জ্বলদর্চি

বাসুদেব মাইতি (লেখক, প্রাবন্ধিক, পাঁশকুড়া)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৮০
বাসুদেব মাইতি (লেখক, প্রাবন্ধিক, পাঁশকুড়া) 

ভাস্করব্রত পতি

'ফা হিয়েন' ছদ্মনামে লিখেছেন বেশ কিছু বই। যেগুলি একসময় বেশ সাড়া ফেলেছিল পাঠক সমাজে। বিতর্ক এবং নিরাপত্তার খাতিরেই নিজের নাম গোপন রেখে তিনি বিশেষ ধরনের বেশকিছু বই লিখেছিলেন একসময়। সেইসব বই আজও প্রাসঙ্গিক। আজও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা আজ হাতে পাওয়া খুব দুষ্কর। আসলে লেখকও নেই, তাঁর বইও নেই বললেই চলে। 

তিনি পাঁশকুড়ার সুবিখ্যাত লেখক বাসুদেব মাইতি। বর্তমান প্রজন্মের কেউ হয়তো তাঁকে চেনেনা। কিন্তু একসময় জেলার অন্যতম সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। একসময় ডবলু বি সি এস অফিসারও ছিলেন। নানা প্রশাসনিক পদে চাকরির পাশাপাশি লিখে গিয়েছেন নানা বিষয়ে। কখনও গল্প, কখনও ভূমি দপ্তরের বিষয়। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে তাঁর কাজ তো ছিল সর্বজনগ্রাহ্য গ্রন্থ। 

১৯২৬ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন পাঁশকুড়ার হরিনারায়ণচক গ্রামে। বাবা চন্দ্রমোহন মাইতি ছিলেন হাউর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মা সুখদাময়ী মাইতি ছিলেন সাধারণ গৃহবধূ। দুভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়। অন্যজন আশুতোষ মাইতি। বিয়ে করেছিলেন মন্দাকিনী মাইতিকে। গত বছরের ১ লা মে মৃত্যু হয় তাঁর। মোট ছয় মেয়ে তাঁদের। পাঁশকুড়ার অন্যতম লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক বাসুদেব মাইতির জীবনাবসান ঘটে ২০১৮ এর ৩ রা মে। 

'ফা হিয়েন' ছদ্মনামে তিনি লিখেছেন বিপন্ন হিন্দু (সেপ্টেম্বর ১৯৯১, ছয় টাকা), বিপন্ন হিন্দু (অক্টোবর ১৯৯১), নিদ্রিত হিন্দু (অক্টোবর ১৯৯৪), বাঙালি হিন্দুর বিলুপ্তি (জুলাই ১৯৯৪, ৬.৫০ টাকা), মন্দির মসজিদ (জুন ১৯৯৫, ৮ টাকা), ভারতকে ইসলামীকরণ (আগষ্ট ১৯৯৬) এবং ভারতকে ইসলামীকরণ (আগষ্ট ১৯৯৭, ৯ টাকা) বইগুলি। এই বইগুলি আজ ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রয়েছে। নিজের বই প্রকাশের জন্য 'রম্যাণি' নামে প্রকাশনা গড়ে তুলেছিলেন। যার কর্ণধার করেছিলেন স্ত্রী মন্দাকিনী মাইতিকে। 

বাসুদেব মাইতি লিখেছেন আরও অসংখ্য বই। যেগুলির কথা অনেকেরই জানা নেই। সেগুলির মধ্যে দিগন্তিকা (ময়না প্রকাশনী, ১৯৮৫), দেনমোহর (ক্যালকাটা পাবলিশার্স, ১৯৬৩), মহানগরীর নারী (সত্যনারায়ণ প্রেস, ১৯৫৫), ইংরাজি গীতাঞ্জলি ও নোবেল প্রাইজ (দে বুক স্টোর, ১৩৯৬), স্বয়ংবর (নরনারী পাবলিশিং কনসার্ণ, ১৩৫৮), ভূমি নিয়ে ভোগান্তি (সত্যনারায়ণ প্রেস, ১৯৭৫), রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সাহিত্য (বাণী নিকেতন, ১৯৫৬), বর্গাচাষের ইতিবৃত্ত (দে বুক স্টোর, ১৯৯২), তাম্রলিপ্ত বন্দর ও রাজ্য ইতিবৃত্ত (২০০০), রবীন্দ্র রচনা কোষ (১,২,৩ বিশ্বভারতী, ১৩৬৬-১৩৭৩) ইত্যাদি।
শেষ জীবনের ছবি : বাসুদেব মাইতি

