অর্হণ জানা
১৫ নভেম্বর, ১৯১৩। গরুর গাড়িতে চড়ে শান্তিনিকেতনের আশ্রম-সচিব নেপালচন্দ্র রায়ের সঙ্গে কোনও জায়গায় যাচ্ছিলেন। হঠাৎ জোব্বার পকেটে টেলিগ্রামটা বেজে উঠতেই পকেট থেকে টেলিগ্রামটা বের করলেন। বারদুয়েক পড়ে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইলেন দূরের আকাশে। তার পর টেলিগ্রামটা আশ্রম সচিবের হাতে এগিয়ে দিয়ে বললেন, 'নিন নেপালবাবু। এই আপনার ড্রেন তৈরি করবার টাকা।' নেপালচন্দ্র তখন রবীন্দ্রনাথের কথা বুঝতে না পেরে টেলিগ্রাম পড়লেন। পড়ে তাঁর দু'চোখে জল এসে গেল। প্রথম নন-ইউরোপিয়ান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মুহূর্তেই শান্তিনিকেতনের আশ্রমে খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই হই হই শুরু হয়ে গেল রবি ঠাকুরকে নিয়ে।
শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্র ও পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন' গ্রন্থে লিখেছেন, 'সহসা অজিতকুমার চক্রবর্তী রান্নাঘরে ঢুকিয়া চিৎকার করিয়া বলিলেন, 'গুরুদেব নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।' লক্ষ করিলাম অজিতবাবুর চলাফেরা প্রায় নৃত্যের তালে পরিণত হইয়াছে।… তারপর ক্ষিতিমোহন বাবু প্রবেশ করিলেন। স্বভাবত তিনি গম্ভীর প্রকৃতির লোক, চলাফেরায় সংযত, কিন্তু তাঁহাকেও চঞ্চল দেখিলাম। ব্যাপার কী? তারপরে জগদানন্দবাবু পৌঁছিয়া ঘোষণা করিলেন তিন চারদিনের ছুটি তখন বুঝিলাম ব্যাপার কিছু গুরুতর।'
ব্যাপারটা গুরুতরই বটে। ১৯১২ সালের প্রথম দিকে শারীরিক অসুস্থতার জন্য বাতিল হয় রবীন্দ্রনাথের বিলেতযাত্রা। তখন আরোগ্য লাভের জন্য শিলাইদহে বসে 'গীতাঞ্জলি'-র পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু কবিতা তিনি ইংরেজিতে তরজমা করেন। পরে 'গীতাঞ্জলি' থেকে ৫৩টি এবং 'গীতিমাল্য', 'নৈবেদ্য', 'খেয়া' মিলিয়ে আরও ৯টি কাব্যগ্রন্থ থেকে মোট ১০৩টি কবিতার অনুবাদ নিয়ে তৈরি হয় ইংরেজি 'গীতাঞ্জলি' (Song Offerings)। ১৯১২-র ২৭ মে পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে নিয়ে লন্ডন যাত্রা করেন রবীন্দ্রনাথ। লন্ডন পৌঁছিয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রোদেনস্টাইনের হাতে তুলে দেন সেই পাণ্ডুলিপি। ৩০ জুন রোদেনস্টাইনের বাড়িতে এক সান্ধ্য-আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন গীতাঞ্জলি-র কিছু কিছু কবিতা। সেই পাঠ শুনে সেখানে উপস্থিত কবি ডব্লিউ. বি. ইয়েটস, চার্লস ট্রেভেলিয়ান, আর্নেস্ট রাইস মুগ্ধ হয়ে যান। পরবর্তীকালে নোবেল কমিটির কাছে বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেন ইয়েটস। ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর নোবেল কমিটি ঘোষণা করে, এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন প্রাচ্যের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
🍂
রবীন্দ্রনাথের কাছে নোবেল-প্রাপ্তির খবর এসে পৌঁছয় ১৫ নভেম্বর বিকেলে। কবি তখন তাঁর কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে কোথাও একটা বেড়াতে যাচ্ছিলেন। নোবেল-প্রাপ্তির খবর জানিয়ে কবিকে প্রথম টেলিগ্রাম করেন কবির ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই তারবার্তায় লেখা ছিল--- 'Swedish Academy awarded you nobel prize literature. Please wire acceptation.'।
এই নোবেল-প্রাপ্তির সূত্রেই তাঁর নাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তাঁর লেখাপত্র নিয়ে পাঠকদের মধ্যে উন্মাদনা দেখা দেয় এবং একের পর এক বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে শুরু করে। ফলে রয়্যালটির বেশ কিছু টাকা রবীন্দ্রনাথ পান। এ ছাড়াও শুভেচ্ছা হিসেবে দেশ-বিদেশ থেকে ব্যক্তিগত কিছু অর্থসাহায্যও আসে।
