জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প-- ২৬০/এক অদ্ভূতুড়ে বুড়োর গল্প /কুনমিঙ, চীন (এশিয়া)/চিন্ময় দাশ


দূর দেশের লোক গল্প-- ২৬০

এক অদ্ভূতুড়ে বুড়োর গল্প

কুনমিঙ, চীন (এশিয়া)


চিন্ময় দাশ


এক গ্রামে থাকত এক বুড়ো। রোগা হাড্ডিসার চেহারা। মাথায় উস্কোখুস্কো এক  বোঝা পাকা চুল। মুখের গোঁফ আর দাড়িতে যে দু’চারটে চুল, সেগুলোও শনের গুছির মতো সাদা ধবধবে। 

গাঁয়ের লোকজন বিশেষ কথাবার্তা বলত না বুড়োটার সাথে। একদিন বুড়ো ভাবল, দূর ছাই। কেউ যদি কথাই না বলল, গাঁয়ে থেকে আমার লাভটা কী?

একলার সংসার। থাকবার মধ্যে ছিল গোণাগুণতি সাতটা ভেড়া-ভেড়ি, আর দুটো ঘোড়া। এইমাত্র সম্বল তার। তবে, ঘোড়া দুটোর মধ্যে একটা ঘোড়ার পিঠে দুটো ডানা আছে। ওড়াউড়ি  করতে পারে ঘোড়াটা। তাতে চড়েই এদিক ওদিক যাওয়া-আসা করে বুড়ো। গ্রাম থেকে খানিক দূরে ছিল একটা পাহাড়। গ্রাম পড়ে রইল। ভেড়া ঘোড়া সব গুটিয়ে নিয়ে পাহাড়ে চড়ে পড়ল বুড়ো। একটা কুঁড়ে বানিয়ে বাস করতে লাগল।

পাহাড়ই বেশ ভালো। নিরিবিলিতে থাকা যাচ্ছে। ভেড়া চরানো যাচ্ছে নিশ্চিন্তে। যাওয়া-আসার জন্য ঘোড়াটা তো আছেই। উড়ুক্কু ঘোড়াটা রাখে কুঁড়ের পূর্ব দিকে। আর পশ্চিমে থাকে অন্য ঘোড়াটা। 

বুড়ো ভেড়াগুলোর দিকে তাকায় আর ভাবে—আহা, যদি একটা চাঁদকপালী বাচ্চা হোত আমার ভেড়ার। ইন্দ্রঠাকুরের নামে বলি দিতাম সেটাকে। খালি হাতে কী আর ঠাকুরের পূজা হয়?

🍂

একদিন তার একটা ভেড়ার বাচ্চা হল। আর, কী কপাল বুড়োর! বাচ্চাটা সত্যি সত্যিই চাঁদকপালী হয়েছে। বুড়োর তো আনন্দ ধরে না। কত দিনের মনের সাধ তার। ভাবল, কাল সকালে উঠেই পূজো দেব ইন্দ্রঠাকুরকে।

বুড়ো তো ডেরা বেঁধেছে পাহাড়ের উপরে। রাতের বেলা ভারি সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস বয়। তাই রাতের বেলায় কুঁড়ে পড়ে থাকে। খোলা আকাশের নীচে শুয়ে ঘুমায় সে। 

সেদিনও তা-ই শুয়েছে। ভেড়ার বাচ্চাটাকে একটা থলের মধ্যে ঢুকিয়ে পাশে রেখেছে। আকাশে রুপোর মতো ঝকমক করছে তারার দল। দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে বুড়ো। 

ইন্দ্রঠাকুরের স্বর্গে ছিল এক দাঁড়কাক। অতো সুন্দর একটা ঘোড়ার বাচ্চা চোখে পড়ে গেছে তার। সারা দিন তক্কে তক্কে ছিল কাকটা। রাত নামল। বুড়ো ঘুমিয়ে পড়তেই, ঝুপ করে নেমে এসেছে কাক। ভেড়ার বাচ্চার দুটো চোখই খুবলে তুলে নিয়েছে। বুড়ো উঠে পড়বার আগেই, কপ করে গিলেও ফেলেছে চোখ দুটো। 

বুড়ো তো রগে কাঁই। লাফিয়ে উঠে চড়ে বসেছে তার উড়ুক্কু ঘোড়ার পিঠে। কাক পালাচ্ছে, বুড়োও যাচ্ছে তাড়া করতে করতে। এক সময় ধরেও ফেলেছে কাকটাকে। তার ভেড়াছানার চোখ খুবলে নিয়েছে। মাথায় আগুন জ্বলছিল বুড়োর। কাকটাকে ধরেই ঠোঁট দুটো ধরে, এক মোচড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে। তার বদলে, কাকের মুখে এক জোড়া কাঠের ঠোঁট সেঁটে দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে তাকে।

সকালে কাকটাকে দেখে, ইন্দ্রদেব তো অবাক। জিজ্ঞেস করলেন—কী ব্যাপার? তোর এই অবস্থা কেন? কে করল এমন কাজ? 

