জ্বলদর্চি

দয়ানন্দ গরানি (কোচিং স্টাফ, ভারতীয় ক্রিকেট দল, জামিট্যা) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭৭

দয়ানন্দ গরানি (কোচিং স্টাফ, ভারতীয় ক্রিকেট দল, জামিট্যা) 

ভাস্করব্রত পতি

'Fight Koni Fight'! 
'ফাইট কোনি ফাইট'! 
এ ডায়লগ সাঁতারু 'কোনি'র কোচ ক্ষিদ্যা ওরফে ক্ষিতীশ সিংহের। মোতি নন্দীর বিখ্যাত উপন্যাসের (১৯৭৪) অন্যতম চরিত্র এই কোনি। যে কিনা সমাজের উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাশালী ক্রীড়া ক্লাবগুলির তৈরি সামাজিক বৈষম্য ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। শ্যামাপুকুর বস্তির সেই কনকচাঁপা পালের (কোনি) মতোই গল্পরূপ উদ্ভাসিত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাটে রূপনারায়ণের পাড়ের গ্রাম জামিট্যায়। ফের নতুন করে অভিনীত হল আরেক 'কোনি' দয়ানন্দ গরানির হাত ছুঁয়ে। হাজার প্রতিবন্ধকতা, আর্থিক অনটন, সামাজিক উপেক্ষা জয় করে আজ তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ক্রিকেট দলের অন্দরমহলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র। সদ্য এশিয়া কাপ জয়ী ভারতীয় দলের হয়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্যতম একজন প্রতিনিধি। 

'কোনি' উপন্যাসের শুরু গঙ্গার ঘাটে বারুণী উৎসবে সাঁতারের মাধ্যমে। দয়ানন্দের জয়যাত্রাও নদীর পাড়েই। কোলাঘাটের রূপনারায়ণের পাড়ে বেড়ে ওঠা আর কোলাঘাট ক্রিকেট ক্লাব ৮০ এর সাথে একাত্মতার মাধ্যমে। জুপিটার ক্লাবের প্রতিযোগিতায় অমিয়াকে হারিয়েই কোনির প্রথম পদক জয়। আর জামিট্যা গ্রাম থেকে উঠে গিয়ে দয়ানন্দের প্রথম সাফল্য ২০১৬ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ রঞ্জি টিমের সাথে ম্যাসিওর হিসেবে যুক্ত হওয়া। এরপর বিশ্বমানের সাফল্য ২০২৩ এ বার্বাডোসের বুকে রোহিত শর্মার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়। আর সদ্য সদ্য দুবাইতে পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জয়। এ যেন স্বপ্নের জয়তিলক। এক বহু ঈপ্সিত পাওয়া। 
তমলুকের পদুমবসান হারাধন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের মোটিভেশন করছেন দয়ানন্দ

খেলার প্রতি অনুরক্ততা শুরু হয়েছিল ছোটবেলায়। বাবা লক্ষ্মীকান্ত গরানি একজন সাধারণ চাষি। মা আভারাণি নিপাট গৃহবধূ। দাদা সেবানন্দের আসবাবপত্রের ব্যাবসা। দারিদ্র্য আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। প্রথমে যখন জামিট্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন সেসময়কার শিক্ষিকা কৃষ্ণা মণ্ডল সাহু ছিলেন তাঁর প্রথম ট্রেনার। এককথায় 'ফ্রেণ্ড ফিলজফার অ্যান্ড গাইড'। সেসময় পুরস্কার হিসেবে দিয়েছিলেন একটি ব্যায়ামের বই। যা তাঁর কাছে অনেকটা বেদ, উপনিষদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ আজও। এরপর জামিট্যা হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ক্ষারুই ইউনিয়ন হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়ায় আর্থিক অনটন। ফলে স্নাতকস্তরের পড়াশোনা আর হয়ে ওঠেনি। 

এরপর জামিট্যা গ্রাম থেকে সেই ছোট ছেলেটি আরও বেশি করে আত্মনিবেশ করে খেলাধুলার প্রতি। ২০০৭ সালে যুবভারতী স্টেডিয়ামে ফ্রেণ্ডস অফ দি স্টেডিয়ামের ট্রেনিং ক্যাম্পে অনুশীলন করতে যেতে হত। কিন্তু খরচ সামলানোর উপায় ছিলনা একরত্তি দয়ানন্দের। ফলে গুটি গুটি পায়ে চলে আসে ১৯৮০ তে প্রতিষ্ঠিত কোলাঘাট ক্রিকেট ক্লাব ৮০ তে। তখন তাঁর পাশে দাঁড়ান কোনির কোচ 'ক্ষিদ্যা' তথা ক্ষিতীশ সিংহের মতো কোলাঘাটের ডাঃ মলয় পাল, কৌশিক ভৌমিকরা। লক্ষ্য ছিল ক্রিকেট অনুশীলন। 
বিশ্বকাপ জয়ের পর বিরাট কোহলির সাথে সেই বিখ্যাত নাচ

