জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে( ত্রয়োবিংশতি পর্ব)/মলয় সরকার

মার্কেজের খোঁজে
( ত্রয়োবিংশতি পর্ব)


মলয় সরকার


মার্কেজের স্কুলের তরুণ শিক্ষক Carlos Martin একবার তাঁকে Eduardo Carranza ও Jorge Rojas নামে দুই বিখ্যাত কবির ইন্টারভিউ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন, এক বড় সভায়। সেই প্রথম তাঁর কোন বিখ্যাত সাহিত্যিকের মুখোমুখি হওয়া। 
ফল বিক্রেতা প্যালেঙ্কেরো রমণী ওপিছনে ধাতুপাতের শিল্পকলা

ক্রমশঃ তিনি ফ্রয়েডের ধারণা ও কাফকার ‘মেটামরফোসিস’’ এর অনুবর্তী হয়ে পড়েন। তিনি বলতেন ১৯৪৭ সালে প্রথম বোগোটাতেই তিনি কাফকার নাম শোনেন। তবু তাঁর মনে হত তিনি বোধ হয় স্কুলে থাকতেই তাঁর বই পড়েছেন।তাঁর শিক্ষক Senor Calderon Hermida তাঁর লেখার খুব ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ভবিষ্যদবাণী করেন যে , মার্কেজ নিশ্চয়ই একদিন, “ the best novelist in Colombia” হবেন। তাঁর এই কথা সত্য হয়েছিল। 

এই সমস্ত কথা নিশ্চয়ই তাঁর মানসিক শক্তি বাড়িয়ে তুলেছিল।স্কুলে থাকাকালীনই তাঁর সাহিত্যকীর্তির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে স্কুলেও তাঁর সুনাম ও কদর বাড়ছিল। ১৯৪৪ সালে স্কুলে দ্বিতীয় বর্ষের শেষে El Tempo (কলম্বিয়ার সবচেয়ে নামী পত্রিকা) তাঁর কবিতা প্রকাশ করেছিল।তখন তাঁর ছদ্মনাম ছিল Javier Garces।এখানেই তিনি মোটামুটি স্থির করে নেন জীবনের লক্ষ্য। 

তিনি বলেছেন, “ When I left there, I wanted to be a journalist, I wanted to write novels, and I wanted to do something to bring about a more just society. “

গ্যাবিটোর বোনেরা স্মরণ করতেন, যে Magangue শহরে প্রথম গ্যাবিটোর ভাবী স্ত্রীর (Mercedes Barcha) সাথে পরিচয় হয়।গ্যাবি বলতেন, যখন স্ত্রীর সাথে প্রথম দেখা হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ন’ বছর। সম্ভবতঃ সময়টা ছিল ১৯৪১ বা '৪২ এর নভেম্বর মাস। তখন তাঁর নিজের বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ বছর। তিনি তখনই স্থির করেন, একেই বিবাহ করবেন।
জেনুদের তৈরী সোনার বক্ষ আবরণী

১৯৪৫ সালে তিনি একটি কবিতা লেখেন, যার নাম, “ Morning Sonnet to an Incorporeal Schoolgirl “।  আর এই ’স্কুল গার্ল’ যে মার্সিডিস বার্চা ছাড়া আর কেউ নয়, তা বলাই বাহুল্য। বার্চা তখন মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া,শেষ করছেন।এই কবিতাটি বহুল প্রচারিত হয়েছিল জিপাকিরা ও Magangue তে। এ ছাড়া Girl  নামেও একটি কবিতা প্রকাশিত হয় তাতে স্বাক্ষর ছিল, Javier Garces”। 
তাঁর স্ত্রীর পুরো নাম ছিল Mercedes Raquel Barcha Pardo।  তাঁর বাবাও ছিলেন, গ্যাবির ব্যবার মত ঘুরে বেড়ানো চিকিৎসক।  একই রকমের ব্যবসায়ে যুক্ত থাকার জন্য গাব্রিয়েল তাঁকে ভালই চিনতেন।সেই সঙ্গে বার্চাকেও খুব ছোটবেলাতেই চিনতেন। 

