জ্বলদর্চি

কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিলেন গল্পকার অখিলেশ সুর(উৎসব ১৪২৮)

বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্র, বাঙালির জীবন ও যাপন প্রণালীর কথক, সাহিত্য আকাদেমির ফেলো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গল্পকার অখিলেশ সুর

গত ১৯ শে সেপ্টেম্বর সাহিত্য আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন পরম শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তার ঠিক দশ দিন আগে ০৯/১১/২০২১ - তারিখ 'জ্বলদর্চি' পত্রিকার নেওয়া অন্তরঙ্গ  সাক্ষাৎকার। যদিও এই সাক্ষাৎকারে রয়েছে  অধ্যাপক অরুণ শাসমল ও  শিক্ষক কালিপদ নন্দ মহাশয়ের এই সময় ও সাহিত্য বিষয়ক মূল্যবান কয়েকটি প্রশ্নও। সব মিলিয়ে এই সাক্ষাৎকার ধরে নিতে পারেন সমবেত সাক্ষাৎকার। এই করোনাকালে সাক্ষাৎকার নিয়েছি ফোনে। তাই এটা ফোনেটিক সাক্ষাৎকারও।


অখিলেশ : গত দুই বছর ধরে এই করোনা পরিস্থিতি মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে বিরাট একটা শূন্য স্থান সৃষ্টি করেছে। চলমান পৃথিবীকে গৃহবন্দি করে চিন্তা চেতনার সংকোচন ঘটিয়েছে। এমন একটা সময় সাহিত্য চর্চায় কতটা প্রভাব ফেলেছে?

শীর্ষেন্দু : করোনা পরিস্থিতি তো ভালো হলো। এখন তো সবাই লিখছে। ঘরে বসে বসে প্রায় দুই বছর হতে চললো। কাজেই, এতে মানুষের অভ্যাস হয়ে গেছে অনেকটাই। মানুষ এখন করোনাতে কোনো ভয় পাচ্ছে না। আমার মনে হয়, করোনা যেমন আমাদের অনেক মানুষ মেরে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে ঠিকই, তেমনি অনেক উপকারও হয়েছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে--মানুষ সময় পেয়েছে, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার, নিজেকে কাজে যুক্ত করার। বিশেষ করে চিন্তাবিদ যারা, লেখক যারা, শিক্ষিত মানুষ, তারা অনেক সময় পেয়েছে এই করোনার জন্য।
অখিলেশ :  আপনার সাহিত্য সম্ভারের ভিতরে একটা পজিটিভ জীবন দর্শন পাই। বর্তমান অবক্ষয়ের যুগে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেটা খুব প্রয়োজন। আপনার 'মানবজমিন' এখন এতো রুক্ষ, শুষ্ক কেন? 


শীর্ষেন্দু :  তোমাকে একটা কথা বলি যে, আমি শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের শিষ্য। ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র ছিলেন একজন অত্যন্ত শক্তিশালী পজিটিভ জগতের জনক। তিনি জীবনের অস্তিবাচক দিকগুলো প্রমিনেন্ট করেছেন সারা জীবন ধরে। মানুষকে সাধারণ বুদ্ধি থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন। মানুষকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আর একটা ব্যাপার তুমি দেখতে পাবে, যে অবক্ষয় ঢুকেছে, সেই অবক্ষয় তো সাংঘাতিক। বাইরে থেকে অতটা বোঝা যায় না। কিন্তু, ভেতরে ভেতরে মানুষের বিশ্বাসের জায়গা, আস্থার জায়গায় অবসাদ এসে যাচ্ছে। এখন বেশির ভাগ মানুষ অবসাদের রুগি। প্রচন্ড ডিপ্রেশনে ভোগে। এই যে ডিপ্রেশন, এটা কিন্তু নানা দিক থেকে আসছে। তুমি আমার লেখার মধ্যে একটা ডিফারেন্ট লক্ষ্য করছো ঠিকই। আমিও এখনকার লেখার মধ্যে একটা অবক্ষয় লক্ষ্য করছি। তার মধ্যে আমি একটু ওই কী বলে, জীবনের অস্তিবাচক দিক গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি। সেটা কতখানি কাজে দেয় জানি না।


অখিলেশ :  আপনি ময়মনসিংহ ছেড়ে এসেছেন ১১ বছর বয়সে। দেশ ভাগের সেই মর্মান্তিক সময়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আজও বাংলার মাটিতে আতঙ্ক রেখে গেছে। আপনার গল্প, উপন্যাসেও সেই ছায়া দেখা যায়। সমরেশ বসু থেকে সমরেশ মজুমদার, সবাই সাহিত্যের পাতায় তুলে এনেছেন সেই অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা। আপনার সেই দেশ ছেড়ে আসার স্মৃতি এখন কেমন কষ্ট দেয়?

