জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /কমলিকা ভট্টাচার্য

গুচ্ছ কবিতা 

কমলিকা ভট্টাচার্য


কাশফুল

শরতের আকাশে প্রথম সাদা নদীর ঢেউ—
কাশফুল দুলে ওঠে নীরব ঢাকের শব্দে,
পথে পথে জানায়—ফেরার ঋতু এসে গেছে।

মা দুগ্গা প্রতি বছর বাপের বাড়ি আসে,
তবু কত দুগ্গা-হৃদয়ই বা সত্যি
ফিরতে পারে শৈশবের উঠোনে?
সতীর মতোই তাদের পথের শেষে পড়ে থাকে খন্ডিত মনদেহ—
স্বাগতমেই শুরু হয় বিদায়ের গণনা।

কাশের সাদা শিরাগুলো দূর থেকে যেন
অপরূপ মেঘের হাসি;
কাছে গেলে বোঝা যায়—
ওরা শিউলি-পড়া আঙিনার
নিঃশব্দ সাদা শোক।

আমাদের পুজো-পার্বণের গল্পেও
আগেভাগেই বাঁধা থাকে বিসর্জনের মন্ত্র:
অভ্যর্থনার মিঠে ধ্বনি,
আদরের আড়ালে ধুনোর গন্ধে লুকোনো বিদায়,
শেষ দৃশ্যের জন্য অপেক্ষায় থাকা জলের বাঁধন।

বাপের বাড়ির উঠোনে ফেরার টান জাগে মনে,
তবু কাশফুলের নরম ঢেউ মনে করিয়ে দেয়—
এই সাদা রঙই হলো অদেখা বিদায়ের ছায়া।

দুগ্গা হোক কিংবা সতী—
বহু নারীর কাহিনিই শেষে মিশে যায় একই জলে:
বাপের বাড়ি ফেরার আনন্দের বুকের ভেতরেই
বিসর্জনের অক্ষর আগে থেকেই লেখা থাকে,
যেমন শরতের নদী কোনোদিনই
ধরে রাখতে পারে না
কাশফুলের উড়ে যাওয়া বীজ।



শেকড়ের উপাখ্যান


কবিতার পাতা ঝরে গেছে,
মর্মর শব্দে হেঁটে যাওয়া সময়,
শুকনো ডালপালা মেলে দাঁড়ানো গাছটা
ভেতরে ভেতরে লুকিয়ে রাখে
অদৃশ্য সবুজের শ্বাস।

স্বপ্ন বোনা সেই পাখিটা
ঘর ফেলে উড়ে গেছে উষ্ণতার খোঁজে,
আকাশের খোলা দরজায় তার
স্বাধীনতার প্রতিধ্বনি বাজে।
গাছ পারে না উড়তে—
মাটির বাঁধনে শেকড়েরা
রক্তের মতো ছড়িয়ে থাকে অন্ধকারে।

তবু গাছই তো শেখায়—
বিচ্ছেদের ভেতরেও থাকে জন্মের বীজ,
শূন্যতার বুকেও একদিন
বৃষ্টি নামে অব্যক্ত গান হয়ে।

ঝরা পাতারা শুধু প্রমাণ রাখে,
সব বিদায়ই আসলে অনন্তের প্রস্তাবনা—
আর দাঁড়িয়ে থাকা সেই গাছ
সময়কে শিখিয়ে যায়
অচল থেকেও কেমন করে
আকাশের দিকে বাড়ানো যায় হাত।

🍂

আবদার

একটু সময় আমার জন্য রেখো,
যে সময়টুকু আমার—
তার মহুর্তটুকুও ভাগ করতে পারি না।

অনেক অন্যায় দাবি করে বসি,
কাণ্ডজ্ঞানহীন, একলসেঁড়ের মতো।
কিন্তু কী করি—
আমার কাছের সেই সময়টুকু
অনেক কান্নার বিনিময়ে কেনা।

তাই উদারতার বিলাসিতা করতে পারি না।
তুমি যাই ভাবো আমাকে,
তোমার জন্য আমি
সব দোষের ভাগী হতে ভয় পাই না।

সব সহ্য হয়,
কিন্তু তোমার অবজ্ঞা
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়।

নিজের থেকে পালাতে পারলেও
ভালোবাসার সত্যি থেকে পালাতে পারি না।

অবুঝ আবদারগুলো
আমার মাথা খায়...


কিছু না চেয়ে


কিছু না চেয়েও তুমি নিয়ে যাও সব,
আমার দুঃখের ছায়া,
কান্নায় ভেজা শব্দ,
আনন্দের হালকা রোদ্দুর,
হাসির ছোট ছোট রঙিন পাখি—
সবই গোপনে উড়ে যায় তোমার কাছে।

শূন্য করে দিই ভিতরের প্রতিটি কক্ষ,
পড়ে থাকে প্রসব-যন্ত্রণায় ভূমিষ্ঠ
এক অনন্য সুখ অনুভূতি।

আয়নায় দেখি—এক টুকরো অবয়ব দাঁড়িয়ে,
চোখ দুটো অপরিচিত নদী,
যেখানে আমি নেই,
ভেসে গেছে আবেগের সমস্ত নৌকো
তোমার স্রোতে।

ছোঁয়া—আজ এক চাতকের তৃষ্ণা,
আকাশ আছে, বৃষ্টি নেই;
হাত বাড়াই, মুঠোয় ভরি
তোমায় ছোঁয়া বাতাস,
অন্তরে ধুকপুকানির অমিল ছন্দ।

তবু তোমার অদৃশ্য টানেই
আমি আমার সমস্ত ভাঙা-গড়ার ভিতরেও
নিজেকে ভুলে থাকি।

অবয়ব পড়ে থাকে আয়নার কোল ঘেঁষে,
আর আমি অদেখা কোনো তরঙ্গপথে
তোমাতেই সমর্পিত হয়ে
মিলিয়ে যাই।


অন্তর-বৃষ্টি

কাল সারারাত ঝরেছে বৃষ্টি,
অঝোর ধারায় ভিজেছে শহর।
ঝকমকে রাস্তায় ডুবেছে আলো,
কিন্তু আমার অন্তর-বৃষ্টি—
কিছুই ভিজিয়ে তোলে না,
বরং শুকিয়ে যায় মনের প্রান্তর।

তোমার চুম্বন—
আমার সিক্ত মরুদ্যান।
তোমার আলিঙ্গন—
আমার ক্লান্ত মরুছায়া।
তোমার স্পর্শ—
আমার ভরা চোখের কোণে
স্নিগ্ধ হাসি ভরা ঠোঁট।

শহরের মতো আমিও ডুবতে চাই—
তবে অন্তর-বৃষ্টিতে নয়,
শুধু তোমার গভীর দৃষ্টিতে
তোমাকে চেয়ে।

Post a Comment

0 Comments