জ্বলদর্চি

বিষাদ-মায়া/পুলককান্তি কর

চিত্র-শুভম দাস

বিষাদ-মায়া

পুলককান্তি কর


–  বৌদি পঞ্চাশটা টাকা আজ দাওনা, মাসের মাইনেতে অ্যাডজাস্ট করে নেবে। মালতী আনাজ কুটতে কুটতে বলল নীপাকে।
–  কেন গো? এই তো পরশু দিনই নিলে।  
–  ওই তো – ওইটা নিয়ে সেদিন একটু লাউডগার সাথে কই মাছ এর ঝোল করে দিলাম টুসীর বাপকে। ওটা খেয়ে দেখলাম বেশ বল ফিরেছে গায়ে।
–  কি করে বুঝলে?
–   এই দ্যাখো না! বলেই আঙুল দিয়ে মুখটা একটু টেনে দেখালো মালতী। কলের কাছটা অনেকটা কাটা, ভেতরটা এখনও ফুলে আছে। নীপা বলল, ‘ এই জ্বরের থেকে উঠেই  মারধর শুরু হয়ে গেল?’  
মালতী মাথা নিচু করে রইল। একটু পরে বলল, ‘এমন একটা চড় মারলো বৌদি, আমার একদম ব্রহ্মতালু ঘুরে গেল। এতদিন জ্বরে পড়ে কুঁ কুঁ করছিল। তাই ভাবলাম, আর একবার পথ্যটা করে দিই।’ 
–  কেন গো মালতী, তোমার কি পিঠ চুলকাচ্ছে? পড়ে থাকুক ওরকম। সুস্হ হলেই তো মদ খাবে আর তোমায় পেটাবে। 
–  সে আর কী করা যাবে বৌদি। আমাদের সমাজে পুরুষ মানুষেরা এরকমই হয়। টুসীর বাপের মনটা কিন্তু ভালো। মারধর করে বটে। তখন আসলে হুঁশ থাকে না তো। কিন্তু  তারপরে এত আদর করে, কী বলব!
–  হ্যাঁ তাতেই তুমি গলে যাও।
–  কী আর করবো বৌদি। তুমিও তো বোঝ মেয়ে মানুষের জ্বালা।
–  অন্যের কথা ছাড়ো। তোমার ব্যাপার তো অন্য মেয়ে মানুষদের মতো নয়। তুমি নিজে রোজগার কর। বরং তোমার বর সেই টাকা মাতলামি করে ওড়ায়। তোমার ওকে ভয় পাওয়ার কী দরকার? বরঞ্চ ওরই তোমায় ভয় করার কথা। 
–  ওকে কী আর মানিয়ে রাখি সাধে, বউদি? আজ আমার গতর আছে, চাইলে দু-একটা বেটা ছেলেও জুটে যাবে। কিন্তু গতর পড়ে গেলে আমায় কে  দেখবে বউদি? 
–  তোমার বর এই যৌবনেই তোমার ঘাড়ে বসে খায়, বুড়ো বয়সে তোমাকে রোজগার করে খাওয়াবে বলে আশা কর? 
–  আশা করা ছাড়া আর উপায় কী বউদি? আমাদের জীবন এভাবেই কেটে যাবে। তুমি টাকাটা দিও কিন্তু।
–  তোমাকে কবে না বলেছি মালতী?
–   আচ্ছা বউদি, দাদা জানতে পারে না তো? জানতে পারলে কিন্তু তোমায় দেবে!
–  দাদা এত ছোটখাটো ব্যাপারে মাথা গলায় না মালতী। আমাকে দেওয়ার জন্য ওর অনেক অজুহাত আছে। আর শোনো, ফ্রিজে কালকের এক্সট্রা ফ্রায়েড রাইস আর অল্প একটু মাংস আছে। দাদা খাবে না, তুমি নিয়ে চলে  যেও। তবে তোমার বরকে দিতে যেও না, ওর শরীরটা যখন ঠিক নেই ,ফ্রিজের খাবারটা না খাওয়াই ভালো। 
–  দাদা খাবে না কেন? দুপুরে আসবে না ?  
–  না, ও আজ আসানসোল যাবে। ফিরতে রাত হবে। 
–  একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো বউদি?
–  বলো না।
–  কাললে ডাক্তার দেখাতে যাবে বলছিলে, ডাক্তার কী বলল? 
