দূরদেশের লোকগল্প— ২৬৫
দক্ষিণ আফ্রিকা-- জুলু উপজাতি (আফ্রিকা)
রাজাকে বোকা বানানো
চিন্ময় দাশ
অনেকদিন আগের কথা। ঘন বনজঙ্গলে ঢাকা এক পাহাড়। অনেক জীবজন্তুর বাস সেখানে। বাঘ, সিংহ, হাতি, ভালুক, হায়না-- কে নাই?
তাদের সাথে সেই পাহাড়ে থাকে এক শেয়াল। সকলের চোখের আড়ালে তার বাসা। একটা ঝোপের পেছনে, সরু মুখওয়ালা একটা গর্তের ভেতর। বউ-বাচ্চা নিয়ে সেখানেই ডেরা তার।
একদিন শেয়াল বেরিয়েছে খাবারের খোঁজে। এমনটা তাকে প্রতিদিনই বেরোতে হয়। তখন শেয়ালটা যাচ্ছে একটা পাহাড়ি রাস্তা ধরে। বেশ সরু রাস্তা। একদিকে দিকে গভীর খাদ। এতটাই গভীর যে নিচের দিকে তাকানো দায়। বুক ঢিপ-ঢিপ করবে ভয়ে। অন্যদিকে খাড়া পাহাড়। তাতে আবার কোথাও কোথাও বড় বড় পাথর ঝুলে আছে। দেখলেই মনে হবে, এই বুঝি মাথার উপর খসে পড়ল।
নিজের মনেই যাচ্ছিল শেয়াল। হঠাৎই দেখতে পেল, উল্টো দিক থেকে একটা সিংহ এগিয়ে আসছে ওই রাস্তাটা ধরেই। সর্বনাশ। একেবারে সাক্ষাৎ যমের মুখে পড়ে গেলাম আজ। সক্কাল বেলা। নিশ্চয় খালি পেটে বেরিয়েছে শয়তান। চোখে পড়লেই কপ করে গিলে খাবে। অথচ সরে পড়বারও উপায় নাই কোনও।
মাথার ভিতর চিড়িক করে উঠলো শেয়ালের। স্বভাবে ভারি ধূর্ত শেয়াল। তেমনি বুদ্ধিধরও। একটা বুদ্ধি এসেও গেল মাথায়। বোকা বানানো ছাড়া, সিংহের হাত থেকে বাঁচবার অন্য কোনও উপায় নাই এই মূহুর্তে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ঝট করে রাস্তার উপরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। চারখানা পা খাড়া করে তুলে রেখেছে ওপর দিকে। চিৎকার আরম্ভ করেছে—বাঁচাও, বাঁচাও।
চোখ টেরা করে তাকিয়ে নিল। দেখল, সিংহ তখন প্রায় এসে পড়েছে। আবার চেঁচিয়ে উঠলো-- মরে গেলাম। কে আছো, বাঁচাও আমাকে।
সিংহও দেখতে পেয়েছে পুঁচকেটাকে। বিষম একটা ধমক দিয়ে উঠল-- চুপ কর হতভাগা। খামোখা এমন চেঁচাচ্ছিস কেন? ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছিসই বা কেন?
শেয়াল ভাবি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। বলল—হায় হায়, আপনি? সাবধান, মহারাজ। দেখছেন না, পাথরটা ভেঙে পড়ছে মাথার উপর। তাই তো এমন পা তুলে ঠেকে রাখার চেষ্টা করছি।
সিংহ বলল—ঠেলে না রাখলে?
--ঠেলে না রাখলে, কী আর হবে? শেয়াল বলল—দুজনেই বেঘোরে মারা পড়বো। থেঁতলে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে যাব পাথরের তলায়। তার বেশি কিছু হবে না।
মারা পড়বার কথা শুনে, সিংহ একটু থমকে গিয়েছে। তা দেখে, শেয়ালের মনে বড় পুলক। ঠিকঠাক চমকে দেওয়া গেছে রাজাকে। বলল—একেবারে ঠিক সময়ে আপনি এসে পড়েছেন। ভালোই হয়েছে। কিছু একটা করুন, মহারাজ।
শেয়ালের কথা শুনে, উপর দিকে চেয়ে দেখলো সিংহ। সত্যি সত্যি পাথরটা খুবই ঝুলে আছে। তা বলে, এখনই কি আর ভেঙে পড়বে? এমনটা ভাবল বটে, মনে মনে একটু ভয়ও করতে লাগলো। যদি সত্যিই পড়ে যায়? তাছাড়া, পড়বার ভয় না থাকলে, এই হতচ্ছাড়াই বা ভয় পাবে কেন?
