জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের লোকশিল্প যখন বানিজ্যমুখী শিল্প /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের লোকশিল্প যখন বানিজ্যমুখী শিল্প

ভাস্করব্রত পতি
বাহাদুর চিত্রকর ও তাঁর পটচিত্র

মেদিনীপুরের বুকে ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে সহজলভ্য উপাদানের মাধ্যমে তৈরি লোকশিল্পের চাহিদা কিন্তু বজায় রয়েছে এখনও। বরং আরো গুরুত্ব বেড়েছে জনসমাজে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি উদ্যোগে শিল্পমেলার আয়োজনে কিছু শিল্পীদের প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়েছে বলা যায়। তাছাড়া ব্যাপক প্রচারের আলোয় আসায় বেশকিছু লোকশিল্প এখন অনেক আলোকিত হয়েছে। বিশেষ করে পটশিল্প, পাটশিল্প, কাঠশিল্প, শোলাশিল্প, ডোকরাশিল্প, পোড়ামাটির শিল্প লাইমলাইটে এসেছে বর্তমান সময়ে। কিন্তু অনেক প্রাচীন শিল্পই ধুঁকছে। একসময় যেসব শিল্পের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছিল, সেসব আজ চিরনিদ্রায় বা অন্ধকার কুঠুরিতেই আবদ্ধ। বর্তমানে অতীতের অনেক বাণিজ্যমুখী শিল্পই আজ হারিয়ে গিয়েছে সময়ের অন্তরালে। 
একসময় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহল এলাকায় তাম্রনিষ্কাষণ শিল্পের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। মেদিনীপুর জেলার উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে প্রায় ২৫ মাইল পশ্চিমে ঘাটশিলা অঞ্চলে রয়েছে বিস্তীর্ণ পর্বতাঞ্চল। বহড়াগোড়া থেকে সেরাইকেলা পর্যন্ত ৯০ মাইল বিস্তীর্ণ এলাকা বায়ানবিল, সুরদা, বাদিয়া, রুয়াম, সিদ্ধেশ্বর, তুরামডি পাহাড় রয়েছে। এখানে মিলতো মুক্ত তামা। তা দিয়ে নানা জিনিস তৈরি হত। এরপর তামার আকরিক গলিয়ে সেখান থেকে তাম্র নিষ্কাষণ করত। 
তেমনি ঘাটশিলা থেকে ২৫ মাইলের মধ্যে থাকা পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় নিশ্চিতভাবে গড়ে উঠেছিল তাম্র নিষ্কাষণ কেন্দ্র। গরুর গাড়িতে চাপিয়ে তামার আকরিক ঘাটশিলা এলাকা থেকে এখানে আনা কোনও দুরূহ ব্যাপার নয়। আজও জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় মেলে তাম্রনিষ্কাষণের বীজ। শুধু তাই নয় এলাকায়ও তাম্র আকরিকের সন্ধানও পাওয়া গেছে।
ঐতিহাসিক ও গবেষকদের ক্ষেত্রসমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে বেলপাহাড়ির ৫০ টি গ্রামের নাম। যেখানে মিলেছে অন্তত ৫০০ টি তাম্রনিষ্কাষণ চুল্লী। এরকমই কয়েকটি গ্রামের নাম হল : জামতালগোড়া, তুরুপাহাড়ি, আগুইবিল, আসারি, অষ্টজুড়ি, সিঁদুরিয়া, কুলডিহা, বাঁশকেটিয়া, ডোমগড় ইত্যাদি। যেখানে যেখানে তাম্রনিষ্কাষণ চুল্লীর খোঁজ মিলেছে সেখানে পাওয়া গিয়েছে গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত পোড়ামাটির নানা সামগ্রী। অর্থাৎ এই কাজে যাঁরা যুক্ত ছিল তাঁরা চুল্লীর আশেপাশে বসবাস করত। আমবৌলি ময়দান, কঙেলতা বনাঞ্চল, রাজবাসা জঙ্গল, মাজুগোড়া জঙ্গল এলাকায় পাওয়া গিয়েছে তাম্রকেন্দ্রিক শিল্পের নানা চিহ্ন। কোথাও কোথাও পাথরের থালাবাটিও মিলেছে মাটির নিচ থেকে।
