ইতিহাসের ফাঁদ
পর্ব -৩
অরিজিৎ লাহিড়ী
দোতলার ছোট ফ্ল্যাটের বইয়ের ঘরটা বিকেলের ছায়া আর কৃত্রিম আলোর মিশেলে অদ্ভুত রহস্যময়। একটা কোণে দেয়ালজোড়া বইয়ের তাক। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঋতব্রতর পাঠানো হ্যান্ডনোটের প্রিন্ট আউট, কিছু পুরনো পাণ্ডুলিপি, আর দু-তিনটে ডিজিটাল প্যাড। ঘরের আলো ফিল্টারড, স্মার্টলাইটসের নীলচে ছায়া তার চোখে পড়ে।
ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা বসে আছেন, চোখে স্মার্টগ্লাস, ঠোঁটে ধরা ভেপ থেকে মিষ্টি গন্ধের ধোঁয়া ধীরে ধীরে বাতাসে মিশছে, কানে এয়ারবাড। সামনে হোলো-ডিসপ্লে স্ক্রিনে খেলা করছে হাজারো তথ্যের ঢেউ। ঋতব্রতর হাতে লেখা কিছু নোট খুলে রেখেছেন তিনি। ছেঁড়া পাতা, অগোছালো লেখা, কোথাও কাঁচা পেন্সিলের দাগ, কোথাও লাল কালি। সেইসব নোটে ফুটে উঠছে একটা স্পষ্ট সংকেত—কলিঙ্গ যুদ্ধের কোনও নির্ভরযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই, অশোকের তথাকথিত অনুতাপ ও ধর্মান্তর শুধুই পরবর্তী কালের নির্মাণ, বারবার পুনরাবৃত্তি, বারবার ঘুরে-ফিরে আসা একরকমের সিন্থেটিক স্মৃতি।
ডক্টর হাজরা ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে নিজের পুরনো গবেষণার দিকে তাকালেন। সেখানে জমে থাকা কিছু পুরনো ফিল্ড নোট, ইউনিভার্সিটির আরকাইভ থেকে কেটে রাখা পাণ্ডুলিপির অংশ, কয়েকটা পুরনো ফরাসি পত্রিকা—যেগুলোর কালি মুছে গেলেও ছাপ রেখে গেছে। তিনি জানেন, এই ইতিহাসের গায়ে ছায়া লেগে আছে বহুদিনের।
সেই ফরাসি চিন্তাধারাগুলোর প্রচারকদের, যাদের বলা হয় পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট, তারাই প্রথম বলেছিল—ইতিহাস আসলে একটানা লেখা কোনও সত্য নয়। বরং সেটা বহু স্তরের, বহু প্রতিচ্ছবির, একধরনের রিকনস্ট্রাকটেড মিথ। নীচাহ্, ফুকো, দ্যেরিদা, বোদ্রিয়া—সবাই বলেছিলেন সত্যের নামে যেটা চালানো হয়, সেটা আসলে ক্ষমতার ভাষ্য। রুলস, ক্যাটেগরিজ, রেফারেন্স—সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় ছায়া-শক্তি দ্বারা।
হাজরা নিজের মনেই ফিসফিস করে বললেন—‘ইতিহাস আসলে এক ধরনের টেক্সট, যেখানে কোনটা পেরিফেরি, কোনটা সেন্টার—সেটা কেউ জানে না। আর এই না-জানাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কন্ট্রোল।’
তিনি এবার ল্যাপটপ খুললেন। ডার্কমোডে রাখা ব্রাউজারে একের পর এক সাইট, ফোরাম, ব্লগ খুলতে লাগলেন। ডার্ক ওয়েবের একদম গভীরে নেমে গিয়ে খুঁজতে লাগলেন কিছু শব্দ—ফেক ওয়ার, হিস্ট্রি ম্যানিপুলেশন, কনস্ট্রাক্টেড মেমরি। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি থেমে গেলেন। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা নাম—জি ও ডি ( গড )।
প্রথমে মনে হল কোনও ক্রিপ্টোকারেন্সি সংক্রান্ত কিছু। তাই খানিক খুঁটিয়ে পড়লেন। আর পড়তে পড়তেই তিনি বুঝতে পারলেন, এটা কোনও অর্থনৈতিক প্রতারণা নয়। এটা একটা ছায়া-গোষ্ঠী, যার অস্তিত্বের ইঙ্গিত প্রথম পাওয়া গিয়েছিল উনিশশো ষাটের দশকে, কিছু ফরাসি পোস্ট-স্ট্রাকচারাল পত্রিকায়। গোষ্ঠীর নাম—জি ও ডি—জেনারেটর অফ ডিসেপশন।
🍂
