জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের লোকগল্প : রাজার ছেলের মিষ্টির দোকান সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস /কথক- সীমা দাস

জঙ্গলমহলের লোকগল্প 

রাজার ছেলের মিষ্টির দোকান 

সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস 

কথক- সীমা দাস, গ্ৰাম- ডুমুরিয়া, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম 

অনেকদিন আগের কথা আনন্দনগর নামে একটি রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন রাজা আনন্দ পাল। রাজা আনন্দ পালের একটিমাত্র পুত্র সন্তান ছিল। যার নাম রাজকুমার মধু পাল। রাজকুমার মধু খুবই মিষ্টি পছন্দ করতেন। বলতে গেলে তিনি সবসময় মিষ্টির মধ্যেই ডুবে থাকতেন। শুধু তাই নয় তিনি মিষ্টি দিয়ে সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন। 

একদিন রাজকুমার তাঁর গৃহে বসে মিষ্টি খাচ্ছিলেন। তখন সেখানে রাজা আনন্দ পাল ও রাণী ইন্দুমতী এসে উপস্থিত হন। 

রাজা আনন্দ পাল রাণীকে বলেন-“দেখ রাণী, তোমার পুত্রের কান্ডটা দেখ। কোথায় রাজ্য সামলাবে তা না করে সারাদিন মিষ্টির মধ্যে ডুবে আছে।”

রাণীমা তখন বলেন-“মহারাজ, আপনি তো জানেন রাজকুমার ছোটোবেলা থেকেই একটু মিষ্টি পছন্দ করে।”

তখন রাজামশাই বলেন-“হ্যাঁ জানি তো, তাই বলে সবসময় মিষ্টি নিয়ে পড়ে থাকলে হবে। আর কদিন পরে যে রাজ্যের দায়িত্ব নিতে হবে তার জন্য তো রাজনীতি, অস্ত্রবিদ্যা শেখা অতি জরুরী।”

রাজকুমার তখন বলেন-“না পিতা, আমি সিংহাসনে বসতে চাই না।”

এই শুনে রাজামশাই রেগে গিয়ে বলেন-“কী! কী বলছ কী তুমি, তুমি সিংহাসনে বসতে চাও না মানে তাহলে তুমি কী করতে চাও শুনি?”

তখন রাজকুমার বলেন-“পিতা আপনি রাগ করবেন না। আপনিই বলুন সিংহাসনে বসে আমার কী কাজ?”

রাজামশাই তখন বলেন-“সিংহাসনে বসে তোমাকে প্রজাদের দেখাশোনা করতে হবে। রাজ্যের সবাইকে সুখে শান্তিতে রাখতে হবে।”
🍂

তখন রাজকুমার বলেন-“কিন্তু পিতা, সেটা তো অন্যভাবেও করা যায়।”

রাজামশাই রেগে গিয়ে বলেন-“অন্যভাবে করা যায় মানে? তুমি সিংহাসনে না বসে কীভাবে প্রজাদের দেখাশোনা করবে শুনি?”

রাজকুমার বলেন-“পিতা, সবাই শুভ মূহুর্তে মিষ্টি মুখ করে। আমার মনে হয় মিষ্টি খাওয়ায় মাধ্যমে মানুষের জীবনে সুখ শান্তি আসে। তাই আমি একটা মিষ্টির দোকান খুলতে চাই। এতে আমি সবার আনন্দে যোগ দিতে পারব আর একি সঙ্গে রাজ্যের গরীব অসহায় মানুষদের খোঁজও নিতে পারব।”

এই শুনে রাজা রাণীকে বলেন-“দেখ রাণী দেখ, তোমার পুত্র কীসব বলছে। সে রাজার পুত্র হয়ে নাকি মিষ্টির দোকান খুলবে। এ তো আমার মান সম্মান একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দেবে।”

তখন রাণীমা রাজকুমারকে বলেন-“এসব কী বলছ রাজকুমার? তুমি রাজপুত্র হয়ে মিষ্টির দোকান খুলবে। এতে তো তোমার পিতার মান সম্মান সব মাটিতে মিশে যাবে। তাছাড়া তুমি এ রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী। তোমাকে ছাড়া এ রাজ্য চলবে কীভাবে?”

