প্রকৃতির ভেতর আত্ম-উন্মোচন: দিলীপ মহান্তীর কবিতা ও সমসাময়িক পাঠপ্রেক্ষিত
বাপন দেব লাড়ু
জ্বলদর্চি পত্রিকা-র অনলাইন সংস্করণ ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৫- এ প্রকাশিত দিলীপ মহান্তীর দুটি কবিতা
(১) “বৃষ্টি” এবং
(২) “যাও, উত্তরে হাওয়া”
বাংলা কবিতার সমকালীন প্রবাহে প্রকৃতি-চেতনার এক অনন্য রূপকে সামনে আনে। প্রকৃতি এখানে নিছক দৃশ্যমান জগৎ নয়; বরং তা মানুষের গভীরতম অভিজ্ঞতার প্রতীকী ভুবন, যেখানে মিশে যায় অবচেতনের কান্না, দীর্ঘশ্বাস, বেদনা এবং স্মৃতির গোপন স্তর। ওঁর কবিতায় প্রকৃতি কখনো মৃদু সুরের মতো, আবার কখনো আত্মার অনন্ত যাত্রার প্রতীক হয়ে ওঠে। ফলে পাঠক প্রকৃতিকে আর বাইরের প্রেক্ষাপট হিসেবে পড়েন না, বরং অনুভব করেন নিজের অন্তর্জগতের অনুরণন হিসেবে।
“বৃষ্টি” কবিতায় প্রকৃতির চিত্রকল্পগুলি প্রথমে আপাতত বাহ্যিক মনে হলেও, ভেতরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় যে এখানে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা আবেগের অভ্যন্তরে প্রবাহিত।
------“কত কত বৃষ্টি ঝরে রাতের বাগানে”
এই সূচনা পঙক্তিই পাঠককে এক অন্তরঙ্গ পরিবেশে নিয়ে যায়, যেখানে প্রকৃতি কেবল দেখা যায় না, শোনা যায়, অনুভব করা যায়। গোড়ালি ভেজা বিকেল থেকে শুরু করে বুকভরা দীর্ঘশ্বাস পর্যন্ত বৃষ্টির ভিজে ওঠা দেহ আসলে মনের গভীর কান্নারই প্রতিফলন। কবি যেন ইঙ্গিত করছেন, ভেজা শরীর একদিন শুকিয়ে যাবে, কিন্তু অন্তরের যে সিক্ততা, তা বহমান। এইভাবে বৃষ্টি হয়ে ওঠে আত্মশুদ্ধির প্রতীক, যা দুঃখকে ভাষায় রূপ দেয় এবং নীরব আবেগকে প্রকাশ্যে আনে।
কবিতাটির ভেতরে নদীর গান, রাতের নির্জনতা, আষাঢ়-শ্রাবণের উল্লাস, সবকিছু মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে এক সঙ্গীতধর্মী পরিবেশের। এখানে প্রকৃতি কেবল রঙ বা আকারে ধরা পড়ে না; বরং তার নিজস্ব সুর আছে, যা পাঠকের কানে বাজে। বৃষ্টির ধারাকে কবি রূপ দিয়েছেন কান্নার প্রতিধ্বনি হিসেবে, আর এই প্রতিধ্বনিই পাঠককে ফেরত নিয়ে যায় নিজের স্মৃতির কাছে। বৃষ্টি যেমন চারপাশ ভিজিয়ে দেয়, তেমনি কবিতাটি পাঠকের আভ্যন্তরীণ সিক্ততা কেও উন্মুক্ত করে।
🍂
অন্যদিকে, “যাও, উত্তরে হাওয়া” কবিতায় দেখা যায় এক ভিন্ন মাত্রা। এখানে প্রকৃতি কেবল আবেগের প্রতীক নয়; বরং ভূগোল ও ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক আধ্যাত্মিক যাত্রার রূপ নেয়। কবিতায় উজ্জয়িনী, রেবার তীর, বিন্ধ্যপর্বতের ঢালের উল্লেখ কেবল স্থানচিহ্ন নয়, বরং সাংস্কৃতিক স্মৃতির অনুরণন। এইসব নামের ভেতরে আছে ভারতীয় ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনি, এমনকি তীর্থযাত্রার দীর্ঘ ছায়া। কবি যখন বলেন,
“শ্রাবণ রাত্রির হাওয়া ঢাকছে মুখের ছায়া”
তখন প্রকৃতি হয়ে ওঠে আত্ম-অনুসন্ধানের ভাষা, যা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে দেয় বৃহত্তর সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে, সাংস্কৃতিক মানসিকতার সঙ্গে।
