মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭৯
অনিলকুমার গায়েন (পরিসংখ্যানবিদ, অধ্যাপক, খেজুরী)
ভাস্করব্রত পতি
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। তখনও ভারত ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ একটি দেশ। চারিদিকে দারিদ্রতা। সাধারণ মানুষ খুঁজছে মুক্তির পথ। সেসময়ই ১৯১৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী খেজুরীর লাক্ষী গ্রামে এক গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মেদিনীপুরের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ তথা পরিসংখ্যান বিজ্ঞানী ড. অনিল কুমার গায়েন। তিনি ছিলেন মেদিনীপুরের বুকে গড়ে ওঠা বিখ্যাত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব। মানুষের কাছে সমধিক পরিচিত ড. এ কে গায়েন নামেই।
বাবা জীবনকৃষ্ণ গায়েন ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক এবং মা পঞ্চমীদেবী বাড়ির গৃহবধূ। তাঁদের একমাত্র সন্তান ড. অনিল কুমার গায়েন পরবর্তীতে হয়েছিলেন খেজুরীর বিখ্যাত শিক্ষাবিদ। খুব ছোট বয়সে বাবা মারা যায়। কিন্তু পঞ্চমীদেবী অতিকষ্টে নাবালক সন্তানকে মানুষ করেছিলেন একবুক স্বপ্ন নিয়ে।
গ্রামের কাশীকান্ত গোল এবং কৈলাসনাথ দলপতির পাঠশালায় শুরু হয় প্রাথমিক পড়াশোনা। এরপর ১৯২৭ সালে কৃষ্ণনগর মণীন্দ্রনাথ এম. ই. স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। কেটে যায় চার বছর। এসময় তাঁর পাশে ছায়ার মতো ছিলেন এই স্কুলের প্রধানশিক্ষক ধরণীধর জানা এবং প্রধান পণ্ডিত অধরচন্দ্র মাইতি। তাঁরা তাঁকে আগলে রাখেন নানাভাবে।
ভালোভাবে এম.ই. পাশ করে ১৯৩১ সালে ভর্তি হন হেঁড়্যা শিবপ্রসাদ শিক্ষায়তনে। এখানে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। এই স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে গণিত ও সংস্কৃতে লেটার মার্ক পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক উত্তীর্ণ হন। এসময় নিদারুণ কষ্ট এবং অমানুষিক কৃচ্ছ্রসাধন করতে হয় তাঁকে। কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন তিনি। পারিবারিক দৈন্যতা তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল।
এখানকার পাঠ শেষ করে মেদিনীপুর ছেড়ে চলে যান কলকাতা। শুরু হয় নতুন লড়াই। যদিও সে লড়াইয়ে তিনি জয়লাভ করেন। মেদিনীপুরের বুক থেকে উঠে গিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। কলকাতায় গিয়ে ১৯৩৭ সালে প্রথমে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে গণিতে লেটার মার্ক পেয়ে প্রথম বিভাগে আই.এ. এবং ১৯৩৯ সালে তৎকালীন রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে গণিতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করেন। কলকাতায় এইসময় থাকার একটা বিশেষ সুযোগ পেয়েছিলেন কাঁথি রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী মঙ্গলানন্দ মহারাজের সুপারিশে। কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনের স্টুডেন্টস হোমে অবৈতনিক আবাসিক হিসাবে থাকার সুযোগ পান। সেই হোমে থাকার সময় তাঁর আচার, আচরণ, নিয়মানুবর্তিতা, নিষ্ঠা এবং সহজ সরল কথাবার্তা সকলের কাছে প্রিয়পাত্র করে তোলে তাঁকে। বিশেষ করে হোমের অধ্যক্ষ স্বামী নির্বেদানন্দ মহারাজ আপ্লুত হয়ে ওঠেন তাঁর প্রতি।
অনার্স পাশের পর ১৯৩৯ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত নিয়ে এম এ কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু আবারও পারিবারিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। বাড়ি ফিরে আসেন বোনের বিয়ের জন্য। মাকেও দেখাশোনা করতে হত। ফলে খেজুরীতে এসে গৃহশিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে এম এ পরীক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠেনা তাঁর। কিন্তু হোমের অধ্যক্ষ স্বামী নির্বেদানন্দ মহারাজের নির্দেশে ফের হোমে থাকার সুযোগ পান। আসলে তিনি এই হীরক খণ্ডকে চিনতে পেরেছিলেন।
১৯৪৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিষয়ে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান পেয়ে সম্মানজনক স্বর্ণপদক অর্জন করেন। এই সময়ের একটি ঘটনা ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। অনিল কুমার গায়েনের এই অসাধারণ কৃতিত্বে তখন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় পাওনা মকুব করে দেন। এটি ছিল এক অন্য ধরনের 'পাওয়া'। জেলা থেকে গিয়ে কলকাতার বুকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার নজির বিরল বৈকি!
