।  শান্ত মেয়ে নীলা পড়াশোনাতেই নিমগ্ন থাকত।  শরীরের পরিবর্তন সে স্বাভাবিক বলে নিয়েছিল কিনা জানা নেই। শাড়িই পরত। মেয়েদের মতো সাজলেও গলায়   ছির পুরুষ কন্ঠ।  সেই নীলা র জীবনে প্রেম এলো বড়  কাকতালীয় আর আর বেদনা বিধুর।  এক অষ্টমীর দিনে।

 দত্তদের দুর্গা দালানের সে বছর হাজির হয়েছেন  কানপুর আই আইটি থেকে  সদ্য এম টেক করে আসা নীলঞ্জন দত্ত,--দত্তবাড়ির ছোটো ছেলে। নীলা তখন  থার্ড ইয়ার , ম্যাথ অনার্স। 


          অনেক দূরে অনেক মাঠের পর । অনেক দূরে গেরুয়া নদীর চর। সেখানেও কাশ ফোটে, শিউলি ঝরে। মহালয়ার দেবী ভোরে  রেডিও বাজে। আড়িয়াদিঘিতে শালুক ফোটে। আরো দূরে  ময়ূরাক্ষীর বুকে ফোটে পদ্ম। ভোরের শিরশিরানি আর শিশিরে ঘাস ভিজে পা ভিজে যায়। নিস্তরঙ্গ গ্রামে শহুরে হূল্লোড় হয়তো নেই । কিন্তু আছে  মনের ভেতর হূ হূ করা শনশন বাতাস আর অষ্টমীর অঞ্জলি, ঢাকের বাদ্যি আর সন্ধ্যারতি।
 
         সে  বছরেই  অষ্টমীর সকালে হয়েছিল ওদের  চোখাচোখি। অঞ্জলির ফুল নিতে গিয়ে ঠেলাঠেলিতে আঙুলে আঙুল ঠেকেছিল। একটা অপরাজিতা ফুলে দুজনেই হাত বাড়িয়ে কাড়াকাড়ি। ও পক্ষ থেকে নীরব  সরে যাওয়া। অঞ্জলি শেষে প্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল নীলা। নীলাঞ্জনের সঙ্গে মন দেওয়ানেওয়া পর্ব চলেছিল বেশ কিছুদিন‌ধরে। গ্রামের লোকেরা তেমনটাই বলে।  কিন্তু  অভিজাত দত্তবাড়ির  ছেলের সঙ্গে সাধারন একটা ঘরের মেয়ের এই সম্পর্ক দত্তবাবু মেনে নেন নি।  যে কিনা পুরোপুরি মেয়েও নয়, যার জন্মদাতা বাবা মা তাকে বিদেয় করেছে  সেই অপরাধে তার সঙ্গে  দত্তবাড়ির কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।  সুতরাং  সে সম্পর্ক সমূলে বিনষ্ট করার চেষ্টা চলল।

পরের বছর থেকে পুজোয় আসা বন্ধ করল নীলাঞ্জন। নীলা পড়া চালিয়ে গেল। পুজোর মন্ডপে সে আর যায় না।
ওদের বিচ্ছেদে গ্রামের লোক স্বস্তি পেল।  
পুজো চলল বছর বছর। 

  এর বছর সাতেক  পরে। নীলাঞ্জন   বড় কোম্পানি  চাকুরে।  একটি এন জি ও খুলছে  উভলিঙ্গ বা ট্র্যান্সজেন্ডারদের জন্য। সেই কাজে পাশে নিয়েছে নীলাকে। নীলার ব্যথার  অশ্রু যদি মোছে।
  এদিকে দত্তবাবু স্বীকার করতেন না, কিন্তু গ্রামে অনেকেই ফিসফাস করত  নীলাঞ্জনের কেমন যেন মেয়েলি ধরন।  অনেকেই আড়ালে তাকে 'হাফ লেডিস' বলত। তার হাঁটাচলায়  কথাবার্তায় পুরুষালি ভাব কম। নীলাঞ্জন নিজেও সেটা জানত। নীলাও সেটা বুঝেছিল।  এই এন জি ও তে নীলার প্রধান ভূমিকা। দশভূজা হয়ে সে সব সামলায়। 


     সেবছর অষ্টমীর অঞ্জলি দিল আবার ওরা একসঙ্গে। এনজিওর সবায়ের জন্য ওরা পুজোর আনন্দের আয়োজন করে। ওদেরই দালানে। দত্তবাবু আপত্তি করেন না। গ্রামের লোকেরা এখন  অনেকটা বুঝেছে। হিঁজড়ে বলে নাক সিঁটকায় না আর।  এটা যে  জীবনের স্বাভাবিক ব্যাপার সেটা বুঝেছে ধীরে ধীরে। মানুষের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেওয়ার কাজটাই তো করছে ওরা। "মানুষের মনের আঁধার  ঘোচাতে দুগ্গামায়ের তৃতীয় নয়নের আলো ছড়িয়ে পড়ুক ---এটাই তো পুজোর বার্তা। শুধু চর্মচক্ষে দেখে  কি হবে  দুগ্গামাকে দেখতে মর্মচক্ষু লাগে যে!"_--  নীলার এইসব কথায় নীলাঞ্জন অবাক মানে। এখনের  সেল্ফি তোলার  যুগে নিজের সেল্ফ বা সত্তাকে আলোকিত করে তোলাকেই  আসল পুজো  বলে ওরা ওদের গ্রুপের মানুষদের বোঝায়। 

 আজ অষ্টমী।  নীলা একটা  লাল বেনারসী পরেছে।  মাদুর্গার মতোই লাগছে তাকে।  নীলাঞ্জন  অবাক চোখে দেখছে----নীলার তৃতীয় নয়ন থেকে উৎসারিত আলো তাদের চারপাশের মানুষগুলোকে আলোকিত করছে।

Post a Comment

0 Comments