বলাগড়ের রোদ বৃষ্টির খাতা
অয়ন মুখোপাধ্যায়
আনন্দময়ীর ছায়া
গঙ্গার ধার ঘেঁষে, অচেনা একটা বাঁকে, যেখানে নদী হঠাৎ প্রশস্ত হয়ে শান্ত হয়ে গেছে সেই সবুজ দ্বীপের কাছে সোমড়া। সুখোরিয়া গ্রামে আজও, দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা এক লাল ইঁটের মন্দির। দূর থেকে দেখতে লাগে—আধখাওয়া দুর্গ যেন, অর্ধেক ইতিহাস। কাছে গেলে বোঝা যায়, এ শুধু ইট-চুন-সুরকি নয়; এ খোলা আকাশের নীচে মানুষের ভিতরকার লুকোনো কাহিনি—ভক্তির, প্রেমের, দোটানার, আর এক অদ্ভুত আকালের গল্প। লোকজন একে বলে রাধাগোবিন্দের মন্দির, কেউ কেউ আবার আনন্দময়ীর মন্দির ও বলে। নাম বদলে গেলে কি অর্থ বদলায়? অর্থ তো মাটির মতো—ছুঁলে অন্য রূপ, জলে পড়লে অন্য ছাপ।
এই মন্দির গড়েছিলেন মিত্র মুস্তাফি—বংশের রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফি। ব্যবসা, জমিদারি, লেনদেন—সবকিছুর খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে। দিনের আলোয় খাতা-কলম, রাতের অন্ধকারে হিসেবের যোগ-বিয়োগ। কিন্তু জীবনের এক জায়গায় এসে অঙ্কের নিয়ম ভাঙতে শুরু করল। লাভ-ক্ষতির সোজা রেখায় হঠাৎ একটা বেঁকে যাওয়া বাঁক। সেই বাঁক থেকেই সোমড়া সুখড়িয়া তে এই মন্দিরের জন্ম।
শরতের বাতাসে কাশফুল যখন গঙ্গার ধারে সাদা মেঘের মতো দুলছে, সেই দিন গ্রামে কীর্তন বসেছিল। রামেশ্বর তখন বৈষ্ণব পদাবলীর ভাঙা ভাঙা সুর শুনছিলেন দূর থেকে। সেই সুরের ভিতরে এক নারীর গলার আওয়াজ এমনভাবে বুকের মধ্যে কি বিধলো যে, রামেশ্বর সোজা চলে গেলেন মঞ্চের সামনে গ্যাস বাতির আলোয় হিরণ্ময়ী গান ধরল—“গোবিন্দ বলো, গোপাল বলো…”। বিধবা, কপালে সিঁদুর নেই, গলায় বিষন্নতার আর্তি। কণ্ঠস্বর যেন একসঙ্গে মাটি আর আকাশ। সেই কণ্ঠ শুনে রামেশ্বরের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল, তিনি বুঝতে ও পারলেন না।ভক্তি আর আসক্তির মধ্যে যে সুখ্য রেখা থাকে সেদিন থেকে হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে স্ত্রী প্রভাময়ীর চোখ এড়াতে পারলেন না তিনি। প্রভাময়ী দেবরদের পড়ালেখা দেখেন, ভোরে তুলসীতে জল দেন, দুপুরে ভাতের সঙ্গে যেমন টক ঝাল মাপেনা—তেমনি স্বামীর মুখের নীরবতার নুন-মরিচটা আঁচ করতে পারেন। সেদিন রাত্তিরে তিনি ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রামেশ্বর কে “তুমি ঈশ্বর খুঁজছো, না কি কারও চোখের ভিতর দিয়ে পালানোর পথ?” প্রশ্নটা ছিল নরম, তবু তীক্ষ্ণ। রামেশ্বর নির্বাক। জানলার বাইরে গঙ্গার জলে চাঁদের ছায়া ভেঙে ভেঙে পড়ছে; বাতাসে কদমফুলের গন্ধ। তিনি কি বলবেন?—‘দুটোই’?
