জ্বলদর্চি

মহাত্মাদের চোখে 'মহাত্মা' /প্রসেনজিৎ রায়

মহাত্মাদের চোখে 'মহাত্মা'

 প্রসেনজিৎ রায়


১৯৪০ সালের ১৩ই ডিসেম্বর শান্তিনিকেতন-এর উদয়ন ভবনে বিশ্বকবি কবিতা লিখেছিলেন মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে। কবিতাটির নাম, 'গান্ধী মহারাজ'। প্রথম কয়েকটি ছত্রেই বিশ্বকবি বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন তিনি গান্ধীজির অনুরক্ত। 

"গান্ধী মহারাজের শিষ্য 
    কেউ বা ধনী, কেউ বা নিঃস্ব, 
 এক জায়গায় আছে মোদের মিল-
গরিব মেরে ভরাই নে পেট, 
ধনীর কাছে হইনে তো হেঁট, 
আতঙ্কে মুখ হয় না কভু নীল"।

অর্থাৎ সহজিয়া জীবনযাপনে, মানবকল্যাণে ব্রতী মহাত্মা গান্ধী বিশ্বকবির মনের আকাশে জায়গা পেয়েছিলেন, গরীব-দরদী এক লড়াকু জননেতা হিসাবে, যে লড়াই-এ কবি নিজেকেও বারবার অংশীদার করেছেন তাঁর জীবনজুড়ে। নিজের ভাষ্যে কোনোরূপ রাখঢাক না করে কবিগুরু বলছেন, "এতদিন ধরে আমরা নিজেদের গ্রাম ও প্রতিবাসীদের নিয়ে খণ্ড খণ্ড ভাবে ছোটোখাটো ক্ষুদ্র পরিধির ভিতর কাজ করেছি ও চিন্তা করেছি। গ্রামে জলাশয় ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের সার্থক মনে করেছি, এবং এই গ্রামকেই আমরা জন্মভূমি বা মাতৃভূমি বলেছি। ভারতকে মাতৃভূমি বলে স্বীকার করার অবকাশ হয় নি। প্রাদেশিকতার জালে জড়িত ও দুর্বলতায় অনুভূত হয়ে আমরা যখন পড়েছিলুম তখন রানাডে, সুরেন্দ্রনাথ, গোখলে প্রমুখ মহদাশয় লোকেরা এলেন জনসাধারণকে গৌরব দান করার জন্যে।

তাঁদের আরব্ধ সাধনাকে যিনি প্রবল শক্তিতে দ্রুত বেগে আশ্চর্য সিদ্ধির পথে নিয়ে গেছেন সেই মহাত্মার কথা স্মরণ করতে আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি-তিনি হচ্ছেন মহাত্মা গান্ধী।

অনেকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ইনিই কি প্রথম করলেন। তার পূর্বে কংগ্রেসের ভিতরে কি আরও অনেকে কাজ করেন নি।কাজ করেছেন সত্য, কিন্তু তাঁদের নাম করলেই দেখতে পাই যে, কত ম্লান তাদের সাহস, কত ক্ষীণ তাঁদের কণ্ঠধ্বনি"।
🍂

বিদেশী ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে গান্ধীজির অহিংসার অস্ত্রপ্রয়োগ বারবার, বিভিন্ন প্রেক্ষিতে, বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। অস্ত্রহীন যুদ্ধের দ্বারা কি পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচন সম্ভব ! কবিগুরু বলেছেন, " আমাদের মধ্যে এমন লোক খুব কমই আছেন যাঁরা হিংস্রতাকে মন থেকে দূর করে দেখতে পারেন। এই হিংসা—প্রবৃত্তি স্বীকার না করেও আমরা জয়ী হব, এ কথা আমরা মানি কি? মহাত্মা যদি বীরপুরুষ হতেন কিংবা লড়াই করতেন তবে আমরা এমনি করে আজ ওঁকে স্মরণ করতাম না। কারণ, লড়াই করার মতো বীরপুরুষ এবং বড়ো বড়ো সেনাপতি পৃথিবীতে অনেক জন্মগ্রহণ করেছেন"। 

কবির মতে, মহাত্মাজি এমন একজন খ্রিস্টসাধকের সঙ্গে মিলতে পেরেছিলেন, যাঁর নিয়ত প্রচেষ্টা ছিল মানবের ন্যায্য অধিকারকে বাধামুক্ত করা। সৌভাগ্যক্রমে সেই ইউরোপীয় ঋষি টলস্টয়ের কাছ থেকে মহাত্মা গান্ধী খ্রিস্টানধর্মের অহিংস্রনীতির বাণী যথার্থ ভাবে লাভ করেছিলেন"।

