পুলককান্তি কর
৩ রা নভেম্বর
জানো তরী, আজ বাড়ী থেকে বেরিয়ে যখন বাসে উঠতে যাবো, মনে বড় উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। আমার একশো তম গল্পটা কিছুতেই আসছে না। জানালার পাশে একটা সিট পেয়ে বসেও পড়লাম। এখনকার হিমেল হওয়ার স্পর্শে কখন ঘুমও এসে গেল। হঠাৎ দেখি আমার গল্প দেবার দেবীকে। অবিকল তোমার মতোই দেখতে। টিকালো নাক, উঁচু কপাল, ধনুকের মতো ভ্রূ। এসেই আমাকে বলল সে, ‘নাও তোমার একশতম গল্পের প্লট নিয়ে এলাম।’ তারপর কত কী বলল সে। ঘুমের ঘোরে মনে রাখবো বলে মনে মনে কতবার মকস দিলাম, কিন্তু কোথায় কী! ব্রেকের ঝটকায় ঘুম ভাঙতেই সব ভোঁ ভাঁ। আবার চোখ বুজে স্বপ্নকে লিঙ্ক করার কত চেষ্টা করলাম, কিছুই মনে পড়লো না। তোমার কথা ভাবলাম। ভাবতে ভাবতে চোখটা বুঝে এল, তুমি এসেছিলে গল্প দিতে, শুধু এটুকুই মনে এল। কী করি বলো তো? সারাটা দিন কোথায় ছিলে আজ? ভাবলাম তোমার সাথে দেখা হলে যদি ঝিলিক দিয়ে ফিরে আসে ভুলে যাওয়া ছবিগুলো, কিন্তু সেগুড়ে বালি। কোথায় গিয়েছো? কেলো কার্তিক তো দিব্যি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
৪ ঠা নভেম্বর
আজ ভারী বিরক্তিতে কাটলো সারাটা দিন। বাড়ী থেকে বেরোতে গিয়েই বাধা। মোবাইলটা ফেলে এসেছিলাম ঘরে। রাস্তা থেকে ফের ফিরে গিয়ে নিয়ে আসতে হলো। ভাবলাম, যাকগে, কে আর ফোন করবে? একবার ফোন হীন জীবন কাটিয়ে দেখি। সেই কুড়ি বছর আগেকার মতো। শুধু ল্যান্ডলাইন ছাড়া কী ছিল তখন। তখন তো তুমি খুকি, তরী। ইজের পরে ছুটে বেড়াতে হয়তো। জানো, তোমার ছোটবেলা ভাবলে আমার এই দৃশ্যটা কেন যেন মনে আসে। আসলে গ্রামের ছেলে তো। পাঁ ছ'বছরের মেয়েরা খালি গায়ে ইজের পরে যেমন করে দৌড়ে বেড়ায় ঠিক তেমনি। অবশ্যই এখনকার ছোট মেয়েরা এমনটা করে কিনা জানি না। তুমি ছেলেবেলায় থুড়ি তোমার মেয়েবেলায় কেমন দেখতে ছিলে তরী? একবার ফেসবুকে তোমার কিশোরীবেলার ফটো দেখেছিলাম এক ঝলক। একদম অন্যরকম দেখতে ছিলে। কেমন রোগা, যেন হাড় গোনা যায়। সেই মুখ দেখে কে বলবে তোমার যুবতী বেলায় এত রূপ রস গন্ধ বর্ণ এসে ভিড় করেছে এক দেহে। অখিলবন্ধুর ওই গানটা কখনো শুনেছো তরী, ‘সেদিন চাঁদের আলো?’ অবশ্য তুমি তো পুরনো বাংলা গান শোনো না। আমি যদি গানটার লিংক পাঠাই তুমি কি অন্য কিছু ভাববে? ভাবতেই পারো, এই রূপস্তুতির গান তোমাকে পাঠালাম কেন।
🍂
জানো তো, ক'দিন ধরে তলপেটটায় মাঝে মাঝে বড্ড ব্যথা হচ্ছে। ইউরিনটা করার সময় যেন তীব্রতাটা খুব বেড়ে যাচ্ছে। একটা ইউ.এস.জি করে ডাক্তার দেখাবো, নাকি আগে ডাক্তার দেখিয়ে ওপিনিয়ন নেব-বুঝতেই পারছি না। আজকাল ইউরিনের ফ্রিকোয়েন্সি আর আর্জেন্সি দুইই বেড়ে গেছে খুব। যাহোক, যে হেনস্থার কথা শুরু করেছিলাম, খেই হারিয়ে ফেলেছি তার- তখন যে বাসটায় গেলাম তার টায়ার গেল পাংচার হয়ে। পরের অন্য একটা বাসে- বুঝতেই পারছো মাঝ রাস্তায় বাসে ওঠা- কী ভিড় কী ভিড়! এই অবেলায় আর গুঁতোগুঁতি পেরে উঠি না। অফিসে যখন পৌঁছালাম আধ ঘন্টা লেট। আজ ভাস্করবাবুর সাথেও খটামটি লাগলো একটা ফাইল নিয়ে। তার উপর আজও আসোনি তুমি। আজ পুরোটাই অযাত্রা।