চিত্তরঞ্জন দেবের সাথে যৌথভাবে বাসুদেব মাইতির লেখা এই 'রবীন্দ্র রচনা কোষ' সম্পর্কে শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেসময় মন্তব্য করেছিলেন, "আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের একটা বিশিষ্ট শাখার অতি প্রয়োজনীয় পঞ্জীপুস্তক"। এ প্রসঙ্গে দৈনিক বসুমতীতে লেখা হয়েছিল "এই উক্তির যাথার্থ্য সম্বন্ধে আমরাও নিঃসন্দেহ"। এছাড়াও সেসময় বিভিন্ন পত্রিকায় বইটির সম্পর্কে নানা অভিমত লেখা হয়েছিল, যা গর্বিত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। Amrita Bazar Patrika লিখেছিল, "It is a book of perceptive study which men and women of all types and all ranks will find to be of immense use. So wide a range of materials has never been approached in so clear headed and logical way before.... A new world - a new El Dorado"। অমৃতবাজার পত্রিকা জানিয়েছিল, "রবীন্দ্রসাহিত্যের বিশেষ আলোচনার পক্ষে আলোচ্য পুস্তকখানি যথেষ্ট সাহায্য করবে। পথিকৃৎ হিসাবে গ্রন্থকারদ্বয়ের প্রচেষ্টা অবশ্যই স্বীকৃত হবে"। আবার আনন্দবাজার পত্রিকায় বলা হয়েছিল, “ভবিষ্যতের গবেষক এবং রবীন্দ্রসাহিত্য অনুসন্ধিৎসুদের কাছে এই বই যথেষ্ট মূল্যবান্"। দেশ মন্তব্য করেছিল "বাংলা ভাষায় আলোচ্য বইটি নূতন ধরণের"। বিশ্বভারতী পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, "বাংলা ভাষায় সাহিত্যবোধক রেফারেন্স বই সংকলনের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন এঁরা"। মাসিক বসুমতীতে উল্লেখ করা হয়েছিল, "সমগ্র রবীন্দ্র রচনার এক সুসংহত অভিধান"।

হরিনারায়ণচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর কালই গোবর্ধন হাইস্কুলে ভর্তি হন। তখন তাঁকে এখানে নিয়ে গিয়েছিলেন রাধাকৃষ্ণ প্রামাণিক। এখানে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার পর ময়নার পেডী স্কুলে ভর্তি হন সপ্তম শ্রেণীতে। এখানে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর মেদিনীপুর কলেজ থেকে আই. এ. এবং বি. এ. উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে সান্ধ্যকালীন কোর্সে এম. এ. পাস করেন। ইতিহাস ও বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ডাবলু. বি. সি. এস. ডিগ্রিও অর্জন করেন। 

স্যার বীরেণ মুখার্জীর কাছে প্রথম চাকরি করতে শুরু করেন ম্যাট্রিক পাসের পরেই। যদিও মাত্র ছয় মাস করেছিলেন। এরপর বি. এ. পাস করে পাঁশকুড়ার বিখ্যাত বিদ্যালয় ব্র্যাডলি বার্ট হাইস্কুলে তিন মাস চাকরি করেন। এই স্কুলে চাকরি প্রসঙ্গে 'কিছু স্মৃতি, কিছু কথা'তে বাসুদেব মাইতি লিখেছেন সেসময়কার প্রাঞ্জল চিত্র। এত বছর পরে সেই বিবরণ পড়লে অবাক হতে হয় বৈকি। তিনি লিখেছেন, "১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ১ লা সেপ্টেম্বর আমি পাঁশকুড়া ব্রাডলি বার্ট হাইস্কুলে শিক্ষকরূপে যোগদান করি। এর ১৫ দিন আগে ১৫ ই আগষ্ট ভারতবর্ষ তিন টুকরো হয়ে স্বাধীন হয়। সেই চরম উত্তেজনা ও আনন্দের মধ্যে শিক্ষাকার্যে ব্রতী হলাম মাসিক ৪০ টাকা বেতনে। বিদ্যালয়ের অফিসঘরটি ছিল পাকা বাড়ির, বাকি ক্লাস ঘরগুলি ছিল ইংরাজী 'এল' টাইপের টিনের ছাদ দেওয়া বাড়ী। প্রধানশিক্ষক ছিলেন শ্রীহেমেন্দ্রনাথ মিত্র, এম. এ. বি. টি. এবং সম্পাদক হলেন প্রয়াত জ্যোতিষচন্দ্র মাইতি এম. এ. বি. এল.। আমি পড়াতাম সপ্তম, অষ্টম শ্রেণীর ইংরাজী, ইতিহাস এবং দশম শ্রেণীর ইতিহাস, বাংলা ইত্যাদি। আসার কয়েকমাস পরে আসেন ড. হরিসাধন গোস্বামী। তিনি বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে এই স্কুলে শিক্ষকরূপে যোগদান কারন। তবে তিনি কয়েকমাস পরেই বি. টি. পড়ার জন্য স্কুল ত্যাগ করেন। পরে কবি গোষ্ঠবিহারী কুইল্যা এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়ে আসেন। এই সময়ে সারা মেদিনীপুর জেলায় গোটা কুড়ি হাইস্কুল এবং দেড়টি কলেজ (মেদিনীপুরে ডিগ্রি কলেজ এবং কাঁথিতে ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ছিল)। 