দাঁড়কাক তার নিজের দোষের কথা না বলে, বলল—নীচে পাহাড়ে এক বুড়ো থাকে। সে করেছে। 

খুব রেগে গেলেন ঠাকুর—এতো সাহস লোকটার? দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি। 

ইন্দ্র দেবের দু’পাশে দুটো নেকড়ে থাকে সব সময়। বললেন— এক্ষুণি যা তোরা। বুড়োর উড়ুক্কু ঘোড়ার মুণ্ডুটা চিবিয়ে খেয়ে আয় গিয়ে। ঐ ঘোড়াটার জন্যই বুড়োর যতো কেরামতি।

হোল কী, নেকড়ে দুটো দৌড়ে আসছে, সেটা বুড়ো দেখতে পেয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে উড়ুক্কু ঘোড়াটাকে কুঁড়ের পশ্চিমে আর অন্যটাকে পূর্ব দিকে নিয়ে গিয়ে রেখে এলো।

নেকড়ে দুটো নীচে এসে পৌঁছেছে। পূর্বদিকে বাঁধা ঘোড়াটা চোখে পড়ে গেল তাদের। সেটাকেই কচ-কচ করে চিবিয়ে পেট ভরে খেল দুজনে। বুড়ো দেখছে আড়াল থেকে। কিচ্ছুটি বলল না। খাওয়া-দাওয়া সেরে, নেকড়ে দুটো ফিরে যাচ্ছে। বুড়ো লাফ দিয়ে তার উড়ুক্কু ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল। 

মাঝ পথ না পেরোতেই, নেকড়ে দুটোর নাগাল পেয়ে গেছে। ঘোড়া সবাড় করে এসেছে এরা। উচিত শিক্ষা দিতে হবে। দুটোরই পা থেকে নাকের ডগা পর্যন্ত চামড়া ছাড়িয়ে ফেলেছে বুড়ো। দিয়ে বলল—এবার শিক্ষা হয়েছে? যাও বাছারা, ঘরে ফিরে যাও। 

দু’-দুটো নেকড়ের এই হাল দেখে, দুটো দৈত্যকে হাঁক পাড়লেন ইন্দ্রদেব। বললেন—যা এক্ষুণি। গিয়ে বুড়োটাকে ভালো মতন শিক্ষা দিয়ে আয়। 

দুটো দৈত্য। প্রভুর হুকুম পেয়ে ঝড়ের বেগে নেমে আসছে তারা। বুড়ো তখন উনুনের পাশে বসে, ঘোড়ার জন্য জাব ফুটাচ্ছিল গামলায়। দুজনে এসেই হামলে পড়েছে কুঁড়েটার ওপর। দেওয়ালগুলো ধসে পড়তেই বুড়ো দেখতে পেয়েছে। গামলাশুদ্ধ জাব ছুঁড়ে চিয়েছে দুজনের দিকে। মুখ চোখ পুড়ে গিয়েছে দৈত্য দুটোর। যন্ত্রণায় ককাতে ককাতে দৌড়ে পালিয়েছে তারা।

ইন্দ্রদেব তো তাদের দুরবস্থা দেখে রেগে কাঁই। এবার দুটো ড্রাগনকে ডেকে পাঠালেন। বেশ করে জব্দ করে আয় বুড়োটাকে—হুকুম দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন দুজনকে। বুড়ো তখন তার ভেড়াগুলোকে চরাচ্ছিল। ড্রাগন দুটোকে আসতে দেখল বুড়ো। আগুনের হলকা বেরোচ্ছে দুজনের মুখ থেকে। 

চোখে পড়তেই ভেড়ার পাল আর নিজের ঘোড়া নিয়ে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে গেল বুড়া। ড্রাগন দুটো আসামাত্রই দাউদাউ করে পুড়ে গেল বুড়োর কুঁড়েটা। সবাই শুদ্ধ পুড়ে মরেছে ধরে নিয়ে, মনের আনন্দে ফিরে চলল দুই ড্রাগন। 