🍂
এর পরের কয়েকমাসে আশপাশের জমি কিনে নেওয়া হলো। বর্ষার জল নামতেই পুকুর খোঁড়া শুরু। নাম দেওয়া হলো—আনন্দময়ী দীঘি। নাম শুনে গ্রামবাসীরা মুচকি হাসল—আনন্দ কি এভাবে নাম দিয়ে ডাকা যায়? পাশাপাশি উঠল লাল ইটের মন্দির, আকাশছোঁয়া চূড়া। সিংহদ্বারে টেরাকোটার কাজ, কড়িকাঠের গন্ধে মিশে শালগাছের নিঃশ্বাস। বাড়ির নাম দিলেন শান্তিকুঞ্জ। নামের ভিতরে নাম—বাইরে শান্তি, ভেতরে কুঞ্জ, যেখানে গোপনে জন্ম নিচ্ছিল নতুন এক অস্থিরতা।
সেই সময় গ্রামে এলেন এক বৈষ্ণব সাধু, ভবানীচরণ দাস। তাঁর গলায় ছেঁড়া কণ্ঠ, চুলে মেঘ, চোখে দীর্ঘ পথের বিষাদ। দুপুরবেলায় রামেশ্বর তাঁকে ডেকে নিভৃতে বললেন, “মন শান্ত হয় না।” সাধু একটু চুপ করে থেকে বললেন, “ভক্তির রাজ্য গড়ো। কিন্তু মনে রেখো, ভেতরের আগুন যদি নেভাতে না পারো, রাজ্য টিকবে না।” কথাটা ভবিষ্যদ্বাণীর মতো কানে আটকে রইল। ভেতরের আগুন—এটা কী? হিরণ্ময়ীর চোখ? না ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে না-পারার আক্রোশ?
মন্দির ঘিরে যখন চুন-সুরকির ধুলো উড়ছে, সন্ধের পর রামেশ্বর একা বসে থাকতেন দীঘির ধারে। সন্ধ্যের আকাশে কত পাখি উড়ে যাচ্ছে জল নড়ে উঠছে, কচুরিপানায় কেঁচোর মতো চাঁদের আলো পিছলে পড়ে। সেইরকম একদিন রামেশ্বর দেখলেন বজ্রপাতের আঘাতে ছিঁড়ে যাচ্ছে আকাশ । সেই জ্যোৎস্নামিশ্রিত অন্ধকারে তিনি দেখলেন—জলের ভিতর থেকে ভেসে উঠেছে দুটি প্রতিচ্ছবি। একটায় রাধা, আরেকটায় গোবিন্দ। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে রাধার মুখ বদলে গেল—হিরণ্ময়ী। চোখে আলো, ঠোঁটে সুর, তবু নীচে জলের গভীর থেকে উঠে আসছে একটা দীর্ঘশ্বাস। তিনি হাত বাড়ালেন—জল কেঁপে উঠল, প্রতিচ্ছবিটা টলে গেল, আর সেই টাল সামলাতে না পেরে তিনি নিজেই কেঁপে উঠলেন। রামেশ্বর বললেন “তুমি দেবী নও,, “তুমি আমার তৃষ্ণা।” কথাটা বলা মাত্রই রামেশ্বর চমকে উঠলেন এই কথাটা কাকে বললাম আয়নাকে, জলকে, ঈশ্বরকে, না নিজের বুকের গহ্বরকে—তিনি জানলেন না। পরদিন ভোরবেলায় তাঁকে পাওয়া গেল মন্দিরের দোতলায় শুয়ে; ভেজা ধুতি গা ছেড়ে নেমে এসেছে, হাতে ধরা ঘণ্টা থেমে গেছে, ঠোঁটে এখনও একটা সাদামাটার মতো হাসি।
এই ঘটনার পরে গ্রামের কথায় কথায় লোককথা কলম ধরা শুরু করল। কেউ বলল, রামেশ্বর মৃন্ময় দেবতার চোখে চিরতরে সুখ খুঁজে পেলেন। কেউ বলল, হিরণ্ময়ীর ছায়া তাঁকে টেনে নিয়েছে। আর খাস গলির কাঙাল বুড়িরা বলল, “দেখেছেন তো? ভক্তি আর প্রেম একটাই খাতা—পাতা উল্টালেই বিষয় বদলে যায়।”
