চিত্রা ভট্টাচার্য্য
(বাইশতম পর্ব)
(কাজরী রাগ ও গজল গানে কবি)
শ্রাবণী আকাশে ঘনঘোর কাজলা মেঘের দৌরাত্মি। ক্ষণেক্ষণে শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বারি ধারায় সিক্ত ত্রিভুবন , আত্মভোলা বিরহী কবির মন নিঃসীম মহাশুন্যের দিকে তাকিয়ে, তাঁর মনে পড়ে মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের বিরহকাতর যক্ষকে। আষাঢ়ের প্রথম মেঘ দর্শনে প্রিয়ার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য যক্ষ আকুল হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিরহিনী প্রিয়া যে বহুদূরে তাঁর নাগালের বাইরে। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে শ্রাবণে প্রেয়সীর কাছে মনের আগল খুলে জমে থাকা বিস্তর অনুরাগের কথা জানাতে মেঘ কে দূত হওয়ার জন্য যক্ষ অনুরোধ করলেন।
কবি নজরুলের বিরহ কাতর বিচলিত মন একান্তে তাঁর প্রেয়সীর অভাব অনুভব করলেন। মনের মাঝে বাজলো রাগ রাগিনীর অনন্ত ঝংকার।কাজরী রাগে তাঁর রচিত গান গাইলেন --
''শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না
বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না॥
ধানি রঙ ঘাগরি, মেঘ-রঙ ওড়না
পরিতে আমারে মাগো, অনুরোধ ক'রো না
কাজরির কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া
সে কি ফেরার পথ পেল না মা, পেল না॥''
বিরহিণী প্রিয়া ঘরে বন্দিনী। বুনো হাঁসের পাখা যেমন ওড়বার নেশায় উন্মুখ, চঞ্চল- তেমনি তার মনও প্রিয়জনের সাথে মিলনের আকাঙক্ষায় উদ্বেলিত।কবি বিরহিণী প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখে শ্রাবণের প্রবল বরিষণের ধারায় শুষ্ক প্রকৃতির তৃষ্ণার আগুন নিভে গেছে কিন্তু পরক্ষণেই ভাবেন তার মনের বিরহ অনলের জ্বালা ধিকিধিকি করে জ্বলছে। বর্ষার প্রস্ফুটিত কদম তাকে যেন ব্যঙ্গ করে বলে, কোথায় তোর কিশোর শ্যামরূপী দয়িত। চম্পা ডালে বাতাসের আন্দোলনে আজ কাজরির শূন্য দোলনা দোলে। বিরহিণী কৃষ্ণবিহীন রাধার মতো শুধুই মিলনের দোলনায় শূন্যতা অনুভব করে। তবু দুর্বার প্রত্যাশায় প্রতীক্ষার ক্ষণ বয়ে যায়।
কবির কণ্ঠে মধুর স্বরধ্বনি।-কলমে স্বয়ং দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদ। মেঘাবৃত আকাশর দিকে চেয়ে অসীমের প্রেরণায় কাজরী রাগে একে একে গীত রচিত হলো। কবি সুরের খেয়ায় ভাসলেন। স্রষ্টা সৃষ্টি করলেন এক অনন্য সাধারণ নব মেঘদূত ---
পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে।
বলিও আমার পরদেশী রে॥
সে দেশে যবে বাদল ঝরে
কাঁদে নাকি প্রাণ একেলা ঘরে,
বিরহ-ব্যথা নাহি কি সেথা বাজে না বাঁশি নদীর তীরে॥
মেঘদূতের বিরহী যক্ষ তাঁর বার্তা পাঠিয়েছিলেন প্রেয়সীকে।সে বার্তা পাওয়ার পর প্রেয়সীর মনে যে ভাবান্তর ঘটেছিল, কবি যেন এই গানেই তার প্রত্যুত্তর দিয়েছন। গানের শুরুতেই বিরহিনী মেঘদূতকে জানায় - হে ভিনদেশী মেঘ, তুমি ফিরে গিয়ে প্রবাসী প্রেমিক কে আমার কথা বলো। 'পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে/ বলিও আমার পরদেশীরে'। তাঁর পরদেশী প্রেমিকের দেশে যখন বর্ষা নেমে আসে, তখন কি একলা ঘরে সঙ্গীবিহীন বিরহব্যথায় তাঁর মন কাতর হয় না?সে দেশের নদীতীরে কি বিরহ-ব্যথায় করুণ বাঁশি বাজে না ?
