প্রসেনজিৎ রায়
বিদ্যালয় শিক্ষার সূচনার সেই প্রথম যুগে, জ্ঞানচর্চা যখন মুষ্টিমেয় মেধাবী ও বিত্তবানের কুক্ষিগত থাকার কথা, তখনই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন জনশিক্ষা প্রসারে। নিজের খরচে একের পর এক বিদ্যালয় যিনি সাধারণী শিক্ষার জন্য স্থাপন করতে পারেন, ঔপনিবেশিক সরকারের শিক্ষা-সংকোচন নীতির প্রতিস্রোতে গিয়ে, তিনি বিদ্যালোকের শেষতম বিন্দুটুকুও দ্রুত শিক্ষানুরাগী পড়ুয়াদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইবেন, তা কোনো নতুন কথা নয়।
একাধিক পাঠ্যবই রচনার দায়িত্ব যে প্রবল উৎসাহ নিয়ে তিনি অতিবাহন করেছেন, তার একমাত্র মূলসুর ছিল , ছাত্রকল্যাণ।
মনে হয় সেইকারণেই তাঁর রচিত 'বাঙ্গালার ইতিহাস - দ্বিতীয় ভাগ' আমাদের কাছে ঐতিহাসিক আলোচনার গুরুভার পরিসর পেরিয়ে হয়ে ওঠে অত্যন্ত উপভোগ্য একটি গদ্য-যা ঐতিহাসিক তথ্য ও বিশ্লেষণের অন্যতম আকরস্বরূপ।
বাঙ্গালার ইতিহাস (দ্বিতীয় ভাগ) – এর প্রথম প্রকাশ ১৮৪৮, অর্থাৎ মহাবিদ্রোহের বছর নয় পূর্বে।
এই গ্রন্থের 'বিজ্ঞাপন' শীর্ষক ভূমিকায় তিনি নিজেই লিখেছেন,
*"বাঙ্গালার ইতিহাসের দ্বিতীয় ভাগ, শ্রীযুক্ত মার্শমন সাহেবের রচিত ইঙ্গরেজী গ্রন্থের শেষ নয় অধ্যায় অবলম্বনপূর্ব্বক, সঙ্কলিত, ঐ গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ নহে। কোনও কোনও অংশ, অনাবশ্যকবোধে, পরিত্যক্ত হইয়াছে, এবং কোনও কোনও বিষয়, আবশ্যক বোধে, গ্রন্থান্তর হইতে সঙ্কলনপূর্ব্বক, সন্নিবেশিত হইয়াছে।*
*এই পুস্তকে, অতি দুরাচার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনারোহণ অবধি, চিরস্মরণীয় লার্ড উইলিয়ম বেন্টিক মহোদয়ের অধিকারসমাপ্তি পর্য্যন্ত, বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। সিরাজউদ্দৌলা, ১৭৫৬ খৃঃ অব্দের এপ্রিল মাসে, বাঙ্গালা ও বিহারের সিংহাসনে অধিরূঢ় হন; আর, লর্ড বেন্টিক, ১৮৩৫ খৃঃ অব্দের মার্চ মাসে, ভারতবর্ষের শাসনকার্য্য হইতে অবসৃত হইয়া, ইংলণ্ড যাত্রা করেন। সুতরাং এই পুস্তকে, একোন অশীতি বৎসরের বৃত্তান্ত বর্ণিত হইয়াছে।"*
🍂
নবাব সিরাজদৌল্লা, পন্ডিত ইশ্বেরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর বিচারে 'অতি দুরাচার'। আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম লাইনেই আমরা জানতে পারি, ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল সিরাজদৌল্লা তৎকালীন দিল্লীশাহর কাছ থেকে কোনো সনন্দ বা অনুমতিপত্র প্রার্থনা না করেই, সিংহাসন দখল নবাবের মসনদে চড়ে বসেন।
এরপর একে একে সম্পদলোভী সিরাজের কীর্তিকলাপ বিদ্যাসাগরের স্পষ্টবাদী কলমে উন্মোচিত হতে থাকে। ঘটনা পরম্পরা তিনি এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যে, একটি উপভোগ্য উপন্যাসের মতোই তা পাঠকের মননের আকর্ষণ অর্জন করে। ব্রিটিশরা সিরাজের হাত থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছিল- আমরা গড় বাঙালি এই ব্যাপারটাকে ভারতের পরাধীনতা অর্জনের সূত্রপাত বলেই অবচেতনে একটা ধারণা গড়ে নিয়েছি। তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম- এর "কান্ডারী হুঁশিয়ার" - যেখানে কবি ঘোষণা করেছেন,
"কান্ডারী তব সন্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর / বাঙালির খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর/ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর..."