বছরের পর বছর গড়িয়ে গেল। জমিদারি ভাঙল, খাজনা-খতিয়ানের অক্ষর ঝড়ে উড়ে গেল। মন্দিরে রোজ পুজো হয় আলো পড়ে, রোজ ধুলো জমে। শ্যাওলার গায়ে শালিক বসে কিচিরমিচির করে। তবু অনেক মানুষজন আজও মন্দিরে ঢুকলে কোথাও একটা অদৃশ্য ঘণ্টার শব্দ শুনতে পায়, যেন দূর আটপৌরে গ্রামের দুপুরের কুয়ো থেকে জল তুলতে গেলে ঢ্যাঙা বালতির হঠাৎ লোহার গায়ে ঠুকে উঠলে—যে লম্বা, তীক্ষ্ণ, মৃদু আওয়াজ পাওয়া যায় ঠিক তার মতন ।অনেকে আবার বলেন একবার নাকি রানী রাসমনির সাথে রামকৃষ্ণ নিজে এসেছিলেন এই গ্রামে এই মন্দিরে ;দেখতে প্রণাম করেছিলেন, মূর্তির সামনে আরো কেউ কেউ বলে এই মন্দিরটা দেখে রানী রাসমনির এত ভালো লেগেছিল যে তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির এই মন্দিরের আদলেই তৈরি করেছিলেন।। কে জানে সত্যি, নাকি গল্প ।
কেউ কেউ বলেন রামকৃষ্ণ এই মন্দিরের পাশ দিয়ে নদী পথে গিয়েছিলে কিন্তু মন্দিরে আসেননি, সত্যিটা আজও জানা যায় না। কিন্তু কিংবদন্তি থাকলে মন্দিরের গায়ে যে একটা স্পন্দন থাকে; আজও ওখানে দাঁড়ালে বোঝা যায় ।মন্দিরের গায়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করলে এই স্পন্দন , কিন্তু হাড়ের ভেতরে বয়ে যায়।
এর অনেক অনেক বছর পর এমন এক সন্ধ্যায় যখন গঙ্গার বাতাসে জিরে-ভাজা পেঁয়াজের গন্ধ ভেসে আসছে, হঠাৎ হই হই করে সুখোরিয়া গ্রামে ঢুকে পড়ল শহরের এক দল মানুষ। বহু গাড়ি, তার ওপর বাঁধা লাইট, কাঁধে বড় বড় বাক্স, হাতে কাগজ, মুখে ব্যস্ততার রেখা। এসে গেলেন মৃণাল সেন। শুটিং হবে আকালের সন্ধান—দুর্ভিক্ষের গল্প। লোকজন প্রথমে ভাবল, সে আবার কি কিভাবে হবে এই অঞ্চলে তো দুর্ভিক্ষ নেই পরক্ষণেই বুঝল, এটা সিনেমা হ। সিনেমা মানে নতুন গল্প, শুরু হলো গ্রামের লোকেদের কাঁচা কাহিনিতে আলোর ঝলকানি।
মন্দিরের সিঁড়িতে লম্বা লম্বা লাইট, ক্যমেরা । সকলের সামনে মুম্বাই সিনেমার নায়িকা স্মিতা পাতিল টালিগঞ্জের দীপঙ্কর দে বিপ্লব চ্যাটার্জী ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় শ্রীলা মজুমদার এদের দেখতে গ্রাম এর পর গ্রাম ঝাঁপিয়ে পড়ল ।
সাদা শাড়ি পরে একজন অভিনেত্রী দাঁড়ালেন, চোখে যেন বহু বছরের খিদে দৃশ্য শুরু, ক্যামেরা ঘুরছে। হঠাৎ লাইটম্যান চেঁচিয়ে উঠল—“স্যার, ঘণ্টা বাজছে!” সবাই থমকে গেল। কানে কানে, হাল্কা, তবু আকস্মিক। মন্দিরের ভেতর ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই তবু নরম এক টুং টুং শব্দ, মৃণালবাবু স্থির হয়ে, চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন। হাসলেন হাল্কা। “এটাই চাই। যখন সময়ের ভেতরে আরেকটা সময় ঢুকে পড়ে, তখনই সিনেমা সত্যি হয়।” তাঁর কথা শুনে কেউ কেউ কেঁপে উঠল, কেউ মুচকি হাসল,।
