বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৯৩
বেত
ভাস্করব্রত পতি
'জিনিসপত্র জুটিয়ে এনে
গ্রামের মানুষ বেচে কেনে।
উচ্ছে বেগুন পটল মুলো,
বেতের বোনা ধামা কুলো'।
-- হাট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বেতের তৈরি তথাকথিত ধামা, কুলো ছাড়াও এখন অবশ্য ঘর সাজানোর আরও নানা উপকরণ মিলছে। বসার চেয়ার, ল্যাম্পশেড, টেবিল ল্যাম্প, টি টেবিল, খাট, সোফা, চাঙারি, টোকা, ঢুষি, আউড়ি, ফুলের ঝুড়ি, ফলের ঝুড়ি, বই রাখার তাক, বসার মোড়া, খুবি, ডালা, হাতপাখা, দোলনা আরও কত কি! মূলত গৃহকাজে ব্যবহৃত সৌখিন জিনিস তৈরির জন্য বেত হয়ে ওঠে অন্যতম উপকরণ।
বেত ফল
ইদানিং একটা কথা বেশ চালু হয়েছে -- 'শিক্ষকদের হাতের বেত ফিরিয়ে দাও, পড়াশোনা তাতেই ভালো হয়ে যাবে'। ছাত্র ছাত্রীদের ঢিঁট করার জন্য শিক্ষকদের হাতের ছড়িকেই বলা হয় 'বেত'। একসময় বেত গাছের ডাল কেটেই তৈরি হত শিক্ষকদের ছড়ি। যদিও পরবর্তীকালে বাঁশের কঞ্চিই হয়ে ওঠে সেই ছড়ি। সাধুভাষায় 'লাঠ্যাংশ'। চড়ক গাজনের সময় ভক্তাদের হাতে থাকে শিবের আশীর্বাদ পুষ্ট বেতের গুচ্ছাকার ছড়ি। যা এই গাজনের 'বেতচালা' উপচারে অন্যতম ব্যবহার্য উপাদান। নিজের শরীরে এই বেত দিয়েই বারংবার আঘাত করে কষ্ট দেন ভক্তা তথা গাজন সন্ন্যাসীরা। তাছাড়া গাজনের হিন্দোলার সময় সন্ন্যাসীদের পেটে এই বেতফল দিয়ে জলের ছিটে দেওয়ার রীতি লক্ষ্য করা যায়।
রাস্তার পাশে, পতিত জমিতে, ঝোপঝাড় জঙ্গলের মধ্যে এই গাছটির দেখা মেলে। মূলত ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলের স্যাঁতস্যাঁতে, ভিজা, জঙ্গলাকীর্ণ নিচুভূমিতেই বেতগাছের বেড়ে ওঠার পক্ষে উপযুক্ত। ভারত সহ ভিয়েতনাম, ভুটান, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, জাভা, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ডে ব্যাপক দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে প্রায় ২০০ ধরনের বেতগাছ রয়েছে। কেবলমাত্র ভারতের বুকে ৪৮ রকমের গাছের দেখা মেলে। ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে সবচেয়ে বেশি জন্মায়। ইদানীং বেতের চাষ হচ্ছে বানিজ্যিকভাবে। কেননা বেত দিয়ে গেরস্থালির অসংখ্য সামগ্রী তৈরি হচ্ছে।
বেতের কাঁটা
বেতকে সংস্কৃতে অভ্রপুষ্পবেতস, মারাঠিতে খোরবেত, বেডিসু, হিন্দিতে বেংত, কন্নড়ে বেতসু, গুজরাটিতে নেতর, তেলুগুতে পীরারুবা বলে। এছাড়াও এটি বেত্র, বেতস, যোগিদণ্ড, মধুপচক, বেতন, বেতুইন, বেথুর নামেও পরিচিত। বেশ কয়েক প্রজাতির বেতগাছ পাওয়া যায়। সবচেয়ে পরিচিত হল ছাঁচিবেত (সংস্কৃতে যোগিদন্ড, সুদন্ড, মারাঠীতে বেত বলে) হল লতানে উদ্ভিদ। মোটামুটি হাতের কড়ে আঙ্গুলের মত মোটা। এই গাছে অনেক কাঁটা রয়েছে। এগুলি প্রায় ২০০-৩০০ ফুট লম্বা হয়। সাধারণত পূর্ণবয়স্ক বেতগাছ ৪৫ - ৫৫ ফুট লম্বা এবং কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি হতে পারে। উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় বেতগাছ পরিচিত Calamus viminalis নামে। এটি Arecaceae পরিবারের উদ্ভিদ। বেতের আরও কিছু প্রজাতি হল --