শীর্ষেন্দু :  ময়মনসিংহ আমার জন্ম শহর। কিন্তু বলে রাখা ভালো যে, আমার কিন্তু দেশ ময়মনসিংহ নয়। আমার দেশ ঢাকা বিক্রমপুর। গ্রামের নাম বায়েনহারা,বংশি গঞ্জ, টঙ্গিপাড়া থানা। আমার দাদু ময়মনসিংহে মোক্তার ছিলেন। সেইখানে আমার বাবার বিয়ে হয়। আমার দাদামশাই দেবকুমার চট্টোপাধ্যায় ময়মনসিংহে স্টেশন মাস্টার ছিলেন। সেখানেই আমার জন্ম। ময়মনসিংহ আমার খুব প্রিয়। এখনও ময়মনসিংহের কথা ভাবলে আমার বুকটা হু হু করে ওঠে। আমার মনে হয় ওরকম সুন্দর জায়গা বোধহয় পৃথিবীতে আর নাই। আসলে ওটা একটা দুর্বলতা। ওটা যে খুব সুন্দর জায়গা তা নয়। নদী আছে, বাসঘাট আছে, অনেক গাছপালা- এই সব আর কী। আমি এরকম পাকা বাড়িতে থাকতাম না। টিনের ঘরে থাকতাম। মাটির ভিটে। সেইখানে আমার মনে হতো তাজমহলে আছি। তাই যখনই ময়মনসিংহে যেতাম মন ভালো হয়ে যেতো। ঘটনাক্রমে দেশ ভাগের সময় আমরা ময়মনসিংহে ছিলাম। বাবা তখন ময়মনসিংহ স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন। সেই সময়, আমরা যখন চলে আসি, সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারিনি। ভোর বেলা বাড়ি থেকে বেরোলাম। পিঁপড়ে কামড়েছিল খুব। তখন খুব রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমার দেশ আমাকে এইভাবে বিদায় দিচ্ছে। পিঁপড়ের কামড়ের জ্বালা নিয়ে আমি এসেছি। সেই জ্বালা আমি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি।দেশ ভাগের জ্বালা আমরা আজও ভুলতে পারি না।



অখিলেশ : আপনি তো শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন মেদিনীপুর জেলা থেকে। সেখানকার কথা মনে আছে? 


শীর্ষেন্দু : হ্যাঁ, নারায়নগড়ে আমি বোধহয় ১২ কি ২২ দিন চাকরি করেছিলাম। স্কুলটি বড়ো রাস্তার পাশে ছিল। দিঘা যাওয়ার রাস্তার পাশে।স্কুলেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। স্কুলের কমন রুমে বিছানা পেতে রাত্রিবেলা শোবার ব্যবস্থা। হোস্টেলে ছাত্রদের সঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা। ভালোই ছিলাম। তারপর মা এসে নিয়ে গেল। আর আসতে দিল না।


অখিলেশ : আপনার 'উজান' উপন্যাসের মধুসূদনের মধ্যে আপনার ছায়া দেখতে পাই। মধুসূদন কি আপনি? 


শীর্ষেন্দু : মধুসূদন তো আমিই। তবে, এখানে পুরোপুরি আমি নেই কিন্তু। আংশিক ভাবে আছি, আমার ছায়া ধরতে পারো।


অখিলেশ : আপনার গল্পগুলো সব কেমন উদ্ভট।  মশা, বাঘ, লুলু, চিঠি, মাসি- গতানুগতিক জীবনের আপাততুচ্ছ বিষয়। এই তুচ্ছতার ভেতরে রয়েছে অমূল্য জীবন বোধ। এই ব্যতিক্রমী পরীক্ষা কেন?