মেদিনীপুরের দেওয়ালি পুতুল

তামাজুড়ি গ্রামটির কথাই ধরা যাক। সম্ভবত 'তামা' নিষ্কাষিত হত বা তামা মিলতো—এ থেকেই এসেছে গ্রামের নাম। সেসময় এতদঞ্চলে তাম্রনিষ্কাষণ কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছিল তারাফেনি, ডুলুং এবং সুবর্ণরেখা নদীর আশেপাশে। ফলে তাম্র সরবরাহ করা হত নদীপথে। তাম্রলিপ্ত বন্দরে আনা হত তারাফেনি থেকে কাঁসাই হয়ে রূপনারায়ণ নদের মাধ্যমে। সুবর্ণরেখা থেকে নৌকায় করে কাঁথির দক্ষিণ দিক দিয়ে কেলেঘাইতে এসে খুব সহজে তমলুকে নিয়ে আসা যেত। তখন এইভাবেই তামা পাঠানো হত নদীপথে। সহজে নৌকায় তামা বোঝাই করার জন্য নদী তীরবর্তী এলাকাতেই গড়ে উঠেছিল বিশাল তাম্রনিষ্কাষণ কেন্দ্র।
নিষ্কাষিত তামা এসে পৌঁছাত তাম্রলিপ্ত বন্দরে। এই তামা হয়ে উঠেছিল বাণিজ্যের মুখ। বহু ব্যবসায়ী তা দিয়ে তাম্রকেন্দ্রিক নানা শিল্প সামগ্রী বানাতে থাকলো। তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে মাত্র ৯০ মাইলের মধ্যে থাকা জঙ্গলমহলের তাম্র নিষ্কাষণ কেন্দ্রগুলি সে সময় তাম্রযুগের সূচনায় বড়সড় ভূমিকা নিয়েছিল। আমরা 'তাম্রলিপ্ত' নামটির মধ্যেও তাম্র দ্বারা লিপ্ত বা তামা দিয়ে লেপে দেওয়া হয়েছে বলা যায়। অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন- "উত্তর পশ্চিম মেদিনীপুরের উপজাতীয় নিষ্কাষণকারীরা প্রথম থেকেই তাঁদের উদ্বৃত্ত নিষ্কাষিত তামা বাণিজ্যার্থে এইস্থানে নিয়ে এসে জমা করেছে এবং কেনা বেচা শুরু করেছে, সেই হচ্ছে তাম্রলিপ্তের জন্ম। ধীরে ধীরে সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে সেটি একটি বিশাল আন্তর্জাতিক বন্দরে পরিণত হয়েছে। তামা দিয়ে শুরু করে সেখানে অজস্র বহুমূল্য জিনিসের আমদানি রপ্তানি ঘটেছে এবং কয়েক হাজার বছর ধরে এ বন্দর পৃথিবীর ইতিহাসে তার সমৃদ্ধি ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমে মধ্য এশিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এবং পূর্বে ও দক্ষিণে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ব্রহ্মদেশ, শ্যাম, মালয়, ইন্দোচিন, সুমাত্রা, যবদ্বীপ ও চিনসাগর পর্যন্ত ছিল তাম্রলিপ্তের বাণিজ্য ব্যাপ্তি। সাক্ষী আছেন খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর রোমান ঐতিহাসিক প্লিনি। দ্বিতীয় শতাব্দীর গ্রীক ভৌগোলিক টলেমি যাঁরা ঐ বাণিজ্যের উল্লেখ করেছিল"। 