নোবেল-প্রাপ্তির ৯১ বছর পর এশিয়ার প্রথম নোবেল চুরি গেল শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবন থেকে। দিনটা ছিল ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ, বুধবার। আশ্রমের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বৃহস্পতিবার রবীন্দ্রভবনের তালা খুলতেই দেখা গেল, চুরি গিয়েছে নোবেল পদক। শুধু নোবেল পদকই নয়, সঙ্গে চুরি গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের দামী সোনার আংটি, সোনার পকেট-ঘড়ি, মৃণালিনী দেবীর প্রিয় বালুচরী শাড়ি, রুপোর রেকাবি, রুপোর কফি কাপ-সহ মোট ৩৭টি জিনিস। চুরির খবর প্রকাশ্যে আসতেই নানা মহল থেকে প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে। দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। নবনীতা দেবসেন জানালেন, 'আমি বিস্মিত, বিমূঢ়। এমন যে হতে পারে, সে তো কল্পনার বাইরে। যেখানে যে প্রতিষ্ঠানে এই জিনিস ছিল, সেখানে যে এমন তীব্র নিরাপত্তার অভাব পড়েছিল, সেখান থেকে যে কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে পারে, এ ঠিক ভেবে ওঠা যায় না।'
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, 'নোবেল চুরির কলঙ্ক আমাদের বুকে ভার হয়ে রয়েছে। কোনও উচ্চস্তরের ষড়যন্ত্র এর জন্য দায়ী বলে মনে হয়।'
বিশ্বভারতীর উপাচার্য তখন অধ্যাপক সুজিত বসু। তিনি এই নোবেল চুরির বিষয়টিকে 'জাতীয় লজ্জা' বলে আখ্যা দেন। তখনকার বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারি বিবৃতি দিয়ে জানান, 'আমরা অবশ্যই এই কালপ্রিটদের গ্রেপ্তার করে নোবেল প্রাইজ ফেরত আনব।' এহেন চুরির ঘটনার দায়িত্ব দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-কে। তদন্তের সময় দেখা গেল, চুরির সময় রবীন্দ্রভবনের পিছনের জানলার গ্রিল ভেঙে চোর ভেতরে প্রবেশ করে। চুরির রাতে গোটা 'উত্তরায়ণ' এলাকার দায়িত্বে ছিলেন মাত্র দু'জন এনডিআরএফ কর্মী।
তদন্তভার হাতে নিয়েও এশিয়ার প্রথম নোবেল চুরির কোনও সুরাহা করতে পারেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তার পরে এই বিষয়ে তদন্ত শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু তাতেও নোবেলের কোনও দিশা পাওয়া যায়নি। ঘটনার প্রায় ১২ বছর পরে চুরির বিষয়ে অগ্রগতির কথা জানায় সিবিআই। সেই তদন্ত প্রসঙ্গে 'দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া' একটি প্রতিবেদনে জানায়, নোবেল পাচারের মূল চক্রী ছিলেন বাংলাদেশের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী এবং এক ভারতীয় ব্যবসায়ী। গোয়েন্দাদের মতে, নোবেল চুরির ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল শান্তিনিকেতনের স্থানীয় লোকজন।
নোবেল চুরির পর প্রায় ২১ বছর কেটে গেছে। কেন্দ্র-রাজ্য, সিবিআই-সিআইডি--- কেউ-ই উদ্ধার করতে পারেনি এশিয়ার প্রথম নোবেল। আজকের রিলস-প্রিয় বাঙালি, ফেসবুক-প্রিয় বাঙালিও ভুলে গেল নোবেল চুরি। আদৌ কি কোনও দিন উদ্ধার হবে নোবেল! এ বছর হাঙ্গেরিয়ান লেখক লাজলো ক্রাজনাহোরকাইয়ের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খবরে যখন সবাই উচ্ছ্বসিত, তখন আমার মনে হল, যে কবি বাঙালি তথা এশিয়াকে এনে দিল প্রথম নোবেল পুরস্কার, নোবেল চুরির সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক মঞ্চের সেই স্বীকৃতির আখ্যানও বেবাক ভুলে গেল বাঙালি। এ বড়ই বেদনার।
0 Comments