অয়ন মুখোপাধ্যায়
ইতিহাস সবসময় গর্জনের মধ্যে লেখা হয় না। ইতিহাসের এক বিশাল অংশ জন্ম নেয় নীরবতায়, ধুলোমাখা বইয়ের পাতায়, শীতল পাঠাগারের শান্ত আলোছায়ায়। আর এই নীরব ইতিহাসেরই এক অগ্রদূত ছিলেন মুনীন্দ্র দেব রায়। তিনি রাজনীতি বা বিপ্লবের প্রচণ্ড আলোড়নে নাম লেখাননি, তবু তাঁর কাজের ভিতর দিয়ে উঠে এসেছে সভ্যতার এক অন্যতর স্বপ্ন—যেখানে বই মানুষের মুক্তির হাতিয়ার, আর পাঠাগার সমাজের প্রাণকেন্দ্র।
বাঁশবেড়িয়ার রাজপরিবারে তাঁর জন্ম, ১৮৭৪ সালের ২৬শে আগস্ট। রাজপরিবার মানেই প্রাচুর্য, ভোগ, ঐশ্বর্য—কিন্তু সেই আভিজাত্যের ভেতর থেকেও তাঁর চোখ সরে যেত বাইরে, সাধারণ মানুষের দিকে। এক কিশোর মনের ভিতর তখনই জন্ম নিচ্ছিল অন্যরকম স্বপ্ন। পরবর্তী সময়ে হুগলী মহসিন কলেজের আঙিনা, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পাঠশালা—সবকিছু মিলিয়ে সেই স্বপ্ন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাঁর কাছে শিক্ষা মানে কেবল পরীক্ষায় পাশ করা নয়, শিক্ষা মানে জ্ঞানকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।
মুনীন্দ্র দেব রায় বিশ্বাস করতেন, বই কেবল অক্ষরের ভাণ্ডার নয়। বই মানুষের মুক্তির পথ, বই সমাজকে অগ্রসর করার সোপান। তাই তিনি আজীবন ছুটেছেন গ্রামের মেঠো পথ থেকে শহরের জনপদে, দরিদ্র কৃষকের ঘর থেকে শিক্ষিত নাগরিক সমাজে—শুধু একটি বার্তা নিয়ে, “গ্রন্থাগার হলো সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র।” তাঁর সমাজসেবার কাজ একসময় সরকারী স্বীকৃতিও পেয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সিলভার জুবিলি ও করোনেশন মেডেল দিয়েছিল, কিন্তু তাঁর চোখে এ পুরস্কার ছিল সামান্য ধাতব অলঙ্কার মাত্র। তাঁর আসল পুরস্কার ছিল এক শিশুর হাতে ধরা বই, এক ছাত্রের চোখে দীপ্ত নতুন আলোকরেখা।
🍂
তাঁর কলম ছিল অদম্য। গ্রন্থাগার, দেশ-বিদেশের গ্রন্থাগার, হুগলী কাহিনী, বাঁশবেড়িয়া পরিচয়—এইসব গ্রন্থ আজও প্রমাণ করে তাঁর স্বপ্ন কতটা সুদূরপ্রসারী ছিল। এগুলো কেবল তথ্যের ভাণ্ডার নয়, বরং সমাজকে জাগিয়ে তোলার ভাষা। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন এক সফল সম্পাদক। দি ঈস্টার্ন ভয়েন্স, দি ইউনাইটেড বেঙ্গল, পাঠাগার, পূর্ণিমা—সবখানেই তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন জ্ঞানের শিখা, রেখে গেছেন স্থায়ী ছাপ।
তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ নিঃসন্দেহে গ্রন্থাগার আন্দোলন। ১৯৩২ সালে বাংলায় যখন তিনি প্রথমবার লাইব্রেরি বিল উত্থাপন করেন, তখন হয়তো অনেকে তার গুরুত্ব অনুভব করতে পারেনি। কিন্তু সেই মুহূর্তে তিনি ভবিষ্যতের জন্য বপন করেছিলেন এক চারা গাছ—যা আজ অসংখ্য পাঠাগারের বিশাল বটবৃক্ষে রূপ নিয়েছে। ১৯৩৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হুগলী জেলা গ্রন্থাগার সমিতি, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নিখিল ভারত গ্রন্থাগার সম্মেলনে। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় গ্রন্থাগার আন্দোলন পেল এক সুদৃঢ় ভিত্তি।
