জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে—সপ্তবিংশতি পর্ব/মলয় সরকার

মার্কেজের খোঁজে

সপ্তবিংশতি পর্ব

মলয় সরকার


এবার আসি একটি ফেলে আসা গল্পে। যদিও এটি মার্কেজের কথার বা সাহিত্যকীর্তির সঙ্গে যুক্ত নয়, তবুও সঠিক জানি না, এর সঙ্গে তাঁর মনের অন্তর্নিহিত কোণে কোথাও ছাপ যুক্ত ছিল কিনা, যতই হোক, কাহিনীটি তাঁর দেশেরই কিছু ‘মিথ’ লোকশ্রুতি যা সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এক দুরন্ত কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে। তা হল “এল ডোরাডো”র গল্প, যা আমি আগে, বলব বলে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।

আসলে এল ডোরাডো একটি অনাবিস্কৃত দেশের নাম শুধু নয়, এটি সারা পৃথিবীর সমস্ত কৌতুহলকে একীভূত করার এক রহস্যময় শব্দগুচ্ছ। রামায়ণের সোনার হরিণ শুধু রাম আর সীতার চাহিদা এবং স্বর্ণতৃষার গল্পমাত্র নয়, এটি একটি রূপক আর এটিরই বাস্তব রূপ এই সোনার হরিণ ‘এল ডোরাডো’। যা খুঁজতে গিয়ে কত মানুষ নিজের প্রাণ পর্যন্ত বাজী রেখেছেন।

এল ডোরাডো মানেই স্বপ্নের শহর, ঠিক সোনার লঙ্কার মত, ( কিংবা সত্যজিত রায়ের সোনার কেল্লার মত কি জানিনা), তবে কিংবদন্তি বলে এই শহরে রয়েছে অফুরন্ত সোনার গুপ্তভাণ্ডার। আর তাই সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা গল্পকথা, নানা উপাখ্যান বা কল্পকাহিনী। আর সেই সোনার খাটের ঘুমন্ত রাজকন্যার খোঁজে কতশত অভিযাত্রী ছুটে বেরিয়েছে, পাড়ি দিয়েছে কত সাতসমুদ্র তের নদী, চালিয়েছে কত দুঃসাহসিক অভিযান, প্রাণও দিয়েছে কত সাহসী মানুষ। তবু কি পাওয়া গিয়েছিল সেই দেশের ঠিকানা! 

আসলে এল ডোরাডো কথার অর্থই হল, ‘যেটি সোনা’। এটি স্প্যানিশ শব্দ। আমরা আমাদের ভ্রমণ কাহিনীতে দেখিয়েছি, যে কলম্বিয়া অঞ্চলে বা তাদের দেশে সত্যিই সোনার ব্যবহার বেশিই ছিল। বোগোটার মিউজিয়ামটিও তারই সাক্ষ্য দেয়। জেনুরা ঘরের জানালা দরজাতেও সোনার ব্যবহার করত। কাজেই এ সমস্ত ঘটনাই তাদের দেশের সোনার প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার কারণ।
🍂

এক সময়ে আমেরিকায় ‘’গোল্ড রাশ” হয়েছিল। তার টানে ছুটে এসেছিল সারা পৃথিবীর মানুষ। সে সময়ের কথা লেখা আছে বিভিন্ন বইতে আর দেখিয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন তাঁর “গোল্ড রাশ” সিনেমাটিতে।কাজেই সোনার টান মানুষের চিরকালীন।
অনেকদিন আগে কলম্বিয়ার এক আদিম অধিবাসী গোষ্ঠী ছিল, যাদের নাম মুইস্কা। এদের কথা আগেও আলোচনা করেছি।
এই মুইস্কাদের নিয়ম ছিল, নতুন যিনি রাজা হবেন, তাঁকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনার গুঁড়ো মাখিয়ে লেক গুয়াতাভিতায় স্নান করানো হত। তিনি বাহকের কাঁধে চেপে লেকে যেতেন স্নান করতে। এটি ছিল এক রাজকীয় উৎসব। তাঁকে বলা হত ‘এল হোম্ব্রে ডোরাডো’ বা সোনার মানুষ। এর থেকেই কি ভাবে কখন যেন তাঁর দেশের নাম লোকমুখে হয়ে যায় এল ডোরাডো, যার খোঁজে মানুষ দৌড়াচ্ছে।

