জ্বলদর্চি

অয়ন মুখোপাধ্যায়ের চারটি কবিতা

অয়ন মুখোপাধ্যায়ের চারটি কবিতা


হাল ছাড়া মানুষের জন্য শেষ নির্দেশিকা — ১


সবকিছু যখন আমার বিরুদ্ধে যায়
শহরটা আমার সামনে নোটিস বোর্ড হয়ে দাঁড়ায়।
সে আমার কথা শোনে না—
শুধু দেখায়,
এখানেই তুমি ভুল করেছ।
এখানেই তোমার ভুল।

আমি যাদের হাসতে দেখি
তারা সুখী নয়—আমি জানি।
তবু সেই হাসিগুলোর সামনে
আমার মুখটা ছোট হয়ে আসে।

ওদের ঘরে ঢুকলে
দরজার পেছনে ঝুলে থাকে
ব্যবহার না হওয়া স্বপ্ন।
আমার ঘরেও তাই।
শুধু আমি আলো জ্বালাই না।

আমি বলি—
আমি পারছি না।
শহর বলে—
তোমার পেছনেই পরের জন দাঁড়িয়ে।

সময় এখানে নদী নয়—
স্ক্রল করলে সময় কেটে যায়।
ফেসবুকে আমাকে কেউ কেউ পড়ে ফেলে,
আমি ও কাউকে কাউকে পড়ে ফেলি।

কেউ তিরিশে স্বীকৃতি পায়।
আমি তালিকায় নিজের নাম খুঁজি।
কেউ পঞ্চাশে বাতিল।
আমি হিসেব করি—আমার কতটা বাকি।

চল্লিশে জীবন শুরু করি না।
মৃত্যুকে শুধু
একটু পিছিয়ে দিই।

আমার অনেক কবিতা
ছাপা হয় না।
কারণ জানি না।
তাই শব্দগুলো ছুড়ে দিই স্ক্রিনে—
যেন শ্বাস নেওয়া যায়।

আমার চলার পথটার
কোনো নাম নেই।
নাম থাকলে
হয়তো আমিই ভেঙে দিতাম।

তাই আমি গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
পাখি ভুল করে
বাসা বাঁধে।

আর আমি?
হাল ছাড়ি না।
কারণ
ছাড়ার মতন আর ছেড়ে যাওয়ার মতন
আমার কিছু নেই।

🍂


হাল ছাড়া মানুষের জন্য শেষ নির্দেশিকা — ২

সকালে উঠে দেখি
নিজের নামটাই আজ ভারী লাগছে।
আয়নার ভেতর লোকটা
আমাকে চেনে,
কিন্তু বিশ্বাস করে না।

স্কুলের রেজিস্টারে
আমার নাম ঠিকই আছে।
তবু কোথাও যেন
আমি পাশ করি না।

ক্লাসে দাঁড়িয়ে
অন্যদের ভবিষ্যৎ বোঝাই।
নিজেরটা
চকের ধুলোয় ঢেকে যায়।

বন্ধুরা বলে—
এটা তো স্থায়ী হওয়া।
আমি মাথা নাড়ি,
ভেতরে ভেতরে নম্বর কাটি।

শহর দৌড়য়,
আমি রোজ ঠিক সময়ে পৌঁছই।
কিন্তু পৌঁছনোটা কেই
কেউ গন্তব্য বলে না।

রাতে ব্যক্তিগত খাতার পাশে
নিজের জীবনটা খুলে বসি—
দেখি,
এখনে কোনো লাল কালি নেমে আসেনি।


হাল ছাড়া মানুষের জন্য শেষ নির্দেশিকা — ৩ 

আমাকে কেউ ডাকলে
আমি ঘুরে তাকাই—
ডাকটা যদি ভুল হয়।

আমার জীবনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত
পরে ভাবব বলে শুরু করেছিলাম।
পরে আর কখনো ফিরে আসেনি।

আমি সাফল্যের গল্প পড়ি
খবরের কাগজে।
ওগুলো পড়ে
নিজের জীবনটাকে ফোল্ড করে তুলে রাখি।

ভালো থাকা
এখন একটা স্কিল।
আমার সিভিতে সেটা নেই।

আমি জিতিনি।
হারও মানিনি।
আমি শুধু
আজও এখানে রয়ে গেছি।


শেষ নির্দেশিকার পর

একদিন হঠাৎ
আর পালানোর জায়গা থাকে না।
তখনই বোঝা যায়—
দাঁড়িয়ে থাকাটাও একটা সিদ্ধান্ত।

আমি আর নিজেকে
ছোট করে বলি না।
জীবন যেমন ছিল
আমি তেমনই এসে পৌঁছেছি।

সব হার মানা মানুষ
ভেঙে যায় না।
কেউ কেউ
নিজের ভাঙা জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে।

আমি কাউকে ছাড়িয়ে যাইনি।
কাউকে হারাইওনি।
আমি শুধু
নিজের পাশে রয়ে গেছি।

এই দাঁড়িয়ে থাকাটাই
আমার জবাব।
এই দাঁড়িয়ে থাকাটাই 
আমার এক ধরনের বিদ্রোহ।

Post a Comment

0 Comments