শীর্ষেন্দু :  আমি গতানুগতিক লেখা কোনোদিন লিখতে চাই না। সেই জন্যই অনেক উদ্ভট গল্প, যেটা তোমাদের কাছে হয়তো অচেনা মনে হবে। এটা তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী নয়, আমি ওইভাবে লিখি।আজও আমি এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসি। পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া আমি লিখতেই পারি না।


অখিলেশ : বর্তমান প্রজন্মের শৈশব মোবাইল আচ্ছন্ন। কম্পিউটার গেমস নিয়ে মেতে আছে। গোয়েন্দা গল্পের রোমাঞ্চকর অনুভূতি তাদের গ্রাস করে না আপনি গোয়েন্দা গল্প লেখার পথে গেলেন কেন? বর্তমান প্রজন্মের জন্য আপনার বার্তা কি? 

 
শীর্ষেন্দু : আমি গোয়েন্দা গল্প খুব পড়েছি। আমার বাড়িতে অনেক গোয়েন্দা গল্পের বই আছে। ফিলিপ পার্লো, শার্লক হোমস আমার ভালো লাগে। কিন্তু এরা আমার মডেল নয়। আমার মডেল অন্য। আসলে গুপ্তধন এখনো আছে। শিশুদের সেই ধনের প্রতি আকর্ষণ অন্য মাধ্যমে আসছে।

অখিলেশ : আপনার সৃষ্ট চরিত্রগুলো বেশির ভাগ গ্রামীন কেন?


শীর্ষেন্দু :  না, শহুরে চরিত্র, গ্রামীন চরিত্র- এমন ভাবে আমি আলাদা করে দেখি না। যখন যেটা মনে হয়, তখন সেটা লিখি। তবে গ্রামকে আমি খুব ভালো করে চিনি। অন্যান্য লেখকরা আমার মতো চেনেন না। তার কারণ হচ্ছে, আমি ঠাকুরের কাজে গ্রামে গঞ্জে প্রচুর ঘুরেছি। সারা বাংলা, আসাম ঘুরেছি। ফলে গ্রামটা আমার ভালো করে চেনা। তাছাড়া বিশেষ কথা হচ্ছে, গ্রামে যে সব গুরুভাই আমার আছেন তাদের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। আমাকে তাঁরা লেখক হিসেবে চেনেন না। আপনজন হিসেবে চেনেন। ফলে এইটা আমার এক বিরাট কাজ হয়েছে। ঠাকুরকে ধরার পর, ঠাকুরের কাজে বেরিয়ে আমি গ্রাম বাংলাকে খুব ভালো করেই চিনেছি। তাই গ্রাম বাংলা আমার অভিজ্ঞতায়, স্বভাবে, চরিত্রে ঢুকে গেছে।


অখিলেশ :  আপনার কর্মক্ষেত্রে ছিল নক্ষত্র সমাবেশ। তাদের সঙ্গে, বিশেষ করে  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিভাবে আড্ডা দিতেন? তিনি তো অন্য মার্গের মানুষ...! 

 
শীর্ষেন্দু : আমরা যখন আনন্দবাজার পত্রিকা দপ্তরে বসে আড্ডা দিতাম, তখন তিনি খুব ভালো আড্ডা দিতেন। আমি একটু আগেই আসতাম ১১টা ১১.৩০টার দিকে। সুনীল আসতো ২ টো ২.৩০ টার দিকে। এসে কবিতা টবিতা নিয়ে ফাইলে একটু কি সব দেখতেন , তারপর আড্ডা শুরু হয়ে যেত। আমি সুনীল,পার্থ বসু, সিদ্ধার্থ ঘোষ, দিব্যেন্দু। জমজমাট আড্ডা দিতাম। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মাঝে মধ্যে আসতেন। বয়সে বড়, কাজের লোক ছিলেন। মাঝে মাঝে এসে একটু কথা বলে চলে যেতেন। সিরাজ আসতো।

অখিলেশ :  ছোটদের নিয়ে লেখা কমে যাচ্ছে কেন ?  আপনার মনোজের 'অদ্ভুত বাড়ি', 'হেতমগড়ের গুপ্তধন' 'নবীগঞ্জের দৈত্য' 'ডাকাতের ভাইপো', 'নীলু হাজরার মৃত্যু রহস্য' 'আশু বাবুর টেলিস্কোপ' এখন মোবাইল ফোনে হারিয়ে গেছে। এই মোবাইল মগ্নতাকে কেমন ভাবে দেখছেন?