আজ তথাকথিত পটের গান তো প্রায় হারিয়ে যেতেই বসেছে। তুমুল দৈন্যদশা বেশিরভাগ পটশিল্পীদের কপালের লিখন। বাধ্য হয়ে পটচিত্র আঁকা সামগ্রী তৈরি করে বেচতে হয় মেলায়, বাজারে, পর্যটনকেন্দ্রে। সরকারি সুযোগ সুবিধা এখনও অনেকটাই ডুমুরের ফুল। সর্বোপরি মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে এখন। তাই এই রুজির মানুষদের একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলতে হয়েছে। ফলে রুটির অভাবে পেট কাঁদলেও মনোহর ফাঁসুড়ার স্রষ্টাদের এখন রূপহীন জীবন।
সবংয়ের মসলন্দ মাদুর

"দেখিতে ভবের শোভা আকাশের পটে" - হেমচন্দ্র। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় পটচিত্র অঙ্কনের কাজে যুক্ত আজ বহু মানুষ। পূর্ব মেদিনীপুরের দেউলপোতা, আমদাবাদ, হবিচক, মুরাদপুর, নানকারচক, কাখর্দা, ঠেকুয়াচক, আকুবপুর, কেশববাড়, ঘোলপুকুরিয়া, টাকাপুরা, চৈতন্যপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসুদেবপুর, পেরুয়া, নির্ভয়পুর, নয়া, নাড়াজোল, মুরুনিয়া, ষাঁড়পুরা, কুলিয়া চন্দনপুর, বাঘাগেড়িয়া ইত্যাদি গ্রামে এখনও বেশকিছু মানুষ বাংলার এই উজ্জ্বল লোকশিল্প কলাটিকে টিকিয়ে রেখেছেন। এঁদের মধ্যে রজনী চিত্রকর, গৌরী চিত্রকর, শ্রীশচন্দ্র চিত্রকর, গুরুপদ চিত্রকর, আনোয়ার চিত্রকর এবং কল্পনা চিত্রকর পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি সম্মান। পটচিত্র এঁকে বিদেশ বিভুঁই যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন অনেকেই। মেদিনীপুরের পটচিত্রকে বিভিন্ন সময়ে বিদেশেও নিয়ে গিয়েছেন রাণী চিত্রকর, দুঃখুশ্যাম চিত্রকর, মামনি চিত্রকর, স্বর্ণ চিত্রকর, সায়েরা চিত্রকর, বাহাদুর চিত্রকর, সুমন চিত্রকর, গুরুপদ চিত্রকর, মনিমালা চিত্রকর, ময়না চিত্রকর, আনোয়ার চিত্রকর, মনোরঞ্জন চিত্রকর, জবা চিত্রকররা। 
ঐতিহ্যবাহী চৌকো এবং জড়ানো পটচিত্র তেমন বিকোয় না। খদ্দের কমেছে এই পট কেনার। বিদেশের বাজারে বিদেশী খদ্দেরদের কাছে বেশ বিকোয় জড়ানো পট। এখনও আন্তর্জাতিক বাজার কিছুটা হলেও দখল করে রেখেছে মেদিনীপুরের এই পটশিল্প। এখন পটুয়ারা ছাতা, ফুলদানি, পেন স্ট্যাণ্ড, কি হোল্ডার, চুড়িদার, কেটলি, কলসি, টি শার্ট, শাড়ি, ওড়না, হাতপাখা, জলের বোতলে পটচিত্রের নানা আঙ্গিক ফুটিয়ে তুলছেন। এসবের গায়ে আদিবাসীদের ছবি, মাছ, ফুল, পাতা, শিকার করার ছবি, ধামসা, মাদল, তবলা, বাঁশি, নৃত্য ইত্যাদির ছবি আঁকছেন পটুয়ারা। সেই অঙ্কনে থাকছে পটশিল্পের আঙ্গিক। শিল্পীরা বিদেশে গিয়ে সেখানেও বিভিন্ন সামগ্রীতে পটচিত্র অঙ্কন করে উপার্জন করছেন। কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক মুখ হয়ে উঠেছে আলোচিত পটচিত্র। 
