জ্বলদর্চি

ঔরঙ্গজেব ফাইলস/অয়ন মুখোপাধ্যায়

ঔরঙ্গজেব ফাইলস

অয়ন মুখোপাধ্যায়


বাঁশি বনাম ইতিহাসের মাইক

ঔরঙ্গজেবের নাম শুনলেই চোখে-মুখে ভেসে ওঠে—
একজন ভয়ঙ্কর বুড়োর মুখ, মাথায় টুপি, হাতে তরবারি,
আর মুখে সবসময় বলছে— “হারাম! হারাম!”
আর কেউ না শেখাক,
বলিউড আমাদের তাই শিখিয়েছে।

কিন্তু বাদশার জন্মদিনে
দরবার ভেসে যেত গান-বাজনায়।
টোড়ি, আশাবরী, শ্রী—
যে রাগ শুনলে আজকালকার
ছেলে-মেয়ের দল ঘুমিয়ে পড়ে,
সেই রাগেই তখন বন্দিশ লেখা হতো।
ব্রাহ্মণ কবিরাও দিব্যি বসতেন বাদশার কোল ঘেঁষে।

কিন্তু এসব কথাগুলো যদি ফাঁস হয়ে যায়—
সিনেমার কোনো খলনায়ক পাওয়া যাবে না।
নায়ক-নায়িকার প্রেম ভাঙবে কী করে?
সত্তর মিলিয়ন টাকা উঠবে তো?

তাই ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে—
“ঔরঙ্গজেব গানকে ঘৃণা করতেন।”
অনেকটা আমাদের চেনা স্যারেদের মতো,
যে ছাত্র পরীক্ষার খাতায় কবিতা লিখেছে,
সেইখানে তিনি চিৎকার করে বলছেন—
“এইসব ছাইপাঁশ লিখে কী হবে? অঙ্ক করো!
কম্পিটিটিভ এক্সামিনেশনে বসতে হবে।”

চাকরি...
চাকরি...
চাকরি...

তাহলে শেষ পর্যন্ত আসল সত্যিটা কী দাঁড়ালো?
ঔরঙ্গজেব গান শুনতে ভালবাসতেন কি বসতেন না— সেটা বড় কথা নয়।
আসল কথা হলো—
আমাদের কানে যে বাঁশি বাজছে,
সেটা রাজনীতি বাজাচ্ছে,
আমরা শুধু হাততালি দিচ্ছি।

🍂


 ট্যাক্সির মিটার — আর বাদশাহর জিজিয়া কর

ঔরঙ্গজেব শুধু গান নিয়ে ঝগড়া করেননি,
হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর ট্যাক্সও বসিয়েছিলেন—
অনেকটা হলুদ ট্যাক্সির মিটারের মতো,
ঘুরছে আর ঘুরছে,
কিন্তু যাত্রী জানে না কিসের জন্য সে টাকা দিচ্ছে।

ব্রাহ্মণরা বলল— “ধর্মে আঘাত।”
মোল্লারা বলল— “ইমান রক্ষা হল।”
বাদশা বলল— “টাকা চাই।”

আজকের সরকারও কম যায় না।
কোথাও জিএসটি তোলে, আবার কোথাও জিএসটি বসায়।
আমরা শুধু খালি পকেট টিপে ভাবি—
এটা ইতিহাস, না কি আজকের খবরের কাগজ?



বাদশাহর লাস্ট ফেসবুক পোস্ট

বুড়ো ঔরঙ্গজেব মৃত্যুর আগে ছেলেকে লিখেছিলেন—
“কে আমি, কেনই বা এই পৃথিবীতে এসেছি,
দেশের জন্য বা জনগণের জন্য কিছুই করতে পারলাম না,
যুদ্ধ করতে করতে অযথাই আমার দিন কেটে গেল।
আমার পরেই আসবে ভাঙন।”

তাহলে বাদশা কথাটার মানে কী দাঁড়ালো?
যেন কোনো অফিসার,
যেন কোনো সওদাগরি অফিসের কেরানি,
যিনি সারা জীবন ফাইলের পর ফাইল সই করতে করতে
নিজের নামটাই ভুলে গেলেন,
আর অবসরের দোরগোড়ায় এসে বুঝলেন—
“এত করলাম, আমার কিছুই থাকল না।”

এই রকমই অনুভূতি হয়
পাড়ার পুরোনো জমিদারবাড়িগুলোর দিকে তাকালে—
এদের কোনো পেনশন নেই, ভাতা নেই, এমনকি জমিগুলোও নেই,
শুধু ইতিহাসের ফাঁকা ড্রয়ার।

তাহলে ঔরঙ্গজেব কি আমাদের সহকর্মী ছিলেন?



কৃচ্ছ্রসাধনের কবর

মুঘল বাদশাহরা বানিয়েছিলেন বিশাল বিশাল স্থাপত্য সমাধি—
হুমায়ুনের কবর থেকে তাজমহল,
যেন আর্কিটেকচারের সেলফি।

কিন্তু ঔরঙ্গজেব? তিনি কিছুই করে গেলেন না।
শুধু বানিয়ে গেলেন একটা সাদামাটা কবর—
না মার্বেল, না সোনা,
শুধু মাটি আর একটুকরো কাপড়।

ইতিহাসবিদরা বললেন— “ঔরঙ্গজেব খুব ধর্মভীরু।”
আমি বলি—
হয়তো ফান্ড শেষ হয়ে গেছিল,
অথবা বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে
বিল্ডিং প্রজেক্ট বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

যাই হোক, আজ সরকার বাজেটে জিনিসের দাম কমালে
আমরা বলি— “নীতিগত কৃচ্ছ্রসাধন।”

ঔরঙ্গজেবও তাই বুঝি চলে গেলেন চুপচাপ,
পেছনে রেখে গেলেন—
একটা সস্তার কবর, আর কিছু দামী বিতর্ক।

Post a Comment

4 Comments

  1. আকাশ নট্টNovember 14, 2025

    অভিনব।

    ReplyDelete
  2. এরকম লিখতে দম লাগে নাটকের সংলাপ এর মত অনেকট

    ReplyDelete