শীর্ষেন্দু : দেখো মোবাইল ফোন খারাপ কিছু নয়। একটা মোবাইল ফোন হাতে থাকলে দুনিয়া তোমার মুঠোয়। যে কোনো সময় পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের লোকের সাথে যোগাযোগ করা যায়। যে কোনও ইনফরমেশন গুগল সার্চ করে পেয়ে যেতে পারো। ভূগোল, ইতিহাসের অনেক তথ্য পেতে পারো। আমার হাতেও সব সময় মোবাইল থাকে। এমনকি সকালে যখন পুজো করতে বসি, তখনও ঠাকুরের ছবির পাশের একটি আসনে মোবাইল রেখে পুজো করি। সুতরাং মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। ক'দিন আগেই এক মজার ঘটনা বলি- আমার ছেলে, মেয়ে ডাক্তারের কাছে অভিযোগ করে- 'আমার বাবা সব সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এই ফোনের জন্য যতসব। ডাক্তার তখন বলেন- ওতে শরীরের কিছু ক্ষতি হবে না। উনি ব্যাবহার করতে পারেন। এই যে দীর্ঘ লক্ ডাউনের সময় মোবাইল না থাকলে মানুষ তো পাগল হয়ে যেতো। মোবাইল ফোন ছিল বলে মানুষ বেঁচে গেছে। কাজেই মোবাইল খারাপ নয়। তবে হ্যাঁ, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কিছু খারাপ কাজ হয়। লোক ঠকানো হয়, এসবের পাল্লায় পড়লে খারাপ।


অখিলেশ :  প্রেম আছে, প্রেমিক প্রেমিকা আছে , কিন্তু আপনার সেই ঘূনপোকা, বৃষ্টির ঘ্রান, রঙ্গিন সাঁকো, কিংবা কুসুম কুমার, আর নেই। বাংলা উপন্যাসের পাঠক কি কমে যাচ্ছে? এই শিল্পের ভবিষ্যৎ কী ? 


শীর্ষেন্দু :  দেখো,পাঠক যদি কমে যায়, তাতে অসুবিধার কি আছে। পাঠক আসলে কমে না। কারণ, গল্পের তোতা পাখি বরাবর ছিল, এখনও আছে। মানুষ গল্প শুনতে আজও ভালোবাসে। কিন্তু, সেটা কি ফর্মে শুনবে, সেটাই আসল কথা। কেউ হয়তো সিনেমা, সিরিয়ালে গল্প শুনতে ভালো বাসে। নানারকম মাধ্যমে গল্প তারা শোনে। নাটক দেখে। আল্টিমেটলি আমরা যারা বই লিখি, সেই বই হয়তো পাল্টে যাবে। ই-বুক আসবে। এসেও গেছে। নতুন নতুন কিছু মাধ্যম এসে আমাদের পুরোনো অভ্যাস পাল্টে দিচ্ছে। একদিক থেকে ভালোই। তবে হ্যাঁ, উপন্যাসের পাঠক কমে- তা আমি বিশ্বাস করি না। কারন, প্রচুর পত্রপত্রিকা এখনো বিক্রি হচ্ছে। আমি ফিডব্যাক পাই অনেক।


অখিলেশ : গ্রাম বাংলার লিটল ম্যাগাজিন বাংলা সাহিত্যকে কতটা সমৃদ্ধ করে? 


শীর্ষেন্দু : লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা তো নিশ্চয়ই আছে। মস্ত ভূমিকা আছে। অনেক লেখক, অনেক কবি লিটল ম্যাগাজিন থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু একটা মুশকিল হচ্ছে যে, মফসসলের লিটল ম্যাগাজিনগুলো তো তেমন পাবলিসিটি পায় না। তাই কি লেখা হচ্ছে না হচ্ছে তা অনেক সময় বোঝা যায় না। তবে আমি মনে করি, কবিতার স্ট্যান্ডার্ড এখনো খুব ভালো। গ্রামাঞ্চলের যে সব পত্র পত্রিকা আমি হাতে পাই, আগে কবিতা গুলো পড়ি। গদ্য চর্চার একটু দুর্বলতা আছে। তবে হতাশ হবার মতো নয়। লিটল ম্যাগাজিন যারা করে, তারা খুব বেশি আশা করে না। তারা জানে যে তাদের পত্রিকা খুব বেশি বিক্রি বাটা হবে না। আমরা অল্প পরিসরে অল্প কিছু নিয়েই থাকবো। তার মধ্যে ভালো লিখে এক আধ জন ভবিষ্যতে ভালো পাঠক পেতে পারে। এটা কপালের ব্যাপার।


অখিলেশ :  আপনি সদ্য আপনার সহধর্মিণীকে হারালেন। মানসিক ভাবে কেমন আছেন?
 