মেদিনীপুরের মাদুরশিল্পও আজ বিশ্বজনীন। বিশেষ করে মসলন্দ মাদুর। এই মাদুর তৈরি করেই সবংয়ের মাদুরশিল্পী পুষ্পরাণী জানা ১৯৮২ তে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হাত থেকে তিনি পুরস্কার নিয়েছিলেন। তেমনি ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগর-১ নং ব্লকের হলদিয়া-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের খােলাবেড়িয়া গ্রামের সরযুবালা গিরি। সবংয়ের সারতার বাসিন্দা অলককুমার জানাও ২০০৮ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। তিনি ২০১৪ সালে হ্যান্ডিক্র্যাফট এর প্রতিনিধি হিসেবে জিম্বাবােয়ে গিয়েছিলেন। ২০১০ এ ভারত সরকারের মিনিস্ট্রি অব টেক্সটাইলস এর আয়ােজিত প্রতিযােগিতায় তৃতীয় স্থান পেয়েছেন। মসলন্দ মাদুর বানিয়ে তিনি আজ প্রােথিতযশা শিল্পী। এঁদের হাত ধরেই আজ মাদুরশিল্পও পেয়েছে আন্তর্জাতিক ছোঁয়া। ক্রমশঃ হয়ে উঠছে বানিজ্যের মুখ। 
সিংয়ের চিরুনি

১৩৬০ বঙ্গাব্দে বৈতা গ্রামের নগেন্দ্রনাথ পয়ড়্যা গোড়াপত্তন করেছিলেন 'ড্রাই ফ্লাওয়ার্স' শিল্পের। যা আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছে বিদেশের বাজারেও। আজ এই শিল্প রীতিমতো বাণিজ্যের মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু মানুষের রুজিরুটির অন্যতম মাধ্যম। কোটি কোটি টাকা আয় হচ্ছে বৈতার 'ড্রাই ফ্লাওয়ার্স' শিল্প থেকে। অবিশ্বাস্য আয়ের পথ দেখিয়েছে 'বল' তৈরি। লতা-র বল। কালো ও সাদা বল। স্থানীয়রা বলেন 'লটা'। আসলে তা ড্রাই ফ্লাওয়ার্স। সম্পূর্ণ গাছের ঝুরি দিয়ে তৈরি হয় বল। সেই বল বানানোর কাজ করছেন অনেকে। পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ওডিশা লাগোয়া গ্রামগুলিতে এখন এই পেশার সাথে যুক্ত মানুষজন পাচ্ছেন আয়ের সুযোগ।
আমড়ার আঁটি, বেতকুল, পুরুল ছাল, খাবালি ফল (হাওয়ালি), চিঁচড়া ফুল, বেলকাপ, খসখস, দুধিলতা, গাছের ছাল, হাতিকান ফল, কালীলতা, কতবেল, গৌরি ফল, দৌড়ি, মুরসা, অসন ফল, চুনাআলু ফল, সোয়ান ফল, একশিরা ফল, ছাতু, ফনফনা ফল ইত্যাদি 'সাধারণ' সামগ্রী দিয়ে বানানো হয় অসাধারণ সামগ্রী। বৈতা গ্রামকে কেন্দ্র করে এখন এই শিল্প পাশাপাশি ১৫-২০ টি গ্রামের মানুষের উপার্জনের পথ। মোহনপুর ব্লকের কুসুমদা, ঝাঁটিয়া, মৈষামুণ্ডা, চৈতা, ধৌড়াঝামুয়া, গোবিন্দপুর গ্রামে গেলেই দেখা মিলবে অদ্ভুত এই কুটিরশিল্পের বাস্তব চিত্র। 
