জ্বলদর্চি

উপকারী মুচি/সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস/কথক- গোপাল দাস

জঙ্গলমহলের লোকগল্প 
উপকারী মুচি

সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস

কথক- গোপাল দাস, গ্ৰাম-বেড়াজাল, থানা-নয়াগ্ৰাম, জেলা-ঝাড়গ্ৰাম 

এক গ্ৰামে রামু আর সামু নামে দুই মুচি বাস করত। সামু ছিল খুবই অহংকারী। তার ব্যবহারও বেশ খারাপ ছিল। এমনকি সে তার নিজের গ্ৰামের লোকজনকেও রেয়াত করত না। 

আর রামু ছিল ঠিক তার উল্টো। একদিন রামু তার বাড়ির বাইরে বসে জুতো সেলাই করছে। আর তার সামনে তখন এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। 

জুতো সেলাই করে রামু বলে-“এই নাও গো খুড়ো, তোমার জুতো সেলাই হয়ে গেছে।”

বৃদ্ধ তখন জুতোটি পরে বলেন-“বা বাবা বাঃ, বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে। তা কত হয়েছে রে রামু?”

রামু বলে-“ওই কুড়ি টাকা হয়েছে খুড়ো।”

এই শুনে বৃদ্ধ বলেন-“কুড়ি টাকা! কিন্তু অত টাকা তো আমার কাছে নেই রে রামু। এই বুড়ো বয়সে ঠিকমতো খাবারই জোটে না, আর টাকা তো দূরের কথা।”

তখন রামু বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে খুড়ো। তুমি যা পারবে তাই দাও।”

বৃদ্ধ বলেন-“এই, এই নে। আমার কাছে এই দশটা টাকাই পড়ে আছে, এইটা নে।”

তখন রামু বলে-“এ কী খুড়ো, তুমি বললে তোমার কাছে কেবল এই দশটা টাকাই আছে। আর এর পুরোটাই যদি তুমি আমায় দিয়ে দাও তাহলে তোমার চলবে কী করে? এই নাও এই নাও এই পাঁচটি টাকা তুমি রাখ।”
🍂

বৃদ্ধ তখন বলেন-“রামু রে, তোর মতো ভালো মানুষ এই গ্ৰামে আর একটাও নেই রে। তুই সুখী হোক বাপ, সুখী হো।”

এই বলে বৃদ্ধ সেখান থেকে চলে যান। 

ঠিক তখনই সেখানে সামু আসে। সে রামুকে বলে-কী রে রামু, সকাল সকাল সমাজসেবা করেছিস নাকি? হে হে হে।”

রামু তখন কিছুটা থতমত খেয়ে বলে-“না না,মানে, না মানে….”

সামু বলে-“বেশ বেশ তুই ওই কর। তোকে আর টাকা কামাতে হবে না।”

তখন রামু বলে-“আর কী করব দাদা, তুমি তো জানো এই গ্ৰামে কতজনইবা বড়লোক আছে?”

সামু বলে-“সেইজন্যই তো আমি এই গ্ৰামে আমার তৈরি জুতো বিক্রি করি না রে, শুধু শহরে বিক্রি করি। তোর থেকে পাঁচগুণ বেশি দামে। হে হে হে।”

এই বলে সামু সেখান থেকে চলে যায়। 

দিন এগোতে থাকে। একদিন এক বেঁটে অর্থাৎ এক বামন লোক রামুর কাছে আসে। সে এসে রামুকে বলে-“এই যে শুনছেন, আপনি কী রামু মুচি?”

রামু তখন বলে-“আজ্ঞে হ্যাঁ। তা আপনি কে গো? আপনাকে তো এই গ্ৰামে আগে কোনোদিনও দেখিনি।”

তখন বামন লোকটি বলে-“আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। শুনেছি আপনি নাকি খুব দয়ালু।”

এই শুনে রামু বলে-“হে হে হে, না না সেরকম কিছু না। তা আপনার কী জুতো লাগবে?”

বামন লোকটি বলে-“হ্যাঁ, আসলে আমার পায়ে না একটা কঠিন রোগ হয়েছে, এই খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে। তাই ডাক্তারবাবু আমাকে ভালো চামড়ার জুতো পড়তে বলেছেন। কিন্তু চামড়ার জুতোর তো অনেক দাম। আমার কাছে তো অত টাকা নেই, তাই আমি আসলে আপনার কাছে এসেছি।”

রামু বলে-“ও হো ও, বুঝেছি বুঝেছি। তা কেমন জুতো লাগবে আপনার?”

বামন লোকটি বলে-“যেমন হোক হলেই হবে। কিন্তু টাকা তো….”

এই বলে বামন লোকটি আমতা আমতা করতে থাকে।

তখন রামু বলে-“ও নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনাকে কোনো টাকা দিতে হবে না।”

এরপর রামু একজোড়া চামড়ার জুতো লোকটিকে দিয়ে দেয়।

জুতো পরে বামন লোকটি বলে-“বা বাবা বাঃ, আপনি তো বেশ ভালোই জুতো বানান। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমার অনেক অনেক উপকার করলেন।

রামু বলে-“না না, এ কী বলছেন আপনি? এ তো আমার কর্তব্য।”

বামন লোকটি বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে, এখন তবে আমি আসি।”

এই বলে বামন লোকটি সেখান থেকে চলে যায়।

রামুর বউ সবকিছু দেখে, কিন্তু তখন কিছু বলে না। সেদিন রাতে তার বউ তাকে বলে-“হ্যাঁ গো, সকালে এত দামী জুতোটা বিনে পয়সায় দিয়ে দিলে। এরকম করলে আমাদের সংসার চলবে কী করে বলো তো?”