শীর্ষেন্দু : আমার স্ত্রী ছিলেন মস্ত অবলম্বন ও সহায়।সর্বদাই আমার দিকে নজর রাখতেন। আমার খাওয়া দাওয়া, সব সময় আমার কথা চিন্তা করতেন। স্বামীর কল্যাণ কামনায় নিজেকে উজাড় করে দিতেন। নিজে অসুস্থ ছিলেন, তা সত্ত্বেও আমার খুঁটিনাটি খোঁজ রাখতেন। নিজে কিছু করতে পারতেন না। তবু ওর একটা ভাইব্রেশন আমার কাছে কাজের ছিল।


অখিলেশ : আপনার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন কোনটি? 


শীর্ষেন্দু : দুঃখের দিন তো একটা নয়, বাবার চলে যাওয়া, মায়ের চলে যাওয়া, শ্রী শ্রী ঠাকুরের চলে যাওয়া সব শেষে স্ত্রীর চলে যাওয়া।


অখিলেশ : আপনার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন? 


শীর্ষেন্দু :  দেখো, কোনো আ্যচিভম্যান্ট নিয়ে আমার আনন্দ হয় না। রাহু মুক্তি ঘটলে সেটা আমার খুব আনন্দের হয়। যে রকম আমার- আমি যখন বি এ ক্লাসে পড়ি, তখন আমার খুব ডিপ্রেশন চলছিল। ঠিক ডিপ্রেশন নয়, মেলানকলিয়া। প্রায় দেড় দুই মাস ধরে খেতে পারছি না, ঘুমোতে পারছি না, শরীর খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। কাউকে কিছু বলতে পারছি না। সেই সময় একদিন দুপুর বেলার ঠিক আগে আফ্টারনুন হোস্টেলের বিছানায় শুয়ে আছি, জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে।রোদটা ঠিক ভালো লাগছে না। ওই অবস্থায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানিনা। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার মেলানকলিয়া নেই, উধাও হয়ে গেছে। তখন যে কি একটা আনন্দ হলো, ওইরকম আনন্দ খুব কম পেয়েছি জীবনে। তারপর ছোট খাটো আনন্দ তো আছেই- আমার মেয়ে হলো, ছেলে হলো, স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে হলো।


অখিলেশ :  শেষ প্রশ্ন গ্রামীণ সাহিত্যিকদের প্রতি আপনার বার্তা কি? 


শীর্ষেন্দু : আমি বার্তাতে বিশ্বাস করি না। সিনসিয়ারলি লিখতে হবে। অনেক বই পড়তে হবে। না হলে ভাষা, ভাব ধারালো হবে না। আর জীবনটাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। সব মিলিয়ে একটা জীবন যাপন করতে হবে। লেখার জন্য আমি বেঁচে নেই, বেঁচে আছি বলেই লিখছি- এটাই আসল কথা। আন্তরিকতার সঙ্গে লিখতে হবে। আমার কাছে অনেকেই আসে- এইটা একটু দেখে দিন না! আমি বলি- তুমি আরো ভালো করে লেখো। কবিতা তোমার হয়নি। ছন্দ জানো না। যারা কবি তাদের উদ্দেশ্য বলি- ছন্দ ভাঙার আগে ছন্দটা ভালো করে শেখো। গদ্য কবিতা লিখতে হলে বই কিনে ছন্দ, মিল, শব্দ, ভালো করে শিখুন। তারপর কবিতা লেখার জন্য নামুন। জয়গুরু। ভালো থেকো। শুভ রাত্রি।

অখিলেশ: আপনিও খুব ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। অনেক সময় দিলেন, জ্বলদর্চির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই।  

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments