জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের লোকগল্প/মিথ্যেবাদী বউ/সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস /কথক- লাবণ্যময়ী দাস

জঙ্গলমহলের লোকগল্প

মিথ্যেবাদী বউ

সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস 
কথক- লাবণ্যময়ী দাস, গ্ৰাম- বেড়াজাল থানা-নয়াগ্ৰাম, জেলা-ঝাড়গ্ৰাম 

এক গ্ৰামে এক চাষি আর তার বউ বাস করত। চাষি সারাদিন খেটে খুটে ঘরে টাকা নিয়ে আসত। কিন্তু চাষির বউ কিছুতেই খুশি হত না। শুধু তাই নয় চাষি যা রোজগার করে আনতে তা থেকে কিছু টাকা লুকিয়ে নিজের জন্য রেখে দিত। এছাড়া সে চাষির উপর জোর জুলুম ফলাত। এর জন্য চাষিও তার বউকে ভয় পেত।

এমনই একদিন চাষি সারাদিন খাটাখাটনির পর ক্লান্ত হয়ে যখন বাড়িতে এসে তার বউকে ডাকাডাকি করতে থাকে, তখন তার বউ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে-“কী হয়েছে কী, চেঁচিয়ে সাড়া পাড়া মাথায় করছ কেন?”

তখন চাষি বলে-“না গো গিন্নি, আসলে আজ আমি খুব ক্লান্ত। তাই আমাকে যদি একটু নুন চিনি জল করে দিতে তাহলে খুব ভালো হত এই আর কী। এর জন্য তোমাকে ডাকছিলাম।”

তার বউ তখন বলে-“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তো ওই করতেই আছি। ঠিক আছে, ঠিক আছে যাও হাত মুখ ধুয়ে এস তারপর দিচ্ছি।”

এই কথা শুনে চাষি খুশি হয়ে যায়। আর শিগগিরই সে হাত মুখ ধুতে চলে যায়। 

হাত মুখ ধুয়ে এসে চাষি তার বউকে বলে-“এই যে গিন্নি, আজকের যা রোজগার হয়েছে তা আমি ওই বিছানার নিচে রেখেছি।”

তখন চাষির বউ বিছানার নিচ থেকে অর্ধেক টাকা বের করে বলে-“হুম্….. মাত্র একশো টাকা। এই একশো টাকায় কী হবে শুনি।”
🍂

এই কথা শুনে চাষি চমকে উঠে। সে বলে-“কী বললে গিন্নি, একশো টাকা! কিন্তু আমি তো ওখানে দুশো টাকা রেখেছিলাম।”

তার বউ তখন বলে-“ইস্, দুশো টাকা। এই তো এখানে একশো টাকাই আছে। তুমি কী ভাবছ আমি মিথ্যে কথা বলছি?”

চাষি তখন আমতা আমতা করে বলে-“না তা নয়, মানে ইয়ে মানে।”

তার বউ বলে-“থাক্ থাক্ আর মানে মানে করতে হবে না, এই নাও পঞ্চাশ টাকা। এই দিয়ে দুদিন যেভাবে হোক সংসারটা চালাতে হবে। আর বাকি পঞ্চাশ টাকা আমি একজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম তাকে দিতে হবে।”

এরপর চাষি আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। এইভাবে তাদের দিন কাটতে থাকে।

একদিন এক ভিখারী বুড়ি চাষির বাড়িতে ভিক্ষা চাইতে আসে। 

চাষির বাড়ির সামনে এসে বুড়ি বলে-“বাড়িতে কেউ আছ গো, আমাকে দুটো পয়সা দাও না। দুদিন হল আমার পেটে কিছু পড়েনি। এই বুড়ি মানুষটাকে একটু সাহায্য করো। কী গো কেউ আছ?”

বুড়ির ডাক শুনে চাষির বউ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সে বুড়িকে বলে-“কী হল কী, এত চেঁচাচ্ছ কেন বাপু?”