তাদের ম্যানিফেস্টো খুব পরিষ্কার। ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, ইতিহাস—সবই তৈরি করা ন্যারেটিভ। মানবসভ্যতার প্রতিটি বড় ঘটনা, প্রতিটি বিপ্লব, প্রতিটি ধর্মান্তর, প্রতিটি যুদ্ধ, এমনকি যে সব ঘটনাকে স্বতঃস্ফূর্ত মনে হয়, সেগুলিও এই গোষ্ঠীর ডিজাইন করা। তাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য একটি ধর্মহীন, জাতিহীন, নিরস্ত্র পৃথিবী তৈরি করা। সমস্ত মিথ্যা ইতিহাসকে উন্মোচিত করে, সমস্ত সাংস্কৃতিক ধাপ্পাবাজিকে ফাঁস করে দিয়ে তারা এমন এক পৃথিবী চায় যেখানে মানুষ কেবল মানুষ হবে—কোনও পরিচয় থাকবে না, কোনও বিশ্বাস থাকবে না।
তাদের দর্শন কোথাও যেন ব্যদ্রিয়ার সিম্যুলাক্রা, দ্যেরিদার ডিফারাঁস আর ফুকোর ডিসকোর্স থিওরির গভীর ছায়ায় দাঁড়িয়ে। তাদের কাছে সত্য বলে কিছু নেই—আছে কেবল পরস্পরবিরোধী প্রতীক, ছায়া আর ভাঙ্গা আয়না।
হাজরার চোখ স্থির। স্মার্টগ্লাসে প্রতিফলিত হচ্ছে স্ক্রিনের আলো। তিনি ফিসফিস করে বললেন—‘ভিলেন নয়... এরা খেলোয়াড়।’
হঠাৎ তাঁর স্ক্রিনে খুলে গেল একটা ব্ল্যাক আউট পেজ। ওপরে লেখা—ওয়েলকাম টু দ্য প্যাটার্ন। ইউ আর বিইং ওয়াচড। একটা খালি ঘর। মাঝখানে একটা লেখা—কন্ট্যাক্ট দ্য প্যাটার্ন। হাজরা থামলেন না। নিজের আঙুলে টোকা দিলেন। ফর্ম খুলে গেল। কোড ভাষায় একটা প্রশ্ন। তিনি টাইপ করলেন—আমি জানি ইতিহাসের ভুলটা কোথায়। আমি তোমাদের খুঁজছি।
সাবমিট করতেই স্ক্রিন নিভে গেল। শুধু একটা লাইন ভেসে রইল—যদি তুমি দেখছ, তবে আমরাও তোমায় দেখছি।
হাজরা পিছিয়ে এলেন। এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করলেন। তারপর ধীরে ধীরে হাসলেন। ঠাণ্ডা, নির্মম, নির্ভুল। তাঁর মুখে কোনও আতঙ্ক নেই। বরং একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। তিনি জানেন, এটা বিপজ্জনক। তিনি জানেন, যে খেলায় পা রাখলেন, তার শেষ হয় না। তবু তিনি থামলেন না। কারণ এতক্ষণে তিনি স্পষ্ট বুঝেছেন—ঋতব্রতর এই রহস্যে জড়িয়ে পড়াটা মোটেই কাকতালীয় নয়। ওকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কারা বেছে নিয়েছে, কেন বেছে নিয়েছে, সেটা জানার সময় এসেছে।
‘ভুল মানুষকে বেছেছো ভাই,’—তিনি ফিসফিস করে বললেন—‘খেলা হবেনা গুরু।আমি খেলব না, আমি ফাটিয়ে দেব।’
টেবিলে রাখা পুরনো চিঠিটার দিকে তাকালেন। চোখের কোণায় সেই অদ্ভুত আলো। হাসলেন। নিজের মনেই বললেন—‘এবার দেখা হবে।’
সেই মুহূর্তে তাঁর ফোন বেজে উঠল। ডিসপ্লেতে নাম—ঋতব্রত। হাজরা ভেপের ধোঁয়া ছেড়ে ঠাণ্ডা গলায় ফোনটা ধরলেন।
—‘বল ঋতব্রত।’
ওপাশ থেকে অনিশ্চিত কণ্ঠ—‘স্যার... একটা কথা বলার ছিল। একটু দেখা করতে পারি?’
হাজরা নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর গলায় শীতল তীক্ষ্ণতা।
—‘অবশ্যই। কাল সকালে চলে এস।’
হেমাঙ্গ ফোনটা রেখে দিলেন। তারপর হাসলেন। ঠোঁটের কোণে প্রায় অদৃশ্য এক রেখা।
কিন্তু যেটা তিনি জানলেন না—ঋতব্রতের এই ফোন কলটা আরও কেউ কেউ শুনছিল। কোথায়, কারা, কীভাবে—তা কেউ জানে না। শুধু একটা সফট গ্লিচ শব্দের মতো অদৃশ্য কোড ভাসছিল বাতাসে।
1 Comments
Fantasystic!!!
ReplyDelete