৭ ই নভেম্বর
গত দুদিন আর নিজের সামনে আয়না ধরার ফুরসৎ হয়নি তরী, অকালে নিম্নচাপ! সারাদিন শুধু টুপটাপ টুপটাপ। আমার বাড়ীর সামনের বারান্দা দিয়ে একটা পাকুড় গাছ দেখা যায়। আজ সকালেই সেই পাকুড়ের পাতার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির ঝরে পড়া দেখতে দেখতে জীবনানন্দের কবিতাটা মনে মনে আবৃত্তি করছিলাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ দেখি একটা বাদামি লোমওয়ালা মেয়ে কুকুর কোথা থেকে এসে জুড়ে বসলো ওর তলাটাতে। বসেই জিভ দিয়ে সারাটা গা চাটতে শুরু করলো। বোধহয় ভেজা গা পরিষ্কার করার দিকেই তার মন। একটু বাদে সেও কেমন একমনে রাস্তার ওপর বৃষ্টির টুপটাপ ঝরে পড়া দেখতে শুরু করলো, তোমাকে না দেখালে বোঝাতে পারবো না। আমি কয়েকটা ছবি তুলে রেখেছি। জানি তুমি কুকুর খুব ভালোবাসো। তুমি নিশ্চযই ওকে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতে। তোমার কথা ভেবে ইচ্ছে হল- যাই ওকে কখনো বিস্কুট দিয়ে আসি। ও বাবা। হঠাৎ দেখি ঘেউ ঘেউ করতে করতে সে দিল এক মস্ত একটা ছুট। বেপাড়ার কুকুর ঢুকে পড়েছে ওর সীমানায়। বড্ড রাগ হয়ে গেল ওর উপর। স্যরি।
জানো তো, তখন আমার বয়স উনিশ কুড়ি। আমার এক বন্ধুর বোন, ওর নাম তূর্নী, ওর বয়স তখন বোধ করি ষোলো-সতেরো হবে। ও ছিল আমাদের পাড়ার কোহিনুর। আমাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে একটা পিচ রাস্তা চলে গেছে একেবারে নাক বরাবর। প্রত্যেক বিকেলে ওই রাস্তা দিয়ে আমাদের হেঁটে বেড়ানো ছিল একটা রুটিন ব্যাপার। কতকটা সময় কাটানো, কতকটা ঝাড়ি মারা। মেয়েরা ওদের মতো দল করে বেরোত। ছেলেরা তাদের মতো। বন্ধু বান্ধবেরা বলতো তুর্নী নাকি আমার দিকে আলাদা চোখে চায়। আমি ব্যাপারটা বুঝতাম না নাকি না বোঝার ভান করতাম- আজ এই প্রৌঢ়তার প্রান্তে এসে খুঁচিয়ে মনে করার ইচ্ছা হয় না। রোজ তুর্ণীর বাড়িতে আড্ডা মারা ছিল আমার বাঁধা। ওর দাদার সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে তুর্নীর সাথেও যে ইয়ার্কি ফাজলামি মারতাম না- এমন নয়। বছর দেড় দুই পরে বেপাড়ার এক ছেলের আমদানি শুরু হলো আমাদের রাস্তার ধারে। পরিষ্কার বোঝা যেত সে কেবল তুর্নীর টানে। আমি এই নিয়ে কত মজা করতাম তুর্নীর সাথে। দ্যাখ তোকে কত ভালবাসে, তোর জন্য জান কবুল... ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ সেই ছেলেটি তুর্নীর হৃদয় মন শরীর জয় করে তার সাথেই বাসা বেঁধেছে শহরতলীতে। আফটার অল, আমরা মানুষ তো। আমাদের কী আর পাড়া দখল করা শোভা পায়?