রোগা পাতলা, কিন্তু সুঠাম দেহ। চূড়ান্ত বডি ফিটনেস। ম্যাসেজ করার দক্ষতা ছিল বেশ। সেইসাথে মিডিয়াম পেস বোলিং করতে পারতো। বোলিংয়ের সৌজন্যে কলকাতার ময়দানে নিত্য যাওয়া আসা। প্রথমে বরানগর স্পোর্টিং ক্লাবের সি এ বি দ্বিতীয় ডিভিশনের দলের হয়ে খেলতে শুরু করেন। এরপর হোয়াইট বর্ডার, মৌড়ি স্পোর্টিং ক্লাবে যুক্ত হন। পরবর্তীতে পুলিশ ক্লাবের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এসময় তিনি গ্রিন পুলিশের কাজ পেয়ে যান। কিন্তু ধীরে ধীরে মূল খেলা থেকে সরে এসে খেলোয়াড়দের ফিটনেস রক্ষার কাজে মনোনিবেশ করতে শুরু করে। ফিটনেস ট্রেনিং তথা ম্যাসিওর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। এজন্য সংশ্লিষ্ট নানা কোর্স করে ফেলে সে। 'স্ট্রেংথ অ্যান্ড স্ট্যামিনা' বিষয়ক কোর্স করে নেয়। বেঙ্গালুরু জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতেও প্রশিক্ষন নিয়েছে সে। কাজের সুবাদে তাঁর সাথে আলাপ হয় রাজস্থান রঞ্জি দলের ট্রেনার সঞ্জীব দাসের সাথে। তাঁরই পরামর্শে থ্রো ডাউন বোলার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপরই সুযোগ জোটে অন্ধ্রপ্রদেশ রঞ্জি টিমের সাথে যুক্ত হওয়ার। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি মেদিনীপুরের এই ছেলেটির। 

কৌশিক ভৌমিকের (লাট্টুদা) কাঁধে আজ ক্লাবের কোচিং এর দায়িত্ব। বিগত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর তত্ত্বাবধানে এই কোচিং সেন্টার চলছে। এখানেই দয়ানন্দের মতই বহু ছেলে অনুশীলন করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছে। দয়ানন্দ, অশোক দিন্ডা, নন্দন মাজী, বরদা রঞ্জি টিমে সুযোগ পাওয়া ঋত্বিক চ্যাটার্জী, ভি ভি এস লক্ষ্মণের সঙ্গে কাজ করতে থাকা দেবল চৌহানের মত ছেলেরা আজ স্বপ্ন দেখাচ্ছে প্রতিনিয়ত। একসময় ঠিক যেমনভাবে স্বপ্ন দেখিয়েছিল বর্তমানে লন্ডননিবাসী অমিত প্যাটেল, গোপাল ভূঁইয়ারা।

প্রায় চার বছর ধরে অন্ধপ্রদেশ রঞ্জি টিমের সাথে থেকে লাগাতার ভালো পারফরম্যান্স এবং অধ্যবসায় তাঁর কর্মতৎপরতাকে মান্যতা দিয়ে আরও বড় জায়গায় ঠাঁই পেতে সাহায্য করেছে। এরপর ২০১৮ সালে আই. পি. এল. এ কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব টিমের সাথেও যুক্ত ছিলেন। করোনা সময়কালে ২০২০ সালে অষ্ট্রেলিয়াগামী ভারতীয় দলের হয়ে প্রথম সুযোগ পান ম্যাসিওর থেরাপিস্ট ও থ্রো ডাউন বোলার হিসেবে। উত্তরণের সিঁড়ি বেড়েই চলেছে উত্তরোত্তর।

এই মুহূর্তে দয়ানন্দ দুহাতেই বোলিং করতে পারে। ডান হাতে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার বেগে এবং বাম হাতে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে থ্রো ডাউন বল করতে সিদ্ধহস্ত। দু হাতে লাগাতার বল ছোঁড়া ও ফিটনেস ধরে রাখা একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। এই কাজ ধারাবাহিকভাবে সে করে চলেছে নিরলস পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। মেদিনীপুরের মানুষ হিসেবে বিশ্ব ক্রিকেট ময়দান দাপানো ভারতীয় দলের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে চব্বিশ ঘন্টা থাকার কৃতিত্ব -- বড় কম কথা নয়। 