সেই শহরটির নাম বা সন্ধান সঠিকভাবে কেউ দিতে পারে নি।লোকে মনে করত, এই দেশটি পুরোটাই সোনা দিয়ে মোড়া। ঠিক বোধ হয় রামায়ণের “সোনার লঙ্কা” বা “স্বর্ণলঙ্কা”র মত কিছু। 
আটশ’ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এর চর্চা একটু একটু বাড়ে।কিন্তু বহুদিন অর্থাৎ প্রায় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এটা সম্বন্ধে মানুষ বিশেষ কিছু জানত না।

তবে ১৫৩১ সালে ফ্রান্সিস্কো পিজারো যখন ইনকা সাম্রাজ্য জয় করে সমস্ত কিছু লুট করছেন, তখন বাইরের পৃথিবীর সবাই ভাবতে শুরু করল, এই ল্যাটিন আমেরিকার কোন জায়গাতেই নিশ্চয় সেই সোনার রাজ্য এল ডোরাডো রয়েছে। আর হবে না-ই বা কেন! পিজারো তাঁর দূর সম্পর্কের তুতো ভাই, হার্নান কর্টেজ, মেক্সিকোতে আজটেক সাম্রাজ্য লুট ও ধ্বংস করে প্রচুর ধনরত্ন পাচ্ছেন দেখে উদবুদ্ধ হয়ে ইনকা সাম্রাজ্য লুট করতে আসেন। এখানে ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপাকে বন্দী করে মুক্তিপণ হিসাবেই আদায় করেন ২৪’x১৮’x ৮’ মাপের এক ঘর ভর্তি সোনা ও একই মাপের দু’ ঘর ভর্তি রূপা।  এ ছাড়া মন্দির বাড়িঘর লুট করা সোনারূপা তো ছিলই, যা ছিল অপর্যাপ্ত। এই সমস্ত সোনা গলিয়ে, নিয়ে যাওয়ার সুবিধার জন্য,  ছোট ছোট ‘বার‘এ পরিণত করে স্পেনে পাঠানো হয়। আর ওদিকে হঠাৎ এত সোনাদানা আমদানী হওয়ায় স্পেনের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। মুদ্রাস্ফীতি হয় প্রচণ্ড ভাবে। যাক, সে অন্য গল্প।

কাজেই যেখানে এত সোনাদানা এমনিতেই পাওয়া যায়, সেখানে নিশ্চয়ই প্রচুর সোনা থাকবে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে দেরী হয় নি।
কাজেই এর জন্য নানা অভিযান শুরু হয়। এক অভিযাত্রী গুয়াতাভিতা হ্রদের জল থেকে চার হাজারের মত সোনার টুকরো পেয়েছিলেন। ফলে ধারণা করা হয়েছিল, উৎসবের সময় মুইস্কারা এখানে বরাবর সোনা উৎসর্গ করত। এর ফলে বহু মানুষ এর জলে বা আশে পাশে সেই শহরের সন্ধান চালিয়েছে। কিন্তু সবই নিষ্ফলা হয়েছে।
এমন কি স্প্যানিশরা এই সোনা খুঁজতে এসে সেখানকার আদিম যে অধিবাসীরা ছিল তাদের মারধর থেকে তাদের উপর নানা অত্যাচার চালাতে থাকে।কিন্তু লাভ হয় না কিছুই। তখন এই সমস্ত অধিবাসীরা, এই অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য নানা গুজব তৈরী করে। যা একসময় হয়ে দাঁড়ায় এল ডোরাডোর গল্পকথা।
আসলে মুইস্কারা ছিল ভাল সোনার কারিগর। তারা সোনার তৈরী সুন্দর জিনিসপত্র বানাত।তাই তাদের উপর বার বার ইউরোপীয়ান হামলা হয়েছে।কিন্তু তারা যে সোনা উৎপাদন করতে জানত তা নয়। তারা ছিল মূলতঃ কৃষিজীবি। তবে তারা ভাল তাঁত বস্ত্র বানাতে পারত। এবং সোনার গহনাপত্রও বানাতে পারত। তারা সোনা পেত মূলতঃ বিনিময় প্রথায় বাণিজ্য করে।তারা সোনা ও তামায় মিশ্রণ বানাতেও জানত।

