জ্বলদর্চি

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি / (উনিশ তম পর্ব)/চিত্রা ভট্টাচার্য্য

"ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি " 
(উনিশ তম পর্ব)
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

লোকসংগীতে নজরুল

ছায়া সুনিবিড় গ্রামীন বাংলার মেঠোপথের কাঁচামাটির গন্ধে,আউশের ধানের ক্ষেতে শ্যামলিমায় ঢেউ তোলা ফসলের মাঠে ,ঋতুর বৈচিত্র্যে জলেস্থলে লাবণ্যে জড়ানো বাংলার আদি অকৃত্রিম লোকসঙ্গীত --বাংলার সংগীতের জগতে একটি অন্যতম ধারা। সহজ সরল মানব জীবনের বারমাস্যায় সুখ, দুঃখের কথার মালায় গাঁথা একান্ত আপন সংগীত। এর কোনো লিখিত রূপ হয় না, বাউলরা মুখেমুখে এ গান বাঁধেন ৷ একতারা বাজিয়ে এ গান গাওয়া হলেও দোতারা, খামক, ডুগডুগি, ঢোল, খোল, করতাল, মঞ্জিরা, ঘুঙুরের ব্যবহারও প্রয়োজনে এই গানে করা হয়। কথা আর সুরের মূর্ছনাই এই সংগীতের প্রধান আকর্ষণ। 

বাংলার লোকসঙ্গীতের মধ্যে ব্যাপকভাবে আকর্ষণীয় বাউল, গম্ভীরা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কবিগান, কীর্তন গাজন, ভাদুগান ইত্যাদি ৷ এছাড়াও, ঝুমুর , ঘেঁটু , সারি গান, বারোমাসি, মেয়েলি গীত, ধামগান ইত্যাদি ও বিশেষ জনপ্রিয়। গাঁ গঞ্জের রাঙা পথে বসন্ত বৈশাখের উদাসী হাওয়ায় পাতা ঝরা ধূলিধূসরিত মিষ্টিগল্পে জড়ানো বঙ্গ প্রকৃতির নিজস্ব সম্পদ এই লোকগান। 

এই প্রবন্ধে আজকের সংগ্রহে চলেছি লোকসংগীতের  প্রিয়শিল্পী কবি নজরুল কে তাঁর গানের কথা ও সুরের মায়াবী গোলোক ধাঁধায় খুঁজতে।  লালন ফকির যেমন বাউল গানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ,কাজী নজরুলের বাউলগান ও তেমনি মন কে উতলা করে পাড়িদেয় নিরুদ্দেশে।
🍂

যে মাটির জল হাওয়া কে আশ্রয় করে কবির প্রাণ বিকশিত হয়ে উঠেছে সে চেতনায় উদাস বাউলের ভৈরবী সুর তাঁকে বেপথু করে। বাউল ধর্মমত প্রথম থেকেই পাশাপাশি লৌকিক ধর্মমত গুলিকে স্বীকৃতি দিয়ে  সৃষ্টি করে অজস্র বাউলসংগীতের । যেখানে তিনি প্রেম, ভক্তি, এবং বিপ্লবের বিষয়বস্তু নিয়ে সংগীত লিখেছেন। লোকগীতির বিভিন্ন ধারায়  জারি সারি, ভাটিয়ালি ও অন্যান্য পল্লীগীতিতে নতুনত্ব দেখাগেল তাঁর গানে লোকগীতির সুর এবং তার কাঠামোর সঙ্গে আধুনিক গীতির সংমিশ্রণে গাইলেন--
             বাঁশি বাজায় কে কদমতলায় ওলো 
            ললিত শুনে সরে না পা পথ চলিতে॥
            তার বাঁশির ধ্বনি যেন ঝুরে ঝুরে
             আমারে খোঁজে লো ভুবন ঘুরে
             তার মনের বেদন শত সুরে সুরে----
              (ও সে)  কি যেন চাহে মোরে বলিতে॥ 

