জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(ষড়বিংশতি পর্ব)/মলয় সরকার

মার্কেজের খোঁজে
(ষড়বিংশতি পর্ব)

মলয় সরকার
কার্তাহেনাতে আমাদের টুরিস্ট বাসের ভিতর

মার্কেজ বোগোটার একটি রাস্তা সম্বন্ধে বলেছিলেন,  “ It is a good place to get killed”। বোগোটারও বহু মানুষ শহরের মাঝের বাস তুলে শহরের বাইরে বাস করতে শুরু করেন। একমাত্র যাঁরা মার্কেজের মত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারতেন, তাঁরাই সেখানে থাকতে পারতেন।

মার্কেজ এবং তাঁর স্ত্রী যে বাড়িতে থাকতেন, সেটি বিশাল ডুপ্লেক্স ধরণের বাড়ি ছিল, যার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত জানালা ছিল, যাতে পাশের লন ও বাগান দেখা যায়। তাঁর বাড়ি ছিল আপাদমস্তক সাদা, কার্পেট, সোফা, দেওয়াল সব।দেওয়ালে থাকত অনেক দামী দামী ছবি।

তিনি মার্সিডিজের সম্বন্ধে খুব গর্ব করে কথা বলতেন।তিনি তাঁর এবং কাস্ত্রোর সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্বন্ধে বলতেন, “ Fidel trusts even more than he trusts me.” এবং এ- ও বলতেন যে, “ She is the only person I know who can scold him”। তাঁর উপর গার্সিয়া খুব ভরসা করতেন। মার্সিডিসও যথেষ্ট বুদ্ধিমতী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী ছিলেন। তাঁদের দুই সন্তান Rodrigo, যিনি লস এঞ্জেলস এ থাকতেন ও সিনেমা নির্মাতা; আর একজন Gonjalo যিনি হলেন মেক্সিকোতে গ্রাফিক ডিজাইনার ।

যদিও মার্কেজ কলম্বিয়ার বিশিষ্ট নাগরিক এবং নোবেল প্রাইজও পান, বোগোটা কখনওই তাঁর প্রধান আবাস হয় নি।তিনি জীবনের অনেকখানিই মেক্সিকো সিটিতে কাটান। এ ছাড়াও তাঁর অনেকগুলি বাড়ি ছিল, যেমন Cuernavaca,  Barcelona,  Paris, Havana, Cartagena,  Barranquilla ও ক্যারিবিয়ান উপকূলে।এর প্রত্যেকটিই একই ভাবে সজ্জিত ছিল,  যেমন সাদা কার্পেট, বিশাল কাঁচের কফি টেবিল, মডার্ণ আর্টের ছবি, দামী সাউণ্ড সিস্টেম, এবং সব জায়গাতেই একই ধরণের দামী ম্যাকিন্টস কম্পিউটার। তাঁর এই সমস্ত জিনিসের প্রতি আলাদা আকর্ষণ ছিল।
🍂

তিনি বলতেন, তিনি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠতেন। তারপর সকাল সাতটা পর্যন্ত বই পড়তেন, খবরের কাগজ পড়তেন, ইমেইল করতেন, তারপর দুনিয়ায় যাই ঘটুক বেলা দশটায় লিখতে বসতেন।বেলা আড়াইটা পর্যন্ত লিখতেন। তার পর দ্বিপ্রাহরিক খাওয়া এবং পরিবারের সবার সঙ্গে ও বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো, এই ছিল তাঁর প্রাত্যহিক দিনলিপি।

তাঁর জীবনের শেষ বই ছিল “ News of kidnapping “ এটি ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
তাঁর লেখক জীবন শুরু হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে La Violencia যুগে ৯ ই এপ্রিল,  ১৯৪৮ এ যখন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা Jorge Eliecer Gaitan প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁর অফিসের সামনেই খুন হন।

আসলে এখানে যে অশান্তি ও গৃহযুদ্ধ চলেছিল, তার প্রধান কারণ হল, চোরাই ড্রাগ, কোকেনের ব্যবসা।FARC নামে একটি গেরিলা দল ছিল সব চেয়ে শক্তিশালী ও ধনী।তারা দখল করে রেখেছিল এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কোকেন উৎপাদন হয়।এদের , প্রায় সরকারের সমান বা বেশি রক্ষী,  কম্যাণ্ডোবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল।এরাই সমস্ত ব্যবসার কাজে বেশি মদত দিয়ে এটিকে বাঁচিয়ে রাখত।আর ওদিকে আমেরিকার বাজারে যত কোকেন বিক্রী হত, তার আশি শতাংশ এখান থেকে যেত।

এর ফলে কলম্বিয়া সরকারের সঙ্গে আমেরিকা সরকারের যোগাযোগ ও কথাবার্তা চলত।
এই সমস্ত ক্ষেত্রে মার্কেজ শান্তি চুক্তির জন্য কথাবার্তা চালাতেন।তিনি ওয়াশিংটন ও বোগোটার মধ্যে একটা সুসম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছিলেন। ক্লিন্টন তাঁকে হোয়াইট হাউসে মাঝে মাঝেই ডেকে পাঠাতেন।
শুধু ক্লিন্টন একা নন, অনেক রাষ্ট্রপ্রধানই এই সমস্যার ব্যাপারে মার্কেজের সঙ্গে মাঝে মাঝেই আলোচনা করতেন ও ডেকে পাঠাতেন বা নিজেরাও আসতেন। কারণ এই ব্যাপারে যেমন নিরপরাধ বহু লোক মারা গিয়েছিল, তেমনই সরকারী বা গেরিলা ইত্যাদি বহু শ্রেণীর মানুষই মারা গিয়েছিল। এটি একটি জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল,  অবশ্য এখনও এ সমস্যা পুরো মেটে নি। অবশ্য ১৯৯৩ তে ওয়াশিংটনের একটি পত্রিকায় লেখেন, “War on drugs” was merely an “ instrument for further intervention in Latin America” ।