বুড়ি বলে-“মা, আমি দুদিন হল কিছু খাইনি। আমাকে দুটো পয়সা ভিক্ষা দে মা, দুটো পয়সা ভিক্ষা দে।”

 চাষির বউ বলে-“হুম… দুটো পয়সা ভিক্ষা। কোথা থেকে পাব দুটো পয়সা। আমার নিজের কাছে কোনো টাকাপয়সা নেই আর আমি দেব ওনাকে দুটো পয়সা। তার থেকে তোমার কাছে যদি দুটো পয়সা থাকে তা নাহয় তুমি আমাকে দাও। হুম পয়সা নেবে, দূর দূর যতসব আমার কপালে জুটে। যাও তো এখান থেকে।”

এই কথা শুনে বুড়ির খুব খারাপ লাগে। সে কাঁদতে কাঁদতে চাষির বউকে বলে-“তোমার কাছে দুটো পয়সা চেয়েছি বলে তুমি আমাকে এত কথা শোনালে মা। তোমার বাড়ি আছে, দুবেলা দুমুঠো খেতে পাও। তাই বলে আমার মতো গরীব বুড়িকে তুমি যা নয় তাই বলে অপমান করবে। এমনকি তুমি আমাকে মিথ্যে কথাও বললে যে তোমার কাছে মাত্র দুটো পয়সা নেই। এই কথা তুমি বলতে পারলে মা। এত বড়ো মিথ্যে কথা বলতে পারলে।”
এই বলে বুড়ি কাঁদতে থাকে।

বুড়ির কান্না দেখে চাষির বউ বলে-“এই এই শোনো বুড়ি, এই নেকা কান্না আমার কাছে কেঁদে কোনো লাভ নেই। আমার কাছ থেকে তুমি একটা টাকাও পাবে না বুঝলে। আর হ্যাঁ কী বললে আমি মিথ্যে কথা বলেছি? শোনো আমি মিথ্যে কথা বলিনা।”

এইসব কথা শুনে বুড়ি খুব রেগে যায়। সে তখন চাষির বউকে বলে-“কী তুই আমাকে অপমান করলি? আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি, এখন থেকে তুই মিথ্যে কথা বললে তোর লেজ গজাবে, তুই বানরের মতো আচরণ করবি। আর যত মিথ্যে বলবি লেজ তত বাড়বে।”

এই শুনে চাষির বউর হাসি আর থামে না। সে হাসতে হাসতে বলে-“কী কী সব বলছ হা হা হা হা। মানুষের আবার লেজ গজায় নাকি হা হা হা। অভিশাপ দিচ্ছে অভিশাপ হা হা। দূর দূর আমার অনেক কাজ আছে। এই তুমি এবার এখান থেকে যাও তো এখান থেকে যাও। যতসব আমার কপালে জুটে।”

বুড়ি তখন বলে-“হাসছিস তো হেসে নে হেসে নে। কিন্তু আমার কথাটি মিলিয়ে নিস, মিলিয়ে নিস।”

চাষির বউ বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে মিলিয়ে নেব। আমার নাকি লেজ গজাবে হা হা হা। যা তা কথা একদম।” 

এই বলে চাষির বউ সেখান থেকে চলে যায়। আর বুড়িও চলে যায়।

রাত্রিবেলা চাষি তার বউকে বলে-“গিন্নি, আজকের রান্নায় নুনটা একটু কম হয়েছিল।”

তার বউ তখন বলে-“ও…. নুন কম হয়েছিল। বলি ঘরে একটুও নুন আছে যে রান্নায় নুন দেব। নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার আবার বড়ো বড়ো কথা।”

চাষি তখন একটু থতমত খেয়ে যায়। সে বলে-“আরে না না, আমি তো এমনি বলেছিলাম হে হে হে।”

তার বউ তখন বলে-“হেসো না তো হেসো না গা পিত্তি জ্বলে যায়। আর একটা কথা ঘরে এক দানাও চাল নেই। আজকে যাইহোক করে চালিয়ে নিয়েছি। কিন্তু কালকে যদি চাল না আনো তো না খেয়ে থাকবে।”

চাষি বলে-“বলো কী গো গিন্নি, চাল নেই।”

তার বউ বলে-“না চাল নেই। এবার ঘুমাও তো আমার খুব ঘুম পেয়েছে। সারাদিন কত খাটাখাটনি করতে হয় জানো। কালকের ব্যবস্থা কাল দেখা যাবে এবার ঘুমাও তো।” 

চাষি তখন আর কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়ে।

সেই সময় চাষির বউ তার পিঠের কাছে একটু অস্বস্তিবোধ করে। সে বলে-“এ কী পিঠের দিকে এমন লাগছে কেন? ও যাকগে্ যাক্ এখন তো ঘুমিয়ে পড়ি।” এই বলে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরের দিন সকালে পাড়ার দুটো মহিলা চাষির বাড়ি আসে। তাদের দেখে চাষির বউ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

ঘর থেকে বেরিয়ে চাষির বউ ওই দুটো মহিলার মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করে-“কী গো রতনের মা, এত সকাল সকাল আমাদের বাড়ি কী ব্যাপার?”