 এ বাউল সংগীতের  বিষয়বস্তু প্রকৃতি কেন্দ্রিক হলেও আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, দর্শন, দেহতত্ত্ব ইত্যাদির যোগসৃষ্টিতে পূর্ণ হয়েছে এ গানের ঝুলি ৷ বৈষ্ণব ও সুফি উভয় সম্প্রদায়ের প্রভাবই এখানে লক্ষণীয়।  শাস্ত্রীয় বা আচার সম্মত বাউল ধর্মের বাইরেও আর একটা লৌকিকধারা যে ধারায় বাউলের সূক্ষ্ম আধাত্মিক অনুভূতির কোনো স্থান নেই। কবি নজরুল তাঁর বাউলগানে সাধারণভাবে জীবনের নানা রহস্যের অনুসন্ধান করেছেন। জীবনের পরপারের আশঙ্কা ও কবি মনকে  ব্যাকুল করে।  
‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল, আমার দেউল
আমারি এই আপন দেহ।
আমার এ প্রাণের ঠাকুর নহে সুদূর অন্তরে
মন্দির দেহ ॥……..

 গানটিতে প্রাণের ঠাকুর প্রাণেই বাস করেন, তাঁর নিত্য পূজার জন্য  মন্দিরে যাবার  প্রয়োজন নেই, দেহেই যে তাঁর বাস।  ঘর ছাড়া ক্ষ্যাপা বাউলের চিরসাথীর সঙ্গে তিনি নৃত্যে মাতেন যেমন তেমনি ভিখ ও মাগেন। এমন করেই স্বর্গ লাভের সুখে কবি মুগ্ধ হন ।

“সংসার ছক পেতে হায় বসে রোস মোহের নেশায়,
হেরে যে সব খোয়ালি যাসনে তবু খেলা ছাড়ি
প্রাণমন এই দুই ঘুঠিতে যুগ বেঁধে তুই যা এগিয়ে,
দেহ তোর একলা ঘুঠি রাখ আড়িতে মার বাঁচিয়ে।
আড়িতে মার খেলে তুই স্বর্গে যাবি জিতবি হারি।"
  
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে আমরা পেয়েছি বাংলা বাউলের ধারায়  লোক সংগীতের সুর অবলম্বনে গান রচয়িতার অগ্রগন্য রূপে। মধ্যযুগের কবি রামপ্রসাদ সেনও লোকসংগীতের ঢঙে বাউলের সুরে বিস্তর শ্যামাসংগীত রচনা করেছিলেন। তেমনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্বে স্বদেশী গানে বাউল লোকসংগীতের সুর ব্যবহার করেছিলেন সে সময়ের বহু গুণীকবি। কিন্তু কবি নজরুল ইসলাম ও লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারা অবলম্বনে বহু গান রচনা করেছেন।    