কবি দ্বিধাহীনভাবে গান্ধীর অহিংস-পন্থাকে সমর্থন করেছিলেন, একথা স্পষ্ট বোঝা যায় কবির এই কথাগুলি থেকে-
"...ঔদ্ধত্যের ফলে ইউরোপে কী মহামারীই না হচ্ছে। মহাত্মা নম্র অহিংসনীতি গ্রহণ করেছেন, আর চতুর্দিকে তাঁর জয় বিস্তীর্ণ হচ্ছে। তিনি যে নীতি তাঁর সমস্ত জীবন দিয়ে প্রমাণ করছেন,সম্পূর্ণ পারি বা না পারি, সে নীতি আমাদের স্বীকার করতেই হবে" ।
 কবির দৃষ্টিতে মহাত্মা গান্ধী ছিলেন একজন পুণ্যব্রতী। তিনি মনে করতেন যুগ থেকে যুগান্তরে  দৈবাৎ যেসব মহাপুরুষের আগমন হয় গান্ধীজি তাঁদেরই একজন। সব সময় নয়, কবির মতে পরম সৌভাগ্যের অধিকারী হলে তবেই গান্ধীর মতো ক্ষণজন্মা পুরুষের জন্ম হয়।  শতসহস্র দুঃখ, পীড়ন, দৈন্য, রোগ, শোক, তাপ ছাড়িয়ে  যে মাটিতে আমরা বেঁচে আছি, চলাফেরা করছি, সেই ভারতবর্ষের মাটিতেই  তুলনাহীন গান্ধীজি জন্মগ্রহণ করেছেন বলে কবি বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন‌।

কৃতবিদ্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বিশ্বকবির মতোই  আমাদের বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া আর এক মহাত্মা। তাঁর "আত্মচরিত" গ্রন্থে তিনি মহাত্মা গান্ধীর প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে সেই  রবীন্দ্রনাথকেই আশ্রয় করেছেন:-
"রবীন্দ্রনাথ চিরদিনই 'অচলায়তন' হিন্দুসমাজের নানা অর্থহীন প্রথা ও জীর্ণ আচারের নিন্দা করিয়াছেন। মহাত্মা গান্ধীর ৬৩তম জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ দেশবাসীর নিকট যে বাণী প্রদান করেন, তাহাতে তিনি বলিয়াছেনঃ-

'যুক্তিহীন কুসংস্কার, জাতিভেদ এবং ধর্মের গোঁড়ামি, এই তিন মহাশত্রুই আমাদের সমাজের উপর এতদিন প্রভুত্ব করিয়া আসিতেছে। সমুদ্রপার হইতে আগত যে কোন বিদেশী শত্রুর চেয়ে উহারা ভয়ঙ্কর। এই সব পাপ দূর করিতে না পারিলে, কেবলমাত্র ভোট গণনা করিয়া বা রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করিয়া আমরা স্বাধীনতা লাভ করিতে পারিব না। মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে এই কথাই আমাদের স্মরণ করিতে হইবে, কেননা মহাত্মাজী নবজীবনের সাহস এবং স্বাধীনতালাভের দুর্জয় সঙ্কল্প আমাদিগকে দান করিয়াছেন। জড়তা ও অবিশ্বাস হইতে আত্মশক্তি ও আত্মনির্ভরতা-মহাত্মা তাঁহার অতুলনীয় চরিত্রপ্রভাবে এই বিরাট আন্দোলনই দেশে সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা আমরা উপলব্ধি করিতেছি। সেই সঙ্গে ইহাও আমরা আশা করি যে, এই আন্দোলনে জাতির মনে যে শক্তি সঞ্চার হইবে, তাহার ফলে আমাদের বহু দিনের সামাজিক কুপ্রথা এবং জীর্ণ আচারের পুঞ্জীভূত জঞ্জালরাশিও দূর হইবে।”
নিজের আত্মচরিতে আচার্য স্মরণ করেছেন তখনকার বোম্বের জনৈক 'কলওয়ালা' বা বস্ত্র উৎপাদনকারীর সাথে গান্ধীজির কথোপকথন, যেখানে গান্ধীজি বলেছেন "বাঙালীর প্রকৃতি আমার মতোই বিশ্বাসপ্রবণ"। গান্ধীজি এই প্রসঙ্গে অসাধু কলওয়ালারা কিভাবে বিদেশী কাপড়কে 'দেশী' বলে চালিয়ে প্রতারণা করেছিল, সেই প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন। 'আত্মচরিত' গ্রন্থটির নবম পরিচ্ছেদে বিজ্ঞানাচার্য 'গোখেল ও গান্ধীর স্মৃতি' আলোচনা করেছেন।