রাজকুমার তখন বলেন-“মাতা, সিংহাসনে বসে যেমন প্রজাদের দেখাশোনা করতে হবে, খুশি রাখতে হবে সেখানে আমি আমার মিষ্টির দোকানে বসে সবাইকে খুশি রাখব। এতে দোষের কী আছে?”

তখন রাজামশাই আরও রেগে গিয়ে রাণীকে বলেন-“রাণী, তোমার পুত্র কী পাগল হয়ে গেছে? মিষ্টি খেতে খেতে এখন মিষ্টি ছাড়া ও কিছুই ভাবছে না। তুমি তোমার পুত্রকে বোঝাও নয় তো এর ফল কিন্তু ভালো হবে না, এই বলে দিলাম।”

এই বলে রাজামশাই সেখান থেকে চলে যান। তখন রাণীমা নানাভাবে রাজকুমারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই রাজকুমার সিংহাসনে বসতে রাজি হন না।

এরপর কয়েকদিন কেটে যায়। একদিন রাজামশাই রাজকুমারকে রাজদরবারে হাজির করেন। 

রাজকুমার রাজসভায় এসে বলেন-“পিতা, আমায় ডেকেছেন?”

তখন রাজামশাই বলেন-“হ্যাঁ ডেকেছি। কাল থেকে তুমি অস্ত্রশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি চর্চা করবে। আমি তোমার জন্য শিক্ষকের ব্যবস্থা করেছি।”

এই শুনে রাজকুমার বলেন-“ক্ষমা করবেন পিতা। কিন্তু আমি এসব শিখতে চাই না।”

রাজামশাই তখন বলেন-“শিখতে চাও না মানে, কেন শিখতে চাও না? তুমি জানো না এগুলো শেখা তোমার পক্ষে কতটা জরুরী।”

রাজকুমার বলেন-“ক্ষমা করবেন পিতা। আমার মনে হয় আমি এগুলো না শিখেও রাজ্যের প্রজাদের সুখে রাখতে পারব।”

তখন রাজামশাই বলেন-“তার মানে কী? তুমি কী এখনো সেই মিষ্টির দোকানের কথা ভাবছ?”

রাজকুমার বলেন-“আজ্ঞে পিতা, আমি আমার প্রতিজ্ঞায় অটুট।”

রাজামশাই তখন বলেন-“কী! তোমার এত বড়ো সাহস তুমি আমার কথার অমান্য করছ। শোনো তুমি যদি আমার কথা না শোনো তাহলে এই মহলে তোমার কোনো জায়গা হবে না।”

রাজকুমার বলেন-“ঠিক আছে পিতা, আমি আজকেই এই মহল ছেড়ে চলে যাব।”

এই শুনে রাজামশাই বলেন-“বেশ, আজই তুমি এই মহল ছেড়ে চলে যাও। আজ এই মুহুর্ত থেকে আমি তোমার মুখও দেখতে চাই না।”

এরপর রাজকুমার সমস্ত প্রকার বিলাসিতা ছেড়ে রাজমহল থেকে বেরিয়ে পড়েন। এতে রাণীমা অনেক কষ্ট পান। কিন্তু রাজকুমার কারোর কথা শোনেন না।

এরপর কয়েকদিন কেটে যায়। রাজকুমার মধু পাল গ্ৰামে এসে এখানে একটা মিষ্টির দোকান খুলেন। আর দোকানের নাম দেন “রাজকুমার মিষ্টান্ন ভান্ডার।” এই দোকানে রাজকুমার নিজের হাতে মিষ্টি বানান। কিন্তু গ্ৰামবাসীরা রাজকুমারকে না চিনে দোকানের নাম দেখে অনেক ঠাট্টা তামাশা শুরু করে।

একজন গ্ৰামবাসী বাকি গ্ৰামবাসীদের বলে-“দেখ দেখি এই ছোঁড়া আবার কোথা থেকে এসে এখানে মিষ্টির দোকান দিল, এই দোকানের মিষ্টি কে খাবে?”

তখন আর একজন বলে-“শুধু কী তাই, দেখ দেখি দোকানের আবার নাম দিয়েছে রাজকুমার মিষ্টান্ন ভান্ডার। এ যদি রাজকুমারই হয় তাহলে মহলে না থেকে মিষ্টির দোকান দেবে কেন শুনি? তোমরা কী কেউ কোনোদিন শুনেছ রাজকুমার হয়ে কেউ মিষ্টির দোকান দেয়?”