তখন রতনের মা বলে-“তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে এলাম গো বউ, এই দেখ।”

রতনের মার সঙ্গে আসা আর একজন তখন চাষির বউকে বলে-“রতনের বাবা এই সোনার হারটা রতনের মাকে গড়িয়ে দিয়েছে। খুব সুন্দর দেখতে তাই না বউ।”

চাষির বউ বলে-“হ্যাঁ গো খুব সুন্দর হয়েছে। ইস রতনের মা তোমার বর তোমার কথা কত ভাবে বলো।”

রতনের মা তখন বলে-“দূর পোড়ারমুখী, আসলে আমি রতনের বাবার কাছে বায়না করেছিলাম তাই এনে দিয়েছে। ভালো হয়েছে না বল।”

চাষির বউ বলে-“হুম ভালোই হয়েছে। তোমার ভাগ্য কত ভালো গো রতনের মা। রতনের বাবা তোমার জন্য কত কিছু এনে দেয়। আর একটা আমার বর। আমার জন্য কিছুই এনে দেয় না।”

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে চাষির বউর লেজ একটু বড়ো হয়ে যায়।

তখন রতনের মা ও আর একজন মহিলা বলে-“এ কী বউ এটা কী?”

তখন চাষির বউ বলে-“কী কী? ও কিছু না, আসলে আমার একটা ফোঁড়া বেরিয়েছে।”

তারা তখন বলে-“ও এই ব্যাপার। হ্যাঁ তুমি কী যেন বলছিলে বউ?”

তখন চাষির বউ বলে-“আমি বলছিলাম আমার বর আমাকে কিছুই এনে দেয় না।”

এই কথা বলতেই চাষির বউর লেজ আরও বড়ো হয়ে যায়। 

লেজ দেখে তারা চেঁচিয়ে উঠে। তারা বলে-“এ কী এ কী এ কী দেখছি? এ তো ফোড়া নয় এ তো লেজ। এ বাবা চাষির বউর লেজ গজিয়েছে।”

চাষির বউ তখন ভয় পেয়ে বলে-“লেজ লেজ কোথায় লেজ? আমার কোনো লেজ-টেজ নেই।”

এটা বলতেই লেজ আরও বড়ো হয়ে যায়। আসলে ও যত মিথ্যে বলবে লেজ তত বড়ো হবে।

এই দেখে তারা হাসতে থাকে। আর বলতে থাকে-“এই দেখে যাও গো সবাই দেখে যাও চাষির বউর লেজ গজিয়েছে লেজ গজিয়েছে হা হা হা।”

তাদের চিৎকারে পাড়ার সবাই চাষির বাড়ির সামনে জোড়ো হয়। তারা সবাই চাষির বউয়ের লেজ দেখে হাসতে থাকে।

এইসব দেখে চাষির বউ বলে-“এ কী এ কী আমার লেজ গজিয়েছে। এ কী এখন আমার গাছে চড়তে মন করছে কেন?”

এই বলে সে বানরের মতো গাছে উঠে যায়। আর হুফ হুফ করতে থাকে। এই দেখে পাড়ার বাচ্চারা তাকে ভ্যাংচি কাটতে থাকে। 

ঠিক সেইসময় চাষি সেখানে চলে আসে। সে তার ঘরের সামনে এত লোক দেখে অবাক হয়ে যায়। বাড়ির সামনে আসতেই সে দেখে তার বউ গাছে বসে আছে।

তার বউয়ের এই অবস্থা দেখে সে বলে-“ও গিন্নি, তুমি গাছে বসে আছ কেন? তোমার কী হয়েছে? তোমার লেজ গজাল কী করে?”

তখন সেখানে থাকা এক বৃদ্ধ বলেন-“ওহে চাষি, তোমার গিন্নি আর গিন্নি নেই বানর হয়ে গেছে হা হা হা।” এই বলে বৃদ্ধ সেখান থেকে চলে যায়।  

তখন চাষির বউ বলে-“আমি কী করে জানব গো, আমি বানর হলাম কী করে?”

চাষি বলে-“হায় হায় আমার কী সর্বনাশ হল গো। ও গিন্নি নিচে নেমে এসো নিচে নেমে এসো।”

চাষির বউ তখন বলে-“আমি নিচে নামতে পারছি না। আমার গাছে থাকতে ভালো লাগছে হুফ হুফ হুফ।”

চাষি বলে-“তাহলে আমাকে বলো তোমার এই অবস্থা হল কী করে?”