শ্যুটিং চলল তিন দিন। ঠান্ডা সকালের কুয়াশায় গঙ্গার স্রোত, দুপুরে ধুলো, বিকেলে কাকডাকা ভোর। তৃতীয় রাত্তিরে, শ্যুটের শেষে, ইউনিটের তিনজন ক্যামেরাম্যান রাস প্রিন্ট ঘাঁটছিল। স্ক্রিনে সাদা-কালো দৃশ্য, অভিনেত্রীর চোখে জল, বাতাসে উড়ে যাওয়া শাড়ি। এ-সময় ক্যামেরাম্যান অরুণ বলে উঠল—“পজ করো!” স্ক্রিনে ফ্রেম স্থির। মন্দিরের গরাদের ছায়া কৌণিক হয়ে পড়েছে মেঝেতে। ছায়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। ধুতি ভিজে, হাতে ঘণ্টা, মুখে পরিচিত একটা সাদামাটার মতো হাসি। “কে?”—বুকের ভিতর থেকে একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন বেরিয়ে এল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বোঝা গেল—চোখ দুটি ক্লান্ত, তবু জেগে আছে। অরুণের আঙ্গুল থরথর করছে। মৃণাল সেনের দিকে তাকিয়ে বলল “আমি কিছুই ফ্রেমে নিইনি ওভাবে,” কিভাবে এসব এল“ক্যামেরা কি কখনও নিজে থেকে ছবি তোলে?”
গ্রামের বৃদ্ধ হরিপদ, যে তিন রাত ধরে শ্যুটিং দেখতে এসে কোণে বসে থাকত, পানের রস গিলে গিলে বলল, “ওই রামেশ্বর। উনি আছেন। ভোরে ঘণ্টা শুনি মাঝে মাঝে। কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু আপনারা ফ্রেমে নিয়েছেন—তাই ভাবছিলাম, সিনেমা তো সত্যিই ফ্রেমে ভর করে; ফ্রেম কখনও কখনও নিজের ভিতরেরও ছবি তোলে।”
এই ঘটনা ইউনিটের ভিতরে চাপা রইল। কেউ কাগজে লিখল না, কেউ শহরে গিয়ে গল্প করল না। কারণ শহরের লোক হাসবে বিশ্বাস করবে না। “ শুটিংয়ের লোকজন ভাবলো লং শর্ট মিড লং শট কাট”—এমনসব ইংরেজি শব্দের ভিতর লুকিয়ে যাবে সেই চমক। কিন্তু সুখরিয়া গ্রামে থেকে পাশাপাশি সমস্ত গ্রামে সে রাতেই খবর ছড়িয়ে পড়ল—“ক্যামেরায় কি যেনো একটা ধরা পড়েছে।”তার কিছুদিন পর শুটিং শেষ প্যাক আপ।
সিনেমা বেরোল। নাম, আকালের সন্ধান। শহরের হলঘরে মানুষ লাইন দিল। পুরস্কার এরপর পুরস্কার মানুষ দেখল নতুন ধারার একটা সিনেমা পর্দায় দুর্ভিক্ষ—মৃত শস্য, ঘুঘুর ডাক, খালি হাঁড়ি। দর্শকের বুক কেঁপে উঠল। নীরবতায় ভিজল চোখের জলে। সে এক অন্য গল্প ।
কিন্তু ক্যামেরায় ধরা পড়া ছায়ার গল্প এখনো গ্রামের পুরনো মানুষদের মধ্যে ফিসফিস আলোচনা হয় কেউ কেউ দেখে সন্ধের পর লাল ইটের গায়ে চাঁদের আলো ,পড়লে —মন্দিরের ভিতর হাঁটার শব্দ। জুতোর শব্দ হয় না, শুধু ধবধবে ধুতি, ভেজা বাঁক, আর হাতে ঘণ্টা—যেন কোনো অস্তিত্বের আঙুলে সূক্ষ্ম রুপোর ঘড়ি। সে কি রামেশ্বর? নাকি হিরণ্ময়ীর কণ্ঠস্বরের ছায়া? নাকি সেই ভক্ত, যিনি একদিন রামকৃষ্ণকে এই মন্দিরে দেখেছিলেন? নাকি রামকৃষ্ণ নিজেই, খঞ্জনি তালে দুলে উঠছেন?