তখন প্রথমজন বলে-“আরে রাখ তো ভাই, এ মনে হয় কোনো পাগল-ছাগল হবে যে রাজকুমারের নামে মিষ্টির দোকান দিয়েছে। এ কথা যদি একবার মহারাজের কানে যায় তাহলে রাজার পেয়াদারা এসে একে ঠিকই ধরে নিয়ে যাবে। আর মিষ্টি দোকানও ভেঙে গুড়িয়ে দেবে।”

তখন দ্বিতীয়জন বলে-“তা ঠিক কথা। কিন্তু ভাই মিষ্টিগুলো দেখে খুব ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে।”

প্রথমজন তখন বলে-“শোন ভাই, চকচক করলেই কোনো কিছু সোনা হয়ে যায় না। ওই মিষ্টি দেখতে ভালো হলেও খেতে ভালো হবে না। চল সবাই আমরা আমাদের কাজে যাই। এখানে দাঁড়িয়ে আর সময় নষ্ট করা যাবে না।”

এই বলে গ্ৰামবাসীরা সেখান থেকে চলে যায়। এদিকে রাজকুমার মিষ্টির দোকান দিয়ে বসে থাকলেও কেউ আর মিষ্টি নিতে তাঁর দোকানে আসে না। কিন্তু এতে রাজকুমার ভেঙে না পড়ে প্রতিদিন নিত্যনতুন মিষ্টি তৈরি করতে থাকেন।

একদিন গ্ৰামের কয়েকটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে রাজকুমারের দোকানে মিষ্টি কিনতে আসে। 

তাদের মধ্যে একটি ছেলে রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করে-“এই যে দাদা, তোমার দোকানে ভালো মিষ্টি পাওয়া যাবে?”

এই শুনে রাজকুমার বলেন-“হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো মিষ্টি আছে। তোমরা আগে খেয়ে দেখ তারপরে না হয় মিষ্টি নিও।”

তখন ছেলেটি বলে-“তাহলে তো ভালো হয়। আচ্ছা দিন তাহলে।”

এই বলে তারা সবাই রাজকুমারের বানানো মিষ্টি খেয়ে দেখে। 

মিষ্টি খেয়ে তারা সবাই বলে-“বাঃ বেশ ভালো খেতে তো মিষ্টিগুলো। সত্যি বলছি এত ভালো মিষ্টি আমরা এর আগে কোনোদিনও খাইনি।”

রাজকুমার বলেন-“সত্যি বলছ তোমরা? আমার বানানো মিষ্টি তোমাদের ভালো লেগেছে?”

বাচ্চারা বলে-“হ্যাঁ, সত্যি সত্যি সত্যি।”

এতে রাজকুমার খুশি হয়ে তাদের বলেন-“তাহলে তোমরা বেশি করে মিষ্টি নিয়ে যেও।”

তখন বাচ্চারা বলে-“কিন্তু বেশি মিষ্টি নেওয়ার মতো পয়সা তো আমাদের কাছে নেই।”

রাজকুমার তখন বলেন-“পয়সা দিতে হবে না। তোমরাই আমার দোকানে প্রথম এসেছ। তাই তোমরা আমার লক্ষ্মী। সেজন্য আমি তোমাদের বিনা পয়সায় মিষ্টি দিলাম।”

তখন বাচ্চারা বলে-“সবাই বলে আপনি একটা পাগল। কিন্তু আপনি তো অনেক ভালো মানুষ।”

এতে রাজকুমার বলেন-“লোকের কথায় এত কান দিতে নেই। তোমরা কিন্তু প্রতিদিন আমার দোকানে মিষ্টি খেতে আসবে, কেমন।”

বাচ্চারা বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

এরপর বাচ্চারা মিষ্টি নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। রাস্তায় কিছু গ্ৰামবাসীদের সঙ্গে তাদের দেখা হয়।

তাদের মধ্যে একজন গ্ৰামবাসী বলে-“কীরে তোরা কোথায় গিয়েছিলি? আর তোদের হাতে এই মিষ্টির হাঁড়ি এল কোথা থেকে?”