তিনি দৌত্য ও চেষ্টা করেছিলেন, এল সালভাদর, নিকারাগুয়া ইত্যাদি জায়গারও গৃহযুদ্ধ থামাতে। তবে তিনি চেষ্টা করতেন দু'পক্ষেরই বন্দীদেরও ছাড়িয়ে আনতে। তাঁর এই দৌত্যের মাধ্যমে, উভয় পক্ষেরই সুবিধা হত।তবে তিনি শত প্রলোভনেও কখনও প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেন নি। এ ব্যাপারে তাঁকে অবশ্য বেশ কিছু সমালোচনাও শুনতে হয়েছে, যে, উনি এই ‘রোল’ এ থেকে নিজের দামটা বাড়ানোর একটা আনন্দ উপভোগ করতেন।

মার্কেজ কার্তাহেনাতে “ Foundation for New Ibero- American Journalism” প্রতিষ্ঠা করেন। এটি Jaime Cabello Banfi  নামে একজন টেলিভিশন বিশেষজ্ঞ চালাতেন। এর অর্থের জোগান দেয় UNESCO এবং Inter- American Development Bank ও অন্যান্য সংস্থারা। এতে নামী রিপোর্টাররা আমন্ত্রিত হতেন, মার্কেজ নিজেও সেমিনার করতেন।


তিনি একসময়ে Cambio নামে একটি পত্রিকার বড় অংশীদার ছিলেন।  পরে নোবেল প্রাইজের টাকায় পত্রিকাটি পুরোই কিনে নেন।

এই সম্বন্ধে তিনি বলতেন, প্রায় ষোল বছর ধরে এই পুরস্কারের টাকাটি সুইস ব্যাঙ্কে পড়েছিল। তিনি এটির কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন।পরে মার্সিডিস এই টাকার কথা মনে করিয়ে দেন।
এই পত্রিকাটির প্রচারসংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার।কলম্বিয়ার সাধার‍ণ মানুষের খুব আগ্রহ ছিল যে মার্কেজ সমসাময়িক অবস্থার কি বিশ্লেষণ করেন। তাঁর নোবেল প্রাপ্তি সম্বন্ধে বলা হয়েছিল, “ In a country that's gone to shit, Gabo is a symbol of National Pride “ কেউ বলতেন,” Nuestro Nobel “ বা “ El Único Nobel “ বা একমাত্র নোবেল প্রাপক, যদিও সেটি আসলে ঊচ্ছ্বাস ও ভালবাসার প্রকাশমাত্র।

১৯৯৯ সালে মার্কেজের প্রথম লিম্ফোমাস ক্যানসার ধরা পড়ে। তবে এটা বাইরে বেশি প্রচার করা হয় নি।কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।তিনি আমৃত্যু মেক্সিকো সিটিতেই থেকে যান।শেষে ২০১৪ সালে এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে বৃহস্পতিবার নিউমোনিয়া রোগে , সেখানেই ৮৭ বছর বয়সে মারা যান।কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল স্যান্তোস তাঁকে ‘ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কলম্বিয়ান’ হিসামে অভিহিত করেন। তাঁর মৃত্যুতে কলম্বিয়ায় তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছিল।তাঁর স্ত্রী মার্সিডিস বার্চা মারা যান ২০২০ সালের আগস্ট মাসে।

আরাকাতাকা একটি ছোট শহর,যেখানে তিনি জন্মেছিলেন, যেখানে বড় বাড়ি প্রায় ছিল না, একতলা বাড়িই বেশি।

পরবর্তী কালে সেই বাড়িটি,  যেখানে তিনি জন্মেছিলেন,  সেটি একটি মিউজিয়ামে (Casa Museo Gabriel Garcia Marquez) পরিণত করা হয়েছিল। আসল বাড়িটির অল্প অংশই বেঁচে ছিল।যেটুকু ছিল, তা হল, টিনের ছাউনি দেওয়া সাদা রঙের দুটি কামরা।


সাহিত্যজগতে মার্কেজের অবদান অতুলনীয়।তাঁর লেখার যে আলাদা ধারা তাই তাঁকে সকলের থেকে আলাদা করেছে।এটি যদিও কাফকার কাছে তাঁর শিক্ষা, তবু এর মধ্যে তাঁর একটা নিজস্বতা আছে। তাঁর, শুধু উপন্যস নয়, ছোট গল্প বা নিবন্ধ কি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সব কিছুরই পাঠকের কাছে একটা আলাদা মূল্য ছিল।আর তার জন্যই স্পেনীয় ভাষায় আরও নোবেল প্রাপক থাকলেও তাঁর নামই আগে করতে হয়।শুধু স্পেনীয় নয়, সারা পৃথিবীতেই যত সাহিত্যে নোবেল প্রাপক রয়েছেন, ক্রমান্বয়ে সাজাতে গেলে তাঁর নামই প্রথম দিকে থাকবে বলেই অনেকে মনে করেন।

ক্রমশঃ–
আর কিছুদিন কষ্ট করে সঙ্গে থাকুন বন্ধুরা।শীঘ্র বন্ধ করব আমার সুদীর্ঘ গল্পের ঝাঁপি।

Post a Comment

0 Comments