পড়াশোনা শেষ করে ছোটবেলার স্কুল হেঁড়্যা শিবপ্রসাদ শিক্ষায়তনে খুব অল্প সময়ের জন্য শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু এরপরেই তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ এবং শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। সেখানেও বেশিদিন ছিলেন না। আসলে ১৯৪৪ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজের ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ল্যাবরেটরীতে কিছুদিন কাজ করার সুযোগ জোটে তাঁর। এই বছরেই বিদ্যাসাগর কলেজের নবদ্বীপ শাখায় স্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। জীবনের সংগ্রামের পথ ধীরে ধীরে সরলীকরণ হতে থাকে। কন্টকাকীর্ণ দিনগুলো হয়ে ওঠে কুসুমাস্তীর্ণ।
১৯৪৭ এর ২০ শে আগষ্ট স্থাথমোর জাহাজে চেপে স্বাধীন ভারতের প্রথম নাগরিকদের একজন সদস্য হিসেবে তিনি লণ্ডনযাত্রা করেন। সে এক আলাদা অনুভূতি। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক তিনি। লণ্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট ক্যাথারিণ কলেজে ১৯৫০ সালে স্ট্যাটিসটিকসের (পরিসংখ্যান বিজ্ঞান) ওপর গবেষণা করে 'ডক্টরেট' ডিগ্রি অর্জন করেন। ফিরে আসেন কলকাতায়। এখানে এসে যোগ দেন ভারতের আর এক সংখ্যাতত্ববিদ অধ্যাপক প্রশান্ত মহলানবিশের প্রতিষ্ঠিত ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে। অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেইসাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিস্টিক্যাল বিভাগেও শিক্ষকতা করেন।
১৯৫৪ সালে খড়গপুর আই.আই.টিতে গণিতের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু অচিরেই তিনি এখানকার পূর্নাঙ্গ প্রফেসর হয়ে ওঠেন এবং বিভাগীয় প্রধানের পদ অলঙ্কৃত করেন। পরিসংখ্যান বিজ্ঞানে তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব চারিদিকে প্রশংসা কুড়ায়। তাঁর নানা অবদানের জন্য ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ সম্মান এফ.এন.এ. পান। লণ্ডনের এফ. এস. এস. সম্মানও অর্জন করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশন্যাল কাউন্সিল অব এডুকেশন্যাল রিসার্চ এণ্ড ট্রেনিং (NCERT) এর আর্থিক সহায়তায় তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যশিক্ষা পর্ষদের স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার নানা দিক তুলে ধরেছিলেন। যা পরবর্তীতে দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৮ এর জানুয়ারিতে তিনি আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান সংস্থার ভারতীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তিনি বুঝেছিলেন মেদিনীপুরের বুকেই মেদিনীপুরের সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দরকার। আসলে তিনি চেয়েছিলেন মেদিনীপুরের বুকে মেদিনীপুরের আদর্শ মানুষের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হোক। তাঁর যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ এবং গঠনমূলক ভাবনা ফেলে দিতে পারেনি ইউ জি সি তথা ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন। তাঁর পরিকল্পিত রিজিওন্যাল এডুকেশন এসোসিয়েশন সংস্থার প্রথম কাজ ছিল এই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করা। যদিও সেসময় অমানুষিক পরিশ্রমের দরুন হঠাৎ ১৯৭৮ সালের ৭ ই ফেব্রুয়ারী মৃত্যু হয় এই কর্মযোগী মানুষটির। নিজের চোখে দেখে যেতে পারেননি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবয়ব। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল একদিন।
অবশেষে ১৯৮১ এর ২৯ শে সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৮১ (পশ্চিমবঙ্গ আইন ১৯৮১-এর আঠারো) বলে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। ইউ জি সি তথা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ১৯৯০ সালের ১ মার্চ ধারা ১২ খ অনুযায়ী এটিকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দান করেন। যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে কৃতিত্ব ছিল মেদিনীপুরের এক অন্যতম পরিসংখ্যানবিদ ড. অনিল কুমার গায়েনের।
🍂
0 Comments