Calamus tenuis
Calamus amarus
Calamus heliotropium
Calamus horrens
Calamus royleanus
Calamus stoloniferus
Palmijuncus amarus
Palmijuncus heliotropium
Palmijuncus horrens
Palmijuncus royleanus
Palmijuncus tenuis
Rotang royleanus
বেতগাছের কাণ্ড বেশ চকচকে, লম্বা, কাঁটাযুক্ত, শক্ত এবং শাখা প্রশাখাহীন। নলের মতো সরু। কাণ্ডের সামনের অংশ থেকে নতুন পাতা বেরোয়। একটি গ্রাম্য ধাঁধায় পাই -- 'একগাছ টান দিলে বেতগাছ লড়ে'। আসলে বেতগাছ এত বেশি লম্বা এবং অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে যে একটি গাছে টান দিলে অনেক দূরের গাছও নড়েচড়ে ওঠে।
সাধারণত অক্টোবর মাসে ফুল ফোটে আর মার্চ এপ্রিলে ফল পাকে। বেতফলগুলি ছোট ছোট আঙুরের মতো গোলাকার বা একটু লম্বাটে গোলাকার (থোকায় থোকায়) হয়। প্রতিটি থোকায় অনেক ফল ঝোলে। এর শক্ত খোসা ছাড়ালে ভেতরে নরম অংশ মেলে। একটু কষযুক্ত কিন্তু টক মিষ্টি স্বাদের। বেতফলকে বেতগুলা, বেতগুটি, বেত্তুন, বেথুন, বেথুল, বেত্তুইন নামেও ডাকা হয়। এদের বীজগুলি শক্ত। কাঁচা ফল সবুজ বর্ণের কিন্তু পেকে গেলে হালকা সাদা বা ঘিয়ে রঙের হয়। এটি থোকায় থোকায় ফলে। প্রতি থোকায় ২০০ টি পর্যন্ত ফল হয়। বেতফলের মধ্যে একটা লাল অংশ পাওয়া যায়, সেটটিকে বিশেষ উপায়ে শুকনো করে একপ্রকার রঙ তৈরি হয়। যা কিনা Dragon's Blood বা খুনখারাপী রং নামে পরিচিত। বেত গাছের অবয়ব সাপের মতো। আর বেতের ফুলগুলি ডিমের মতো। এই নিয়ে ঢাকা এলাকার একটি ধাঁধায় পাই --
'জঙ্গল দিয়ে বেরোল সাপ,
ডিম পাড়ে কাপ কাপ।'
বেতফল দেখতে লাল এবং ভেতরের অংশ কালো রঙের। তা নিয়ে ঢাকার লোকজনের মুখে শোনা যায় --
'উপরে লাল ভিতরে কালা
এই ধাঁধা যে বলতে না পারবে
সে আমার বাপের শালা'।
বেতফল খেতে টক স্বাদের। তাই নুন লঙ্কা দিয়ে খেতে হয়। সেই বিষয়টিই উঠে এসেছে টাঙ্গাইলের প্রচলিত ধাঁধায় --
'উপরে সাদা ভিতরে কালো,
ঝাল লবনে খেতে ভালো'।
গাজীপুরের একটি আঞ্চলিক ধাঁধায় পাই --
'এতন গাছে বেতন ধরে,
বেদভাষ্যে, চরকের সূত্রস্থানে, সুশ্রুতের সূত্রস্থানে, চক্রপাণি দত্তের চক্রদত্ত সংগ্রহে বেতের নানা উপকারিতার কথা উল্লিখিত রয়েছে। পুরাতন জ্বর (রক্তবহ স্রোতে বিকার হ'লে যে জ্বর হয়) নিরসনে, রক্তপিত্ত থেকে মুক্তি দিতে, পিত্তজ বিকারে, সর্দিতে, পিত্তজ অগ্নিমান্দ্যে, বিষ জাতীয় খাদ্য খেলে, গেঁটে বাতে, স্ত্রী পুরুষের জননেন্দ্রিয় শৈথিদিতে বেতের বিভিন্ন অংশ খুব উপকারী। বেত হল দাহনাশক, পিত্তপ্রশমক এবং প্রদাহনিবারক ভেষজ উদ্ভিদ।
🍂
0 Comments