আনন্দময়ী মন্দির
প্রভাময়ী তখন বেঁচে নেই। তাঁর বোনঝি মাঝে মাঝে এসে দীঘির ধারে বসত হাতের পাতায় তেলতেলে পুরোনো আলতা শুকোয়। বলে, “কাকিমা বলতেন, মানুষকে একসঙ্গে দু’জায়গায় রাখা যায় না। এক উঠোনে ভক্তি, অন্য উঠোনে প্রেম—তবু মানুষ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’দিকেই তাকিয়ে থাকে।” এই কথায় কতটা তিক্ততা, কতটা সমবেদনা আছে—বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু শুনলেই মনে হয়, শান্তিকুঞ্জ নামটা কতটা নিপাট ব্যঙ্গ—শান্তি আছে কি? কুঞ্জ আছে। হাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে পাতা, পাতার ভিতর মড়মড়ে শিরা, শিরার নিচে জল।
রামকৃষ্ণের কথাটাও লোকমুখে ঘুরে বেড়ায়। কেউ দেখেছে বলে, কেউ শুনেছে বলে। কেউ মন্দিরের পোড়া দেওয়ালে হাত রেখে বলে, “এইখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।” হাতের তালুতে শ্যাওলার স্যাতসেঁতে স্পর্শ। মনে হয়, ওই স্যাতসেঁতে—কি যেন একটা শব্দ, যে শব্দ চিনলে কানের ভিতরে বাজে দূর-ঘণ্টা। বলা যায় না, লেখা যায় না। শুধু বোঝা যায়—এই মন্দিরের শরীরের ভিতর অনেকগুলো সময় থরে থরে জমে আছে; হালকা ঠেলায় গড়িয়ে পড়ে কারও কাঁধে।
এরই মধ্যে এক উৎসুক সাংবাদিক আসে। নোটবুকে লিখে, “আনন্দময়ী দীঘি—এই নামকরণ কি কেবল বিশ্বাসের ভাষা?” পাশ থেকে এক স্কুলশিক্ষক বলে ওঠেন, “আনন্দ তো জল নয় যে দু’বালতি ভরে নেওয়া যায়। কিন্তু নাম দিলে মানুষ মনে রাখে—এখানে কেউ আনন্দ খুঁজেছিল।” সাংবাদিক হাসে। “কেউ?” শিক্ষকের কণ্ঠে উত্তর—“সবাই।” উত্তরটা প্রথমে ভাসা ভাসা, তারপর ভারি—শিক্ষক বলতে থাকলেন আসলে আনন্দের খোঁজ সকলেই করে কেউ তার সন্ধান পায় কেউ তার পায় না কিন্তু সন্ধান চলতেই থাকে চলতেই থাকে। আনন্দের খোঁজ করাটাই তো জীবনের একটা উদ্দেশ্য কেউ ঘন্টা হাতে খোঁজে কেউ কলম হাতে।
শীত পড়ে। কুয়াশার ভিতর মন্দিরের শিখর একরকম লুকোচুরি খেলে। দুপুরবেলায় পাঁচিলে হেলে পড়ে রোদ মন্দিরের চাতালে বাচ্চারা খেলা করে। তারা ঘণ্টার কথা জানে না; তাদের কাছে ঘণ্টা শুধু পুজোর সময়ের শব্দ। যে পুরোনো প্রহরী ভোরে দরজা খুলে, সে জানে। সে কখনও কখনও চাবি ঢোকানোর আগেই ভিতর থেকে একটা ঝিরঝির শব্দ শুনতে পায়। বলে না—কারণ বললে লোক হাসবে। প্রহরীর হাসির ভয় নেই, তবু কিছু কিছু কথা বললে ফিকে হয়ে যায়—তাই সে চুপ করে। কখনও কখনও, কেউ একা হলে, সে ফিসফিস করে বলে—“বাবু, এভাবে থাকবেন না, ঠান্ডা লাগবে।” কে বাবু? প্রশ্নের উত্তর দেয় না। প্রশ্নেরা কখনও কখনও ঘণ্টার ভিতরে বাসা বাঁধে, আর ঘণ্টা বাজলে তারা আলগা হয়ে বাতাসে উড়ে যায়।