অপর একটি লোকগানে কবি তাঁর প্রাণের ঠাকুরকে ভক্তহৃদয়ের প্রতিদিনের অনুভব থেকে গভীর হৃদয়াবেগ  থেকে দুখের মাঝে উপলব্ধি করেছেন।  
"তুমি তুলে দিয়ে সুখের দেয়াল ছিলে আমার প্রাণের আড়াল
আজ আড়াল ভেঙে দাঁড়ালে মোর
সকল শূন্য ভরি ॥’
(‘তুমি দুখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি হরি’)"
শৈশব থেকে কবির জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ।  তাঁর বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষাগ্রহণ সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা পাই নজরুল গবেষক মিলন দত্তের লেখায়---
''শেখ চাকর গোদা এবং মুন্সী বজলে করীমের প্রভাবে নজরুল লেটো দলের জন্য গান লিখে দিতে লাগলেন। তাঁর লেখা গান দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠল। গ্রামে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল কিশোর কবির নাম। বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাঁর কাছে লোক আসতে লাগল গান লিখিয়ে নেবার জন্য। আর নজরুলও মুক্তহস্ত। যে এসে গান চায়, তাকেই তিনি গান লিখে দেন। আর গানই কি এক রকম? কেউ চায় সঙের গান, কেউ চায় ছড়ার গান, কেউ চায় বন্দনা গান, কেউ চায় চাপান গান, কেউ চায় ঠেস গান। নজরুল চাহিদামাফিক সকল ধরণের গানই লিখে দিতে লাগলেন। আরবি, ফার্সি, বাংলা, ইংরেজী শব্দ ও বাক্য মেশানো গানও তাকে লিখতে হতো। পরবর্তীকালে নজরুল এক অসাধারণ সংগীত রচয়িতা ও সুরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এক দিনে এক সঙ্গে চৌদ্দ পনেরোটি গান লিখে, তাতে সুর দিয়ে এবং তা সকলকে শেখানোর দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তার মূল উৎস ছিল লেটোর দলের জন্য বিচিত্র অসংখ্য গান রচনার মধ্যে। এর মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন প্রানের আরাম, মনের তৃপ্তি। (দত্ত মিলন, ১৯৭৬: ২২)।

তিনি অনেক প্রচলিত লোকগানের কাঠামো ও বিষয়বস্তু নিজের মতো করে তৈরি করেছেন, যেমন   
"এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা
(রে ভাই) এই তো বিধির খেলা।
সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা॥
সেই নদীর ধারে কোন ভরসায়
(ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায়,
যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই
পারে যাবার ভেলা॥"

"এই দেহ ভেঙে হয় রে মাটি, মাটিতে হয় দেহ,
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ – তার খোঁজ নিল না কেহ।  "
বাংলা সংগীতের ক্ষেত্রে লোকসুর প্রয়োগের বিষয়টি অতি প্রাচীন। চর্যাপদের যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান গীতিকবিগণ তাঁদের গান রচনার বিষয়বস্তু এবং সুর হিসেবেও লোকজ ঐতিহ্যের ব্যবহার করেছেন।তারই ধারাবাহিকতায় কাজী নজরুল ইসলামও এর ব্যতিক্রম নন। প্রেম, বিরহ এবং আধ্যাত্মিকতার বিষয়বস্তুর সাথে বিপ্লবী চেতনা ও সংগ্রামকে গানের সুরের মাঝে প্রবাহিত করে যৌবনের রক্তে উন্মাদনা এনেছেন ,নবীন প্রাণ কে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যা তাঁর গানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে সাড়া জাগিয়ে লোকগীতির মত যা বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়েগেছে। 

তাঁর গানে সামাজিক সমস্যা, ধর্মীয় বিষয় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট লোকগীতিকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে।  বাউল, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, ঝাপান, কাজরী সব মিলিয়ে প্রায় একশত লোক অঙ্গের গান রচনা করেছেন তিনি। 

উত্তরবঙ্গে ভ্রমণকালে সেখানের লোকসংগীত  ভাওয়াইয়া গানের সুরেও কবি মুগ্ধ ও প্রাণিত হলেন। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল,পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি জেলার কিয়দংশ ও অসম রাজ্যের কিছু অংশে ভাওয়াইয়া গানের প্রচলন রয়েছে। নিচু জংলা জমিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ভাওয়া। এসব জমিতে পশুপালক,রাখালরাজরা গরু,মোষ চরাতেচরাতে এই গান গাইতেন বলে ,সম্ভবতঃ এর নাম হয়েছে ভাওয়াইয়া। 
 
