মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭৮
অসীম দাস (সমাজসেবী, ভ্রমণপিপাসু গাইড, কোলাঘাট)
ভাস্করব্রত পতি
"আজ মেদিনীপুরের আকাশে বাতাসে কেউ যদি পাত কান
শুনতে পাবে একটি গান সাক্ষরতা অভিযান।
দীঘার সমুদ্র থেকে ঝাড়গ্রামের পাহাড়ে জঙ্গলে
শাল মেহগনি পলাশের দল দোলে
যেন বাতাসের তালে একটি আওয়াজ তোলে
সাক্ষরতা অভিযান সাক্ষরতা অভিযান সাক্ষরতা অভিযান।
অজ্ঞানতার আধার কেটে, অ আ ক খ'র মশাল জ্বেলে
নিরক্ষরের প্রাণে জাগুক স্বাক্ষরতার জ্ঞান
মেদিনীপুর আমার মেদিনীপুর, মেদিনীপুর এই সেই মেদিনীপুর।
পরাধীন যুগে ভারত কাঁপানো শত শহীদের রক্তে রাঙানো
বিদ্যাসাগর মাতঙ্গিনী ক্ষুদিরামের মেদিনীপুর।
সেই মেদিনীপুরে থাকবে না কেউ নিরক্ষর
ছাত্র যুবক তৈরি হও জোট বাঁধো
তোলো সাক্ষরতার ঝড়।
জগৎ মাঝারে মেদিনীপুরকে আবার তুলে ধরব
নিরক্ষতা দূর করে হেথা শিক্ষার বান আনব
মেদিনীপুর, আমার মেদিনীপুর, মেদিনীপুর আমার মেদিনীপুর"।
-- সাক্ষরতার অভিযান (গান, ১৯৯২), অসীম দাস
সমাজের বুকে জনসচেতনতা গড়ে তোলা একজন আত্মনীষ্ঠ নাগরিক তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত এবং আলোপথ গড়ে তোলা একনীষ্ঠ সমাজসেবী। রক্তদান, দেহদান, চুলদান (ক্যান্সার আক্রান্তদের জন্য), চক্ষুদান থেকে শুরু করে চক্ষু অপারেশন, চশমা প্রদান, কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রদান, তালু ফুটো বাচ্চার অপারেশন -- যাবতীয় কাজে তিনি থাকেন অগ্রনী ভূমিকায়। সেইসাথে বিপন্ন মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, দুঃস্থ মানুষের পাশে সার্বিকভাবে দাঁড়ানো সহ নানাবিধ কাজে তিনি একপায়ে খাঁড়া।
কোলাঘাটের অসীম দাস। এই নামটি যেন আজ আলাদা মাধুর্য বহন করে। আলাদা প্রাধান্য বিস্তার করে। আলাদা সম্মান আদায় করে। আলাদা সম্ভ্রম ছিনিয়ে নেয়। যদিও সর্বজনপরিচিত 'নকুলদা' নামেই। যাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয় --
"অরণ্যের আর্তনাদ অরণ্যের আর্তনাদ
ওদের মেরে কোরো না মরুভূমি
এই মাটি মা ওদের জন্মভূমি
সবুজে ভরিয়ে দাও অনাথ জমি
অরণ্যের আর্তনাদ
অসীম দাসের সাথে
১৯৯৭ সালে মাতঙ্গিনী সেবা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কোলাঘাট হাইস্কুল মাঠে কোলাঘাট উৎসবের শুরু হয়। এই উৎসবের জোয়ারে নিজেকে বিলিয়ে দিতে কসুর করেননি এই মানুষটি। তাঁর উদ্যোগ এবং ভাবনার মিশেলে এখানে আয়োজিত হয়েছে মূলমঞ্চে লুপ্তপ্রায় সার্কাস খেলা, নদীতে আতসবাজি প্রদর্শন, ময়ূরপঙ্খীর আদলে নৌসজ্জা, বর্ণময় শোভাযাত্রা, মেহেন্দি, কনে সাজো প্রতিযোগিতা, ভেজিটেবল আর্ট, সেলাই দিদিমণি, পিঠেপুলি, হস্তশিল্প, স্যালাড তৈরি, কেশচর্চা, রূপস্বজ্জা থেকে মা-মেয়ে, শিশু থেকে প্রবীণ-নবীন নানা বয়সের মানুষদের নিয়ে বহুমুখী বিষয়ের আয়োজন। উন্নত এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনা না থাকলে এই কাজ সম্ভব ছিল না। মঞ্চ নির্মানেও তাঁর সৃজনাত্মক ভাবনার আস্বাদন মিলেছে দর্শকদের। বৈচিত্র্যময় মঞ্চ ছিল তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। কখনও তা আন্দামান সেলুলার জেল বা বিদ্যাসাগরের বাড়ি, আবার কখনও হয়ে উঠেছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। তাঁর সংস্পর্শে চিত্রায়িত হয়েছে কোলা ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭৫ বছর পূর্তি, বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন, কোলাঘাট গালর্স স্কুলের পঞ্চাশ ও ষাট বছর পূর্তি, স্বামী বিবেকানন্দ জন্মের সার্ধশতবর্ষ উদযাপন, কোলা ইউনিয়ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭৫ বছর পূর্তি, সারা বাংলা একাঙ্ক নাটকের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন, সংকেত ক্লাবের পঞ্চাশ বছর উদযাপন, ছাত্র সংঘের শারদীয়ার ৫০ বর্ষ পালন অনুষ্ঠান। ভিন্ন ভাবনার মিশেলে এক অভূতপূর্ব রুচির বহিপ্রকাশ ঘটিয়েছেন দিনের পর দিন।
সংকেত ক্লাব
সংস্কৃতিপ্রিয় এই মানুষটি নিত্যনতুন ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকতেন সর্বক্ষণ। ১৯৮৫ সালে সোমনাথ মিত্রের সাথে কোলাঘাট নতুন বাজারহাটে সর্বপ্রথম গ্রামীণ যাত্রার সম্মেলনের আয়োজন করেন। যা কিনা সেসময় যাত্রামোদী দর্শক, কুশীলবদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল বলা যায়। এরপর আর পেছনের দিকে তাকাননি তিনি। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন ভাবনায় জারিত করেছেন নিজেকে, আর উদ্বেলিত করেছেন কোলাঘাট সহ সংশ্লিষ্ট এলাকাকে। তাঁর প্রাণপ্রিয় সংগঠন সংকেতের উদ্যোগে আয়োজন করেছেন সঙ সাজো প্রতিযোগিতা (যেমন খুশি সাজো), রোড রেস (ম্যারাথন), রূপনারায়ণ নদীতে নৌকাদৌড় প্রতিযোগিতা, দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। তাঁর সৃজনশীল ভাবনা কাজে লাগিয়েছেন যুব উৎসব, কোলাঘাট উৎসব সহ নানা সামাজিক উৎসব, আচার অনুষ্ঠানে।
অসীম দাস পরিচালিত সংকেত, জয় জয় ক্লাব এবং মাদল নাট্যগোষ্ঠি একটা আলাদা মাত্রা তৈরি করেছে সর্বত্র। শিশু ও কিশোরদের নিয়ে তাঁর অসংখ্য স্বরচিত ও নির্দেশিত নাটক অভিনীত হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। সেগুলির মধ্যে কনভিক্ট (জয় জয় ক্লাব, ১৯৭৯), দা ওল্ড ফাদার (ইয়ং ফ্রেন্ডস এ্যাসোসিয়েশন, ১৯৮১), ভ্যাটিকান দ্বীপ (ইয়ং ফ্রেন্ডস এ্যাসোসিয়েশন, ১৯৮২), দেবী বর্গভীমা (জয় জয় ক্লাব, ১৯৮৩), ডাক দিয়ে যাই (জয় জয় ক্লাব, ১৯৮৪), জামগাছ (জয় জয় ক্লাব, ১৯৮৫), অসহায় পথিক (জয় জয় ক্লাব, ১৯৮৬), টাক ডুমা ডুম (সংকেত, ১৯৮৭), লাস্ট লোকাল (সংকেত, ১৯৮৬), বাগিচা (সংকেত, ১৯৮৭), বলদ লাঙ্গল কাস্তে (জয় জয় ক্লাব, ১৯৮৮), সত্যমেব জয়তে (সংকেত, ১৯৮৮), রূপ কানোয়ার সতীস্থল (মাদল