মৃণালবাবুর সিনেমা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস হয়ে গেল। তার সাথে এই মন্দির জমিদার বাড়ি যেন আরেক ইতিহাসের ছায়া হয়ে রইল, যা একা দাঁড়িয়ে থেকেও বহুজনের ভেতরে বাস করে। শহরে কলেজপড়ুয়া এক ছেলেমেয়ে একদিন ট্রেনে চেপে এসে এই মন্দির দেখতে গিয়ে ফিরে বলল, “কী সুন্দর ভাঙা।” ভাঙার সৌন্দর্যও আছে—যেখানে অবশিষ্ট অংশে অনুপস্থিতির আঁচড় পড়ে, আর সেই আঁচড় ঠিক যতটা লম্বা হয়, ঠিক ততটাই কেমন এক প্রকৃতির শ্বাস-প্রশ্বাস শোনা যায়।
হিরণ্ময়ী কোথায় গেল? কেউ জানে না। সে কি অন্য গ্রামে গিয়ে নতুন করে জীবন বানিয়েছিল? নাকি বিসর্জনের স্রোতে মিশে গিয়েছিল? লোককথা বলে, একদিন রাতে আনন্দময়ী দীঘির ধারে এক একজন মহিলা গান গাইছিল—“মন রে, কৃষ্ণ নাম রে…”। গানের ভিতরে জল পড়ার শব্দ মিশে ছিল। কে শুনেছিল? যারা শুনেছিল তাদের নাম আর কেউ জিজ্ঞেস করে নাকেউ । শোনার কাজটা সব আচার বিচারের বাইরে।
আর রামেশ্বর? তাঁর নামটাও আস্তে আস্তে দেয়ালের শ্যাওলার মতো ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তবু, কিছু নাম ফিকে হয়ে যাওয়াই তাদের টিকে থাকা। যত কম উচ্চারিত, হয় তত তারা বেশিদিন বেঁচে থাকে ইতিহাসের নিয়মই এই কিছু রামেশ্বর ?রামেশ্বর কি শান্তি পেলেন? শান্তি কি পাওয়ার জিনিস? না কি ঠিকানা-ছাড়া হাঁটা? একদিন দুপুরে গ্রামের চা-দোকানের আড্ডায় আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “ওই যে, রামেশ্বর—উনি কি শেষে ঈশ্বর পেলেন?” চা-ওয়ালা লোকটা, যে আমার দিকে এক চামচ চিনি বাড়াচ্ছিল, হাসল—“দাদা, ঈশ্বর পাওয়ার কি আলাদা রসিদ থাকে? ঘণ্টা বাজে, মানুষ শোনে—এই তো। কার রসিদ কার কাছে?” উত্তর শুনে আর কিছু বলিনি। চা খেতে খেতে দূরে তাকিয়ে ছিলাম—মন্দিরের গা বেয়ে একটি শালিক নামছে, নেমেই উড়ে গেল। উড়ে যাওয়ার সেই মুহূর্তটা বড় সুন্দর—যেন ইটের শরীরের ভিতর থেকে উঠে আসছে একটা স্বচ্ছ নিশ্বাস।
সন্ধে নামলেই গঙ্গার জল ধূসর হয়ে যায়, আর মন্দিরের মাথার ওপর দিয়ে কালো পাখিরা চলে যায় বাড়ি। দূরে মাঠের থেকে গান ভেসে আসে । মন্দিরের দরজা বন্ধ করে পুরুত মশাই বাড়ির দিকে হাঁটেন—পায়ের শব্দ শুকনো পাতায় আলগা কোলাজ। একটু পরে আবার শোনা যায়—মৃদু, নিজস্ব, নির্জন—ঘণ্টার ধ্বনি। কে বাজায়? কোথা থেকে আসে? প্রশ্নগুলো বাতাসে উড়ে বেড়ায়, আর আমি বুঝি—মানুষের ভেতরে যে আকাল, সেই আকালকে ঢাকতে কেউ কেউ ঘণ্টা বাজায়, কেউ কেউ সিনেমা বানায়, কেউ কেউ গল্প লেখে। তিনটেই একই কাজ—শব্দ দিয়ে শূন্যতায় স্পর্শ।