তখন একজন বাচ্চা বলে-“কাকা, আমরা ওই নতুন মিষ্টি দোকান থেকে এই মিষ্টিগুলো এনেছি।”

তখন ওই গ্ৰামবাসী বলে-“,কী বলছিস কী? তোরা ওই পাগলের মিষ্টি দোকান থেকে মিষ্টি আনতে গিয়েছিলি?”

বাচ্চারা বলে-“না গো কাকা, উনি পাগল নন। উনি খুব ভালো মানুষ। আর ওনার মিষ্টিও খুব ভালো। এমন মিষ্টি আমরা এর আগে কোনোদিনও খাইনি।”

তখন একজন বৃদ্ধ বলেন-“বলিস কী! আচ্ছা দে তো বাছারা একটা খেয়ে দেখি।”

তখন বাচ্চারা সবাইকে মিষ্টি দেয়। মিষ্টি খেয়ে গ্ৰামবাসীরা বলে-“বাঃ খুব ভালো খেতে তো মিষ্টিগুলো। একেবারে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সত্যি এমন মিষ্টি আমরা কোনোদিনও খাইনি। আমরা সবাই ভুল করেছি। না জেনে না বুঝে ছেলেটির সম্বন্ধে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছি। চলো সবাই চলো আমরা ওর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাই। আর মিষ্টি কিনে আনি।”

এই বলে সমস্ত গ্ৰামবাসী রাজকুমাররের মিষ্টির দোকানে গিয়ে ভিড় জমায়। কেউ বলে আমাকে কুড়িটা মিষ্টি দাও, আবার কেউ বলে আমাকে পঞ্চাশটা মিষ্টি দাও।

 এদিকে রাজকুমার এত লোক দেখে খুব খুশি হয়ে যান। তিনি বলেন-“দাঁড়ান দাঁড়ান, এত তাড়াহুড়ো করবেন না। সবার জন্য মিষ্টি আছে। তার আগে আপনারা মিষ্টি চেখে দেখুন তারপর না হয় মিষ্টি নেবেন।”

তখন একজন গ্ৰামবাসী বলেন-“না না আমরা খাব না তাতে তোমার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।”

রাজকুমার তখন বলেন-“না না কোনো ক্ষতি হবে না। অনেক মিষ্টি আছে। আপনারা কোন মিষ্টিটা নেবেন বলুন?”

তখন সমস্ত গ্ৰামবাসী বলেন-“বাচ্চারা যে মিষ্টিগুলো নিয়ে গেছে আমরা ওগুলো নেব।”

রাজকুমার তখন বলেন-“সেগুলো ছাড়াও আরও অনেক ভালো ভালো মিষ্টি আছে আমার কাছে।”

এই শুনে সবাই বলে-“ঠিক আছে ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আমাদের মিষ্টি দাও।”

এই ভাবে ধীরে ধীরে রাজকুমারের মিষ্টির সুনাম সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে রাজকুমারের দোকান থেকে মিষ্টি নিতে। এইভাবে রাজকুমারের বানানো মিষ্টির কদর বেড়ে যায়। 

একদিন মন্ত্রীমশাই রাজসভায় যেতে দেরি করলে রাজামশাই তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন-“কী মন্ত্রী, আজ রাজসভায় আসতে এত দেরি হল কেন?”

মন্ত্রীমশাই তখন বলেন-“আমাকে ক্ষমা করবেন মহারাজ। আসলে লোকের মুখে রাজকুমারের মিষ্টির কথা শুনে রাজকুমারের মিষ্টির দোকান দেখতে গিয়েছিলাম। তাই এখানে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।”

এই শুনে রাজামশাই বললেন-“রাজকুমারের মিষ্টির দোকানে গিয়েছিলে মানে, কী সব বলছ তুমি?”