নাট্যগোষ্ঠী, ১৯৮৮), দার্জিলিংয়ের সূর্যোদয় (জয় জয় ক্লাব, ১৯৯০), এবং নয় গোর্খাল্যান্ড নয় খালিস্থান (সংকেত, ১৯৯০)। এছাড়াও তাঁর লেখা এবং নির্দেশনায় মাদল নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজিত বড়দের নাটক শহীদ মিনারের পাদদেশে (১৯৯০), বন্ধন (১৯৯২) এবং বিষাক্ত পৃথিবী (১৯৯৩) সেসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি পুরস্কার পেয়েছেন লাস্ট লোকাল, নয় গোর্খাল্যান্ড নয় খালিস্তান, বলদ লাঙ্গল কাস্তে, বাগিচা, রূপকানোয়ার কি সতীস্থল, দার্জিলিং এর সূর্যোদয়, দেবী বর্গভীমা নাটকের জন্য।
লিখেছেন অসংখ্য গান। নিজেই দিয়েছেন সুর। গলাও ছেড়েছেন সেইসব গান নিয়ে। আসলে প্রতিবাদী মেদিনীপুরের যে সহজাত প্রবৃত্তি সঞ্চারিত থাকে, তা তাঁর মধ্যেও প্রস্ফুটিত। সাক্ষরতা অভিযান, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি, বিদ্যাসাগরের ১৭৫ তম জন্মজয়ন্তী, নেতাজী জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর কিংবা যে কোনো ক্লাব, প্রতিষ্ঠানের থিম সং রচনায় তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। তাঁর লেখা গানে শ্রমজীবী মানুষ থেকে গৃহবধূ, শিশু, ছাত্র -- উদ্বেলিত হয় আত্মিকভাবে।
১৯৮৫ সাল থেকে নাটকের আবহসংগীতকার হিসাবে কাজ করলেও ২০০২ থেকে তা ছেড়ে দেন আরও বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ার দরুন। যদিও এ কাজের জন্য কখনও কোনও পারিশ্রমিক নেননি তিনি। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সেসময় তিনি বাসুদেব দাশগুপ্ত, কার্তিক ঘোষ, পঞ্চানন বসুদের সান্নিধ্যে থেকে কাজ করে গিয়েছেন নিরলসভাবে। আসলে তাঁর প্যাশন ছিল 'কাজ'। তাঁর ভালোবাসা ছিল 'কাজ'। তাঁর ভাবনার ফসল ছিল 'কাজ'।
তাঁর ভাবনায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রস্ফুটিত হয় বিভিন্ন বিষয়ের উপস্থাপন। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই, ফিরিয়ে দাও ছোটবেলা, পুরানো দিনের স্মৃতি, বাহারি ফুলের মেলা, বৈচিত্র্যময় পাখির সমারহ, নানা দেশের পতাকা ও ডাক টিকিট সংগ্রহ, জীবমণ্ডল, ক্যাকটাস ও বনসাই সংগ্রহ, হস্তশিল্প, স্বাধীনতা আন্দোলন, অপরূপ স্মারকবেদী, বিজ্ঞান প্রদর্শনী, পত্রিকা ও গ্রন্থ প্রদর্শনীর পাশাপাশি কবিসভা ও সাহিত্যপাঠ, পুতুল নাচ ইত্যাদি। অতি সাধারণ এই বিষয়গুলি অসাধারণ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তাঁর সঠিক বাস্তবায়ন এবং পরিচালনার গুণে। খেলাধুলার প্রতিও তাঁর অগাধ ভালোবাসা। কোলাঘাটের বাসিন্দা তাপস বৈদ্যর কথায়, "খেলাধুলার জগতেও তাঁকে প্রধান ভূমিকায় পাওয়া যায়। কোলাঘাটে দাবা থেকে ফুটবল, ক্রিকেট থেকে কের্যম, রোড রেস থেকে রূপনারায়ণে সাঁতার প্রতিযোগিতা -- সবেতেই সংগঠক হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন খেলা চলাকালীন তা নিয়ে স্পোর্টস ক্যুইজ কোলাঘাট এলাকায় তিনিই জনপ্রিয় করে তুলেছেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন দক্ষ সংগঠক"।