বার্চাও গ্যাবির মত পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ৬ই নভেম্বর ১৯৩২ সালে। তিনি ছোটবেলায় কালো হরিণের মত চোখ ও সুন্দর মুখশ্রী সমেত খুবই সুন্দরী ছিলেন। তাঁর বাবার নাম ছিল Demetrio ও মায়ের নাম ছিল Raquel । 

বার্চা বলতেন, তাঁর বাবা মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘যে রাজপুত্র তাঁকে বিয়ে করবে, সে এখনও জন্মায় নি।’কিন্তু গার্সিয়া বলতেন, তিনি নাকি বার্চাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, যখন সবেমাত্র বার্চা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করেন।বার্চা প্রথমে Franciscan convent স্কুল এ পড়াশোনা করেন। 

গ্যাবি অনেক সময়েই বার্চার বাবার সঙ্গে নানা ব্যাপারে কথা বলতেন।বার্চা মজা করে বলতেন, গ্যাবি আমার চেয়ে আমার বাবাকে বোধ হয় বেশি ভালবাসে।


তিনি ধূমপান শুরু করেন ১৯৪৫ সাল থেকেই এবং দিনে প্রায় চল্লিশ- পঞ্চাশ টি সিগারেট খেতেন। এই অভ্যাস ছিল প্রায় তিন দশক ধরে।
কার্তাহেনার রাস্তায় বিক্রী হচ্ছে হাতে আঁকা ছবি

তিনি স্কুলে সাহিত্য ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে খুব আকর্ষণ বোধ করতেন না। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি নিজের সাফল্যে আশ্চর্য হতেন এবং ভাবতেন, তাঁর অন্য বিষয়ে এত সাফল্য আসতেই পারে না। নিশ্চয়ই শিক্ষকরা তাঁকে ভালবেসে বেশি নম্বর দেন।

ইতিমধ্যে তিনি সুবক্তা হিসাবেও খ্যাতি অর্জন করেন। আঠারো বছর বয়সে তিনি যে বক্তৃতা দেন বহু নামী দামী মানুষের সমাবেশে, তা এক উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা ছিল।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁকে স্কুলে কিছু বলতে বলা হয়েছিল। তিনি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট সম্বন্ধে বলেছিলেন, তিনি এমন একজন বীর যিনি, “win victories even after his death” এই কথাগুলি তাঁকে খ্যাতির শিখরে তুলে দিয়েছিল।
তাঁদের পরিবারে তাঁর বাবার চরিত্রহীনতা, ব্যবসা বা উপার্জনের ক্ষেত্রে খেয়ালীপনা এবং দায়িত্বহীন ভাবে কেবল সন্তান উৎপাদন, পরিবারের যথেষ্ট যন্ত্রণার কারণ ছিল।

মাত্র উনিশ বছর বয়সেই গ্যাবি কবি হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।এরপর ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে তিনি স্নাতক হন।এই সময়ে দেশে বেশ রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। ১৯৪০ এর পর থেকেই যা চলছিল চারিদিকে, তাকে La Violencia বলে বলা হয়েছে। এই গৃহযুদ্ধে প্রায় আড়াই লক্ষ নিরীহ মানুষ বিভিন্ন ভাবে মারা যান।
১৯৪৮ সালে গার্সিয়ার জিপাকিরাতে পড়া,শেষ হয়। আপ্রাণ চেষ্টার ফলে তাঁর পরীক্ষার ফল অসাধারণ ভাল হয়। 

এই সময় একটি ঘটনা ঘটে। পরীক্ষার আগে তিনি মারাত্মক এক অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হন। তিনি এক রাত্রে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাইরে রাত কাটান। ধরা পরার পর তাঁকে সাসপেণ্ড করা হয় ও এক বছরের জন্য পরীক্ষায় না বসার শাস্তি দেওয়া হয়। পরে  প্রধান শিক্ষক চিন্তা করেন যে, স্কুলের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছাত্রের উপর এই শাস্তিতে স্কুলের বদনামের আশঙ্কা আছে। তখন শাস্তি ফিরিয়ে নেওয়া হয়।গ্যাবো পরে স্বীকার করেন  যে, তিনি জিপাকিরাতে যা শিক্ষালাভ করেছেন, তার জন্য তিনি স্কুলের প্রতি কৃতজ্ঞ।