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষায় "নির্বোধ, নৃশাস ও অবিমৃষ্যকারী” সিরাজের কীর্তিকলাপ এই প্রাজ্ঞল ইতিহাসগ্রন্থে এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, সিরাজের শাসনাধীন এলাকার প্রজাদেরও স্বাধীন বলতে আমাদের দ্বিধা হবে, তা ব্রিটিশ শাসকেরা যতই "বিদেশী" বা ঔপনিবেশিক হোক না কেন।
সিরাজদৌল্লাকে দুরাচারী বলা হলেও কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার দায় এই ইতিহাসগ্রন্থে তাঁর কাঁধে চাপানো হয় নি। ঘটনার পরদিন সকাল পর্যন্ত সিরাজ এই ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানতেন না, সে রাতে দুর্গের দায়িত্বে থাকা সেনাপতি মানিকচাঁদকেই এই ঘটনার জন্য দায়ী বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
আমাদের ছাত্রজীবনে এমন কিছু মাননীয় শিক্ষকের সংস্পর্শে আমরা এসেছিলাম, যাঁদের ইতিহাস পড়ানো ঠিক 'পড়ানো'র মতো শুষ্ক ছিল না। বর্ণনা ও উপস্থাপনার গুণে ঠিক যেন গল্পের মতো সহজ হয়ে যেত ইতিহাস।
বাঙ্গালার ইতিহাস ( দ্বিতীয় ভাগ) আমাদের সেই আনন্দপাঠের অভিজ্ঞতাই প্রদান করে। গল্পের মতো চোখের সামনে ফুটে ওঠে কোম্পানী বাহাদুর শাসিত ঔপনিবেশিক বাংলার ছবি।
আমরা সাহিত্যের পাঠকমাত্রেই জানি, একজন সার্থক ঔপন্যাসিক পাঠক এবং চরিত্রের সঠিক মনোবিশ্লেষণ করে, দুই পক্ষের মধ্যে একটি সেতু রচনার চেষ্টা করেন। এই সংযোগ পাঠকের মনকে চরিত্রের গভীরে প্রকাশ করতে প্রভূত সহায়তা করে। এইরকম বর্ণণার গুণে, "বাঙ্গালার ইতিহাস" শেষ পর্যন্ত আর ইতিহাসগ্রন্থ থাকে নি, একটি উপন্যাসের চরিত্র অর্জন করেছে অত্যন্ত সফলভাবে।
ঊনিশ শতকের বাংলায় মাতৃভাষায় স্কুলপাঠ্য বই রচনার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তা ছিলেন। মার্শম্যানের লেখা ইতিহাসের এই পাঠ্যপুস্তকটি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি তাঁর পরিচিত মহলে মিশনারিদের সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠা সত্বেও সেগুলি উপেক্ষা করেছেন।
মিশনারি মার্শম্যান উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এই বইটি লিখেছিলেন।
বাংলার নবাবদের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের শাসকদের নীতিহীন অত্যাচারের কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুকে অনেক দুর্যোগ সহ্য করেছে বলেই মার্শম্যান তাঁর মূল গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন। সমালোচনার সম্ভাবনা রয়েছে জেনেও বিদ্যাসাগর তাঁর অনুবাদে হিন্দু এবং মুসলিমকে দুটি ভিন্ন সত্তা হিসাবেই দেখিয়েছেন।