নীপা একটু  চুপ থেকে বলল, ‘ চান্স কম’  
–  কেন? সমস্যাটা কার ?
–  ছাড়ো মালতী। ওসব ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই বেশ আছি। 
🍂

–  না বউদি। একটা বাচ্চা -কাচ্চা হলে ঘরে পুরুষ মানুষ থিতু হয়। আর বাচ্চা-কাচ্চার সামনে যখন তখন বৌ- এর গায়ে হাত তুলতে লজ্জা পাবে তখন।
–  তোমার তো টুসী আছে। তাতে কি টুসীর বাপের হাতের সুখে টান পড়ে ?
–  ও তো অশিক্ষিত মানুষ বউদি। ওদের কি আর মান মর্যাদার ভয় আছে? আমাদের সমাজে এটাই দস্ত্তর। তোমরা ভদ্দরলোক। তোমাদের নিশ্চই এসব বোধ বিবেচনা কাজ করবে। 
–  ভদ্দরলোকেরা আরও খারাপ হয় মালতী, তোমার বর তোমাকে মেরে ধরে তাও তো গায়ে মলম দেয় … 
–  জানো বউদি, আমার যদি টুসীর বদলে যদি একটা ছেলে হ’ ত তো বড় ভালো হ’ ত। 
–  কেন - ভবিষ্যতে দেখার চিন্তা ?
–  ও চিন্তা থেকে আমি বলছিনা বউদি। আজকাল মেয়েরাই তাও বাপ মায়ের দুঃখ বোঝে। ছেলে একটু উড়তে শিখলেই পগার পার। 
–  তাহলে?
–  আসলে আমি চাইনা টুসীর জীবনটা এইরকম মার খেয়ে কাটুক। আমাদের সমাজে মার খায় না এমন কোনও বউ মানুষ নেই বউদি।
–  এটার জন্য তোমাদের আমাদের সমাজ বলে কিছু নেই মালতী। এটা পুরুষদের নিজস্ব চরিত্র। ওরা এভাবেই নিজেদের অধিকার কায়েম করে ।
–  বউদি, অনেকদিন দাদা একটু ভদ্র হয়ে আছে, মনে হচ্ছে। 
নীপা কিছু বলল না। ওকে নিরুওর দেখে মালতী বলল, ‘ আর একবার চা খাবে বৌদি?’ 
–  কেন তোমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে  বুঝি?
–  সারাটা গা, হাত-পা এত ব্যথা, কী বলব।
–  কেন? টুসীর বাপের অ্যাকসানে নাকি ?
–  হবে হয়তো ।
–  তাহলে একটু আদা দিয়ে কড়া করে চা খাও। ব্যথা কমে যাবে। আচ্ছা এক কাজ করো, তুমি শুধু রাতের মতো একটু ডিমের ঝোল বানিয়ে চলে যাও,আমি নিজের মতো একটু সেদ্ধ ভাত করে নেব। 
–  তা কেন? এইসব সামান্য বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবলে চলে বৌদি? না হয় তুমি ছুটি দিলে, আর দুটো বাড়ীতে শুনবে কেন ?
–  একটা বাড়ীর কাজ একটু কম হলেও তো আরাম হয় মালতী। তুমি চা এর পাত্রটা মেজে দাও। আমি চা করে দিচ্ছি। 
মালতী এ বাড়ীতে কাজ করছে আজ প্রায় ছ’ বছর। ওর সাথে কখন যেন নীপার একটা সখ্যতা তৈরী হয়ে গেছে। ও নীপার থেকে বছর সাতেকের ছোট। বয়স এবং স্ট্যাটাসের তফাৎ থাকলেও মনের কথা চালাচালি করে ওরা উভয়েই কিছুটা হাল্কা হয়। বেশ একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। মালতী যেদিন কাজে যোগ দিয়েছিল, তার প্রায় দিন দশেকের মধ্যেই বাথরুমে ঢুকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছিল নীপা। গন্ধ পেয়ে মালতী বাথরুমের দরজা ভেঙে আগুন লাগানোর আগেই বের করে এনেছিল মালতীকে। সেই থেকে মালতীর একটা অলিখিত অধিকার জন্মে গেছে নীপার ওপর। 
একমনে বসে উল বুনছিল নীপা। ওর মা খুব ভালো উল বানাতে পারতেন। নীপার ওইটা  টাইমপাশ। সমীরের জন্য আগে বানাতো। তবে ও বানানো সোয়েটার পরতে চায় না। অধিকাংশ সময়ে ডিউটিতে থাকলে ওদের ওয়ার্দিই পরে।