৮ ই নভেম্বর
আজ সকালে ঘুম ভাঙলো একটা অদ্ভুত ভালো লাগা দিয়ে। কারোর বাড়িতে এফ. এম. এ বাজছিল আমার প্রিয় একটা গান। 'একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন জলে, সহসা কে এলো গো, এ তরী বাইবে বলে।’ জানো কি তরী কার গান এটা? তোমরা আজকালকার ছেলে মেয়েরা তো এসব কিছুই শোনো না। আমার খুব ইচ্ছা করছিল সকালে- যদি তুমিও সেই মুহূর্তে কোনওভাবে গানটা শুনতে! এত স্লো গান তোমাদের যদিও ভালো লাগে না। আমি যখন কলেজে পড়ি এই গানটা আমার খুব মনে ধরেছিল একসময়। খুব গাইতাম। যদি তোমাকে একবার শোনাবার অবকাশ হত। বেশীক্ষণ অবশ্য ভালো লাগাটা স্থায়ী হল না। বাথরুমে গিয়ে ভারী ব্যথা হলো ইউরিন করতে। যেমন ব্যথা, তেমনি জ্বালা। কী যে করি। আজই ডাক্তার দেখালাম, আমার বন্ধু-ডাক্তার। ইউ. এস. জি করতে বলল। বলেছে তোর ইউরিন রিটেনশন হচ্ছে; সেখান থেকে ইনফেকশন। প্রৌঢ় বয়সে নাকি প্রোষ্টেট গ্ল্যান্ড বেড়ে যায়। রক্তের পরীক্ষাও করাতে বলল কিছু। সেই জন্যই আজ অফিস যাওয়া হল না।
জানো তরী, আজ আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি তুমি ফোন করে আমার খবর নেবে। আমি তো এর আগেও দু-একবার অফিস কামাই করেছি, অবশ্য বাধ্য হয়েই, কই তখন তো ফোন করোনি? একেই কি টেলিপ্যাথি বলে? আসলে আজ আমার খুব ইচ্ছে করছিল তোমার সাথে দেখা করি, কথা বলি। তুমি জানো, তোমার সাথে কথা বলার পর আমার ব্যথা জ্বালা একেবারে গায়েব হয়ে গেল?
ছোটবেলা থেকেই আমার এই সব পরাজাগতিক ব্যাপার নিয়ে খুব আগ্রহ। যখন ম্যানড্রেক পড়তাম, খুব ইচ্ছে করতো তার মত যদি টেলিপ্যাথি করতে পারতাম। ছোট ছিলাম যখন আমার এক সম্পর্কের দাদু এই নিয়ে আমার সাথে মজা করত খুব। সে নাকি চালুনি মন্ত্র জানতো। মন্ত্র পড়ে বড় একটা চালুনিতে বসে সে নাকি আকাশে উড়তে পারতো। ছোটবেলার কত ধরাধরি, খোশামোদ করেছি তাকে- যদি এই মন্ত্রের বল আমিও রপ্ত করতে পারি। দাদু কেবলই বলতো ‘আর একটু বড় হও দাদা।’ আমার খালি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর দু'লাইন বলতে ইচ্ছা করতো ‘আমি আর কত বড় হব দাদা ঠাকুর? বড় হতে হতে যেদিন আমার মাথা চাল ফুঁড়ে....’ দেখতে দেখতে সত্যি একদিন দাদুর মাথা আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেল ঊর্ধ্বপানে।
যৌবনে আমার এক বন্ধু বলল, ‘জানিস কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার সময় যদি বালিশটাকে নিজের দেখে উল্টে নেওয়া যায় তবে সেই স্বপ্নটা সেই লোকও দেখে।’ আমি কোনও মধুর স্বপ্ন দেখতে দেখতে কতবার এইভাবে উল্টে নিয়েছি বালিশ, অথচ কোনওদিন জানতে পারিনি অন্যজনও সেই অভীষ্ট স্বপ্ন দেখতে পেয়েছিল কিনা। বেশ কয়েকবার তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। যা তোমাকে দেখাতে পারলে আমার আনন্দ হতো, কিন্তু আজকাল আর বালিশ ওল্টানোর কথা মনে পড়ে না। শুধু ইচ্ছাশক্তির উপর ভরসা করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