🍂
নজরুল কাজরী রাগের উপর ভিত্তি করে গান রচনা করেছেন, যা তাঁর বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির অংশ। এই গানগুলির মধ্যে "কাজরীর কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া, সে কি "তাঁর রচনার একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশ । নজরুল তাঁর গানের সুরে কাজলী বা কাজরী, হোলি, ঝুলা, শাওনি এবং শাওন-এর মতো হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা ব্যবহার করে রাগরাগিণী সৃষ্টিতে গভীর জ্ঞান ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন ।
শ্রাবণের বারিধারায় শ্যামলে শ্যামল সবুজের বন্যায় পরিপূর্ণ ধরণী কে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের জনজাতি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি ধারা কাজলী বা কাজরীর লোকগীতি ও নৃত্যধারা দিয়ে বরণ করে। .মেঘমেদুর আকাশ থেকে বর্ষার আগমনের সাথে কৃষি শ্রমের মতো বিষয়গুলিকে প্রাণের আবেগে বন্দনায় তারা তুলে ধরেন। বর্ষার আগমন, আকাঙ্ক্ষা ও বিচ্ছেদ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত কাজরী গান মূলত শ্রাবণ মাসেই গাওয়া হয়। মহিলারা দোলনায় দোদুল্যমান অবস্থায় ঢোলের বাজনার সাথে এই লোকগীতি গেয়ে থাকেন।এই গানের উৎপত্তি ভোজপুরি অঞ্চলে।
এটি ভোজপুরি, মৈথিলী ও মগধী ভাষাতেও গাওয়া হয়। উত্তরপ্রদেশ, বিশেষ করে এলাহাবাদ, বারাণসী এবং মির্জাপুর অঞ্চলের কাজরী লোকগীতি একটি বহুল প্রচলিত ঐতিহ্য। কবি নজরুল "কাজরী" নামের এই নির্দিষ্ট ধারার গানগুলোতে "লাউনী" নামক উপাদানের ব্যবহার করে এই গানের সুর রচনা করেন এবং ''কাজলী 'বা "কাজরী"গানের ধারা কে একটি বিশেষ রূপ দিলেন উত্তরপ্রদেশ বিহার অঞ্চলের এ লোকগানের সুরে সংগীত রচনা তাঁর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কীর্তি যা "নজরুল গীতি"র অংশ হয়ে সর্বত্র খ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করেছে।
বর্ষা ঋতুর বর্ণনায় প্রেম, বিরহ ও এবং অন্যান্য আবেগ মিশ্রিত সাজে প্রকৃতির নিখুঁত রূপ প্রকাশ পেল কাজরী রাগে রচিত আরেকটি গান ---
"কাজরি গাহিয়া এসো গোপ-ললনা"।
শ্রাবণ-গগনে দোলে মেঘ-দোলনা॥
পর সবুজ-ঘাগরি চোলি নীল ওড়না,
মাখো অধরে মধুর হাসি, চোখে ছলনা॥
কদম-চন্দ্রহার প'রে এসো চন্দ্রাবলী
তমাল-শাখা-বরণা এসো বিশাখা-শ্যামলী,----
কাজরী গান গেয়ে বৃন্দাবনের বর্ষাকালীন ঝুলন উৎসবে সকল গোপ-ললনাদের সুসজ্জিতা হয়ে মিলিত হতে কবি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি রাধার সখি রঙ্গপ্রিয় বিশাখা, ললিতা এবং কুলকলঙ্কিনী হওয়ার ভয়ে ভীতা ব্রজবধূদের ও আহ্বান করেছেন এই ঝুলনোৎসবে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে উৎযাপন করার জন্য। এমন কি তিনি রাধার প্রেম-প্রতিদ্বন্দ্বী কৃষ্ণারাগিণী চন্দ্রবলীকে কদম-চন্দ্রাহারে সুশোভিতা হয়ে এই উৎসবে নিমন্ত্রণ জানালেন। উৎসবের সাজসজ্জায় ও প্রকৃতির বর্ণনায় কবি ব্যবহার করেছেন অপূর্ব রূপকল্প চিত্র।