ওড়িশার চন্দনেশ্বর, ময়ূরভঞ্জ, বারিপদা, কেওনঝড়, বালেশ্বর বন বিভাগের বাংরিপোসি, আসাডলা, কালিয়ানি, গুড়গুড়িয়া, বিজাতলা, সেসান পাটনা, গোয়ালডাংরি, সাতকোমিয়া, চম্পাঝর এলাকা থেকে এসব মেলে। এছাড়া গোপীবল্লভপুর, সাঁতরাগেড়িয়াতেও পাওয়া যায়। নারকেলের কাঠি দিয়ে বানানো হয় 'টিং টিং'। গাছের ছাল দিয়ে বসবার আসন। তৈরি হয় লতার জাম্বু, লতার পাঁচু, চোদ্দথিংলা, কোকোমাল, লতার বল ইত্যাদি উদ্ভট নামের সামগ্রী। তীরধনুক, বর্ষা, ল্যাম্পদানি থেকে শুরু করে ফানুস, ঝাড়বাতি তৈরি হচ্ছে এখানে। সবই এঁদের কাছে 'ড্রাই ফ্লাওয়ারস মেকিং'। বিদেশের বাজারে এখানকার ড্রাই ফ্লাওয়ার্সের ব্যাপক চাহিদা। এখান থেকে কলকাতা হয়ে সেসব সামগ্রী চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড সহ প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। ইদানীং ইন্টিরিয়র ডেকরেশানে ঝোঁক বেড়েছে মানুষের। মূলতঃ সেই কাজেই ব্যবহৃত হয় এখানকার সামগ্রী। এইসব কৃত্রিম ফুল বিদেশের ধনীর গৃহশোভা এবং বড় বড় হোটেলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। 
ডেকোরেটিং শিল্পী গৌরাঙ্গ কুইল্যার সৌজন্যে আজ মণ্ডপ নির্মাণ শিল্পের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অপূর্ব শিল্পকর্ম বানানাের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবসান গ্রামের গৌরাঙ্গ কুইল্যা। বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে এক বিশেষ ব্যতিক্রমী শিল্প তাঁরই আবিষ্কার। সামান্য পাট, পাতা, কাগজ, শুকনো ফল, ফুল দিয়েই তিনি বানান অপূর্ব শিল্পকর্ম। তমলুকের চারটি বিষয় হিউয়েন সাং, বর্গভীমা মন্দির, তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ি ও মাতঙ্গিনী হাজরাকে একই ফ্রেমে রেখে সম্পূর্ণ রঙবিহীন এক শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তুলে ২০০২ সালে এ.পি.জে আব্দুল কালামের হাত থেকে নিয়েছেন সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় সম্মান। আজ এ রাজ্যের অসংখ্য পূজা কমিটিগুলির কাছে অতি পরিচিত নাম। যাঁরা শৈল্লিক মানসিকতার পূজারী, তাঁরা শ্রদ্ধা করেন গৌরাঙ্গকে। ইতিমধ্যে স্পেন, চায়না, রােম, কুয়েত, আমেরিকা, প্যারিস, ইটালি, জার্মানী গিয়েছেন তাঁর নিজের আবিষ্কৃত জুট হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট এর সম্ভার নিয়ে। এই মুহূর্তে এ রাজ্যের বহু শিল্পী অনুসরণ এবং অনুকরণ করেন গৌরাঙ্গের কাজকে। সম্প্রতি স্পেনে গৌরাঙ্গের তৈরি 'ভবানীপুর অবসর' এর প্রতিমা স্থান পেয়েছে মিউজিয়ামে। 
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশংসা করেছিলেন মেদিনীপুরের গয়নাবড়ির। একান্ত গ্রাম্য ঘরানার এই লোকশিল্পটি আজ কিছুটা হলেও বাণিজ্যের মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুস্বাদু, মুচমুচে এবং ঐতিহ্যবাহী এই শৈল্পিক শিল্পকলাটি দেশ বিদেশে পাঠানো হচ্ছে রসনার তৃপ্তি ঘটাতে। যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে বিদেশেও। ১৯৯২ এর ২৬ শে আগস্ট মুক্তি পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা 'আগন্তুক' এ উল্লিখিত হয়েছে গয়নাবড়ির কথা। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক তকমাও জুটেছে গয়নাবড়ির। 