মন্ত্রীমশাই বললেন-“হ্যাঁ মহারাজ, রাজকুমার রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গ্ৰামের এক কোণে একটা মিষ্টির দোকান খুলেছেন। আর সেখানে নাকি সারাক্ষণ ক্রেতাদের ভিড় জমে থাকে। এছাড়া রাজকুমারের বানানো মিষ্টি নাকি এত ভালো, যে একবার খেয়েছে সে বারবার খেতে চাইবে। সারা রাজ্যে প্রজাদের মুখে রাজকুমারের মিষ্টির প্রশংসা শোনা যায়।”

তখন রাজামশাই বললেন-“বলো কী মন্ত্রী? তাহলে তো একবার গিয়ে দেখতে হয় ব্যাপারটা।”

মন্ত্রীমশাই তখন বলেন-“কিন্তু মহারাজ, আপনি তো রাজকুমারকে মহল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন?”

রাজামশাই বলেন-“তাতে কী হয়েছে? আমরা ছদ্মবেশে যাব রাজকুমারের মিষ্টির দোকানে।”

তখন মন্ত্রীমশাই বলেন-“যথা আজ্ঞা মহারাজ।”

এর পরেরদিন সকালে মন্ত্রীমশাই ও মহারাজ ছদ্মবেশে রাজকুমারের মিষ্টির দোকানে যান। তারা সেখানে গিয়ে দেখেন মিষ্টি দোকানের সামনে বহু মানুষের ভিড় জমেছে।

এই দেখে রাজামশাই মন্ত্রীকে বলেন-“মন্ত্রী, এত লোকের মধ্যে আমরা রাজকুমারের কাছে যাব কী করে? আর কাছে না গেলে মিষ্টি খাবই বা কী করে?”

মন্ত্রীমশাই তখন বলেন-“মহারাজ, আমরা এখন ছদ্মবেশে আছি। তাই আমাদের কেউ চিনবেও না আর জানবেও না। তাই সবার মতো আমাদেরও লাইনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি খেতে হবে।”

রাজামশাই বললেন-“না না মন্ত্রী, আমি তার করতে পারব না। তুমি অন্য উপায় বের করো।”

মন্ত্রীমশাই তখন বললেন-“ঠিক আছে মহারাজ, আমি দেখছি।”

সেইসময় একটা লোক ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। মন্ত্রীমশাই তাকে ডেকে বললেন-“এই যে ভাই, এদিকে শোন।”

তখন লোকটি কাছে এসে বলে-“কী হয়েছে আমাকে ডাকছেন কেন? যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। বাড়িতে বউ এই দোকানের মিষ্টি খাবে বলে অপেক্ষা করছে।”

মন্ত্রীমশাই তখন বলেন-“বলছি কী ভাই আমরা এই দোকানের মিষ্টি নেব বলে অনেক দূর থেকে এসেছি। কিন্তু এসে দেখি এখানে অনেক ভিড়। তুমি যদি আমাদের দুটো মিষ্টি খেতে দিতে তাহলে খুব ভালো হত। আসলে আমরা প্রথমে খেয়ে দেখতে চাই এই দোকানের মিষ্টিটা কেমন।”

লোকটি বলে-“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। দেব না কেন। বরং এমন মিষ্টি কাউকে খাওয়াতে পারলে আমার ভালোই লাগবে। এই নিন।”

এই বলে লোকটি মন্ত্রীমশাই ও মহারাজকে মিষ্টি দেয়। তাঁরা মিষ্টি খেয়ে দেখেন।

মিষ্টি খেয়ে রাজামশাই বলেন-“আঃ হাহা হা এ তো অমৃত।”

মন্ত্রীমশাই বলেন-“হ্যাঁ, ঠিক তো এমন মিষ্টি আমি কোনোদিনও খাইনি।”

লোকটি বলে-“খাবেন কী করে? এমন মিষ্টি তো শুধু এখানেই পাওয়া যায়।”

তখন রাজামশাই বলেন-“আচ্ছা এবার বলুন তো এই ছেলেটি তো রাজকুমারের নামে দোকান খুলেছে। এখন যদি রাজার পেয়াদা এসে দোকানটা ভেঙে ফেলে ছেলেটিকে ধরে নিয়ে যায়, তাহলে কী হবে?”

লোকটি বলে-“যুদ্ধ, যুদ্ধ শুরু হবে। রাজার বিরুদ্ধে সব প্রজারা যুদ্ধ ঘোষণা করবে।”

রাজামশাই তখন বলেন-“কী! এই সামান্য মিষ্টি দোকানদারের জন্য প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে?”

লোকটি বলে-“আপনি এই ছেলেটিকে সামান্য বলছেন। আরে মশাই এই ছেলেটি শুধু মিষ্টি বিক্রি করে না। সে সবার খেয়াল রাখে। তার মিষ্টি বিক্রির টাকা সে সমস্ত অসহায় মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়। আর এমন মানুষকে রাজা ধরে নিয়ে গেলে আমরা চুপ করে বসে থাকব নাকি?”

রাজামশাই তখন বলেন-“আচ্ছা, ঠিক আছে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এখন আপনি আসতে পারেন।”

এরপর লোকটি সেখান থেকে চলে যায়।

তখন মন্ত্রীমশাই রাজামশাইকে বলেন-“মহারাজ অপরাধ ক্ষমা করবেন। আপনি সিংহাসনে বসে যা করতে পারেননি রাজকুমার সামান্য মিষ্টি দোকানে বসে তা করে দেখিয়েছেন। তিনি প্রজাদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন। তাই আমার মনে হয় রাজকুমারকে তার মতো চলতে দেওয়াই ঠিক হবে।”

রাজামশাই তখন বলেন-“হ্যাঁ, মন্ত্রী তুমি ঠিকই বলেছ। সিংহাসন কিংবা সামান্য মিষ্টির দোকান বড়ো কথা নয় আসল কথা হল প্রজাদের খুশি রাখা। আর রাজকুমার তাতে সফল হয়েছে।”

মন্ত্রীমশাই তখন বলেন-“তাহলে চলুন মহারাজ, আমরা রাজকুমারের কাছে যাই। তিনি আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবেন।”

রাজামশাই বলেন-“হ্যাঁ চলো চলো।”

 এই বলে মন্ত্রীমশাই ও মহারাজ রাজকুমারের কাছে যান। ছদ্মবেশে থাকলেও রাজকুমার নিজের পিতাকে এবং মন্ত্রীমশাইকে ঠিক চিনতে পারেন।

তখন রাজকুমার বলেন-“পিতা, মন্ত্রীমশাই আপনারা এখানে?”

রাজামশাই বলেন-“হ্যাঁ, আমরা দেখতে এলাম তুমি কী করছ।”

তখন রাজকুমার বলেন-“পিতা, আপনারা ভেতরে আসুন।”

রাজামশাই বলেন-“না না ভেতরে যাব না। আমি তোমাকে ভুল ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি ঠিক ছিলে, আমি এতদিন সিংহাসনে বসে প্রজাদের মন জয় করতে পারিনি আর তুমি সামান্য মিষ্টির দোকান দিয়ে তা করতে পেরেছ। তাই আমি চাই তুমি তোমার মতো থাকো। কিন্তু সিংহাসনে বসার জন্য তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, তাহলে আমি এখন কী করব বলো?”

তখন রাজকুমার বলেন-“চিন্তা করবেন না পিতা, আমি মিষ্টির দোকান আর সিংহাসন দুটোই সামলে নেব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।”

রাজামশাই তখন বলেন-“বেশ, তাহলে আমার আর কোনো চিন্তা নেই। তবে তোমার মায়ের জন্য মিষ্টি নিয়ে যেও তিনি তোমার হাতের তৈরি মিষ্টি খেলে খুব খুশি হবেন।”

এরপর মহারাজ ও মন্ত্রীমশাই সেখান থেকে চলে যান। রাজামশাইয়ের কথা শুনে রাজকুমার অনেক খুশি হন। আর ধীরে ধীরে পুরো রাজ্যের প্রজারা জানতে পারে মিষ্টির দোকানদার আর কেউ নয় সে হল এই রাজ্যের রাজকুমার। যিনি প্রজাদের খুশির জন্য সাধারণ জীবনযাপন করছিলেন। এতে প্রজারা খুব খুশি হয়।

এরপর থেকে রাজকুমার সিংহাসন ও মিষ্টির দোকান দুটোই সামলাতে থাকেন। যার ফলে পুরো রাজ্য সুখে শান্তিতে ভরে ওঠে। আর প্রজারা খুশি হয়ে রাজকুমারের মিষ্টি দোকানের নতুন নাম রাখে-“আনন্দ মিষ্টির ভান্ডার।”

Post a Comment

0 Comments