শ্রাবণের আকাশের দোলায়িত মেঘ যেন ঝুলনের দোলনা। ঘন নীলাম্বরী মেঘের সাথে রঙ মিলিয়ে রাধার সখীরা সাজবেন সবুজ ঘাগরির সাথে নীল ওড়নায়। কলঙ্কের ভয়ে ভীতা ব্রজবধূবালারা ও ফুল সাজে সাজবেন। তাঁদের অধরের মধুর হাসিতে আর চোখের ছলনায় ঝুলন হয়ে উঠবে শৃঙ্গার রসের সিক্ত প্রেম ময়। তাঁদের নৃত্যগীতে উদ্বেলিত ছন্দের অনুষঙ্গী হয়ে তালবনের পাতার করতালে মুখরিত হয়ে উঠবে দিগন্ত।
এই ঝুলনোৎসবের ছন্দ-সৌন্দর্যকে সঙ্গ দিতেই শ্রাবণ-মেঘের দোলনার আবির্ভাব যা আকাশের সাথে কবির মনকেও দোলায়িত করেছে। কবি নজরুলের রচনায় রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে একাধিক রসসিক্ত ভক্তিগীতি পাওয়াযায় , --"কৃষ্ণ কৃষ্ণ বল্ রসনা রাধা রাধা বল্"বা "মম মধুর মিনতি শোন ঘনশ্যাম গিরিধারী"--- , যেখানে রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কের গভীরতা তুলে ধরা হয়েছে। রাধাকৃষ্ণের লীলায় রাগ অনুরাগের পালায় কাজরী রাগে কবি গাইলেন ---
''রঙ্গিলা আপনি রাধা তারে হরি রঙ দিওনা ''--
বা '' আজি নন্দ দুলালের ও সাথে খেলে ব্রজনারী হোলী ''
কাজরী রাগে আরেকটি হৃদয় স্পর্শী গান যদিও তা সরাসরি রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে নয়।
---"কে সাজালো মাকে আমার বিসর্জ্জনের বিদায় সাজে": গানে কবির ভক্তিধর্মী সুরের স্পষ্ট প্রকাশ পাওয়া যায় ।
"কে সাজালো মাকে আমার বিসর্জনের বিদায় সাজে
আজ সারাদিন কেন এমন করুণ সুরে বাঁশি বাজে॥
আনন্দেরি প্রতিমাকে হায়, বিদায় দিতে পরান নাহি চায়
মা-কে ভাসিয়ে জলে কেমন ক’রে রইব আঁধার ভবন মাঝে॥"-----
'শারদোৎসবে আনন্দ ধারায় মাতৃরূপিণী দুৰ্গা দেবীর অভয় রূপের আগমনে ভক্তদের দুঃখপীড়িত জীবনস্রোতে জেগেছিল আনন্দের জো্য়ারে। সুখের উৎস ছিল মাতৃরূপিণী-- কল্যাণরূপিণী দেবী।দুর্গাপূজার অবসানে দেবীর বিসর্জনে বেদনবিধূর অভিব্যক্তিই দিয়েই এই গানের শুরু। দেবীপক্ষের মহালয়া থেকে দশমী পর্যন্ত সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই পূজা হয়ে ওঠে ভক্তি ও আনন্দ সুখের মহোৎসব। এই মিশ্রিত উৎসবে ভক্তরা ভুলে থাকেন যাপিত জীবনের সকল দুঃখ ভয় বিড়ম্বনাকে। কিন্তু উৎসব শেষে মায়ের বিদায়ীবেলায় ভক্তের মন ভারাক্রান্ত চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে আবেগাশ্রিত বেদনাবিধুর অসহনীয় অনুভবে । দশভুজা মা তাঁর দশ হাতে এনেছিলেন যে আনন্দধারা, তাঁর বিসর্জনের পালায় বেদনা দ্বিগুণ হয়ে বিষণ্ণ করে তুলেছে ভক্ত তথা কবির হৃদয়কে।' তাই তো তিনি বলেন," মা মৃন্ময়ীকে ভাসিয়ে জলে,পাব চিন্ময়ীকে বুকের মাঝে॥'' ব্যথিত কবি নিজেকে স্বান্তনা দিলেন চিন্ময়ী হয়ে মা দুর্গা সর্বদা অন্তরে বিরাজ করবেন।