পত্রপত্রিকা প্রকাশেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৯২ সালে 'সংকেত' ক্লাবের প্রকাশনায় শুরু হয় কোলাঘাটের নিজস্ব সংবাদপত্র 'কোলাঘাট দর্পণ'-এর ধারাবাহিক প্রকাশ। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় টানা দশ বছর (১৯৯২-২০০২) এই পত্রিকাটি জেলা ও জেলার বাইরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে 'জীবন সাথী' (তথ্যমূলক গ্রন্থ / ২০০০), রজতজয়ন্তী স্মারক গ্রন্থ (কোলাঘাটে ছাত্রসংঘ এবং সংকেত আয়োজিত শারদ উৎসবের রজতজয়ন্তী বর্ষ), কোলাঘাট সম্পদ (১৯৮৯, ১৯৯১ এবং ২০১৪), স্বর্ণালী স্মরণিকা (২০২২) এবং পকেটবই : করোনা রক্ষাকবচ (২০২১)। ইতিমধ্যে কবি তাপস বৈদ্য অসীম দাসের বহুমুখী কর্মকে তুলে ধরেছেন তাঁর সম্পাদিত 'তোমার অসীমে' গ্রন্থে।
দক্ষিণ আন্দামানের শহীদ দ্বীপে ভ্রমণরসিক অসীম দাস
ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এই মানুষটি আজ হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের আইকন। নিজে ভ্রমণ ভালোবাসেন। অন্যদের নিয়েও ভ্রমণ করতে যেতে ভালোবাসেন। আর পাঁচটি ট্যুরের মতো তাঁর ভ্রমণপদ্ধতি সাদামাটা কিংবা রঙচটা কিংবা গতানুগতিক নয়। অন্যান্য কাজের মতো তাঁর এই ভ্রমণ কাজটিও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। একজন দক্ষ গাইডের মতো হিল্লিদিল্লি নিরাপদে ও নিরুপদ্রবে ঘুরিয়ে আনেন বিশ্বজুড়ে। সেই ১৯৯২ সালে কয়েকজনকে নিয়ে তৈরি করেন 'বলাকা ভ্রমণ সংস্থা'। যা নিয়েই আজ তাঁর পথচলা। নুন্যতম অথবা নামমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থ রেখে সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিকভাবে এবং একটি সুপ্রতিষ্ঠিত একান্নবর্তী পারিবারের নির্মল আমেজে ব্যতিক্রমী ভ্রমণসূচির মাধ্যমে তিনি ভ্রমণের রসনা পূরণ করে চলেছেন অমায়িকভাবে। যেকোনো ট্যুরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানকার স্থানীয় লোকসংস্কৃতির দল ও বাদ্যবাজনা সহযোগে ভ্রমণসাথীদের নিয়ে জমজমাট অনুষ্ঠান উপহার দেন তাঁর সাথে যাওয়া ভ্রমণপিপাসুদের। তাঁর এই ভ্রমণসংস্থার লভ্যাংশ নানা সামাজিক কাজে ব্যয় করা হয়। কখনও প্যাডেল চালিত শবদেহ বাহিত গাড়ি, বিভিন্ন শ্মশানঘাটে বৈদ্যুতিক আলো, ঝড় বন্যা সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজ করে চলেছে। অসীম দাসের কথায়, "আমি নতুন করে জানলাম, বুঝলাম, শিখলাম। মানবিক অমানবিক, স্বার্থ নিঃস্বার্থ, মানুষ অমানুষ, বিবেচক অবিবেচক, উপকারী অপকারী, হৃদয়বান হৃদয়হীন এই শব্দগুলির সংজ্ঞা ও মানে। এই মহামারি ক্রান্তিকালে আমি যেন আরও সামাজিকভাবে বেশি শিক্ষা লাভ করলাম। পৃথিবী স্বাভাবিক হোক, সবাই ভালো থাকুক"।
🍂
0 Comments