কাল তুমি চেয়ার থেকে উঠে মাঝে মাঝে আড়মোড়া ভাঙছিলে কেন তরী? কোমরে ব্যথা হয়েছে? এই স্টাইল মারা চেয়ারগুলোই যত নষ্টের গোড়া। কী বা করবে, এই অফিসে তো কাঠের চেয়ারের কোনও অপশনই নেই। আর বিকেলের দিকে এমন করে বসেছিলে কেন? তোমার তো মাথা ধরে খুব। জানো কাল মনে মনে কতবার তোমার মাথা টিপে দিয়েছি। জানিনা তোমার তাতে উপশম হয়েছিল কিনা।
একটা কবিতার লাইন কেন মাথায় এলো তরী? প্রাসঙ্গিক তো নয়। ‘শূন্য হয়ে ঝরে গেছে হেমন্তেই ঝিরি ঝিরি পাতা। শেষ কবে এসেছিল নারী নদী হয়ে/ ভুলে গেছে হৃদি-চর।/ শেষ কবে ডুবে ছিল সপ্তডিঙা তরী,/ মনসা ভাসানে গেছে। কার স্পর্শে প্লব হবে?/ চাঁদ আমি ডুবে যাই, ডোবে বিষহরি।’ বাঃ বেশ ভালোই তো হল লেখাটা! ছাপতে তো দিই না কোথাও, পড়ারও কেউ নেই, তাই নিজের লেখা নিজেই তারিফ করি। না না, সত্যি সত্যি, লেখাটা ভালই হয়েছে। আমি বুঝতে পারি। তরী তুমি জানো, বেহালা কোন নদীতে ভেলা ভাসিয়েছিল? তোমাদের বাড়ির কাছেই গো! গাঙ্গুর নদী। বেহুলা ভাসিয়েছিল ভেলা গাঙ্গুরের জলে। এখন যে বৃহত্তর গড়িয়া, এটা তো গাঙ্গুরেরই গতিপথ ছিল। এক এক জায়গায় এখনো দু একটা পুকুরের মতো অংশ দেখা যায় যেটা আসলে গাঙ্গুরের অংশ বিশেষ। যে জায়গা গভীর ছিল বেশী, সেগুলো মজতে না পেরে পুকুর হয়ে গেছে। জানো তরী, আমার মনে হয় এর চেয়ে মজে যাওয়া ছিল ভালো। এখন বোড়াল শ্মশান ঘাটের পাশে যে পুকুরটা রয়েছে সেটা ওই রকমই একটা না-মজা অংশ। পাশের যে শিব মন্দিরটা, ওটা নাকি চাঁদ সওদাগরের কোন বংশধরই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। গড়িয়া মোড় থেকে নরেন্দ্রপুরের দিকে যেতে পেট্রোল পাম্পের পাশের পুকুরটাও তাই। কেউ কেউ বলেন গাঙ্গুর নদীটা আদি গঙ্গার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে মাতলায় মিশেছিল। কেউ কেউ আবার আদি গঙ্গাটাকেই গাঙ্গুর নদী বলেন। ভাবো তরী, একটা পুরো নদী কালের জাদুকরীতে একেবারে ভ্যানিশ! অথচ সেই সওদাগরও ছিল, তাদের সওদাগরিও চলত একসময় পৃথিবীর নানা অংশ জুড়ে। চাঁদ সওদাগরের বাড়ী ছিল আদি সপ্তগ্রাম। কদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকে কোথায় যেন চাঁদ সওদাগরের ভগ্নস্ত্তপের একটা ছবি দেখলাম। উইকিপিডিয়াতেও ফটোটা দিয়েছে। কিন্তু তরী, একটা কথা মনে হচ্ছে ভারী। চাঁদ সওদাগর চরিত্রটা সত্যি হোক মিথ্যে হোক, কবি তাঁর কল্পনায় গাঙ্গুরের জলে বেহুলার ভেলা ভাসিয়ে ছিলেন কী উদ্দেশ্যে? ধর্মের উত্তেজনায় কি তাঁর বাস্তববোধ হারিয়ে গিয়েছিল? পথে যেতে যেতে স্বর্গ রাজ্য- লক্ষীন্দরের জীবন ফিরে পাওয়াটা কি নিছক মনসা দেবীর যথাযথ প্রচারের এক অতিকাল্পনিক উপাখ্যান? আমার কেন যেন মনে