বুড়োও যে তার উড়ুক্কু ঘোড়ায় এপে পিছু নিয়েছে, খেয়াল নেই তাদের। তাদের ধরে ফেলেছে যখন, দুই কোপে দুজনের লেজ দুখানা কেটে দিয়েছে বুড়ো। 

তা দেখে, বেমালুম রেগে গিয়েছেন ইন্দ্রদেব। এক শাগরেদকে ডেকে বললেন—যা তো, ধরে নিয়ে হতভাগা বুড়োটাকে। 

শাগরেদ অত শত কাণ্ড ঘটেছে, কিছুই জানে না। সে এলো হেলতে দুলতে। এতখানি পথ। পাড়ি দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা না কি? সে এসে বলল—চলো হে, বুড়ো। তোমার ডাক পড়েছে।

--কোথায় যাবো? কে ডেকেছে, সেটা তো বলো আগে।

শাগরেদ বলল—কে আবার ডাকবে? ইন্দ্রদেবের ফরমান হয়েছে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবার। বিচার হবে সেখানে। 

স্বয়ং ইন্দ্রদেব ডেকেছেন। শুনে প্রথমে খানিক ভড়কে গেল বুড়োটা। তারপর ভাবল, কপাল ভালো বলতে হবে। এই সুযোগে একবার সাক্ষাৎ দর্শন হয়ে যাবে ঠাকুরের। বলল—চলো তাহলে, যাই। দেখি কী বিচার হয়। 

শাগরেদকেও ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে, দুজনে এসে ইন্দ্রের দরবারে হাজির হোল। বুড়ো ঢিপ করে একটা পেন্নাম ঠুকে দিল ইন্দ্রদেবকে। বলল—আমাকে কেন ডেকেছেন, ঠাকুর? যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন। আমার সাত-সাতটা ভেড়া মাঠে ছেড়ে এসেছি।

ইন্দ্রদেব বললেন— রাখো তো ভেড়ার পাল। নিজের প্রাণই যেতে বসেছে তোমার। সেটা তো আগে বাঁচুক। শোন, বুড়ো। চার-চারটে অভিযোগ তোমার বিরূদ্ধে। প্রথমে বলো, আমার দাঁড়কাকের ঠোঁট ছিঁড়ে নিয়ে, কাঠের ঠোঁট লাগিয়ে দিয়েছিলে কেন?

বুড়ো বলল—তাহলে বলি, ঠাকুর। আমার অনেক দিনের সাধ, কোন ভেড়ার একটা চাঁদকপালী বাচ্চা হয় যদি, সেটা বলি দিয়ে, তোমার পূজো দেব। কপাল গুণে, এতো দিন বাদে একটা চাঁদকপালী বাচ্চা হোল একটা ভেড়ার। মনে ভারি আনন্দ। বাচ্চাটা বলি দিয়ে, তোমার পূজো দেব। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু কী ফল হোল? হঠাৎ কোথা থেকে আচমকা ঐ দাঁড়কাকটার উদয়। বলা নেই, কওয়া নেই, দুটো চোখ খুবলে তুলে নিয়েছে বাচ্চাটার। 

এই বলে একটু দম নিল বুড়ো। আবার বলল—চোখ খুবলে নিলে, সেই খুঁতো ভেড়ার ছানা দিয়ে, পূজো দেওয়া যায় তোমার? তুমিই বলো? ভয়াণক কষ্ট হোল মনে। রাগও। তাই তো ওই কাজ করলাম। এইটা আমার দোষ হোল?

ইন্দ্রদেব বললেন—নাহে, এতে তোমাকে দোষী বলা যায় না। ঠিক আছে। ছেড়ে দাও। কিন্তু নেকড়ে দুটোর ছাল ছাড়িয়ে নিয়েছিলে কেন? 

বুড়ো বলল—তুমি ঐ হতভাগা দুটোকে পাঠিয়েছিলে কেন? আমার উড়ুক্কু ঘোড়াটাকে খাওয়ার জন্যই তো? 

--হ্যাঁ। তাইই তো বলে দিয়েছিলাম।

--তাহলে, ওরা আমার অন্য ঘোড়াটা খেল কেন? সেটা অপরাধ নয়? তাতেই রেগে গিয়ে শাস্তি দিয়েছি দুজনকে। সেটা আমার অপরাধ হয়ে গেল?