সিংহকে বেশি ভাববার সুযোগ না দিয়ে, শেয়াল বলল—হুজুর, আপনার পায়ে তো বেদম জোর। একটু কাজে লাগান পা দুটোকে। তাতে দুজনেই বেঁচে যাব বিপদ থেকে।
সিংহ চকিত হয়ে বলল—আরে, হতভাগা। করবোটা কী, সেটা তো বলবি।
শেয়াল ঠিক এই কথাটাই শুনতে চাইছিল। সে তাড়াতাড়ি বলল-- বেশি কিছু করতে হবে না আপনাকে। আপনি শুধু এইভাবে চার পা দিয়ে ঝুলন্ত পাথরটাকে একটু ঠেকিয়ে রাখুন। জোর দিয়ে ঠেলে রাখবেন কিন্তু।
সিংহ জানতে চাইলো-- আর তুই কী করবি?
শেয়াল বলল-- আমি দৌড়ে যাই। কতকগুলো কাঠের যোগাড় করে আনি। আপনি হলেন রাজামশাই। কাঠ খোঁজাখুঁজির কাজ আপনি পারবেন না। মানাবেও না আপনাকে। তার চেয়ে বরং…
সিংহ যেমন বিরক্ত, তেমনি একটু অবাকও হয়েছে শুনে। বেশ রাগ-রাগ ভাব দেখিয়ে বলল-- কাঠ দিয়ে কী করবি তুই? শেয়াল বলল-- কাঠগুলো ঠেকনা দিয়ে দেবো পাথরটা্র তলায়। তাতে পাথর পড়তে পারবে না। সেই সুযোগে আমরাও দুজনে সরে পড়বো এখান থেকে। প্রাণটা তো বাঁচাতে হবে আগে।
এমন কথা শুনে, মনে মনে বেশ খুশিই হল সিংহ। মুখে বলল-- তুই ধূর্ত বটে। সেই সাথে ঘটে উপস্থিত বুদ্ধিও আছে তোর। শিয়াল মনে মনে বলল—আমার ঘটে কত বুদ্ধি, সেটা এখনই বুঝতে পারবে। এদিকে সিংহ ভাবল, আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো। বনের রাজা বলে কথা। এভাবে ধুলোমাটির উপর চার পা তুলে গড়াগড়ি খাওয়া যায় কখনো? কারো চোখে পড়ে গেলে, তখন কী হবে? মান সম্মান বলে কিছু থাকবে না আর। হাসাহাসি করবে সবাই। মুখে বলল—সবই তো বুঝলাম। কিন্তু বাপু, পথের উপর চার পা তুলে গড়াগড়ি দেওয়া, আমার দ্বারা হবে না।
শেয়াল দেখল ভারী বিপদ। সে আতঙ্কের গলায় বলল-- তাহলে ঠেকাবেন কী করে ভারী পাথর? তবে কি মরবেন?
সিংহ জোর গলায় হেসে উঠল হা হা করে। বলল-- দূর হতভাগা। মরতে যাব কেন? এমনিই বললাম, আর কী? তুই তোর কাজে যা। কাঠের যোগাড় কর তাড়াতাড়ি। দেখিস আমাকে যেন বেশি কষ্ট করতে না হয়।
এই বলে সিংহ এগিয়ে গিয়ে, চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে উপর দিকে ঠেলতে লাগলো পাথরকে।
--বলিহারি যাই, মহারাজ। যেমন আপনার বিবেচনা, তেমনি গায়ের শক্তি। বলতে বলতে গা ঝাড়া দিয়ে, শেয়াল উঠে দাঁড়ালো মাটি থেকে। বলল-- একটুখানি সময় ধরে রাখুন, হুজুর। কাঠ জোগাড় করে আনতে বেশিক্ষণ লাগবে না আমার। এই গেলাম আর এলাম।
এই বলে সুড়ুৎ করে শেয়াল সরে পড়ল সেখান থেকে। মনে মনে ভাবল, যাক বাবা। আজকের মত প্রাণটা তো বাঁচানো গিয়েছে। সেই অনেক।
অনড় পাহাড়কে কতক্ষণ ধরে ঠেলা লাগিয়ে, একা শুয়ে ছিল সিংহ, সেকথা কেউ জানে না। তবে এটা সবাই জানে যে, বনের রাজাকে বোকা বানিয়ে, বেশ গুমোর হয়েছিল শেয়ালের। ঘুরে ঘুরে বনের সবাইকে শুনিয়েছিল রাজাকে বুদ্ধু বানাবার সেদিনের কাহিনী।
তবে, সেদিনের পর থেকে পশুরাজকে দু’গুণ সমঝে চলে শেয়াল। খুব হুঁশিয়ার হয়েও থাকে সবসময়। সামনা সামনি না পড়ে যায় কখনও। মনে ভালোই জানে, এবার বাগে পেলে, আর রেহাই থাকবে না। একেবারে দফা রফা করে ছাড়বে সিংহ। কোন চালাকিই খাটবে না আর।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments