জ্বলদর্চি

পুজোর পাঁচকাহন(পঞ্চম ও শেষ পর্ব)পুরোহিত একজন শিল্পী/তনুশ্রী ভট্টাচার্য

পুজোর পাঁচকাহন
(পঞ্চম ও শেষ পর্ব)

পুরোহিত একজন শিল্পী

তনুশ্রী ভট্টাচার্য 

মনকে ত্রাণ করে যা তাই মন্ত্র ,তনুকে ত্রাণ করে যা তাই তন্ত্র। শরীর আর মন মিলেই ত সাধনা। শরীরের ব্যথায় কাবু হলে  বা দুর্বল শরীর হলে একজন ব্রাহ্মণের পক্ষে মন্ত্রের যে তেজ, যে ভাইব  যে ফোর্স তা  উচ্চারণে বা আবৃত্তিতে পুরো রূপ ফুটিয়ে তোলা যায় না।  আর মন্ত্র দিয়েই তে আবাহন স্থাপন  চক্ষুদান প্রাণ প্রতিষ্ঠা  ভোগ নিবেদন যাবতীয় ষোড়শ উপচার সম্পন্ন করতে হয় ,তবেই সে  আরাধনা‌ হয়ে ওঠে সর্বাঙ্গীন --বহিরঙ্গে আর অন্তরঙ্গে। এই মন্ত্র তন্ত্রের পুজো একপ্রকার সৃষ্টি। একজন পূজককে একজন স্রষ্টা হতে হয়। পুজোর সময় বা দিনগুলোয় তিনিই তো মৃন্ময়ী মাকে চিন্ময়ী তে পরিবর্তিত করেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গীর পুজা পদ্ধতি  একাগ্রতা নিষ্ঠা  শ্রদ্ধা ভক্তি দিয়ে ।   যেমন করে প্রেমের কবিতায় বিপ্লবের ভাষ্য অনুপস্থিত  থাকে বা ভ্রমণ কাহিনীতে উপন্যাসের পরত থাকে না-- যে যার একটা নিজস্ব‌ ভাষা থাকে আঙ্গিক থাকে, একজন কবির নিজস্ব দর্শন ও সেইমতো ভাষা  রূপক উপমা ব্যবহার করে তার কবিতাকে শ্রুতিমধুর ,হৃদয়গ্রাহী  করে তোলেন পুজো ব্যাপারটাও ঠিক তাইই। একজন পূজারী একজন কবি একজন চিত্রশিল্পী একজন গায়ক বা বাদ্যকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য  নেই। সবাই সেই আদ্যাশক্তির আরাধনা করেন। মাধ্যমটা আলাদা। এই মন্ত্র উচ্চারণের সময় ভারতীয় রাগ রাগিণীর প্রয়োগ দেখা যায়। প্রকৃত দীক্ষিত ব্রাহ্মণ জানেন  পুজোর প্রারম্ভ থেকে ঘট বিসর্জন পর্যন্ত বিভিন্ন  পর্যায়ে দিন রাতের বিভিন্ন সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কখনো মালব কখনো ললিত কখনো কেদার,বিভাস আবার কখনো বসন্ত বা ধানসি  ইত্যাদি রাগের সুরে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে দেবীকে জাগ্রত করতে হয়,মনোরঞ্জন করতে হয়,প্রীত, সন্তুষ্ট  করতে হয়।সঠিক মন্ত্র ,কন্ঠ মাধুর্য বাচনভঙ্গী মন্ত্রের সিলেবল মেনটেইন  কন্ঠের উচ্চাবচ  সাবলীলতায় চন্ডীপাঠের মাধ্যমে একটা সুরেলা পুজা মন্ডপ তৈরী করেন একজন পুরোহিত। এ হেন  একজন সত্যিকারের ব্রাহ্মণের শক্তি ও ক্ষমতা সেল্ফিমগ্ন ,রিলসবানানো আমজনতার  বোধের অগম্য।
যজ্ঞ উপবীত ধারণের পর পুজাদি নিত্যকর্মে নিযুক্ত হওয়া সাধু ব্রাহ্মণের একান্ত কর্তব্য। উপনয়ন বেদীতলে পবিত্র হোমাগ্নি সম্মুখে মন্ত্র উচ্চারণ ও প্রাসঙ্গিক  ক্রিয়া কর্মাদি সমাপনান্তে গায়ত্রী মন্ত্র অধিকারী হয়ে  দ্বিজত্ব‌প্রাপ্ত হবার কালে এই অঙ্গীকার  করতে হয়। ব্রাহ্মনত্ব অর্জন করে সেটিকে না প্রয়োগ করা যেমন অকর্তব্য তেমনি তার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে ব্রাহ্মণত্বের ক্রমান্বয়ে  উন্নীতকরণ একটি অবশ্য কর্তব্য। ঠিক যেমন নার্সিং  ট্রেনিংএর শেষে ল্যাম্প লাইটিং সেরিমনিতে সেবার কর্তব্যের শপথ নিতে হয় প্রতিটি নার্সকে।  বি এড‌এর ট্রেনিং নিয়ে উপযুক্ত শিক্ষক হতে হয়, এ ও ঠিক তেমনি। 
🍂

পুর  এর হিত করেন যিনি তিনিই পুরোহিত।  সেই পুর এখন নগর শহর  গ্রাম গঞ্জ পাড়া ওয়ার্ডে  বিস্তারিত হলেও মূল কথা একই ---সার্বিক কল্যাণ। একজন পুরোহিত সেই মনন নিয়ে পুজার আসনে বসেন। বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজোতেও  সেই গ্রামবাসী বা উদ্যোক্তাদের নামেই সংকল্প করেন তিনি। বাড়ির পুজোতে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠের নাম সংকল্প করেন আর পুরোহিতকে নিজের নামেও সংকল্প করতে হয়। যিনি ব্রহ্মত্ব অর্জন করেছেন তিনিই ব্রাহ্মণ। এই অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া সাধনা। সবাই যে পারেন এমন নয় তবে এখনো অনেক পুরোহিত এই শক্তি অর্জন করেই দেবী আরাধনার  জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন ।
চার দিনের এই পুজোয় দেবীকে জাগ্রত করার কাজটি একজন সূক্ষ্ম বোধের  শিল্পী না হলে করা যায় না।

আধুনিক ভাষ্য বলছে ---পুরোহিতই জানেন ভগবান বলে কিছু নেই। আইনস্টাইনের কথা না তুললেও বলা যায়  এই ব্রহ্মান্ডে বা ইউনিভার্সে একটি সংজ্ঞা বিহীন শক্তি আছে ---তাকে ঐশী শক্তি যদি নাও বলি তবু তাকে নানা ভাবে    সংজ্ঞায়িত করার  সহজ পদ্ধতিই হল পুজো। কথাটা সহজ হলেও আসলে ব্যাপারটা ঠিক ততটা সহজ নয়। তাই কিছু উপাচার উপাদান উপকরণ কে উপজীব্য করে এই বঙ্গে একটি মুর্তছবি মূর্তি হিসাবে লাগে। আমরা তো এতটাও অন্তরশক্তির অধিকারী  হয়ে উঠিনি। তাই মূর্তি মন্ডপ  মন্ত্র সজ্জা লাগে বৈকি।  মুশকিল এই যে আমরা যেমন গুরুজনদের সম্মান ভয়ভক্তি করি এই দেবদেবীদের ও তাইই করি ---এখানে কোনো ধর্মের কথা আসে না।  সেটাই অনেকে গুলিয়ে ফেলেন। দেবতা বা ভগবান  কোথাও নেই এটা সবাইই জানেন। কিন্তু যেটা আছে   তা হোল নিজের মানবিক গুণের অনুশীলন আর প্রকাশ।  দুর্গা পুজোয়  কোটিকোটি  মানুষের যোগদান  সুতরাং  নানা ধ্যানধ্যারনায় পুজো হচ্ছে ---সজ্জা থিম প্যান্ডেল আলো বার্তা সচেতনতা উপকারীতা প্রয়োজনীয়তা দান্যধ্যান ---সব রকম পুণ্য কর্মে এই পুজার আয়োজন। সেখানে দেবতা হয়তো আপনিই উদয় হবেন ---চাই কি সবার হৃদয়ে যে সবথেকে নরম জায়গাটা আছে সেখানে দেবতা নড়েচড়ে বসবেন। তখন তো সবাই নিজেই নিজের পুরোহিত।  নিজের সদগুণের বিকাশ ঘটানোই ত দেবত্ব অর্জন করা । সেখানেই হোক না দেবীর আরাধনা। নিজের পুজোর পুরোহিত হন আপনি নিজেই। 
এ বছরের এই  দশমীর  পর থেকে আগামী বছর পর্যন্ত নিজের জীবনের পুরোহিত হয়ে নিজের  মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা দেবতার গুণাবলী জাগিয়ে তুলুন।তবেই ত এ আয়োজন সার্থক।
শুভম।
শারদীয়া মহা দশমীর শুভেচ্ছা।

Post a Comment

0 Comments