এই সময় তাঁর বাবা গাব্রিয়েল এলিজিও আবার একটি নতুন বাড়ি বানান, যেখানে তাঁর ঠাকুমা ও পিসিরাও থাকতেন।এই নতুন বাড়িকে গ্যাবো বলতেন “হাসপাতাল” , এর সাদা রঙের জন্য। বাবার সঙ্গে তাঁর যদিও মোটেই সম্পর্ক ভাল ছিল না, যদিও বাবা তাঁর পরীক্ষার এই সাফল্যের জন্য বাড়িতে বিরাট ভোজ দিয়েছিলেন। এতে তিনি পুরো সুক্রের সমস্ত লোককে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
গ্যাবি কিন্তু মোটেই তাঁকে ঘিরে এই হৈ চৈ খুব পছন্দ করছিলেন না। অবশ্য সে যুগে এরকম একটি স্কুলের স্নাতক হওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না, তাঁদের মত এত দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা পরিবারের পক্ষে তো বটেই, এমন কি একটু উচ্চবিত্ত ঘরেও এটা এত সহজ ছিল না।তাঁর বোন পরে বলেছেন, বাবার এত আনন্দ হয়েছিল যে, একটা শুয়োর মারা হয়েছিল, প্রচুর খাদ্য পানীয় হয়েছিল। সারা রাত তাঁরা নাচ গান করেছেন।
🍂

গ্যাবি তখনও জানেন না যে ভবিষ্যতে তিনি কি পড়তে যাচ্ছেন।এরপর গ্যাবি অনেক টানাপোড়েন,  নানা চড়াই উৎরাই এর পর মা এবং বাবার কথায় অনিচ্ছা সত্বেও National University তে আইন পড়তে আসেন।

 কুড়ি বছর বয়সে তিনি বোগোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে,  পিতার ইচ্ছায়, আইন পড়তে যান।কিন্তু তখন থেকেই এই পড়ায় অনীহা প্রদর্শন করে তিনি লেখার দিকে আগ্রহ দেখান। দৈনিক সংবাদপত্র El Expectador এ তাঁর প্রথম ছোট গল্পগুলি প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই তিনি ভবিষ্যতের শক্তিমান সাহিত্যিক হিসাবে পরিচিত হন।১৯৪৮ সালের এক বসন্তে যখন রাজনৈতিক নেতা Jorge Eliecer Gaitan এর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে তাঁর হস্টেলে আগুন লাগানো হয়, তিনি তাঁর কিছু বই ও গল্পের পাণ্ডুলিপিগুলি নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে আসেন। ধীরে ধীরে রাজনীতির প্রতি আকর্ষণও বোধ করতে থাকেন।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ও রাজনৈতিক অবস্থার কারণে বোগোটা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। তাঁকে কার্তাহেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু অল্পদিনেই তিনি পড়াশোনা ছেড়ে রিপোর্টারের কাজ নেন।

এক বছর পর তিনি বারাঙ্কুইলাতে (Barranquilla)একটি পতিতালয়ে ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন। এখানে তাঁর ছোট গল্প ও পত্রিকার জন্য লেখা চলতে থাকে। সম্ভবতঃ এখানেই তাঁর বই ‘দুঃখ ভারাক্রান্ত বেশ্যারা’ বইটির মালমশলা জোগাড় করেন। এই বারাঙ্কুইলাতে হাই স্কুলে তাঁর নামে একটি বিভাগও খোলা হয়, Gabriel Garcia Marquez Department । এখানে তাঁর বোন Aida শিক্ষকতা করতেন।

ক্রমশঃ-
পথের বন্ধুরা থাকুন সঙ্গে-

Post a Comment

0 Comments