আমাদের সময় বিদ্যালয়ে সামান্যই ছাত্র ছিল এবং দূরদূরান্ত থেকে ছেলেরা এখানে পড়তে আসত। কেউ কেউ বোর্ডিংয়ে থাকত। কেউ কেউ কারও বাড়ীতে থাকত এবং কেউ কেউ বাড়ী থেকে হেঁটে যাতায়াত করত। এইসময় এই বিদ্যালয়ে নীচের দিকে অর্থাৎ সপ্তম শ্রেণীতে দু একটি ছাত্রী নেওয়া শুরু হয়। এবং অবশ্যই তাঁদের বাড়ি ছিল এই পাঁশকুড়া বাজারে। মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ঢল তখনও নামেনি।

আমার বাড়ী এই বিদ্যালয় থেকে মাইল ছয়েক দক্ষিণে হরিনারায়ণচক গ্রামে। আমাদের গ্রাম থেকে এবং আশেপাশের গ্রাম থেকে বহু ছাত্র প্রতিদিন পায়ে হেঁটে পড়তে আসত। তখন সাইকেলের ছড়াছড়ি ছিল না। বিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রার্থনার স্তোত্র ছিল 'দশ অবতার' গানটি। স্বাধীনতার প্রবল উচ্ছ্বাসে মহাত্মা গান্ধীর রচিত ও গীত 'রামধুন' গানটি এ বিদ্যালয়ের প্রার্থনাসঙ্গীতরূপে চালু করা হয়। পরে অবশ্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের 'জন গণ মন' গানটি প্রার্থনাসঙ্গীত রূপে চালু করেন"। 

অবশেষে কলকাতায় খাদ্যবিভাগে চাকরি করতে শুরু করেন। এটিই সরকারি চাকরি হিসেবে প্রথম যোগদান। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর এই চাকরি পেয়েছিলেন। এই চাকরিরত অবস্থাতেই তিনি এম. এ. পড়া চালিয়ে যান। সেসময় তাঁর শিক্ষক ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁদের লেখা পড়ে নিজেও ধীরে ধীরে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন লেখার প্রতি।
 
এরপর কানুনগো ডিপার্টমেন্টে চাকরি পেয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে যান মুর্শিদাবাদের লালগোলাতে। সেখান থেকে জে এল আর ও পদে পদোন্নতি হয়ে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। লেখালেখি কিন্তু চলতেই থাকে। ভূমিদপ্তরে চাকরির সুবাদে জমিজমা বিষয়ক নানা লেখা লিখতে শুরু করেন। যা কিনা দলিল হয়ে রয়েছে আজ। 'বর্গাচাষের ইতিবৃত্ত' সেরকমই এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। 

শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসেন নলহাটি। এরপর তাঁকে উত্তরবঙ্গে ট্রান্সফার করা হলেও তিনি যাননি। সেসময় এক বছরের বেশি কিছু সময় চাকরিই করেননি। এ ঘটনা জানতে পেরে তৎকালীন কংগ্রেস নেতা তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী শ্যামাদাস ভট্টাচার্য (তিনিও পাঁশকুড়ার বাসিন্দা) তাঁকে ডেকে নেন। এই শ্যামাদাস ভট্টাচার্য ১৯৫২, ১৯৫৭ এবং ১৯৬২ সালে পাঁশকুড়া পশ্চিম বিধানসভা ক্ষেত্রে জয়ী হয়ে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের এবং জলসেচ দপ্তরের মন্ত্রী হন। পাঁশকুড়ার মানুষকে প্রাধান্য দিতেন তিনি। ফলে কর্মোদ্যোগী বাসুদেব মাইতিকে অব্যাহতি দেননি কাজ থেকে। আর বাসুদেব মাইতি ভূমিদপ্তরে কাজ করার সুবাদে এই সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করেন রীতিমতো গবেষণা পর্যায়ের কাজ করে। নলহাটি থেকে মিউচুয়াল ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসেন ঘাটালের গোপীগঞ্জে। এরপর তাঁকে যেতে হয় বাঁকুড়া। সবশেষে ও. সি. এল.  আর. ও. পদে নিযুক্ত হন মেদিনীপুর সদরে। এখানেই তিনি অবসর নেন। 

২০০২-২০০৩ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে পান 'ধরনীধর সাহিত্য পুরস্কার'। প্রক্কন সাহিত্য পত্রিকার পরিচালনায় এই পুরস্কারের দাতা ছিলেন অনাদিরঞ্জন দে এবং এস কে দে। এছাড়া আর তেমন প্রতিষ্ঠিত কোনও সংস্থা থেকে সম্মাননা পাননি। প্রায় নীরবে নিভৃতে কাজ করে গিয়েছেন নিরলসভাবে। এহেন মানুষটি সত্যিকারেই 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' হয়ে জেলাবাসীর মননে অন্তর্লীন রয়েছেন আজও।

🍂

Post a Comment

0 Comments