মন্দিরে ঢুকে যদি আপনি দাঁড়ান, নাকে যদি ধূপের গন্ধ না লাগে আপনি নিশ্চয়ই টের পাবেন—পায়ের নিচের মাটি একটু নরম। নরম মাটির মধ্যে মানুষের পদচিহ্ন সহজে বসে। রামকৃষ্ণ এসেছিলেন কি না—তর্ক শেষ হয় না; কিন্তু তর্কের প্রয়োজনও কোথায়? কিংবদন্তির কাজ হলো একটি মন্দিরের ভিতরে প্রার্থনার জায়গা তৈরি করা। ঠিক যেমন—হিরণ্ময়ী ও প্রভাময়ীর নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করলে তিক্ততা ও কোমলতা মিলেমিশে যায়; ঠিক যেমন—রামেশ্বরকে ব্যবসায়ী বললে তাঁর হাতে কলম আসে, ভক্ত বললে ঘণ্টা; দুইয়ের মাঝখানে তিনি মানুষ—এটাই যথেষ্ট। তবু আমরা নাম চাই, পরিচয় চাই, ইতিহাস চাই। কারণ আমরা গল্পের শেষে একটা নিশ্চয়তা চাই। আর গল্পের কাজ হলো—নিশ্চয়তার ঠিক আগে, আমাদের কান ঘেঁষে, একবার মৃদু ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া।
রাত যত গভীর হয়, আনন্দময়ী দীঘির জল তত কালো হয়। সেই কালোই নাকি সবচেয়ে সত্যি আয়না—নিজের ভেতরটা সেখানে স্পষ্ট দেখা যায়। বহু বছর আগে রামেশ্বর যে রাতের ঝড়ে নিজের মুখের ভিতর প্রেম আর ভক্তির দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন—সেই দৃশ্য নাকি জল আজও মনে রেখেছে। জল মনে রাখে; মাটিও। মানুষ ভুলে যায়, সিনেমার ফ্রেম পুড়ে যায়, কাগজে ছাপে, কাগজ হলুদ হয়। তবু, কোথাও, কোনো গূঢ় ঘন্টার ভিতরে, একটা কম্পন থেকে যায়—যা এই মন্দিরের প্রাণ।
আমি যখন শেষবার এই মন্দিরে গিয়েছিলাম, গরম পড়েছে, আকাশে ধুলো। দুপুরের একেবারে মোটা আলোয় লাল ইটগুলো এমন চকচক করছিল যে, চোখ কুঁচকে গেল। সিঁড়িতে বসে একটা বউ শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে। সে মুখ তুলে একবার তাকিয়ে হাসল—“দাদা, ঘণ্টা বাজে, জানেন?” আমি হেসে বললাম, “শুনেছি।” সে বলল, “দুপুরবেলাতেও বাজে। তখন কম লোক থাকে বলে শোনা যায়।” আমি মাথা নাড়লাম। সত্যিই—কিছু শব্দ কেবল ফাঁকা সময়ে শোনা যায়। অনেক কথা নিজেদের, ঘোষণাপত্র, নিজেদের কথার ভিড়ের মধ্যে চাপা পড়ে যায় তাই হয়তো আকালের ভিতরে যতটা খিদের,গল্প আছে তার চেয়েও বেশি আছে নীরবতার গল্প ।আর সেই নীরবতা ভাঙতেই এই ঘণ্টার জন্ম।
চলে আসার সময় আমবাগানের নিচে থেমে দাঁড়ালাম। বাতাসে কাঁচা আমের টক গন্ধ। দূরে গঙ্গা ধূসর; জলের উপর দিয়ে এক কাঠের নৌকা যাচ্ছে, আমার মনে হলো—ঘণ্টা হয়তো বাজে না; না-বাজলেও তার একটা উপস্থিতি আছে। যেমন এই মন্দির—অনেক সময়ই নীরব, তবু তার ভিতর দিয়ে মৃদু এক সুর বয়ে যায়।