হয় না। কবি এখানে মনসা দেবীকে ঠিক প্রাচীন পুরনো শক্তিশালী দেবদেবীর মতো তৈরী করেননি। এই মনসা অনেকটাই মানুষের মতো যার ক্রোধ, লোভ কাম বাসনা পুরো মাত্রায় আছে। সে সুন্দরী নয়, তার নিজের এক চক্ষু কানা, সে নিজের পূজা প্রসারের জন্য সওদাগরের ভিক্ষাপ্রার্থী। আচ্ছা সে সময়ে আশেপাশে বড় রাজা-মহারাজা কি ছিলেন না যাঁকে বশ করে এই কাজ আরও সহজে যে করা যেত? তুমি অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’ উপন্যাসটা পড়েছ তরী? আমার আজকের লেখাটা অনেকক্ষণই ডায়রির নয় আর দশ তারিখের জন্য বরাদ্দ কাগজটুকু গ্রাস করে ফেলেছে। কী করি? শুনতে ইচ্ছা করছে তোমার? আচ্ছা লিখেই ফেলি তবে।
‘গান আইল্যান্ড’ উপন্যাসটা সুন্দরবন এলাকার প্রাচীন ইতিহাসকে কেন্দ্র করেই। তখন এটা বাংলা তথা ভারতবর্ষের একটা অতি সমৃদ্ধ নগরী ছিল- খানিকটা হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর মতো, হয়ত তার থেকেও উন্নত। তখন সারা পৃথিবীর সাথে জলপথে বাণিজ্য হত এখান থেকে। সেই সময় ভারতের এই অংশে বিষ চিকিৎসার উৎকর্ষ অতিমাত্রায় ছিল। এই চিকিৎসার নাম অগদতন্ত্র। তখন এখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাপের বিষ রপ্তানি হত এবং এইসব জায়গা অনেক সর্পবৈদ্য বসবাস করতেন। যাদের পরম্পরা বয়ে চলেছে এখনকার চাঁদসী সম্প্রদায়। তবে ওদের এখন মূলধারা অর্শ -ফিসার-ফিসচুলা ইত্যাদি রোগ নিয়ে। খেয়াল করে দেখবে চাঁদসী সম্প্রদায়ের চিহ্ন হিসাবে সাপের ছবি আঁকা থাকে। ইদানিং কালের এলোপ্যাথি ডাক্তারবাবুরাও সাপের ছবি আঁকেন যদিও, তবে সে ভিন্ন কথা। বেহুলা খুব সম্ভবত যে বুড়ীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন সে এইসব বৈদ্যর সন্ধানই দিয়েছিল। না হলে ভাবো, কলার ভেলায় কোন স্বর্গপথে পৌঁছাবে গাঙ্গুর নদী। এই নদীর নিম্নগতি মাতলায় মিশেছে যা শেষমেষ সমুদ্রের মোহনায় গিয়ে পড়বে। এখানে স্বর্গ কই? স্বর্গ হচ্ছে আরোগ্য যা এখানকার বৈদ্যরা লক্ষীন্দরকে দিয়েছিলেন। বাকি যা মনসা সংক্রান্ত- সেগুলো গল্পটাকে আরও উপজীব্য করার জন্যই। ভাবো, যেখানে আজ তোমার বসতি, সেইখানে বয়ে চলা নদীর উপর এক রাতে একা একা শূন্য হৃদয়ে রাতে কলার ভেলায় প্রায় মৃত স্বামীকে নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিল বেহুলা। আমি ক'দিন আগে গড়িয়ায় গিয়ে দেখে এসেছি পুকুর দুটো। খুব ইচ্ছে করছিল তোমাকেও ডেকে দেখাই। তোমাকেও নিয়ে যাই ওই গান আইল্যান্ডে।
১১ই নভেম্বর