শেষে গঞ্জালো জিমেনেজ দ্য কুয়াসাদা (Gonzalo Jiménez de Quesada) ১৫৩৭ সালে এই মুইস্কাদের থেকে প্রচুর সোনা রূপা লুঠ করেন।তাদের রাজা জিপাকে হত্যা করে কিছু সোনাদানা পেলেও আসল সোনার উৎসের সন্ধান অজানাই থেকে যায়।

পরে ভাবা হয় আরও ভিতরে লেক পারিমে (Lake Parime) তেই আছে আসল ঠিকানা। তাই তার খোঁজে আবার চলে অনেক অভিযান। শেষে আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ড অনেক অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ঘোষণা করেন লেক পারিমের কোন অস্তিত্বই নেই।
আলেকজাণ্ডার হামবোল্ড আঠার শো সালের শুরুতে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালান ও শেষে রিও ম্যাগদালেনাতে পৌঁছান। কিন্তু তিনিও এই শহরটি খুঁজে পান নি। 

আসলে বিখ্যাত আমেরিকা আবিষ্কারক ক্রিষ্টোফার কলম্বাস ১৪৯২ সালে আদিবাসীদের শরীরে নানা সোনার গহনা দেখে ধারণা করেন, এখানে প্রচুর সোনা আছে নিশ্চয়ই। তাই তিনি বহু সময় ব্যয় করেন নানা দ্বীপে ঘুরে এই সোনার সন্ধানে।
তিনি স্পেনে ফিরে সেই দেশের রাজাদের কথা দেন, যদি ঠিকমত সাহায্য পান, তাহলে যত সোনা চাই ততই এনে দেবেন। তিনি হয়ত এরকমই কিছু গল্পে বিশ্বাস করেছিলেন।

পরে ফ্রান্সিস্কো দ্য ওরেয়ানা এই অভিযানে আমাজন নদীর ধার দিয়ে যেতে যেতে পুরো নদীটার মোট দৈর্ঘ্যই মেপে ফেলেন।
ফলে,  আমাজন যে বিশ্বের দীর্ঘতম নদী এই আবিষ্কারটা তাঁর এক বড় আবিষ্কার হিসাবে স্বীকৃতি পায় ইতিহাসের পাতায়। এই অভিযানে তাঁর অবশ্য এটা একটি বিরাট লাভ।

এ ছাড়াও বিগত দিনে বহু সংগঠিত ও অসংগঠিত অভিযান চালিয়ে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সম্প্রতিও বিংশ শতাব্দীতেও বেশ কিছু অভিযাত্রী এরকমই সোনার দেশের খোঁজে নিছক হারিয়ে গিয়েছেন।
তবু আজও সেই সোনার মায়া হরিণ “এল ডোরাডো”র নাম এক রহস্যময় হাতছানি দেওয়া যাদু  শব্দবন্ধ হয়ে মানুষকে আজও হাতছানি দিয়ে চলেছে।

এখানেই শেষ আমার এই পর্বের লেখা ও খোঁজা। অনেক ধন্যবাদ আমার পাঠক বন্ধুদের, যাঁরা এত সুদীর্ঘ দিন আমার সঙ্গে থেকে আমাকে এগিয়ে চলার উৎসাহ জুগিয়েছেন।হয়ত দেখা হবে আবার আগামী কোন পথের বাঁকে। ভাল থাকুন সবাই। 
ধন্যবাদ সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠীকে, আমার এই গল্পের জমিতে মাদুর বিছিয়ে দেওয়ার জন্য।

Post a Comment

0 Comments