জ্বলদর্চি

গিমাশাক/ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ১০৪

গিমাশাক

ভাস্করব্রত পতি

'চৈতে গিমা তিতা, বৈশাখে নালিতা মিঠা,
জ্যৈষ্ঠে অমৃত ফল।
আষাঢ়ে খই, শাওনে দই,
ভাদরে তালের পিঠা, আশ্বিনে শশা মিঠা,
কার্তিকে খলের ঝোল।
আগনে ওল, পৌষে কাজি, 
মাঘে তেল, ফাল্গুনে চূড়ান্ত বেল।'
     -- খনার বচন। 

একসময় এই গিমাশাকের প্রাচীন ভারতীয় নাম ছিল 'গ্রীষ্মসুন্দরক'। ঋকবেদের ১।৪৮।৮ এবং ৮।২৯।১ সূক্তে এই 'গ্রীষ্মসুন্দরক' নামের উল্লেখ পাই -
'গ্রীষ্মমুন্দরঃ সবনমসি ব্যুহচরণে প্রাণঃ প্রাণিনাং ব্যরংহৎ।'

ভৌগোলিক কারণে সূর্যের তাপেরও ভিন্নতা হয়। তাই গ্রীষ্মঋতু সমানভাবে সর্বত্র কিরণ বিকীরণ করে না। কিন্তু যেখানে করে, সেখানেই গ্রীষ্মসুন্দরের অর্থাৎ গিমেশাক জন্মায়। আসলে গ্রীষ্মের প্রখর তাপে অন্যান্য গাছ যখন মৃতপ্রায়, তখন এই ক্ষুদ্র গুল্মলতাটির যৌবন এবং জৌলুষ ফেটে ওঠে। 

ভেষজ বিশেষজ্ঞদের মতে, চরকের কল্পস্থানের একাদশ অধ্যায়ে যেটি যবতিক্তা বা নীলী অথবা সপ্তলাই, সেটাই গিমেশাক। সপ্তধাতুর পৃষ্ঠপোষক গিমাশাকের অন্য নাম সপ্তলা। চরকের সূত্রস্থানের ২৭ তম অধ্যায়ের ৭৫ শ্লোকগুচ্ছের প্রথম শ্লোকটি-
'মণ্ডুকপর্ণী বেত্রাগ্রং কুচেলা বনতিস্তকম্'।
কারও কারও মতে, এই কুচেলাই হল গিমাশাক। 

এছাড়াও গিমাকে আরও বিভিন্ন নামে চেনা যায়। গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত পিতাশাক, পিতা গহম (ওড়িশা), নোনতাসা, নোনার, নুইন্না, বাইলে শাক (বাগেরহাট), গিয়ানলি, খাটাই, নুনটা, নুনতি, নুনা শাক, ছেলানঞ্চি (বীরভূম), ডিমার শাক (চাঁদপুর), খ্যাতা শাক (যশোর), চিরা শাক, কাঁথা শাক (বাগেরহাট), ছক্কুনি শাক, শাইবানী শাক, হেইছা শাক (কিশোরগঞ্জ) ইত্যাদি নামে। আঞ্চলিক ছড়ায় পাই --
'নোয়াখালীর ভাষায় নুনা শাক,
খাবেন করে শুটকি দিয়ে পাক।'

এটি মাটির সাথে লেপটে থাকা একপ্রকার ছোট শাকবিশেষ। এদের পাতাগুলো সরু সরু। সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল ফোটে। শীতকালের এই ভেষজ শাকটি বেশ উপাদেয় কিন্তু তেতো স্বাদের। ফল পাকলে ফেটে যায়। গিমাশাকের বিজ্ঞানসম্মত নাম Erythroca centauroids এবং Erythroca roxburgie। ইংরেজিতে Lady Bed Straw, Purslane বলে। একে বাগানের হীরার খনির সাথে তুলনা করা হয়। ড. হরিসাধন গোস্বামীর কবিতায় রয়েছে গিমাশাকের অনুষঙ্গ। 
'শুশনি কলমি গিমা শাক
গেড়ি গুগলি কাঁকড়া কুচো মাছ
মাঝে মাঝে হরিমটর
নিষ্ফলা নির্জলা সারা দিনমান
রাত্রির বাতাস কী ভীষণ ভারী'
রসুই ঘরের পরিচিত গিমাশাক

গিমাশাকের ভেষজগুণ বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে --
'তিক্তত্বম্, লঘুত্বম, কফপিত্তদোষনাশিত্বম্ রুচিকারিত্বও';
অর্থাৎ এটি স্বাদে তেতো এবং কফপিত্তের আধিক্য নাশক এবং রুচিকারক। গিমার মধ্যে সাবান জলের মত কিছু ফেনিল পিচ্ছিল পদার্থ রয়েছে। যা স্যাপোনিন নামে পরিচিত। তবে যেসব মহিলার স্রাবের আধিক্য আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই শাক খাওয়ায় বিধিনিষেধ রয়েছে। লিভারের সমস্যার সমাধানে গিমাশাকের তরকারি উপকারী। 

গ্রামনাম সৃষ্টির পেছনেও এই গিমাশাকের অবদান মেলে। গিমাগাছ থেকে গিমাগেড়িয়া নামকরণ হয়েছে বলে অভিমত অনেকের। গ্রামেগঞ্জের অতি পরিচিত এই শীতকালীন তিতা স্বাদের শাকটি সেদ্ধ করে আলু ভাতের সাথে মাখিয়ে খাওয়া হয়। 
          গিমা + গেড়িয়া > গিমাগেড়িয়া

🍂

Post a Comment

0 Comments