সেদিন সন্ধের একটু আগে, মন্দিরের দরজা আবার বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে, হঠাৎ দূর থেকে টুং টাং শব্দটা ভেসে এল। কেউ নেই, তবু বাজল। আমি থমকে দাঁড়ালাম। মনে হলো—এটা বাহ্যিক নয়। এটা গল্পের ভিতরে বসা সেই শেষ শব্দ, যা দিয়ে বোঝানো যায় না—শুধু অনুভব করা যায়। এবং তখন স্পষ্ট বুঝলাম—রামেশ্বর, হিরণ্ময়ী, প্রভাময়ী, ভবানীচরণ, রামকৃষ্ণ, মৃণাল সেন—সবাই এখানে আছেন, ছিল, থাকবেন। ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন ফ্রেমে, কিন্তু একই মন্দিরের ভিতর। এই মন্দির—আনন্দময়ী নামেই অথবা অন্য নামে—আমাদের ভেতরের অভাবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, আর নীরবে ঘণ্টা বাজায়। আমরা শুনি কি শুনি না—সেটা আমাদের কানের, আমাদের সময়ের, আমাদের মনের গন্ডগোল
শহরে ফিরে এসে খবরের কাগজে দেখলাম—কোথাও পাথর ভাঙায় শ্রমিক মারা গেছে, কোথাও বৃষ্টি হয়নি, কোথাও আবার বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে। এ সংবাদগুলো পড়তে পড়তে আচমকা মনে হলো—আকালের সন্ধান শুধু ইতিহাসের অধ্যায় নয়; প্রতিদিনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট অবসাদ, ছোট ছোট শূন্যতাই আসল আমাদের আকাল। তার পাশে এই মন্দির একটা শব্দ-তুলে ধরা আয়না। আপনি শুনলে আপনার কাহিনি শোনাবে, না শুনলে বাতাসে মিলিয়ে যাবে। তবু সে বাজবে—মৃদু, দীর্ঘ, টের পাওয়া মাত্র।
আমি আবার যাব—এমন প্রতিশ্রুতি দিইনি। মন্দির তো কারও ব্যক্তিগত নয়। তবু কখনও রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেলে অন্ধকারে শোনা যায়—কোথাও একটা দূর ঘণ্টা বাজছে। তখন আমি বুঝি, গল্প শেষ হয়নি; গল্প শেষ হয় না। শুধু একটা ফ্রেমে আলো নিভে যায়, আরেকটা ফ্রেমে আলো জ্বলে। আনন্দময়ীর ছায়া তখনও লাল ইটের গায়ে হেলে আছে—নীরব, দৃঢ়, অনুবাদের অপেক্ষায়। আমরা যাই, আসি; সে থাকে। এবং থাকার অর্থটাই সম্ভবত মন্দির হওয়া—মানুষের ভিতরের শূন্যতা জুড়ে একটা মৃদু সুর বাজুক চিরকালের।
4 Comments
ভীষণ ভালো লাগলো
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteপড়তে পড়তে যেনো অনেক বছর আগে ফিরে গেলাম , খুউব ভালো লাগলো,, শব্দ দিয়ে শূন্যতায় স্পর্শ - এই লাইনটা ভীষন ভালো লাগলো।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আশা রাখি পরের পর্বগুলো পড়বেন
Delete