এই পরিচ্ছেদে আচার্য লেখেন, ১৯০১ সালের শেষ ভাগে গোখেলের অতিথিরূপে  মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কলকাতায় আসেন। প্রথম থেকেই তাঁহার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আচার্য তাঁর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন।  তাঁদের দুইজনের প্রকৃতির মধ্যে যে  বিষয়ে  আচার্য সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন সেগুলি হল 'ত্যাগ ও তিতিক্ষার প্রতি নিষ্ঠা'।  মহাত্মাজীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও তাঁর সাথে সুসম্পর্ক ঐ প্রথম দর্শনের পর থেকে ক্রমশঃ বেড়েই চলে, আচার্য নিজেই একথা তাঁর আত্মচরিতে উল্লেখ করেছেন। 
 দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয়দের দুঃখ-দুর্দশার মর্মস্পর্শী কাহিনী গান্ধীজির মুখেই আচার্য প্রথম শোনেন। আচার্য এবং  মহামতি গোখেল কলকাতায়  মহাত্মা গান্ধীকে প্রধান বক্তা হিসাবে রেখে একটি সভা আয়োজনের পরিকল্পনা করেন। এই সভা প্রধানত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের উদ্যোগেই অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠিত হয় এবং সভায়  সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন সংবাদপত্র 'ইন্ডিয়ান মিরর'-এর সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন। গর্বের সাথে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছেন:
" এইরূপে কলিকাতার জনসভায় গান্ধীজীর প্রথম আবির্ভাবের জন্য আমিই বস্তুতঃ উদ্যোক্তা। উপরোক্ত বিবৃতি হইতে দেখা যাইবে যে, যে সত্যাগ্রহ ও নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ পরবর্তীকালে জগতে একটি প্রধান শক্তিরূপে গণ্য হইয়াছে, এই শতাব্দীর প্রথমেই তাহার উন্মেষ হইয়াছিল।
গান্ধীজীর সঙ্গে এই সময়ে আমার প্রায়ই কথাবার্তা হইত এবং তাহা আমার মনের উপর গভীর রেখাপাত করিয়াছে। গান্ধীজী তখন ব্যারিস্টারিতে মাসে কয়েক সহস্র মুদ্রা উপার্জন করিতেন। কিন্তু বিষয়ের উপর তাঁহার কোন লোভ ছিল না। তিনি বলিতেন- "রেলে ভ্রমণ করিবার সময় আমি সর্বদা তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ীতে চড়ি, উদ্দেশ্য-যাহাতে আমার দেশের সাধারণ লোকদের সংস্পর্শে আসিয়া তাহাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানিতে পারি।"
এই ত্রিশ বৎসর পরেও কথাগুলি আমার কানে বাজিতেছে। যে সত্য কেবলমাত্র বাক্যে নিবন্ধ, তদপেক্ষা যে সত্য জীবনে পালিত হয় তাহা ঢের বেশী শক্তিশালী"।

গান্ধীকে 'মহাত্মা' উপাধি কে দিয়েছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি  হয়েছে। আমরা জানতাম,  ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান্ধীজি-কে এই উপাধি দিয়েছিলেন। আবার হাল আমলে গুজরাটের কোনো সমাজ সংস্কারক কিশোর মেহতাই নাকি প্রথম এই উপাধি ব্যবহার করেছিলেন বলে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। এইসব বিতর্কে না প্রবেশ করেও বলা যায়, মহাত্মাদেরই ক্ষমতা থাকে মহাত্মা-কে চিনতে পারার। আজ মহাত্মা গান্ধীর ১৫৭ তম জন্মদিবসে তাঁর স্মৃতির কাছে প্রার্থনা, দেশে শান্তি ফিরুক, দেশের প্রতিটি কোণে সার্থকভাবে  প্রতিষ্ঠিত হোক, গণতন্ত্রের ভিত্তি।

Post a Comment

0 Comments