জ্বলদর্চি

বলাগড়ের রোদ বৃষ্টির খাতা-চতুর্থ পর্ব/অয়ন মুখোপাধ্যায়

চিত্তাপ্রসাদ

বলাগড়ের রোদ বৃষ্টির খাতা
 চতুর্থ পর্ব

অয়ন মুখোপাধ্যায়

 রিলিফের বাইরে মানুষ ও একজন শিল্পীর আত্ম দর্শন



গঙ্গার পাড়ের বাতাসে আজ কাদার গন্ধ।
এইরকম এক ভেজা দুপুরে কলকাতা থেকে এসে চিত্রশিল্পী চিত্তপ্রসাদ নামলেন জিরাট স্টেশনে। উদ্দেশ্য — এই গ্রামটায় ঘুরে দেখা, আঁকা, আর একবার চোখে দেখা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বাড়ি। যাঁকে ঘিরে আজকাল বাজারে, মেলায়, সংবাদপত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানারকম রঙিন গল্প।

চিত্তপ্রসাদ মনে মনে ভাবলেন,
“যে মানুষকে জাতীয় নায়ক বানানো হচ্ছে, তাঁর নিজের গ্রামটা কেমন আছে—একটু দেখা যাক।”

হাতে স্কেচবুক, পকেটে পেন্সিল।
চোখে শুধু প্রশ্ন—
“দুর্ভিক্ষের বাংলায় শ্যামাপ্রসাদের গ্রামে কে বাঁচল, কে মরল?”
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নতুন বাড়ি


রোদে পোড়া পাটক্ষেতের পাশে এক বৃদ্ধ বলল,
“বাবু, ওইদিকে যাবেন না—নোনা জলে মাটির প্রাণ গেছে।”

চিত্তপ্রসাদ দেখলেন লোকটার শরীরে কঙ্কালের ছায়া।
জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কি রিলিফ পাননি?”

বৃদ্ধ হেসে ফেলল—শুকনো দাঁতের হাসি।
“রিলিফ কই বাবু? শুনেছি কলকাতা থেকে লাখ লাখ টাকা এসেছে। কিন্তু সে সব আমরা কিছুই পাইনি। আমরা বেঁচে আছি আমাদের মতো করেই। শ্রীকান্ত বগা বলে যে চাষি, তার অবস্থা আরো খারাপ। রিলিফের চাল কোথায় গেল কেউ জানে না। তবে এত কিছু হোক, আমরা খিদের গন্ধ এখনো পাই।”

চিত্তপ্রসাদ শুনে চুপ করে রইলেন।
লোকটার কণ্ঠে তিক্ত গর্বের সুর—যেন দুর্ভিক্ষের ভেতরেও সে নিজের আত্মসম্মান বাঁচিয়ে রেখেছে।

তিনি নোটবুকে লিখলেন—
“যাদের নাম রিলিফের তালিকায় ওঠে না, তারাই বেঁচে থাকে বিবেকের তালিকায়।”


🍂


গ্রামের বুক চিরে বয়ে গেছে এক নদী—
যে নদী একসময় প্রাণ ছিল, এখন বন্যার জলে প্রাণ নিচ্ছে।
বারো দিন ধরে জিরাটের অনেক গ্রাম ডুবে আছে।
বাড়ি ভেসে গেছে, গোলা খালি, গবাদি পশুর খড় নেই।
বিশ্বাসটুকুও যেন স্রোতের জলে ভেসে গেছে।

এক মাঝির সঙ্গে কথা হল চিত্তপ্রসাদের।
সে বলল,
“আমরা ভেবেছিলাম পরের বছর ভাল ধান হবে, কিন্তু তখনই এল দুর্ভিক্ষ। ভগবান আমাদের চাইতে বড়লোকদেরই বেশি ভালবাসেন।”

চিত্তপ্রসাদ চুপ।
চোখে শুধু ধূসর মাটি, ফাটা ক্ষেত।
দূরে দেখা যায়—হিন্দু মহাসভার নেতা, জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নতুন বাড়ি, চকচকে চূড়ায় রোদ লেগে ঝলমল করছে।



বিকেলে তিনি পৌঁছলেন শ্যামাপ্রসাদের বাড়ির সামনে।
বিশাল লোহার গেট, বাগানে মোটরগাড়ি, ছেলেরা হাসছে, বল ছুঁড়ছে।
দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া, বন্যার হাহাকার—সবই গেটের বাইরে থেমে গেছে।

চিত্তপ্রসাদ দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন,
“বাবু আছেন? কলকাতা থেকে এসেছেন কি?”

দারোয়ান হাসল,
“ওঁর সময় কোথায়! এখন শহরে সভা, কাজের ভিড়।”

চিত্তপ্রসাদ ভেতরে তাকালেন—
পুরনো আশুতোষ মুখার্জির প্রাসাদ ভেঙে পড়েছে, জানালায় শ্যাওলা, থামে ফাটল।
আর পাশে নতুন দোতলা বাগানবাড়ি—ঝকঝকে, মার্বেল পাতা।

রাস্তার পাশে দোকানদার বলল,
“দুর্ভিক্ষের বছরে জিরাটে একটাই নতুন বাড়ি উঠেছে—শ্যামাপ্রসাদবাবুর। আমরা তখন আমের আঁটি খাচ্ছি, আর উনি গেস্টরুম সাজাচ্ছেন।”

চিত্তপ্রসাদ লিখলেন—
“নতুন বাড়ি, অন্ধকার বিবেক।”
এবং স্কেচ করতে শুরু করলেন।
মনে মনে ভাবলেন,
“আমি থাকব না, কিন্তু আমার ছবিগুলো একদিন কথা বলবে।”


পরদিন সকালে তিনি গেলেন রিলিফের হাটে।
বড় ফেস্টুনে লেখা—
“হিন্দু সমাজের ত্রাণ হাট — শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর উদ্যোগে।”

ভিতরে গিয়ে দেখলেন—
ধনী ব্যবসায়ীরা বস্তায় বস্তায় চাল কিনছে,
গরিব চাষির হাতে ফাঁকা ঝুড়ি।

চিত্তপ্রসাদ এক চাষিকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কিছু পেয়েছ?”
চাষি হেসে বলল,
“পেয়েছি বাবু—অপমান।
চাল আছে, কিন্তু কেবল যাদের ভোট আছে, পয়সা আছে, প্রণাম আছে।”

এক তরুণ বিক্রেতা বলল গর্বভরে,
“শ্যামাপ্রসাদ নিজে উদ্বোধন করেছেন, ন্যায্য দামে বিক্রি হচ্ছে।”
চিত্তপ্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, “দাম কত?”
“চার টাকা সের।”
পাশ থেকে কেউ বলল, “বাজারে তিন টাকা!”
লোকটা হেসে বলল, “কিন্তু এই চাল শ্যামাপ্রসাদের আশীর্বাদে পবিত্র।”

চিত্তপ্রসাদ চুপ করে রইলেন।
মনে হল—
“এখানে ধর্ম আর খিদে একই টেবিলে বসে ভাত খায়।”


সন্ধ্যার আলোয় স্কুলঘরের বারান্দায় বসে আঁকছেন চিত্তপ্রসাদ।
দেখলেন, ছেলেমেয়েরা খেলা করছে, হঠাৎ এক বৃদ্ধ চিৎকার করল,
“তোরা মানুষ হবি না রে!”

এক বাচ্চা হেসে বলল,
“ইস্কুলই তো বন্ধ দাদু, মানুষ হব কেমন করে?”

কথাটা শুনে চিত্তপ্রসাদের কৌতূহল জাগল।
এক বৃদ্ধ শিক্ষক বললেন,
“আমরা গরিব মানুষ, শহরের বাবুদের কথা বুঝি না। কিন্তু জানি, শিক্ষা দরকার। আপনি যদি পারেন, একজন মাস্টার দেন—আমরা না খেয়ে থাকলেও ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করব।”

চিত্তপ্রসাদের চোখ ভিজে গেল।
তিনি বুঝলেন—
যেখানে রাজনীতি মুখে মুখে,
সেখানেই সাধারণ মানুষ নিঃশব্দে মানবতার পাঠ শেখায়।
এবং শিক্ষাবিদ আশুতোষ মুখার্জির ছেলে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির গ্রামে স্কুল বন্ধ—এই irony-টাই হয়তো বাংলার ইতিহাসের সত্য মুখ।


ফেরার দিন সকালে এক তরুণ দৌড়ে এসে বলল,
“আপনি চিত্তপ্রসাদ? সাবধান থাকবেন—শ্যামাপ্রসাদবাবুর লোকেরা আপনাকে খুঁজছে। শুনেছে আপনি কিছু লিখছেন।”

চিত্তপ্রসাদ হেসে উত্তর দিলেন,
“আমি তো শুধু দেখেছি। দেখা যদি অপরাধ হয়, তবে সব চোখই দোষী।”

ট্রেনে ওঠার সময় তিনি জানালার বাইরে তাকালেন—
ধানের ফাঁকা জমি, ভাঙা ঘর, খিদের গন্ধ।
নোটবুকের শেষ পাতায় লিখলেন—

“একদিন ইতিহাস বলবে,
জিরাটের মানুষ খিদের বিরুদ্ধে লড়েছিল,
আর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তাঁদের বাঁচানোর নামে রাজনীতি করেছিলেন।
তাঁর নাম রইল ধানের গন্ধের পাশে—ধূসর অক্ষরে।”
দুর্ভিক্ষের সময় গোলা ভরা ধান বাগান এই সমস্তই চিত্তপ্রসাদ এঁকেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বাড়ি দেখে।


ট্রেন মিলিয়ে গেল দূরে। চিত্রপ্রসাদ দেখলআকাশে সূর্য নামছে ধীরে ধীরে, নদীর জলে আগুনের মতো আলো। ট্রেনের  দুলনিতে আচ্ছন্ন ঘুমের ভেতর
চিত্তপ্রসাদ ভাবতে থাকলো—এই গল্প শুধু লেখা নয়,
এ যেন তাঁর চোখে দেখা অন্য অন্য ইতিহাস। যে গল্প শহরের বেশিরভাগ মানুষই জানে না

ট্রেনের জানালায় ভেসে উঠল মুখ—
বৃদ্ধ চাষি, মাঝি, স্কুলের বাচ্চা, আর সেই অপুষ্ট মহিলার চোখ।
সব মুখ মিলেমিশে তৈরি করল এক ধানক্ষেতের রঙের মানুষ,
যে নীরবে বলল—
“আমরা খিদের মধ্যেও বেঁচে থাকব তোমার ছবিতে।”

চিত্তপ্রসাদ হালকা হাসলেন।
আকাশে একটা পাখি উড়ে গেল
মনে হল, সে যেন তাঁর স্কেচবুকের ভেতর ঢুকে পড়ল,
আর ইতিহাসের পাতায় রেখে গেল এক অমোচনীয় দাগ—
ধানের গন্ধে মিশে থাকা মানুষের সত্য গন্ধ।


ক্রমশ

কৃতজ্ঞতা স্বীকার এই গল্পটি চিত্র প্রসাদের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত।।

Post a Comment

0 Comments