 সমীর আজকাল সব কিছু রেডিমেডই পরে। তাই অনেক সময় নীপা কোনও একটা কিছু বুনেও আবার খুলে দেয়। নিজের জন্য প্রয়োজনীয সব কিছুই তো আছে।  এখন টুসীর জন্য একটা মাঙ্কি ক্যাপ বানাচ্ছে। ভালোই হবে- বাচ্চা মানুষ। এটা পড়ে আরাম পাবে। এই দুপুর বেলা সময়টা একেবারেই কাটাতে চায় না। ওর মনে পড়লো এইরকমই একটা শীতের দুপুরে বেলা ছিল সেদিন। ওর মামী এসে বললেন, ‘টুকু, তোর মামা একটা  সম্বন্ধ এনেছে, কালই তোর বিয়ে।’ 
–  মানে? আঁতকে উঠলো নীপা।
–  দ্যাখ টুকু, আমাদের অভাবের সংসার। অত ধুমধাম করে তো তোর বিয়ে দিতে পারবো না। একটা সম্বন্ধ এসেছে, ছেলে বোম্বাইতে চাকরী করে। দাবী দাওয়া নেই কোনও। 
–  কিন্তু মামী …
–  কোনও কিন্তু নয়। ছেমরী!
–  মামী আমার বি-এ পরীক্ষাটা তো অন্তত হয়ে দাও ।
–  সে তোর বরকে বলে কয়ে দিতে পারলে দিবি। আমাদের আর মাথা খাসনে।  আর শোন– মামা এলে এই নিয়ে যেন কোনও  কথাবার্তা তোকে বলতে না শুনি। 
হঠাৎ করে চোখে সর্ষে ফুল দেখেছিল সে সেদিন। একদিনের কথায় কী বিয়ে হয়। মামী পারবে – ওর নিজের মেয়েকে এভাবে পার করতে? কিছু করার নেই। আশ্রিতাদের বক্তব্য থাকতে নেই। সুকেশ তো জানাতেই পারবে না ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ওকেই বা কীভাবে জানাবে? এখন তো  কলেজ বন্ধু। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল নীপার। হঠাৎ থাই এর কাছটা বড় জ্বালা করে উঠল। শাড়ীটা তুলে দেখল ফোস্কাটা  ফেটে গেছে। একটু মলম টলম কিছু লাগিয়ে দিল হতো, কিন্তু এখন আর উঠে কিছু করতে ইচ্ছে করল না। সমীর কালকে জ্বলন্ত সিগারেটটা দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়েছে ওখানে। কী এমন অপরাধ ছিল তার ? সমীরের আসতে অনেকটা দেরী হয়েছিল বলে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্রথমবার কলিং বেলটা শুনতে পায়নি। এত নৃসংশ মানুষ হতে পারে?
 কলিংবেলের আওয়াজটা পেয়ে যখন নীপা দরজাটা খুলে দিয়েছিল, তখন অর্পণের সাথে মোটা মতো একটা লোক এসে ওর রুমে ঢুকলো। নীপা প্রস্তুত ছিল না। সাধারণ একটা নাইটি পরেই বসেছিল ঘরে। অর্পণ বলে গেছিল, একটুখানি বসো আমি একটা সিগারেট কিনতে যাচ্ছি। ফিরে এলে তোমাকে জহুবীচ দেখাতে নিয়ে যাবো। 
–  তোমার ফ্ল্যাট দেখতে যাবার ছিল, তার কী হল? 
–  আরে এটা হল বোম্বাই শহর। জানো এখানে ফ্ল্যাটের ভাড়া? আমাকে ওই থানে টানের দিকে ফ্ল্যাট দেখতে হবে।  
–  তাহলে তাই দেখো। হোটেলে এভাবে কদিন থাকবে? ভাড়াও তো দিতে হবে গুনে। সেও তো কম কিছু হবে না। 
–  ও তুমি ভেবে নাও সোনা। তুমি যখন আমার ঘরে এসেছো, টাকা-পয়সার কী অভাব হবে? বলেই নীপাকে জড়িয়ে ধরেছিল সে। ওকে এভাবে অপ্রস্তুত দেখে বলল, এত হেজিটেট করার কিছু নেই টুকু, আজ থেকে ইনি তোমার নতুন নাগর। একে তুষ্ট করো মন প্রাণ দিয়ে। মালদার পার্টি,  মানুষ ভালো। এঁকে জ্বালিও না। রেগে গিয়ে যদি কোনও জানোয়ারের কাছে তোমায় বেচে দেয় তাহলে কিন্তু তোমার এই বদন আর আস্ত থাকবে না। খুবলে খুবলে খেয়ে নেবে। 
অর্পণ কী বলছে কিছুই মাথায় ঢুকছিল না নীপার। সে বলল, বলছো টা কী? আমি তো কিছুই বুঝছি না! 