--না, না। এতে তোমার কোনও অপরাধ হয়নি। কিন্তু তুমি আমার দৈত্য দুজনের চোখ মুখ পুড়িয়ে দিলে কেন? 

বুড়ো বলল— এটাও বলি তাহলে। নিজেই বিচার করে দেখ। তুমি ওদের পাঠিয়েছিলে আমাকে শিক্ষা দিতে। ঠিক কি না? 

--হ্যাঁ, সেটা ঠিক।

--আমি গরীব মানুষ। তাহলে ওরা আমার কুঁড়ের দেওয়াল ভেঙে দিল কেন? এক কাজ করতে গিয়ে, আর এক কাজ করে দিয়েছে। আমিও দিয়েছি গরম জাব ছুঁড়ে। কী দোষ হোল আমার?

--না। ভুলই করেছিল ওরা। তোমাকে দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু বাপু, আমার দুটো ড্রাগনের লেজ কেটে দিলে কেন? সেটা তোমার দোষ হয়েছে, এটা মানো তো?

বুড়ো বলল— তাহলে, এটাও তুমিই বিচার করো, ঠাকুর। ঐ শয়তান দুটোকে তুমি কেন পাঠিয়েছিলে? আমাকে শাস্তি দিতে, না আমার ঘর পুড়িয়ে দিতে?

--তোমার ঘর পোড়াতে বলব কেন আমি? তোমাকে ভালো মতন শাস্তি দিয়ে আসতে বলেছিলাম।

--তাহলে? ওরা কী করল? কথা নাই, বার্তা নাই। গিয়েই গরীব মানুষের কুঁড়েটাই পুড়িয়ে ছাই করে দিল? রাগ হয় কি না বলো। তাছাড়া, আমি আর এমন কী করেছি? প্রাণে তো আর মেরে ফেলিনি। কুচ-কুচ করে লেজ দুটো এক্টুখানি ছোট করে দিয়েছি, এই মাত্র। এটাকে অপরাধ বলছো তুমি? 

কোথায় গেল রাগ, কোথায় কী? বুড়ো মানুষটার কথার যুক্তি আর বলবার ধরণ দেখে, বেশ ভালো লেগে গেল ইন্দ্রদেবতার। মুখে আর ক্রোধের নামমাত্র নাই। হালকা একটা হাসির রেখাই দেখা গেল বরং।

বুড়োও সেটা দেখেছে। মনে ভাবল, যাক বাবা। এ যাত্রা রেহাই পাওয়া গেল। এবার হাত জড়ো করে বলল—একটা নিবেদন আছে, ঠাকুর। বলব?

ইন্দ্রদেব হাসি মুখ করে বললেন—বলো, শুনি তোমার নিবেদন। 

হাত দুটো জোড়াই আছে বুড়োর। বলল—ঠাকুর! গরীব মুখ্যু মানুষ আমি। ভুল-দোষ হতেই পারে। তাছাড়া, ঠাকুর! থাকিও অনেক দূরে। তোমাদের স্বর্গের আদব কায়দাও কিচ্ছু জানি না। তাতেই ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যাচ্ছে। 

ইন্দ্রদেব ভুরু কোঁচকালেন। বললেন—কী বলতে চাইছ তুমি? খোলসা করে বলো তো।

--ঠাকুর!দয়া করে এখানেই তোমার কাছাকাছি থাকবার একটু ব্যবস্থা করে দাও। তাহলেই তো ঝামেলা মিটে যায়। ভুল বোঝাবুঝির সুযোগই থাকে না কোনও। 

হাসি চেপে রাখতে পারলেন না ইন্দ্রদেব। মাথা নেড়ে দিলেন। তা দেখে বুড়ো একেবারে আহ্লাদে ডগমগ। বলল— সাত-সাতটা ভেড়া ছেড়ে এসেছি পাহাড়ে। অবলা জীব সব। আমি ফিরে না গেলে, বাঘ ভালুকের পেটে যাবে তারা। যাই, নিয়ে আসি ওদের। ভাববেন না, ঠাকুর। এই গেলাম, কী ফিরে এলাম।

বলেই, এক লাফে তার ঘোড়ার পিঠে চেপে বসেছে। ইন্দ্রদেবের সারা মুখ আলোয় ঝলমল করছে তখন।

Post a Comment

0 Comments