আপন আনন্দে মুখরিত স্রষ্টাকবির সৃষ্টির অমূল্য ধারায় মন নিবেশ করে দেখি ১৯২৬ সালের শেষ দিক থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত প্রায় একটানা বহু উৎকৃষ্ট গজল রচনা করলেন যার বিষয়বস্তু প্রেম,ও প্রকৃতি মিশ্রিত এবং অধিকাংশই কৃষ্ণনগরে রচিত। সেগুলির বাণী প্রায়শ উৎকৃষ্ট কবিতা, সুর অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাগাশ্রিত এবং আঙ্গিকের দিক থেকে প্রায় উর্দু গজলের মতোই। তাতে আগাগোড়া তালের প্রয়োগ নেই, কিছু অংশ তাল ছাড়া মুক্তছন্দ ও আলাপের রীতিতে রচিত এবং বাকি অংশ তালের কাঠামোতে গ্রথিত। নজরুল গজল গানের সুরেই প্রথম রাগের ব্যবহার করেন, যা ক্রমশ বিচিত্র ও ব্যাপক হয়। ভীমপলশ্রী রাগে রচনা করেছিলেন ‘‘আসে বসন্ত ফুলবনে’ .সাজে বনভূমি সুন্দরী /চরণে পায়েল রূমঝুম /মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি। .
ভৈরবী রাগে রচনা করেছিলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বহুশ্রুত একটি গজল---,
"বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে
দিসনে আজি দোল ।
আজো তার ফুলকলিদের ঘুম টুটেনি
তন্দ্রাতে বিলোল ।।
আজো হায় রিক্ত শাখায় উত্তরীবায়
ঝুরছে নিশিদিন
আসেনি দখনে হাওয়া গজল গাওয়া
মৌমাছি বিভোল ।।‘
বুলবুল এবং ফুলের মধ্যে একটি রূপক সম্পর্ক তৈরি করে তিনি গানের মাঝে প্রেম, বিরহ এবং প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক তুলে ধরতে চেয়েছেন। যেখানে বুলবুল হলো প্রেমিকের প্রতীক এবং ফুল হলো প্রিয়তমার প্রতীক। প্রেমিকের মনে বিষাদ এবং প্রিয়তমা কবে আসবে তার জন্য গভীর অপেক্ষার অনুভূতি এই গানের সুর তাল লয়ে প্রকাশ পেয়েছে। "ঘুমন্ত তন্দ্রাতে বিলোল" ফুলগুলোতে বুলবুল যেন অসময়ে দোল না দেয় । গানটির শেষে রূপকের মাধ্যমে কবি যেন বোঝালেন অপ্রীতিকর বা অনুচিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার জন্য এক গভীর দুঃখের অনুভূতিতে মন পীড়িত হয়।
সে সময় কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে নজরুলের নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নজরুলের গজলগুলি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে দিলীপকুমারের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। রাগসঙ্গীতে পারদর্শী দিলীপকুমারের কণ্ঠে রাগাশ্রিত সুরে নজরুলের গজলগুলি রচয়িতার কাঙ্ক্ষিত রূপ লাভ করে এবং অসাধারণ শ্রুতিমধুর হয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। শ্রদ্ধেয় দিলীপকুমার তাঁর দরাজ গলায়, সুমধুর কণ্ঠে কাফি-সিন্ধু রাগে ও কাহারবা তালে গাইলেন
"দুরন্ত বায়ু পুরবৈয়াঁবহে অধীর আনন্দে।
তরঙ্গে দুলে আজি নাইয়ারণ-তুরঙ্গ-ছন্দে॥
অশান্ত অম্বর-মাঝেমৃদঙ্গ গুরুগুরু বাজে,----