তুমি ওই কালাচাঁদ ঠাকুরকে কী করে পছন্দ করো তরী? তোমার আর ছেলে জুটল না? বড্ড উদ্ধত। কথা বলতে বলতে শিস দিয়ে গান করে; বিশ্বাস কর, আমার ওই গানগুলোর প্রতিই ভক্তি শ্রদ্ধা উড়ে যায়। মানুষ এত বোদ্ধাও হতে পারে? পৃথিবীর সব বিষয়ে ওর মন্তব্য করা চাই। কোনওকিছুই তার বুদ্ধির অগম্য নয়। আজকেই কোনও কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে ও বললো - প্রবীণদা এত বছরে তুমি একটা বৌদি জোটাতে পারোনি? কথা হচ্ছিল বাড়ীর কাজকর্ম নিয়ে মনোজের সঙ্গে। তোর বাপু মাঝে পড়ে কথা বলার দরকার কী? একেই বলে ডেঁপোমি। বাচ্চাবেলায় ডেঁপোমির জন্য সঠিক দাওয়াই দিতে হয়। তাও বুঝতাম যদি ঘনাদা বা টেনিদার মত ডেঁপোমিতে ওস্তাদ হত! খালি পাকা পাকা কথা। তুমি কী দেখে পছন্দ করো একে তরী? কথায় বলে 'কাউয়া চেনে ঘাউয়া কাঁঠাল'। কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনি। তোমার রুচি, তোমার সংস্কার কী করে ওর ডেঁপোমির মসলায় সাঁতলে ঘরকন্যা সাজাবে- ভাবতেও ভয় হয়।
একবার ছোটবেলায় আমি ডেঁপোমির জন্য খুব সাজা পেয়েছিলাম মায়ের কাছ থেকে। বাবা একবার কোনও এক পত্রিকার জন্য গল্প লিখছিলেন, সেই লেখাটি যখন উনি পত্রিকার সম্পাদককে দিয়েছিলেন আমি পাশ থেকে বলে উঠেছিলাম- জানো তো জেঠু, গল্পটা আমি জানি। এটা আমার দাদুর গল্প। আমি বাহাদুরি মারতে এই কথাটা বলেছিলাম। এতে যে বাবার অসম্মান হয়, এই বোধটা আমার ছিল না। এটা বয়ঃসন্ধিতে বাচ্চাদের হয়। মা সাতদিন আমার সাথে কথা বলেনি। বাবা অবশ্য নিরুত্তাপ ছিলেন।
জানো তরী, আমি যখন কলেজে পড়তাম, আমার সাথে সন্দীপ বলে একটা ছেলে পড়তো। গ্রামের ছেলে, কিন্তু কলকাতায় এসে কর্পোরেশনের জল খেয়ে একটা মেয়ের সাথে লিভ টুগেদার শুরু করলো। মেয়েটির সাথে সন্দীপের রসায়ন যেমনই হোক না কেন, মেয়েটি খুব সুবিধের ছিল না। একটু খেলুড়ে টাইপের। আমার আর একজন বন্ধু ছিল ভাস্কর, অন্য জগতের - তার সাথে সন্দীপের আলাপ ছিল না। একদিন কথায় কথায় জানলাম ছোটবেলায় ওই মেয়েটি ওদের বাড়ীতে ভাড়া থাকতো এবং ভাস্করের সাথে ওর শারীরিক সম্পর্কও ছিল। সন্দীপ আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল বলে বড় মনোদৈন্য হল আমার। ওকে কি আমার ভাস্করের সাথে মেয়েটি রিলেশনের কথা বলা উচিৎ? এখনি সাবধান করলে ওরা ভবিষ্যতের ব্যাপারে অন্যরকম কিছু ভাবতে পারবে। কিন্তু কথাটা কী ভাবে পাড়বো ভেবে উঠতে পারলাম না। দিন গেল, মাস গেল কিন্তু বলে ওঠা আর হল না। এদিকে এসব ভেবে আমার খারাপ লাগাও বাড়তে শুরু করল। একদিন আমি সন্দীপকেই এরকম একটা কল্পনিক গল্প বলে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা এক্ষেত্রে কী করা উচিত?’ সন্দীপ ভারি ভালো একটা কথা বলেছিল, যদি দুজনের নিজেদের মধ্যে রসায়ন জমাটি হয়, মিছিমিছি সেখানে অপ্রয়োজনীয় ঢিল ছুঁড়ে লাভ কী? এতে সব সম্পর্কগুলো খারাপ হবে। যে ছেলেটি সত্য ঘটনাটা বন্ধুত্বের দায় হিসাবে বলতে যাবে সেও কিন্তু ছাড়া পাবে না এই বিষ বাষ্প থেকে। দ্যাখো তরী, কতই বা বয়স তখন সন্দীপের? চব্বিশ পঁচিশ বা বড়জোর ছাব্বিশ। কিন্তু বড় ভালো কথা বলেছিল সে। গত পরশুদিন আমি আইনক্সে