দেশের ভেতরে নয়, বিদেশেও তিনি ছড়িয়েছিলেন এই স্বপ্ন। স্পেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বগ্রন্থাগার সম্মেলনে তিনি ভারতের মুখ হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ইউরোপের নানা সভায় বক্তৃতা দিয়ে তিনি বলেছিলেন—“যে জাতি বইকে আপন করে নেয়, সেই জাতিই সত্যিকারের শক্তিশালী।” তাঁর কণ্ঠস্বর যেন দূর অতীতের ধ্বনি হয়ে আজও ভেসে আসে। পাঠাগার তাঁর কাছে ছিল কেবল বই ধার করার জায়গা নয়, বরং সমাজের আত্মার কেন্দ্র।
১৯৪৫ সালের ২০শে নভেম্বর তিনি বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে। চলে গেলেন হয়তো শরীরে, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আলোকরেখা আজও জীবন্ত। প্রতিটি লাইব্রেরির তাক, প্রতিটি ছাত্রের পাঠাভ্যাসে, প্রতিটি পাঠকের আলোড়নে তাঁর উপস্থিতি মিশে আছে।
এ বছর তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হলো। ২০২৫-এর এই দিনে, যখন চারপাশে স্মার্টফোনের নীল আলো আমাদের চোখকে গ্রাস করে নিচ্ছে, তখন তাঁর কণ্ঠস্বর আরও জোরালো হয়ে শোনা যায়—“বইয়ের আলো ছাড়া মানবসভ্যতার পথ অন্ধকার।” তাই মুনীন্দ্র দেব রায় আজ কেবল ইতিহাসের একটি নাম নন, তিনি এক শাশ্বত আলোকবর্তিকা। তাঁর জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জ্ঞানের দীপশিখাই সভ্যতার প্রকৃত শক্তি, আর পাঠাগার হলো সেই শক্তির নীরব উৎস।
10 Comments
ভালো লাগল পড়ে
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteতথ্য সমৃদ্ধ লেখা
ReplyDeleteঅপূর্ব লেখা
ReplyDeleteভালো লাগলো পড়ে
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteবাঃ বেশ লাগলো লেখাটা পড়তে , বেশ কিছু অজানা তথ্য জানলাম ।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteএই সুন্দর প্রতিবেদনটির জন্য আমি আপনাকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই! বাঁশবেড়িয়া রাজের কৃতি ও গুণী সদস্য মুনীন্দ্র দেব রায় মহাশয় উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থকুলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। গ্রন্থাগার আন্দোলনে তাঁর অবদান অবিস্মরনীয়। আজকের প্রজন্মের কাছে এমন মানুষ আদর্শ হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়, তাই এই লেখাটির প্রভূত গুরুত্ব আছে। আমার পরম সৌভাগ্য বলে মনে করি যে এই মানুষটি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় আত্মীয়! তাঁর জীবদ্দশায় আমি তাঁকে না দেখলেও, তিনি যে আমাদের সকলের অনুপ্রেরণা, সেটা আজন্ম জেনেছি, আর সেই কারণেই আমি প্রতিনিয়ত মনে করি যে আমাদের এমন মানুষের পদানুসরন করতে হবে!
ReplyDeleteআমি এই মুহূর্তে চন্দননগরের যে মূল্যবান প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে আছি, তার গ্রন্থাগারটি ফরাসি আমলের একটি অমূল্য রতন, একটি খনি বললে ভুল হবে না। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, এখানে দীর্ঘ বারো বছরের ওপর কোন গ্রন্থাগারিক নেই। তবে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে এর একটা সমাধান করবই অদূর ভবিষ্যতে! আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় দাদুর জন্মের সার্ধশতবর্ষে আমি যেন তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে এই মূল্যবান গ্রন্থাগারটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি সঠিক ভাবে! আপনাদের সকলের সহযোগিতা প্রার্থনা করি।🙏 Dhritiman Bhar Sirsendu Dutta Patit Paban Halder Dyootiman Pal Dhritiman Pal Souro Ghosh Varman
ধন্যবাদ
ReplyDelete