আতঙ্কে থরথর অঙ্গ মন অনন্তে বন্দে॥
ভূজঙ্গী দামিনীর দাহে দিগন্ত শিহরিয়া চাহে,
বিষন্ন ভয়-ভীতা যামিনী খোঁজে সে তারা চন্দে
মালঞ্চে এ কি ফুল-খেলা, আনন্দে ফোটে যূথী বেলা "
বাণী ও সুরের মেলবন্ধনে বর্ষার এক চিত্রময় রূপ এঁকেছেন কবি। -প্রবলতর হাওয়া বইছে,অজস্র বারিধারা বুকে নিয়ে অধীর আনন্দে মেঘ প্রবাহিত হচ্ছে। যোদ্ধা ঘোড়া যেমন রণক্ষেত্রে ছুটে চলে তেমনি যেন নদীর ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে মেঘের পানসি ও ছুটে চলেছে। আকাশের মেঘমালায় বাজছে গুরুগুরু মৃদঙ্গের ধ্বনি। নানা উপমায়, বিভিন্ন রূপকল্পের ভিতর দিয়ে নিপুণ চিত্রকরের মতো কবি বর্ষার মেঘের, বারিধারার বর্ণনা করেছেন । সেই মেঘনাদের শব্দে আতঙ্কিত ধরণী থরথর করে কাঁপছে দেহ-মন। আকাশে সাপের মতো বিদ্যুৎরেখার প্রাবল্যে দিগন্ত ভয়ে শিহরিত। আলোহীন অন্ধকার রাত্রি ও যেন ভয় পেয়ে, আলোর আশায় আকাশের চাঁদ তারা কে খোঁজে। কিন্তু তবুও এরই মাঝে বর্ষার ফুল-যূথী, বেলি ফোটে সুরভিত হয়। বিরহী কোকিলের কুহ আর ময়ূরীর প্রেমঘন কেকা ধ্বনির সাথে অবিরাম জলধারায় কবি নিজের চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দে বিচলিত হয়ে ওঠেন।
মান্দ রাগে,কাওয়ালির সুরে গাইলেন ---
''এত জল ও-কাজল-চোখে
পাষাণী, আনলে বল কে।
টলমল জল-মোতির মালা
দুলিছে ঝালর-পলকে॥
দিল কি পুব-হাওয়াতে দোল,
বুকে কি বিঁধিল কেয়া?
কাঁদিয়া কুটিলে গগন
এলায়ে ঝামর-অলকে॥"
"পাষাণী"হৃদয়া নারীর"কাজল চোখে জলের মতি বিন্দু -- কবি জানতে চাইছেন কঠোর হৃদয়া "নারী এত দুঃখী, কী কারণে? এবং কীভাবে তিনি এত বিষণ্ণ? "টলমল জল মোতির মালা দুলিছে ঝালর-পলকে"। পাষাণী নারীর চোখের জল মোতির মালার মতো তার আঁখি পল্লবে ঝুলে আছে, যা প্রেমিকের হৃদয়কেও চঞ্চল করে তুলছে । কবি ভাবছেন --পূর্ব হাওয়ায় দোল খেতে গিয়ে বা কেয়াফুলের কাঁটার আঘাত লেগেছে। তাই তার চোখ অশ্রু সজল তিনি কাঁদছেন।
'নজরুল ওস্তাদদের সংস্পর্শে এসেছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এবং কলকাতা বেতারে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পরে, কিন্তু তার আগেই যে তিনি রাগসঙ্গীতে ব্যুৎপন্ন ছিলেন, সে পরিচয় স্পষ্ট পাওয়া যায় তাঁর সৃষ্ট রাগ রাগিণী,গজল গান বিভিন্ন আঙ্গিকের গানের সুরে ও তালের ব্যবহারে পারদর্শীতায়।তাঁর বুলবুল (১৯২৮), চোখের চাতক (১৯২৯) এবং চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০) গীতি-সংকলনের অধিকাংশ গানের সুরই রাগ নির্ভর। বুলবুল-এর গানগুলি গজল আঙ্গিকে হলেও চোখের চাতক এবং চন্দ্রবিন্দু-র গানগুলি গজল ছাড়াও অন্যান্য আঙ্গিকের।
ক্রমশঃ
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
1 Comments
অসাধারণ লেখা! প্রিয় কবি ও নজরুলগীতির ওপর অনেক অজানা তথ্য আহরণ করতে পারলাম
ReplyDelete