একটা মুভি দেখতে গিয়েছিলাম সন্ধ্যেবেলা। সঙ্গে আমার এক বন্ধুও ছিলেন। ফিল্মটা চলাকালীন হলের ওই আলোয় দেখলাম তোমার বয়ফ্রেন্ডটি বসে আছে আমাদের থেকে তিনরো সামনে। সঙ্গে একটি মেয়ে- তোমারই ফেসবুকে আছে ফ্রেন্ডলিস্টে। সিনেমাটি বাবাজীবন কতটা দেখেছে তা সেই বলতে পারবে, তবে যে সিনেমা সে আমাকে দেখালো আমি লজ্জায় হাফ টাইম হওয়ার আগে বেরিয়ে চলে এসেছি- পাছে আলো জ্বললে চোখাচোখি হয়ে যায়। জানিনা তরী, সন্দীপের শিক্ষাটা ঠিক ছিল কিনা।
১৮ই নভেম্বর
আজ ইউ. এস. জিটা করে এলাম। আমার ডাক্তার বন্ধু দেখে টেখে ইউরোলজিস্টের কাছে পাঠিয়েছিল। ইউরেনারি ব্লাডেরের মধ্যে একটা ইরেগুলার মাস আছে, বেশ বড়। সাসপেক্ট করছে কোন ম্যালিগমেন্ট গ্রোথ। বায়োপসি করা দরকার। শুনেছি বায়োপসি করতে গেলে খোঁচাখুঁচি করলে রোগ বাড়ে। রোগ বাড়া না বাড়া নিয়ে যে আমার বিশেষ টেনশন আছে, তা নয়। শুধু ঈশ্বর করুন, আমায় যেন বেশী ভুগতে না হয়। আয়ু নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই আমার। অনেকদিনই বেঁচে নিয়েছি তরী। জীবন থেকে আমার আর চাহিদা কিছু নেই। এমন কিছু আর নেই, যেটা না পেয়েছি বলে আমার দুঃখ আছে। যেগুলো যেগুলো আমার পাওয়া হয়নি, সেগুলো আসলে আমার কোনওদিনও পাওয়ার ছিল না। যে কদিন বাঁচবো, যদি সুস্থভাবে অফিস করে তোমাদের সাথে হেসে খেলে যেতে পারি, তাহলে ভালো লাগবে।
মিথ্যে বলবো না, তোমার সঙ্গ হারাবো- এটা অবশ্যই একটু দুঃখের। কিন্তু তখন তো আর এই দুঃখ অনুভব করার জন্য আমার আমিত্ব বেঁচে থাকবে না, এই যা রক্ষা। তুমি কী বল তরী, আমার কি বায়োপসিটা করে নেওয়া উচিত? ডাক্তাররা তো নিজেরাই কনফিউজড। কেউ বলছে করে নাও। কারও আবার মত নেই। সেদিন কোথায় যেন সংশয় এর সংজ্ঞা টা পড়লাম 'উভয়-হেতু দর্শন'। মানে, এটাও আবার ওটাও। বড় মুশকিল। জীবনে সংশয় এলে জীবনটা বড় টালমাটাল হয়ে যায়।
আজকেই নাকি তুমি অফিসে তোমার বিয়ের নেমন্তন্ন কার্ড দিয়েছ সবাইকে? মনীষদা একটু আগে ফোন করেছিল। আমি তো কালকে অফিসে যাবো না। কিছু টেস্ট ফেস্ট করানোর আছে আরও। পরশু গেলে নিশ্চই আমাকেও চিঠি দেবে। হয়ত কাল ফোনও করতে পারো। কিন্তু তোমার বিয়েতে আমি যাবো না কী বলে? যেতে আমার একদমই ইচ্ছে করছে না তরী। ডিসেম্বরের পনেরো তারিখ। এত তাড়াতাড়ি মরবো না নিশ্চই। কিন্তু কী বাহানায় যাবো না, ভেবেও পাচ্ছিনা। যাওয়া মানে কি কোনওভাবে এই বিয়েতে আমার নৈতিক সমর্থন জ্ঞাপন করা নয়? এই ছেলের সাথে হয়তো তুমি সুখী হবে, কিন্তু আমি একে কোনওভাবেই তোমার সাথে ভাবতে পারবো না তরী। তুমি এমন স্হিতিতে কী করতে, জানতে ভারি ইচ্ছে করে। এমনিতেই শরীরটা ভালো নেই, তার উপর তোমার এই বিয়ের খবরটা যেন সাইক্লোনের মত ধেয়ে এলো আমার কাছে। আমাদের জীবনভর শুধু নীতি আর কর্তব্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বতে