বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৯৭
তেলাকুচা
ভাস্করব্রত পতি
"তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে
নরম ঘাসের পাতে
চম্বন রাখি অধরখানিতে
মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচা – লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি
বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার গায়ের রংখানি তুমি
দেখিবে তাদের পাতে।
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে,
তোমারে সঙ্গে করি,
নদীর ওপারে চলে যাই তবে
লইয়া ঘাটের তরী"।
-- নিমন্ত্রণ, জসীমউদ্দীন
বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে পাই "শাক তেলাকচু"। ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্ম্মমঙ্গলে পাই 'পাকা তেলাকুচা" শব্দবন্ধ। গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন ঝোপঝাড়ে এবং প্রাচীর বা বেড়ার গায়ে অযত্নে জন্মায় এই তেলাকুচা। অনেকটা কুঁদরির মতো দেখতে। তবে ফলগুলি বেশ মোটাসোঁটা। সবুজ ফল পেকে গেলে টকটকে লাল রঙের হয়।
তেলাকুচার ফুল
ওড়িয়াতে গোখুরিয়া, কাইঞ্চি কাকুড়ি (যার ফল কুঁচতুল্য লাল এবং কাঁকুড়ের মতো) বলে তেলাকুচাকে। এছাড়া সংস্কৃতে বিম্বি, বিম্ব, তুণ্ডিকা, কটুতুন্ডী, তুন্ডীকেরী, মারাঠীতে কড়ুতোন্ডপী, হিন্দিতে কন্দুরি কি বিল, কণ্ডবীকন্দুরী, গুজরাটিতে কড়বী ঘোলী, কন্নড়ে টোণ্ডেকায়ি, তেলুগুতে ডোণ্ডাকায়া, তীতকুন্তক, তামিলে কোভাক্কায়ি, অসমীয়াতে কুন্ডুলী, মালয়লামে কোভাক্কা, পাঞ্জাবীতে কন্দুরি, ফারসিতে কাবারে হিন্ডি বলে। তেলাকুচা অবশ্য কুদরি, কুদ্রা, কুচিলা, তেলাহচি, টেণ্ডুরা, কেলাকুচ, তোড়নি শাক, কাউয়ালুলি নামেও পরিচিত। ইংরেজিতে Ivy Gourd, Little Gourd, Scarlet Gourd, Baby Watermelon, Gentleman's Toes বলে। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Cephalandra indica। যা Cucarbitaceae পরিবারভুক্ত।
ভারত ছাড়াও তেলাকুচা গাছ জন্মাতে দেখা যায় থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামে। শাক হিসেবে ব্যবহৃত হয় গাছটি। মূলত এর কচি পাতা ও কাঁচা ফল খাওয়া হয়। ভারতে এই গাছের চাষ হয়না। কিন্তু আপনা আপনিই জন্মায়। কোনও রকম যত্নআত্তির প্রয়োজন পড়ে না।
পাতার আড়ালে সবুজ তেলাকুচা ফল
তেলাকুচা গাছ লতিয়ে লতিয়ে বেড়ে ওঠে। অন্যান্য গাছকে জড়িয়ে বেড়ে ওঠে। বহুবর্ষজীবী গাছ। গাঢ় সবুজ নরম পাতা ও সবুজ কাণ্ড দেখা যায়। হাতের পাঞ্জাব মতো পাতা। ঘন সবুজ পাতা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাদা রঙের ফুল ফোটে। ফলগুলি পটলের মত বড় এবং তেতো। পুরুষ ফুল ও স্ত্রী ফুল আলাদা গাছে হয়। এদের বড় বড় শিকড় হয়।
তেলাকুচার পাকা লাল ফল ও কাঁচা সবুজ ফল
ঝোপঝাড়ে, নদীর পাড়ে, বেড়ার ধারে, বাগানে, রাস্তার ধারে, বসতবাড়ির আশেপাশে, রাস্তার পাশে জন্মায়। অন্য কোনও গাছকে জড়িয়ে বেড়ে ওঠে। এদের মূল সহজে শুকিয়ে যায় না। তাই বর্ষার জল লেগে ফের নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে। শীতকালে ফুল হয়না। কিন্তু বাকি সময় এদের ফুল ও ফল দেখতে পাওয়া যায়। পেকে গেলে ফলের রঙ লাল হয়ে যায়। কবি আতিকুর রহমান শেখ তাঁর 'লাল টুকটুক লাল টুকটুক' ছড়ায় উল্লেখ করেছেন তেলাকুচার পেকে যাওয়া লাল রঙের ফলের কথা --
"লাল টুক টুক লাল টুক টুক
তেলাকুচার ফল,
শালিক পাখি উড়কু নাচে
ঠোঁটের কোনে জল।।
লাল টুক টুক লাল টুক টুক
তেলাকুচার ফল,
দাদার উঠানে ধান খেয়ে যায়
তেলাকুচার ফলে মেলে মাস্ট সেল স্টেবিলাইজিং, এনাফাইলেকটিক রোধী এবং এন্টিহিস্টামিন জাতীয় নানা উপাদান। জ্বর, হাঁপানি, জন্ডিস, ব্রঙ্কাইটিস, ছুলি, কুষ্ঠরোগের উপশমে তেলাকুচা উপকারী। হাতে যুসিপোকা লেগে হাতের তালু চুলকালে বা চামড়া উঠতে থাকলে এই তেলাকুচা গাছের পাতা ঘসে রস বের করে লাগালে উপশম হয়। এছাড়াও এই পাতার ঝোল খাওয়ানো হয় পেটের রোগীদের। রক্ত আমাশয়, সাদা আমাশয়ের পক্ষে খুব কার্যকরী। তেলাকুচার মধ্যে ভালো পরিমাণ থায়ামিন আছে। তাই এটি পরিপাক করতে সহায়ক। তেলাকুচা অবশ্য প্রাকৃতিক ইনসুলিন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
🍂
0 Comments