একসময় মেদিনীপুরের বুকে তৈরি সিংয়ের চিরুনির ভালো চাহিদা ছিল বাংলাদেশে। বিশেষ করে যশোরের সেলুলয়েডের চিরুনির মতোই জনপ্রিয় ছিল 'তেলকম চিরুনি'। এটি অবশ্য মেদিনীপুরের শিল্পীদের হাতের নিখুঁত কাজের পরিচয়। এই তেলকম চিরুনি তৈরির মূল কারিগর ছিলেন দাসপুরের জ্যোতঘনশ্যাম গ্রামের বিষাণশিল্পী সজনী সামন্ত। এই চিরুনির ওপরের মাথার দিকে লম্বা নলাকৃতি ফাঁপা খুপরিতে তেল ভরা থাকতো, সেই তেল চিরুনির প্রতিটি দাঁড়ার মধ্যের ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসতো। ঐ চিরুনি যখন মাথায় ঘসা হত তখন চুলের গোড়ায় গোড়ায় পৌঁছে যেত তেল। এতে তেলের খরচ কম হত। তাই নাম দেওয়া হয় 'তেলকম চিরুনি'। এখন এই চিরুনির প্রয়োজনীয়তা শেষ। তেমনি বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন। তবে একটু যত্ন এবং আর্থিক সহায়তা পেলে এই লোকশিল্পটি আজকের দিনেও হয়ে উঠতে পারতো বাণিজ্যের মুখ। 
জঙ্গলমহলের ভূখন্ডে প্রচুর হাতির আনাগোনা ছিল একসময়। সেইসব হাতির দাঁত কেটে নিয়ে তা দিয়ে নানা শিল্প সৌন্দর্যময় দ্রব্য প্রস্তুত হত। তারপর তা তাম্রলিপ্ত বন্দরের সাহায্যে রপ্তানী করা হত বিদেশে। দেশি বিদেশি ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে জানা যায় জঙ্গলমহলের হাতির দাঁত জাহাজে চড়ে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করা হত তৎকালীন সময়ে। মেদিনীপুরের রেশম শিল্পের রমরমা থাকাকালীন এখানকার বস্ত্র সামগ্রীর যথেষ্ট চাহিদা ছিল বিদেশে। বাণিজ্যের মূল উপাদান ছিল রেশমের বস্ত্র। 
জঙ্গলমহলের হাঁসাপাথর শিল্পের মূল অবস্থান বেলপাহাড়ির বালিচুয়া গ্রাম। সংগৃহীত এই পাথর লাগে বড় ধরনের শিল্পে। ঝাড়গ্রামের জিতুশোলে স্পঞ্জ আয়রণ কারখানাতে এই সাদা হাঁসাপাথর সরবরাহ করতে হয়। তাছাড়া কাঁচ তৈরির কারখানাতেও এগুলি লাগে। কেউ কেউ এখান থেকে ভূটানে এই পাথর সরবরাহ করেন এখনও। আসলে বিভিন্ন ফার্নেসে আগুনের তাপ অনেক সময় ব্যাপী ধরে রাখার জন্য এই বিশেষ পাথর ব্যবহৃত করা হয়। হাঁসাপাথরের তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা প্রবল। চিন দেশের খনিজ থেকে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল বলেই নামকরণ হয় চিনামাটি। আমরা হামেশাই চিনামাটির তৈরি কাপ, প্লেট, গ্লাস, মগ, কেটলি ব্যবহার করে থাকি। ওদলচুয়া এলাকায় ৪০ বর্গ মাইল জুড়ে খড়িমাটি, China Clay রয়েছে। শিমূলপাল গ্রামে একসময় গড়ে উঠেছিল চিনামাটির সামগ্রী তৈরির কারখানা। সাতের দশকের শেষের দিকে তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন সেই ভগ্ন কারখানা স্মৃতিটুকু ধরে রেখেছে। সরকারি উদাসীনতায় এই শিল্প বাণিজ্যের মুখ হয়ে উঠতে পারেনি। অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। 