আমাদের সাড়া দেওয়াটা নিয়েই আমাদের সংশয়। তুমি দ্যাখো তরী, সারা মহাভারত জুড়ে শুধু এই দ্বন্দ্ব। নৈতিকতা এবং কর্তব্যবোধ। স্বয়ং ভীম, দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র, এমনকি কৃষ্ণরাও দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করতে পারেননি, আমরা তো সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে মজা কি জানো তরী ,আমরা সাধারণ মানুষ নৈতিকতার দিকে পাল্লা ভারী করি, নিজের পক্ষে সেই দোহাই দিয়ে গা বাঁচাই, আর বড় মানুষেরা কর্তব্যবোধকেই বেশি গুরুত্ব দেন। তুমি কি এতদিনের মেলামেশায় বোঝোনি তরী, তোমার ফ্রেন্ডটি তোমার জন্য একেবারেই মিসম্যাচ? নাকি এখানেও নৈতিকতা? ওকে দেওয়া কমিটমেন্টটাকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া নিজের জীবনের থেকে? দ্যাখো, জীবনে কেমন মহাভারত এসে গুলিয়ে যায়! যাকে আমি বা তুমি নৈতিকতা বলে ভাবলাম, আদতে সেটা নৈতিকতা নয়। সেটা হলো আমাদের সমাজের চাপিয়ে দেওয়া ছম কর্তব্যবোধ।
১৫ই ডিসেম্বর
অনেকদিন বাদে আবার ডায়েরী লিখতে বসলাম তরী। এতক্ষণ হয়তো তোমার সব মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গিয়ে থাকবে। তুমি নিশ্চয়ই আমার ওপর অভিমান করার ফুরসৎ পাওনি, কায়দা করে আজই নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে গেলাম। কালকে হলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত তা নয়, তবে তোমাকে না যাওয়ার অনেক অজুহাত বানিয়ে বলতে হত। অবশেষে কালকেই বায়োপসি করার সিদ্ধান্ত নিলাম তরী। চিকিৎসা করার জন্য নাকি সঠিক ডায়াগনোসিস হওয়াটা খুব জরুরী। খুব সম্ভবত কালকে অপারেশনটাই হবে। সেখান থেকেই মাস নিয়ে বায়োপসি করা হবে। আমার বন্ধু তো তাই বললো।
জানো তরী, আজকে আমার আবার অতুল প্রসাদের গানটা গাইতে বড় মন করছে- ‘একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন জলে/ সহসা কে এলে গো এ তরী বাইবে বলে/ ভাসিয়েছিলাম নয়ন জলে....’ স্বয়ং ঈশ্বরই এই তরণীর ভার নিয়ে নেবেন গো তরী। ‘আমার তরী থাকবে ডুবে সাগর অবাধ জলে/ বেহুলা আবার পথ ভুলেছে স্বর্গ খোঁজার ছলে।’ ডাইরী লিখতো যে লখীন্দর, তাকে কবে সাপে ছোবল মেরেছে গো! তার বেহুলা হারিয়ে গেছে সরষে হলুদ বনে, তাও আজ অনেকদিনের কথা। শুধু নিজের মৃতদেহ ভেলায় ভাসিয়ে আর কতদূরে পাড়ি দেবে লখীন্দর? তুমি চিন্তা করোনা, কালকের যাত্রায় যদি বেঁচে যাই, এই লখীন্দরের রোজনামচা ভাসিয়ে দিয়ে আসবো গাঙ্গুরের জলে। কিছু না হোক, তোমার পৈতৃক বাড়ীর তো কাছাকাছি। বেহুলাও তো একদিন গাঙ্গুরের জলে ভেলা নিয়ে ‘কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায় -সোনালী ধানের পাশে অসংখ্য অশত্থ বট দেখেছিল হায়/ শ্যামার নরম গান শুনেছিল…’
0 Comments