যদিও এই যাত্রাপথ মোটেও সহজ সরল ছিল না পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছাপোষা ছেলেটির। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। যেখানে ডিউস বল খেলার চর্চাই প্রায় নেই বললেই চলে। এরকম একটি এলাকা থেকে উঠে এসে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ভারতীয় ক্রিকেট টিমের মধ্যে নিয়মিত সদস্য হিসেবে জায়গা করে নেওয়াটা স্বর্গীয় অনুভূতি। অপরিসীম ধৈর্য, অমানুষিক পরিশ্রম আর অকল্পনীয় জেদের প্রতিফল। যেন 'ছেলেদের কোনি'। 

এই টার্গেট ছোঁয়া কেবল কোনো কঠিনতম কাজই নয়, যেকোনো ব্যক্তির জীবনের সিলেবাসে একটি মাইলস্টোন। একটি চ্যালেঞ্জ। একটি সিঁড়িভাঙা অঙ্কের সফল কর্মসম্পাদন। একাগ্রতা, কঠিন অধ্যাবসায়, নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, নিরলস ও একান্ত নিষ্ঠা, নিশ্চুপ ও নীরবে অনুশীলন করার দক্ষতা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের উঁচু শিখরে। দয়ানন্দের এই উত্থান গ্রামের বাসিন্দা শ্যামলেন্দু আদক দেখেছেন সামনে থেকে। তাঁর কথায়, "মনের জোর থাকলেই দেশের হয়ে কিছু করার স্বপ্ন দেখা যায়। ঠিক আজ থেকে অনেক বছর আগে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা থেকে ভারতীয় দলে যেভাবে জায়গা করে নিয়েছিল আমাদের প্রিয় অশোক দিন্ডা। 'নৈছনপুর এক্সপ্রেস'। দুজনেই যে গ্রামীণ পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে, তা মোটেও ক্রিকেটের অনুকূল ছিল না"। 
ছোটবেলার শিক্ষিকা কৃষ্ণা মণ্ডল সাহু খাইয়ে দিচ্ছেন আদরের দয়ানন্দকে

দয়ান্দের আগে আর কোনও বাঙালি ম্যাসিয়র কাম থ্রো ডাউন বোলার হিসেবে ভারতীয় দলে সুযোগ পায়নি। সেই হিসেবে দয়ানন্দ একটা নজির স্থাপন করেছে বলা যায়। আজ দয়ানন্দ ছাড়াও ভারতীয় দলে আছে জামিট্যা গ্রামের আর এক যুবক নন্দন মাজী। ভারতীয় ক্রিকেট দলের অন্দরমহলে এই থ্রো ডাউন বোলারদের চাহিদা এক উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, যশপ্রিত বুমরা, মহম্মদ শামি, শুভমান গিলদের ফিটনেস ধরে রাখার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে বর্তেছিল। সে কাজে চূড়ান্ত সফলতা মিলেছে। তাঁর এই সফলতার দৃষ্টান্তে খুশি ছোটবেলার শিক্ষিকা কৃষ্ণা মণ্ডল সাহু এবং শিক্ষক কার্তিক সাহু। তাঁদের কথায়, এই আনন্দ ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। কোলাঘাট ক্রিকেট ক্লাব ৮০ এর অন্যতম কর্মকর্তা সুজন বেরাও উচ্ছ্বসিত দয়ানন্দের সাফল্যের কাহিনিতে। তাঁদের প্রত্যেকের দাবি, আরও বহু ছেলে মেয়ে উঠে আসুক ক্রিড়া জগতে। অনুপ্রেরণা হয়ে উঠুক দয়ানন্দ গরানিদের মতো ক্রিড়া ব্যাক্তিত্বরা। 

আজ গোটা জামিট্যা গ্রামের বাসিন্দাদের আবেগ আবর্তিত এই দয়ানন্দকে ঘিরে। শ্যামলেন্দু আদকের মতো শুভানুধ্যায়ী, ক্রীড়াপ্রেমী এবং  সহযোগী বন্ধুর বক্তব্য, "দীর্ঘদিন পাশে থাকার কারণে বা আমার বাড়িতে যাতায়াত এর কারণেই দয়ানন্দের এই সাফল্যের অনুভূতিটা আমার ও আমাদের ক্লাবের সকলের কাছে ভিন্ন রকম। মাটিতে পা রেখে চলা, লক্ষ্য থেকে যাতে না সরে যায়, তাই নিজেকে প্রচার থেকে দূরে রাখা, লাজুক দয়ানন্দ তাঁর এই সাফল্য ধরে রাখুক"।
🍂

Post a Comment

0 Comments