অথবা  ভাওয়াইয়া শব্দটির উৎপত্তি ‘বাওয়াইয়া’ বা ‘বাও’ থেকে, যার অর্থ বাতাস। হিমালয়ের পাদদেশে হওয়ায় এ অঞ্চলে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়। এ গানকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছিলেন যিনি, সেই গবেষক ও সঙ্গীতসাধক আব্বাস উদ্দিন এই হাওয়া থেকে উদ্ভূত হওয়ার মতটিকেই সমর্থন করেছেন। এবং  তৃতীয় মতটি হলো, ভাওয়াইয়া আসলে ভাবের গান। ভাব+ইয়া থেকে ভাওয়াইয়া। প্রেম, প্রীতি, আবেগ, ভক্তি, বেদনা সমস্ত ভাবেরই প্রকাশ ঘটে থাকে ভাওয়াইয়ার লোকগানে ।

গবেষকদের মতে,ভাওয়াইয়া গানের বয়স প্রায় দেড়হাজার বছর হবে,চর্যাপদ রচনার ও বহু আগে যে সময় সঙ্গীতই ছিল একমাত্র সাহিত্য। 
 নদীমাতৃক গ্রামবাংলার এই গান সম্পূর্ণ ভাবেই নদী, নারী ও প্রকৃতি নির্ভর। শ্রমজীবী মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, নারীমনের আবেগ-অনুভূতি, প্রেমের আকুতি সমস্ত কিছুই মিশে থাকে এই গানের ছত্রেছত্রে।গানের সঙ্গে বাজনা  দোতারা বা সারিন্দা ছাড়াও তবলা, ঢোল, মন্দিরা আর বাঁশির প্রচলন ছিল সুর মূর্ছনার সৃষ্টিতে এই লোকসঙ্গীতে । 
 
গ্রাম্যবধূটির দূরদেশে থাকা স্বামীর ঘরে ফেরার পথ চেয়ে অপেক্ষারতা তার দুশ্চিন্তা উদ্বেগ পূর্ণ মনের ভাব থেকে গান রচনা, জনশূন্য মেঠো পথের আখ্যান তো বটেই, এখানে এসে মিশতে থাকে সমাজচেতনা, পরিবেশচেতনা, প্রাত্যহিক গ্রামজীবনের চিত্র।
“ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত কান্দিম মুই নিধূয়া পাথারে।”
সবুজ-শ্যামলা গ্রামবাংলার অপরূপ ছবি সেখানে চিত্রিত হয়ে আছে। পাখির কলতান, বটবৃক্ষের ছায়ায় মুগ্ধ কবি-শিল্পীরা সেসব দৃশ্যকে তুলে ধরতেন গানের কথায়।
“ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে
বটবৃক্ষের ছায়া কেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে।”
তখনকার মানুষের কৃষিজীবী জীবন, গো-পালন,মহিষ চড়ানো বা মহিষ দিয়ে গাড়ি টানা বা খাদ্যাভ্যাসের প্রতিচ্ছবি জীবন্ত হয়ে উঠে এই গানে। যেমন, এই পদটিতে রয়েছে মোষের পিঠে আরোহণকারী রাখাল বালকের গান-
“ওকি মইষাল রে
ছাড়িয়া যান না মোক
কাগাশিয়ার ঘরে রে।”

বন্ধুকে আহ্বানের আবেগ, গাড়োয়ানের রোজনামচা, দেশীয় লোকাচার, এবং আরো সামাজিক আচার অনুষ্ঠান বিধি বিধান নিয়েই এই গান তৈরি হতো।  এই অঞ্চলের মানুষ ভাওয়াইয়া গান ছাড়া যেমন সম্পূর্ণ নন, তেমনই মানুষের জীবনগাথা ছাড়া এই গানও যেন অসম্পূর্ণ।
ভাওয়াইয়া শিল্পীগণ প্রধানত স্থানীয় রাজবংশী ও কামতাপুরী সম্প্রদায়ের। তাদের  গানের গায়ন শৈলীতে যে গলাভাঙার মাধুর্য রয়েছে -- কবি নজরুল কে তাই প্রাণিত করেছিল। একাধিক ভাওয়াইয়া রচনায়। আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া-গান --
''তোরষা নদীর পারে পারে ও
দিদি লো মানসই নদীর পারে’-
গানটির অনুকরণে কাজী নজরুল ইসলাম রচনরা করলেন-
'‘পদ্মদীঘির ধারে ধারে ঐ
সখি লো কমল দীঘির ধারে
আমি জল নিতে যাই
সকাল সাঝে সই
সখি, ছল করে সে মাছ ধরে
আর, চায় সে বারে বারে "॥

