জ্বলদর্চি

চেঁচকা /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৯৫
চেঁচকা

ভাস্করব্রত পতি


কথায় কথায় বলা হয় 'লাভের লাভ কিছু নেই, শুধুই চেঁচকা'। অর্থাৎ কিছুই না পাওয়া। আসলে চেঁচকার উপকারিতা তেমন নেই। এই চেঁচকা আসলে আমাদের গ্রামগঞ্জের এক অতি পরিচিত আধডুবি খাড়া গাছ। 

বর্ষা পরবর্তী সময়ে ধানক্ষেতের আলে, কাদা ও জলবদ্ধ জমিতে ভালোই জন্মাতে দেখা যায়। ধানচাষের ক্ষেত্রে এটি একটি 'সেজ' জাতীয় ক্ষতিকর আগাছা। তাই চাষীদের শত্রু। এই ঘাসে হাত ঘষলে হাত কেটেও যেতে পারে। অত্যন্ত অযত্নেই বেড়ে ওঠে মাঠে। দ্রুত বংশবিস্তারও করে। প্রবাদে বলে - 'গল(অনেক) গোরুকে চেঁচকো ঘাস'। অর্থাৎ খুব সহজে এবং কম সময়ে অনেক ঘাস সংগ্রহ করা যায়। তাই এরকম প্রবাদ। গ্রামাঞ্চলে এই ঘাস কেটে গরুর খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। 
ছোটদের কাছে বেশ মজার গাছ

মোটামুটি এক বছর বাঁচতে পারে। শুকনো চেঁচকা গাছ ঘরবাড়ি ছাওয়ার কাজে ছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ছোট ছোট ছেলেরা তাঁদের শিশু বয়সে এই গাছের ফাঁপা কলি হাত দিয়ে টিপে ধরে টানতো। আর এরফলে পটপট শব্দ হত। তাই এর নাম পটপটি। 
মাটিতে এভাবেই জন্মেছে চেঁচকা গাছ

এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায় গাছটিকে। ভারত ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, চিন, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশে জন্মায়। চেঁচকা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। একে পটপটি, পাপ্পাটিচিখা, চেড়চ্যাড়া, চোচড়া, চেঁইচা, চিড়চিড়ে, চেঁচুড়া, নালি ঘাস, চেঁচো (যশোর, গাজিরহাট, খুলনা), চেচোড়া (চট্টগ্রাম), চিচড়া (বরিশাল), চ্যাঁচড়া (গোপালগঞ্জ), ছিচরাই (জগন্নাথপুর), চেঁকো নামেও ডাকা হয়। তামিলে পোপ্পানগরাই, মালয়লামে চেল্লি, মারাঠীতে মাওয়ালা বলে চেঁচকাকে। 

এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Schoenoplectiella articulata। এটি Cyperaceae পরিবারের অন্তর্গত। হিন্দিতে বলা হয় 'বড়া নগর মোথা' পরিবারের অন্তর্গত। চেঁচকা গাছের গোড়া থেকে একসাথে ৩-১০ টি পেঁয়াজকলির মত ফাঁপা কাণ্ড বের হয়। প্রায় ১.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই কলিগুলির প্রতিটির গোড়ার দিকটা শক্ত। আর উপরের দিকের অংশ ফাঁপা হয়। কলিগুলি বেশ মসৃন, গাঢ় সবুজ এবং চকচকে হয়। এই কলিগুলিকে একটু চিরে ফাঁক করলে বা টিপে ধরে টানলে চিড়চিড় বা পটপট শব্দ হয়। এর গায়ে আড়াআড়িভাবে পাতলা প্রাচীর থাকে। কলির নিচের অংশে আঁশের মত বাদামী রঙের পাতলা পাতা 'কলি'কে জড়িয়ে থাকে। আর একসাথে অনেক চেঁচকা ফুল চাকতির মত করে কলির গায়ের গাঁট বরাবর ধার থেকে ফোটে। চেঁচকাকে কৃষিজমি থেকে উপড়ে ফেলা বা দমন করা খুব কঠিন কাজ।
চেঁচকার ফুল

চেঁচকার গোড়াতে শালুকের মতো একটা গোলাকৃতি জিনিস থাকে, যা আঞ্চলিক ভাষায় বলে 'খেঁবুর'। এটি খেতে বেশ সুস্বাদু। একসময় যখন খাদ্যসঙ্কট ছিল, তখন এসব সাধারণ জিনিস খেয়েই তৎকালীন গরিবগুর্বোরা জীবনযাপন করত। গ্রাম্য প্রবাদে পাই - 
'বল বেশি বুদ্ধি কম 
ছাইলগ্যা বেড়ায় চিঁচড়া বন।'

ভেষজ বিশেষজ্ঞ সৌরেন্দুশেখর বিশ্বাস চেঁচকার উপকারিতা সম্পর্কে জানান, "দানাগুলো ভাজলে নাকছাবির মতো খৈ হয়, যা খুব‌ই পুষ্টিকর। পেটখারাপ, বিবমিষা সারাতে ও স্নায়ু সতেজ করা সহ সমগ্ৰ গাছের‌ই বহু ভেষজগুণ‌ আছে। যা একসময় লোকায়তভাবে ব্যবহৃত হতো। এর বীজ অত্যন্ত বলদায়ক ও পুষ্টিবিধানকারী।"
🍂

Post a Comment

0 Comments