–  এতে বোঝাবুঝির কিছু নেই সোনা মোনা। বলেই নীপার গালটা একটু টিপে দিল অর্পণ। 
রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নীপা সপাটে একটা চড় কষাল অর্পণের গালে। একটু সামলে নিয়ে অর্পণ হিসহিস করে উঠলো রাগে। ওকে দেখে মনে হল যেন সিনেমায় দেখা ক্রূরতম ভিলেন। ও ওঠে গিয়ে সপাটে একটা লাথি মারলো নীপার তলপেটে। ও ককিয়ে উঠতেই সঙ্গে মোটাসোটা লোকটা হিন্দিতে ওকে কী একটা নামে ডেকে বললো ‘ও এখন আমার সম্পত্তি, ওর গায়ে তুমি হাত দেবে না। নগদ চারলাখ টাকা ক্যাশ দিয়েছি, সোজা বেরিয়ে যাও।’
নীপাকে কাঁদতে দেখে লোকটা এসে সান্ত্বনার ভঙ্গিতে জাপটে ধরলো ওকে। সারা গায়ে বিশ্রি ঘামের গন্ধ আতরের গন্ধে মিশে একটা এমন হয়ে আছে – নীপার বমি পেতে লাগলো। লোকটা সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল, ‘চিন্তা করো না, তোমাকে আমি দুবাই নিয়ে যাবো, আপাতত ওখানে আমার সাথে থাকবে। চলো আপাতত আমার দিলখুশ করো।’ 
দরজাটা লাগিয়ে লোকটা ধীরে ধীরে নীপার দিকে এগোতে লাগলো। নীপার আর মনে এবং গায়ে তখন একফোঁটাও শক্তি নেই। ওই খাটের উপর স্থির হয়ে বসে রইল। ও শুধু অনুভব করল ওর উপর যেন এক কুইন্টাল পাথর চাপা পড়ে ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওর দৃষ্টি ফ্যাকাশে হয়ে  আসছে। যখন ঘোর ভাঙলো তখন দেখে পুরো ঘরে জনা পাঁচেক পুলিশের লোক, সবার সামনে সাদা পোষাকে সমীর। ওই মোটাসোটা লোকটা আর অর্পণ – দুজনেরই হাত পিছে মোড়া করে বাঁধা। সেই সমীর আজ এতখানি বদলে গেছে ভেবে কান্না পেলে নীপার। ও তো নিজে থেকে কখনওই সমীরের কাছে ওকে আশ্রয় দেওয়ার আর্জি জানায়নি। সমীরই ভগবানের দূত এর মতো হয়ে দেখা করতে আসতো ওর হোমে। ও নিজে থেকেই ওকে প্রস্তাব দিয়েছিল বিয়ে করার। বরঞ্চ নীপা ওর নিজের মনে যাই থাক সমীরকে নিরস্ত করতে চেয়েছিল। সমীর বলেছিল, ‘আমি তো সমস্ত কিছু জেনে বুঝেই তোমায় চাইছি নীপা। তোমার এত কিন্তু কিন্তু করার তো কিছুই নেই। আমি এই ওমেন ট্রফিকিং  নিয়েই কাজ করি। আমি জানি এতে তোমার কোনও অপরাধ নেই। মিছিমিছি আর অন্য কোনও ওজর আপত্তি তুলো না।’ 
আজকাল কি নতুন কোনও মহিলায় আসক্তি হয়েছে সমীরের? মনে তো হয় না। অন্তত নীপা তো সন্দেহ করার মতো পায়নি কিছুই। তবে কি সন্তান না আসাটা একটা ফ্যাক্টর? ডাক্তার বাবু তো স্পষ্ট বলে দিয়েছেন নীপার কোনও সমস্যা নেই। তবে সমস্যা কি সমীরের? জিজ্ঞাসা করার সাহস পায় না সে। শুধু আসার পথে সমীর কী ভেবে বলেছিল, ‘ফালতু ফালতু আর ডাক্তার দেখিয়ে লাভ নেই টুকু, হওয়ার চান্স নেই।’ কথাটা ওর নিজের কথা ভেবে বলা নাকি দু চারবার ডাক্তার দেখানোর বিরক্তি থেকে বলা – বোঝা যায়নি। আজকাল মার খেয়ে খেয়ে নীপারও আত্মবিশ্বাস এত কমে গেছে যে ওর কোনও কথা আর বলার মতন গজায় না। পাছে আলটপকা কিছু বলে বসে এই ভেবে চুপ করে গেছিল সে। ম্যাগাজিন ট্যাগাজিনে সে পড়ে, চাকরীর জায়গায় কোনও ফ্রাস্টেশন থাকলে নাকি পুরুষ মানুষ বাড়ীতে এসে এসব বীরত্ব দেখায়। সমীর তো কোনওদিন অফিসের কথা এসে বাড়ীতে বলে না। প্রথম প্রথম বড় কোনও জায়গায় রেইড করলে বা বড় কোনও চাঁইকে পাকড়াও করলে দু একটা কথা এসে বলতো, আজকাল সময়ের সাথে সাথে সব কিছুতেই গভীর চড়া পড়ে গেছে। নীপা উঠে বাথরুমে গেল। আয়নার সামনে গিয়ে টান মেরে মেরে  খুলে ফেললো নিজের সব জামা কাপড়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নিজের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। টুকটাক কাল রাতের মারের কালশিটে দাগ ছাড়া এখনও নিজেকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় বলেই মনে হল তার। যদিও সে শরীর দিয়ে কখনও ভোলাতে চায়নি সমীরকে, তবু সমীর নিজে কি এই দেখে লুদ্ধ হয় না কখনও? কখনও এই গায়ে এমন নৃসংশ অত্যাচার করার আগে তার মনে হয় না কতখানি কষ্ট পায় সে। নাকি অধিকার করে ফেললে স্বয়ং দ্রৌপদীরও আর মর্যাদা থাকে না স্বামীর কাছে? 
নীপার থমথমে মুখ দেখে মালতী বলল, ‘কী হয়েছে বউদি? রাতে কোনও ঝামেলা টামেলা হয়েছে নাকি? 
–  না গো। শরীরটা ভালো নেই। জ্বর এসেছিল কাল রাতে। 
–  কই কাল যখন গেলাম, সেরকম কিছু বুঝিনি তো? 
–  হ্যাঁ গো। রাতে খুব জ্বর এসেছিল, বেশ কাঁপুনি দিয়েই। 
–  দাদা জানে? 
–  না। এলো তো রাত আড়াইটার পরে। 
–  এসে খায় নি? 
–  আমি তো রুটি আর তরকারী টেবিলে রেখেই শুয়ে পরেছিলাম। শরীরটা আর দিচ্ছিল না। সকালে উঠে দেখি, তেমনিই পড়ে আছে। খায় নি। 
–  দ্যাখো দেখি, এই নিয়ে সকালে উঠে না ঝামেলা করে। 
নীপা ছোট করে একটা ‘হুঁ’ দিয়ে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। মালতি বলল, ‘বৌদি একটা কথা বলব? আমি মুখ্য সুখ্য মানুষ। তবে আমার সেদিন একটা উপলব্ধি হয়েছে। টুসীর বাবা আমাকে মারতে এসেছিল, আগে আমি চুপচাপ বাধা দিতাম। সেদিন আমি দিয়েছি উল্টে ঝাঁটার বাড়ি। তারপর থেকে প্রায় বারো দিন হয়ে গেল আমার গায়ে আর হাত তোলেনি। বরং সরু সরু করে কথা বলছে। আমার মনে হয় তুমি চুপচাপ সয়ে নাও বলেই হয়তো দাদা আরও বেশী করে তেজ দেখাচ্ছে।’ 
–  হবে হয়তো। 
–  আজকে যদি কিছু বলতে আসে, তুমি চুপ করে সয়ে নিও না বউদি। আঘাত না করতে পারো, মুখে তো অন্তত কিছু বলো। তুমি তো এমন ভাবে মার খেয়ে নাও, আমি রান্নাঘরে বসেও শুনতে পাই না। তুমি চিৎকার চেঁচামেচি করল অন্তত দাদার একটা চক্ষু লজ্জার ভয়ও তো হবে। 
–  চুপ করো মালতী। দাদা উঠলো, বোধ হয়। বাথরুমের দরজার আওয়াজ পেলাম। 
–  তুমি চুপ করে ও ঘরে গিয়ে বস বউদি। আমি না হয় আজকে চা টা করে দিচ্ছি। 
–  না গো মালতী। সকাল বেলার চা টা আমার হাতেই খেতে পছন্দ করে দাদা। কাল রাতে খাবার খায়নি। এখন আবার এই নিয়ে মেজাজ গরম হয়ে গেলে মুশকিল। তুমি জলটল মেপে রেডি করে দাও। আমি মাপ মতো চা পাতা আর দুধটা দিয়ে দেব। 
মিনিট দশের পরে সমীর ড্রয়িং রুমে পেপারটা নিয়ে বসলো। নীপার চা টা নিয়ে গিয়ে ওর সামনে রাখলো। আলাদা একটা পাত্রে বিস্কুট রাখা। সমীর ওর দিকে চেয়েও দেখল না। নীপা ধীর পায়ে এসে বিছানায় গা টা এলিয়ে দিল। হঠাৎ সমীরের চিৎকার কানে এল, ‘কী হল? কোথায় মরতে গেলে?’