 কোনো কোনো লোকগানের রচয়িতার ধারণা        ভাওয়াইয়া গান -- গোঠে গরুর পাল নিয়ে রাখাল রাজ গোধূলিতে বেলাশেষের বাঁশিতে সুরতুলে গোচারণ শেষে ঘরে ফেরার সময় পথের রাঙা ধূলি উড়িয়ে যে গানের সুরে গান গেয়ে ক্লান্তি দূর করে।  ফাঁকা পার্বত্য ভূমিতে চড়াই উৎরাইয়ে সে উদাত্ত সুরের লহমা এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে প্রতিধ্বনিত হয়ে অপূর্ব সুরের  সৃষ্টি করে।সে সুরের লহরী তে বাঁধা থাকে একধরনের মোচড়, যে ধ্বনিতে মিঠেকড়া অনুভূতির স্পর্শ থাকে। 

উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, কুচবিহার অঞ্চলের অসমতল পথে, যেখানে গরু ,মহিষের গাড়ি অথবা গো চারণ ভূমিতে গরু -মহিষ -চরানোই মানুষের প্রধান জীবিকা সেখানেই ভাওয়াইয়ার গান। তার বিষয়বস্তুতে প্রেমকেন্দ্রিক ও আধ্যাত্মিক রূপ ও ধরা পড়ে। 
নজরুল ইসলাম রচিত ভাওয়াইয়া গানগুলিতে চিরাচরিত সুরের ব্যবহারটি অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ভাটিয়ালী ও ভাওয়াইয়া রচনার ক্ষেত্রে কবি অনেকখানি অনুপ্রেরণা লাভ করেন প্রসিদ্ধ শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের কাছ থেকে। 
আব্বাসউদ্দীন আহমদ রচিত ‘গীতিকার নজরুল’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়-
 কবি  সরাসরি ভাওয়াইয়া গান রচনা না করলেও, তাঁর সুরেলা কণ্ঠ এবং ভাওয়াইয়ার প্রতি মুগ্ধতা এই লোকগানকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। মূলত, আব্বাসউদ্দীন আহমদ তাঁর ভাওয়াইয়া গান গেয়ে শোনালে, নজরুল মুগ্ধ হয়ে সে সুরের ওপর ভিত্তি করে গান লিখতেন। তিনি 'আহা, কী সুন্দর কী মিষ্টি সুর!' বলে মুগ্ধতা প্রকাশ করতেন এবং গান রচনায় প্রাণিত হতেন। আব্বাসউদ্দীনকে আরো ভাওয়াইয়া গাইতে অনুরোধ করতেন এবং পরে সেই সুরের ওপর ভিত্তি করে খাতা-কলম নিয়ে গান লিখতেন। নজরুল, ভাওয়াইয়া গানকে আধুনিক বাংলা গানের সাথে মিশিয়ে এর পরিধি বাড়িয়েছিলেন।  গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী হিসেবে ভাওয়াইয়াকে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেছিলেন। 
কালক্রমে নজরুল, ভাওয়াইয়া গানের পাশাপাশি ঝুমুর গানকেও আধুনিক বাংলা গানে নিয়ে এসেছিলেন।‘ 

তথ্য সূত্র / 'বিদ্রোহী শতবর্ষের অবলোকন '/  মুকুল দত্ত

নজরুল গীতি / গবেষক আব্বাসউদ্দীন 
নজরুল সঙ্গীত/ বাংলা পিডিয়া
নজরুল / গবেষক গিরিণ চক্রবর্তী
 ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments