জ্বলদর্চি

মাছের মাথা /কমলিকা ভট্টাচার্য

মাছের মাথা

কমলিকা ভট্টাচার্য

একদিন ভোররাতে জগা ধড়মড় করে উঠে বসল। যদিও ওর কাছে তখনো রাত, কিন্তু অন্যদের কাছে ভোর। বাড়ির উঠোনে যেন হই হই রই রই কাণ্ড!

ধাঁধার মতো ঘরের ভিতর ঘর পেরিয়ে উঠোনে পৌঁছাতেই দেখল—সারা পাড়া ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু গুজগুজ ফিসফাস।

জগা চোখ কচলে চারদিকে তাকিয়ে দেখল—মা-বাবা, জেঠু-জেঠি, বিধবা পিসি—সবাই আছে। কারো কিছু হয়নি তো! তবে কি বুড়ি পিসি ঠাম্মা? উফ, বুড়ি আর মরার সময় পেল না! আজ রবিবার, ভেবেছিলাম একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোবো, তারপর জম্পেশ করে মাংস-ভাত খাবো। এখন আবার শোকের পালা!

তবে বাঁচা গেল, বুড়ি তো উঠতে-বসতে খোঁচা দিতেই থাকে—
“বাবা জগা, কাজকম্ম কবে শুরু করবি? তোর বাপ তো এই বয়সেই সংসার সামলাতে শিখে গেছিল।”

মনে হয় মুখের উপর বলেই দেবে— “যাবার সময় হয়েছে বুড়ি, তবে তুমি আর যাচ্ছ কোথায়? আমি তো আমার বাপের খাচ্ছি, তাতে তোমার কী!”
কিন্তু বলার আগেই বুড়ি উত্তর দেয়—
“আমার বাপ-কাকার রোজগারে সাত পুরুষ বসে খাচ্ছে। জমিদারী রেখে গেছে। আজও গ্রামের লোক তাদের নামে পেন্নাম করে। লোকজনের লগা কি কম করসে?”

কোথায় সেই জমিদারী—জগা আজও বোঝেনি। বাবা-জ্যাঠারা কেরানিগিরি করে, মা-জেঠিমারা দাসী-গিরি—এই তাদের সংসার।

এসব ভাবতেই হঠাৎ বুড়ি টনটনিয়ে বলে উঠল—
“সবাই সর দ্যাখনি? আমায় দেখতে দে, মরা না প্রাণ আছে।”

জগার বুকের ভিতর ধড়াস করে উঠল—চুনি দিদিকে তো দেখা যাচ্ছে না! পাশের বাড়ির বলাইদারের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা সে জানত। তবে কি চাকরি না পাওয়ায় বিয়ে ভেস্তে গেছে, তাই দিদি বিষ খেল? বুড়ি তো ওকেও রেহাই দেয়নি—
“ধিঙ্গি মেয়ে ঘরে বসে আছিস! এই বয়সে আমি চার-পোলার মা হইসি।”

ভিড় ঠেলে ছুটে গিয়ে জগা যা দেখল, তাতে হাঁ হয়ে রইল—
ইয়া বড় একটা রুই!

সেই নিয়েই এত হইচই!

সকালবেলায় পুকুরে জাল ফেলতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পাড়া-প্রতিবেশী সকলে এই পুকুরের শরিক, তাই মাছের ভাগ নিয়েই শুরু হলো টানাটানি।
🍂

বুড়ি ঘোষণা করল—
“এই ত্রিশ-চল্লিশ কিলোর মাছ বাড়ির বটিতে ক্যাইটা যাবে না। যা, বাজার থেকে রঘুকে ডেকে আন। সাথে বটি-ওজন-পল্লাও আনতে বল।”

জেঠু আপত্তি করতেই বুড়ি ধমক দিল—
“ও আসবে না মানে? ওর মরা বাপ আসবেক? আমার ঠাকুরদার পুকুরের মাছ বেচে আজ এত টাকা করসে, আমি ডাকলেই আসবেই।”

তারপর নিজের পুরনো কাহিনী শুরু করল—
“এই মাছটা কি দেখছোস? আমার বিয়ের সময় দুটো মাছেই গ্রামশুদ্ধ লোক তিন বেলা পাত প্যাইড়া খাইসিল। ফুলশয্যার রাতেও স্বামী মাছের প্রশংসায় ব্যস্ত ছিল। আমি লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম—ঠিক আছে, বাবাকে বলে ওইরকম মাছ এনে নিজে রান্না করে আপনাকে খাওয়াব।”

লোকজন বুড়ির গল্পে মুগ্ধ, এর মধ্যেই রঘু এসে হাজির। মাছ ওজন করতে গিয়ে বোঝা গেল—পুরো সাঁইত্রিশ কেজি!

বুড়ি এবার জগার দিকে তাকিয়ে বলল—
“এই যে, চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বারবার ফেল করিস, অংকটা তোকে করতে বলছি—ন’জন শরিক, ক’কেজি করে পাবে?”

জগা মাথা চুলকোতে লাগল।

ঠিক তখনই পাশের বাড়ির চিন্টু (ক্লাস টুতে পড়ে) বলে উঠল—
“পিসি ঠাম্মা, চার কেজি করে!”

বুড়ি মুচকি হেসে বলল—
“এই রাখালের পোলা নিশ্চয়ই বড় অফিসার হবে।”

তারপর রঘুকে বলল—
“ওই বাকি এক কেজি তুই ঘরে নিয়ে গিয়ে খাস। চালানি মাছ বেইচা অনেক কামাই করছিস আজকাল।”

রঘু লজ্জায় জিভ কাটল।

মাছ কাটতে গিয়ে রঘুর নাকানি-চোবানি, আর সেই সময় টুনি কাকিমা নতুন খেলা শুরু করল—
“মাছের পেটটা কাটার সময় ভালো করে দেখিস। ওইদিন পুজোর স্নানে আমার নতুন কানের দুল জলে পড়ে গেছিল। যদি মাছের পেট থেকে বের হয়!”

ব্যস! শুরু হলো হুল্লোড়। কার কী হারিয়েছে সেই স্মৃতিচারণায় পাড়া মেতে উঠল। জগার মনে শকুন্তলার গল্প ভেসে উঠল।

শেষমেশ পেটের নাড়িভুঁড়ি ঘেঁটে কিছুই না পাওয়ায় সবাই একটু হতাশ হলো।

এবার বুড়ি হাক দিয়ে সবাইকে চুপ করাল—
“এবার দেখি মাছের মুড়োটা ভাগ হইবা কীভাবে?”

সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। জগা বরাবরই মাছের মাথা খেতে ভালোবাসত। তাই সাহস করে বলল—
“আমি বলি। ছোটবেলা থেকে শুনেছি মাছের মাথা খেলে বুদ্ধি বাড়ে। তাই যার পরিবারের ছেলে-মেয়ের বুদ্ধি কম, তাদেরই দেওয়া হোক মুড়ো।”

সাথে সাথে সবাই চুপ। কে আর নিজেকে বোকা প্রমাণ করতে চায়! তাই যে যার ভাগ নিয়ে কেটে পড়ল।

দুপুরে মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ছ্যাচড়া, চচ্চড়ি দিয়ে ভাত জমিয়ে খেল জগা। তারপর ভোরের ঘুমটা দুপুরে সারল।

পরের দিনের পরীক্ষা ওর ভালোই হলো।

আর চাকরির ইন্টারভিউতে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো—
“বিপরীত পরিস্থিতি সামলাতে জীবনের সবচেয়ে জরুরি জিনিস কী?”

জগদীশ্বর ওরফে জগার মুখ দিয়ে প্রথমে বেরোল—
“মাছের মাথা।”

তারপর মাছটা গিলে নিয়ে বলল—
“মানে, মাথা। উপস্থিত বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।”

কিছুদিন বাদে চাকরির খবর হাতে পেয়ে জগা বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে খবর জানাল। সবাই খুব খুশি। তারপর পিসি ঠাম্মার কাছে গিয়ে বলল—
“এই যে বুড়ি ঠাম্মা, আমায় যে কথায় কথায় এত গাল দিতে—এবার কিছু বলো।”

বুড়ি সেই একই মেজাজে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠে বলল—
“মস্ত বড় মাছের মাথা খাইয়া যে মস্ত অফিসারটা হইলি, মনে রাখিস—এই গ্রামের সরল লোকগুলাকে ঠকাস না। এদের লগে, দেশের লগে মন লগাইয়া কাজ করিস।”

তারপর জগার মার দিকে তাকিয়ে বলল—
“পোলার এবার একখান বিয়ের ব্যবস্থা কর খানে। পুকুরে আবার জাল ফেলতে হবে। এ পুকুরে এখনো তিন-চারটে বড় রুই আছে।”

জগা আজ প্রথমবার ভক্তি ভরে পিসি ঠাম্মাকে প্রণাম করল।

আজ পিসি ঠাম্মা না বলেও তাকে বলে দিল—কেউ আমল না করলেও বুড়ি ঠাম্মা সেদিন তার চালাকি বুঝেছিল। আর আজ, কর্মজীবনের শুরুতেই সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেল।

জগা মনে মনে ভাবল—ঠাম্মা সত্যিই বলে, সে জমিদারবাড়ির মেয়ে। জমিদার তো শুধু পয়সা বা সম্পত্তি থাকলেই হয় না—ভালো মনের জমিদার ক’জন হতে পারে?

Post a Comment

0 Comments