ব্রিটিশ আমলে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় প্রচুর লবণ উৎপাদন ক্ষেত্র ছিল। পর্যাপ্ত হারেই লবণ উৎপাদিত হত। যাঁরা লবণ উৎপাদন করতেন, তাঁদের বলা হত মলঙ্গী। তবে আজ আর এই পেশাজীবী মলঙ্গীদের দেখা পাওয়া যায় না। আগের মতো পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদনও হয় না। মেদিনীপুরের শিল্প মানচিত্রে লবণ শিল্পের যে রমরমা ছিল, তা আজ আর নেই। লবণ খালাড়িগুলি ছিল অর্থ আয়ের উৎস। ব্রিটিশ লবণ (সল্ট) এজেন্টরা এখানে উৎপাদিত লবণ পাঠাতেন বিভিন্ন স্থানে। প্রচুর অর্থের মুনাফা হত। 
সারা ভারতেই উপকূলবর্তী এলাকায় লবণ উৎপাদন হত। ব্রিটিশ সরকার এই লবণ উৎপাদন করাকে বেআইনী এবং জেল জরিমানা ও দণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। আসলে সে সময় গরীব মলঙ্গীরা লোনা জল ফুটিয়ে অল্প স্বল্প লবণ উৎপাদন করে পেট চালাতো। কিন্তু ব্রিটিশরা তা চাইত না। তাঁরা চাইত মুনাফা। ফলে তাঁরা সেসময় বহু মলঙ্গীকে ও তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করে এবং বাংলার লবণ শিল্পকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। একসময় মলঙ্গীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। ১৭৯৯ এর ৫ ই মে মলঙ্গীরা পিটার স্পেকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাঁদের দুর্দশার কথা জানায়। মলঙ্গী আন্দোলনের গোড়াপত্তন ঘটে তখনই। সেসময় নেতৃত্বে ছিলেন বলাই কুণ্ডু। তবে পূর্ণতা পায় ১৮০৪ সালে। তখন নেতৃত্বে ছিলেন প্রেমানন্দ সরকার। তবে সল্ট এজেন্টদের মধ্যে একটু আলাদা ছিলেন হেনরি চার্লস হ্যামিল্টন। তিনি ১৮৫২ সালের মে মাসে তমলুক শহরে স্থাপন করেছিলেন 'ইংরেজি বাংলা বিদ্যালয়'। যা হ্যামিল্টন হাইস্কুল নামে পরিচিত এখন। 

তথ্যসূত্র :
১) মেদিনীপুরের লোকশিল্প - ভাস্করব্রত পতি, উপত্যকা, ডিসেম্বর ২০০৯
২) ঐতিহ্যের গয়নাবড়ি -- ভাস্করব্রত পতি, টেরাকোটা, জানুয়ারি ২০২৩
৩) বাংলার মাদুর -- ভাস্করব্রত পতি, টেরাকোটা, জানুয়ারি ২০২৪
৪) বিষাণশিল্প -- ভাস্করব্রত পতি, টেরাকোটা, জানুয়ারি ২০২৫
৫) জঙ্গলমহল কথা, সম্পাদনা - তাপস মাইতি, শিল্পচিত্র -- ভাস্করব্রত পতি (পৃষ্ঠা : ২৩৫-২৫০)
৬) সৌতি, ১১-১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৫, পঞ্চবিংশ সংখ্যা, মলঙ্গীদের নিয়ে কিছু কথা -- ভাস্করব্রত পতি
৭) ব্যক্তি ঋণ - বাহাদুর চিত্রকর, পুষ্প জানা, আবেদ চিত্রকর, চন্দন জানা প্রমুখ।
🍂

Post a Comment

0 Comments