নীপা ধড়মড় করে উঠে আসতেই ওই গরম চা শুদ্ধু কাপটা সজোরে ছুড়ে মারল নীপার মুখ লক্ষ্য করে। নীপা শুধু ‘উঃ মাগো’  বলে একটা অনুচ্চ কন্ঠে আর্ত্তনাদ করে কপালটা চেপে বসে পড়লো নীচে। 
সমীর চিৎকার করে উঠল, ‘এটা চা হয়েছে? মন কোথায় থাকে? কাল থেকে দেখছি, বড় তেজ বেড়ে গেছে।’ 
নীপা এবার স্পষ্ট দৃঢ় স্বরে বলল, ‘তেজের তুমি কী দেখলে?’
এবার সমীর এক দৌড়ে এসে সজোরে মারল এক লাথি, নীপা প্রায় ফুটবলের মতো উড়ে গিয়ে পড়লো দেয়ালে ‘আবার মুখে মুখে কথা। টেনে জিভ ছিঁড়ে নেব শুয়োরের বাচ্চা কোথাকারের।’ 
নীপা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সমীর এসে ওর ঘাড়টা এমন করে চেপে ধরল দেয়ালে, ওর দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ওর মুখ থেকে শুধু গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোতে লাগলো। হঠাৎ ও খেয়াল করলো ওর ঘাড় থেকে চাপটা সরে গেল। সাথে সাথে ধড়াস করে একটা আওয়াজ শুনতে পেল সে। কোনওরকমে চোখ ফিরিয়ে দেখল সমীর চিৎ হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। আর তার বুকের উপরে পা তুলে বঁটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে মালতী। ‘খবরদার বলছি দাদা, একবার উঠে যদি বউদির গায়ে হাত দাও তবে তোমার মাথা আমি আলাদা করে দেব বঁটি দিয়ে।’  
সমীর তেড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই বঁটির কাঠটা দিয়ে মালতী দিল ওর মাথায় একটা বাড়ি। ‘সারা রাত বউদির জ্বর, একটাবার ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখছো ও কেমন আছে? খাওয়া পরা দেওয়া ছাড়া সোওয়ামির কোন কর্ত্তব্যটা কর? মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মেছে বলে কি ওর বাঁচার অধিকার নেই? 
হঠাৎ নীপার গায়ে কোথা থেকে যেন অযুত হাতির বল এল। ও উঠে দৌড়ে এসে এক ধাক্কায় মালতীকে সরিয়ে দিল সমীরের উপর থেকে। সপাটে ওর গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, ‘আমার এত উপকার তোমাকে কে করতে বলল মালতী? এত যদি তেজ নিজের বরকে সামলাতে পারো না কেন? যাও, এক্ষুনি এই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাও। কাল দুপুর বেলা কাউকে পাঠিয়ে দিও মাইনে দিয়ে দেব। কাল থেকে ওই মুখ যেন আর না দেখি।’ 
নীপার এই রূপ কখনও দেখেনি মালতী। ও খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে বঁটিটা রেখে এসে বলল, ‘আসি বউদি। ভুল করে থাকলে আমাকে মাপ করে দিও।’

Post a Comment

0 Comments