বিদ্যাসাগর তাঁর এই অনুবাদকার্যে 'ভারতীয়' শব্দটির চেয়ে 'দেশীয়' শব্দটি অনেক বেশিবার ব্যবহার করেছেন এবং বাঙালি শব্দটিও খুব বেশি ব্যবহার করেননি। অনেকে মনে করেন, জাতীয় পরিচয় বা জাতি পরিচয়ের ধারণাটি সেই ১৮৪৮ এর অল্প আগে এই পাঠ্যপুস্তক রচনাকালে সর্বভারতীয় বা প্রাদেশিক কোনো ধারণা ছিল না। বিদ্যাসাগর মূলত সেই সময়কার বাংলায় প্রচলিত প্রাক-আধুনিক শব্দগুলিই তাঁর এই ঐতিহাসিক রচনায় অনুসরণ করছিলেন।
নীতিহীন অত্যাচারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসককে তিনি যেমন ছেড়ে কথা বলেন নি, তেমনই একটি কুপ্রথা বিলোপ সম্পর্কে লিখেছেন, " বহুকাল অবধি ব্যবহার ছিল, পিতা মাতা, গঙ্গাসাগরে গিয়া, শিশু সন্তান সাগর জলে নিক্ষিপ্ত করিতেন। তাঁহারা এই কর্ম ধর্মবোধে করিতেন বটে; কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে ইহার কোনও বিধি নাই। গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর, এই নৃশংস ব্যবহার একেবারে উঠাইয়া দিবার নিমিত্ত, ১৮০২ সালের ২০শে আগস্ট, এক আইনজারী করিলেন ও তাহার পোষকতা নিমিত্ত, গঙ্গাসাগরে এক দল সিপাই পাঠাইয়া দিলেন। তদবধি এই নৃশংস ব্যবহার একবারে রহিত হইয়া গিয়াছে"।
একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে গিয়েও আমরা তাঁর কাছে ইতিবাচক বিবৃতিই শাসক সম্পর্কে পাই যেখানে তিনি লিখেছেন, "১৮৩৫ সালের মার্চ মাসে, লার্ড উইলিয়াম বেন্টিক বাহাদুরের অধিকার সমাপ্ত হয়। তাঁহার অধিকারকালে, ভিন্নদেশীয় নরপতিগণের সহিত যুদ্ধনিবন্ধন কোনও উদ্বেগ ছিল না। এক দিবসের জন্যেও, সন্ধি ও শান্তির ব্যাঘাত ঘটে নাই। তাঁহার অধিকার কাল কেবল প্রজাদিগের শ্রীবৃদ্ধিকল্পে সঙ্কল্পিত হইয়াছিল"।
অনুবাদ রচনা হলেও লেখাটি বিদ্যাসাগরের স্পর্শগুণে মৌলিক। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে ব্রিটিশ শাসকের প্রতি তাঁর কোনো পক্ষপাত ছিল। এই মানুষই তো পরম তেজস্বীতার সাথে ঊনিশ শতকের আর এক মনীষী শিবনাথ শাস্ত্রীকে বলেছিলেন ‘ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটিজুতাশুদ্ধ পায়ে টক করিয়া লাথি না মারিতে পারি।’ ঊনিশ শতকের রাজার মধ্যে ব্রিটিশরাও পড়বে। তাঁর জীবন ও আচারে সে উদাহরণ আমরা বহুবার পেয়েছি।
ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়া ইতিহাস-লেখক এই জ্যোতিষ্ক বাঙালীর হৃদয়াকাশে চিরজাগরুক থাকুন, তাঁর জন্মদিবসে আমাদের এই তো প্রার্থনা।।
1 Comments
তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি এককথায় অনবদ্য ।
ReplyDelete