চাষির বউ বলে-“আমি জানি না জানি না… হুফ হুফ হুফ।”

চাষি বলে-“দেখ গিন্নি, তুমি যদি আমাকে সত্যি কথা না বল তাহলে আমি তোমাকে ঠিক করব কী করে? বল গিন্নি বল লক্ষ্মীটি দয়া করে বল। তোমার এই অবস্থা হল কী করে?”

তখন চাষির বউ চাষিকে সব কথা খুলে বলে। 

সব শুনে চাষি বলে-“ও এই ব্যাপার। তাহলে একমাত্র ওই বুড়ি আবার তোমাকে আগের মতো করতে পারবে। চল গিন্নি আমার সঙ্গে চল আমরা ওই বুড়িকে খুঁজে বের করি।”

তার বউ বলে-“ঠিক আছে তুমি চল আমি গাছের ডাল বেয়ে বেয়ে যাচ্ছি। তাহলে খুব তাড়াতাড়ি বুড়িকে পেয়ে যাব হুফ হুফ হুফ।”

এই বলে তারা বুড়িকে খুঁজতে শুরু করে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা বুড়িকে খুঁজে পায়।

তাদের দেখে বুড়ি বলে-“কে বাছা তোমরা, এখানে কী করছ?”

তখন চাষি বলে-“আজ্ঞে বুড়িমা, আপনার অভিশাপে আমার বউটা বানর হয়ে গেছে। আমার বউকে আপনি ঠিক করে দিন বুড়িমা।”

বুড়িকে দেখে চাষির বউ বলে-“হ্যাঁ হ্যাঁ এই সেই বুড়ি।”

বুড়ি তখন বলে-“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে মনে পড়ছে হা হা হা। তোমার বউ আমাকে অপমান করেছিলে, মিথ্যে কথা বলেছিল। তাই আমি তাকে অভিশাপ দিয়েছি হা হা হা।”

চাষির বউ তখন বলে-“আমার ভুল হয়ে গেছে বুড়িমা। আর এই ভুল হবে না। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকে আবার আগের মতো করে দিন হুফ হুফ হুফ।”

বুড়ি বলে-“না না না, তোকে আমি ঠিক করব না। তুই আবার মিথ্যে বলবি।”

চাষির বউ বলে-“না না বুড়িমা, আমি আর মিথ্যে কথা বলব না বলব না। আমাকে বিশ্বাস করুন।”

বুড়ি বলে-“না না কিছুতেই না, তোকে আমার বিশ্বাস নেই।”

তখন চাষি বলে-“বুড়িমা, অত্যন্ত আমার কথা ভেবে ওকে ঠিক করে দিন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ও আর মিথ্যে কথা বলবে না।”

বুড়ি তখন বলে-“ঠিক আছে বাবা। তোমার কথাতেই আমি ওকে ঠিক করে দিচ্ছি। কীরে আর মিথ্যে কথা বলবি না তো?”

চাষির বউ বলে-“না না একদম না।  আমার ঘাট হয়েছে আমার জীবন থাকতে আমি আর মিথ্যে কথা বলব না।”

তখন বুড়ি একটা ফুঁ দিতেই চাষির বউ আবার আগের মতো হয়ে গেল। 

চাষির বউ তখন বলে-“এই তো এই তো আমি আবার আগের মতো হয়ে গেছি। আর আমার লেজও নেই।”

বুড়ি বলে-“মনে রাখিস তুই যদি আবার মিথ্যে কথা বলিস তাহলে তোর ঠিক এই অবস্থা হবে।”

চাষির বউ বলে-“না না আর মিথ্যে নয় এবার থেকে শুধু সত্যি কথা বলব।”

চাষি বলে-“ধন্যবাদ বুড়িমা, আপনি আমাকে বাঁচালেন।”

এরপর বুড়ি সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

চাষির বউ তখন চাষিকে বলে-“হ্যাঁ গো চল বাড়ি চল ঘরে চাল আছে। আমি তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও। চল তোমাকে আমি ভাত আর সোনামুগের ডাল করে খাওয়াব চল চল।”

চাষি বলে-“চল গো চল গিন্নি, বড্ড খিদে পেয়েছে গো বড্ড খিদে পেয়েছে হে হে হে।”

এরপর তারা সেখান থেকে চলে আসে। তারপর থেকে চাষির বউ আর মিথ্যে কথা বলে না এবং তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।

Post a Comment

0 Comments