এই কবিতায় হাওয়া এক বিশেষ প্রতীক। হাওয়া অদৃশ্য অথচ সর্বত্র বিরাজমান; তাকে ধরা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। কবি এই হাওয়াকে উত্তরের দিকে পাঠান, ঠিক Philip Larkin এর The North Ship কবিতার মতো। এখানে বাতাস যেন তার নিজস্ব বেদনা, আকাঙ্ক্ষা এবং মনের জটিলতা যেগুলি ভেসে যায় দূরে। আবার নদী, বন, ঝর্ণার ধারা, সব মিলিয়ে এখানে প্রকৃতি এক চলমান যাত্রার রূপক। নদী বইছে, ঝর্ণা ছুটছে, হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, এইসব চলন মানুষের অন্তর্গত চাওয়ার মতোই, যা কখনো থেমে থাকে না। ফলে কবিতাটি কেবল একটি দৃশ্যের বর্ণনা নয়, বরং মানুষের আত্মিক যাত্রার প্রতিচ্ছবি। দুটি কবিতার ভেতরেই একটি সুরেলা গতি লক্ষ্য করা যায়। শব্দের ছন্দ, অনুষঙ্গের পুনরাবৃত্তি, প্রকৃতির ভেতরে সাংগীতিক অনুরণন, সব মিলিয়ে দিলীপ মহান্তীর কবিতা এক ধরনের লিরিক কবিতার অভিজ্ঞতা দেয়। পাঠক পড়তে পড়তে যেন শুনতে পান বৃষ্টির শব্দ, নদীর কলতান কিংবা হাওয়ার মর্মর। এই শ্রুতিনির্ভরতা কবিতাকে দৃশ্যনির্ভর বর্ণনা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়।
বাংলা কবিতার দীর্ঘ ইতিহাসে প্রকৃতির ব্যবহার নানা রকম রূপ নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে দেখেছেন সৌন্দর্য, প্রেম এবং মানবিকতার প্রতীক হিসেবে। জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির ভেতরে খুঁজেছেন এক অন্ধকারময় অস্তিত্ব, যেখানে মানুষের নিঃসঙ্গতা ও বেদনা প্রতিফলিত। উত্তর-আধুনিক কবিরা প্রকৃতিকে কখনো ব্যঙ্গাত্মক, কখনো বিচ্ছিন্নতার চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। দিলীপ মহান্তী বাবুর কবিতা এই ধারার ভেতর দিয়েই এগোয়, তবে তাঁর বিশেষত্ব এই যে তিনি ব্যক্তিগত আবেগকে ভৌগোলিক বিস্তারের সঙ্গে মিলিয়ে দেন। এতে তাঁর কবিতায় তৈরি হয় দ্বৈত স্তর, একদিকে অন্তর্জগতের গভীরতা, অন্যদিকে বহির্জগতের সাংস্কৃতিক ভ্রমণ।
“বৃষ্টি” কবিতায় যেখানে প্রকৃতি হয়ে ওঠে স্মৃতির প্রতীক, “যাও, উত্তরে হাওয়া”-য় সেখানে প্রকৃতি হয়ে ওঠে যাত্রার প্রতীক। এই দ্বৈততা কবির কাব্যসত্তাকে আরও জটিল ও সমৃদ্ধ করে। প্রকৃতিকে তিনি কখনো মমতার আশ্রয় হিসেবে দেখান, আবার কখনো তা হয়ে ওঠে দীর্ঘ ভ্রমণের সঙ্গী। পাঠকও এই কবিতার ভেতর দিয়ে নিজের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতিকে মিলিয়ে নিতে পারেন।
সবশেষে বলা যায়, দিলীপ মহান্তী বাবুর কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতি শুধুই বাহ্যিক দৃশ্য নয়, বরং মানুষের আত্মিক স্বরের প্রতিফলন। তাঁর কবিতার প্রতিটি চিত্রকল্প পাঠকের মনের ভেতর অনুরণিত হয়, কখনো বিষণ্ণ সুরে, কখনো যাত্রার আহ্বানে। বাংলা কবিতার সমকালীন প্রেক্ষিতে এই কবিতাগুলি তাই একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করে, কারণ এগুলি প্রকৃতিকে নতুনভাবে পড়তে শেখায়, যেখানে প্রকৃতি আর বাইরের জগতের ছবি নয়, বরং মানুষের অন্তর্জগতের অনিবার্য প্রতিবিম্ব। এর জন্য অজস্র ধন্যবাদ জানাই জ্বলদর্চি পত্রিকাকে, আমাদের মতো পাঠকের সামনে এই কবিতা উপহার দেবার জন্য। পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।
0 Comments