রামু তখন বলে-“ও ঠিক চলে যাবে বউ। তুমি কোনো চিন্তা করো না। ভগবান, ভগবান, ভগবান সব দেখছেন গো।”

এই শুনে তার বউ বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন এসো খেয়ে শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে।”

এরপর রামু ও তার বউ খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ে। তারা শুয়ে পড়ার পর সকালের সেই বামন লোকটি রামুর বাড়ি আসে। আসলে সেই বামন লোকটি কোনো সাধারণ মানুষ ছিল না সে ছিল সাক্ষাৎ ভগবানের দূত। সে বামন রূপে মুচির পরীক্ষা নিচ্ছিল। মুচি তার পরীক্ষার সফল হয়েছে বলে সেই বামন রূপে এসে মুচির কেটে রাখা জুতো তৈরি করার চামড়াগুলো সুন্দর সুন্দর জুতোয় পরিণত করে চলে যায়।

পরেরদিন সকালে উঠেই রামু দেখে তার বাড়ির সামনে বেশ কয়েক জোড়া জুতো পড়ে আছে। এত জুতো দেখে রামু অবাক হয়ে যায়। সে বলে-“আরে, আরে এত জুতো এখানে এল কী করে? আমি তো এখানে শুধু চামড়াগুলো কেটে রেখেছিলাম। বউ, বউ, আরে ও বউ, এই দেখ দেখ কত জুতো। এই জুতোগুলো এখানে এল কী করে বলো তো?”

রামুর বউ তখন বলে-“ওমা, কী সুন্দর জুতো গো। সত্যি তো এত জুতো এল কোথা থেকে?”

সেইসময় একটি লোক রামুকে ডাকতে ডাকতে রামুর বাড়ি আসে। এসে লোকটি বলে-“রামু মুচি ও রামু মুচি, বাড়ি আছ নাকি? একজোড়া জুতো কিনব।”

রামুর বউ তখন রামুকে বলে-“ওই যে কে জুতো কিনতে এসেছে। যাও যাও তাকে জুতো দাও। এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে।”

এই শুনে রামু ওই জুতোগুলো থেকে একজোড়া জুতো লোকটিকে দেয়। 

জুতো পরে লোকটি বলে-“আরে এই জুতোগুলো তো দারুণ দেখতে। দারুণ হয়েছে রামু দারুণ। খুব সুন্দর জুতো বানিয়েছ রামু। তা এই জুতোর দাম কত?”

রামু বলে-“দাম। তা যা ভালো বোঝেন দেবেন।”

তখন লোকটি বলে-“তা বেশ বেশ, এই নাও একশো টাকা।”

এইভাবে কিছুদিন কেটে যায়। একদিন গ্ৰামের মোড়ল আসেন রামুর বাড়িতে। তিনি রামুকে বলেন-“কই গো রামু, শুনলাম তুমি নাকি খুব ভালো জুতো বানাচ্ছ। তা বেশ বেশ আমাকে একজোড়া জুতো দাও তো।”

তখন রামু মোড়লমশাইকে জুতো দেয়। জুতো দেখে মোড়লমশাই বলেন-“বা বাবা বাঃ, খুব সুন্দর জুতো তো। তার এত সুন্দর জুতো তুমি বানাও কখন শুনি?”

রামু বলে-“আজ্ঞে, ওই রাত্রিবেলা বানাই আর কী।”

মোড়লমশাই বলেন-“বা, বেশ বেশ, দারুণ জুতো বানিয়েছ। খুব সুন্দর হয়েছে। তা এই নাও তোমার টাকা।”

এই ভাবে একে একে করে লোক আসতে থাকে। আর সব জুতো বিক্রি হয়ে যায়।

রাত্রিবেলা রামু যখন হিসেব করতে বসে তখন তার বউ তাকে বলে-“বাঃ, আমাদের দু মাসের কামাই একদিনেই হয়ে গেছে গো।”

রামু বলে-“কিন্তু বউ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বুঝলে। আমি ভাবছি এই জুতোগুলো আসছে কোথা থেকে?”

তার বউ তখন বলে-“ও তোমার ভালো কাজের ফল গো। আচ্ছা বাদ দাও ওইসব। এখন শুয়ে পড় দেখি, অনেক রাত হল।”

এরপর তারা শুয়ে পড়ে। তারা শুয়ে পড়তেই আবার সেই বামন লোকটি এসে রামুকে ভালো ভালো জুতো দিয়ে যায়। আর এত ভালো ভালো জুতো খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়।

এইসব দেখে রামু ভাবে-“একদিন রাত জেগে দেখতেই হবে আসলে জুতোগুলো আসছে কোথা থেকে?”

এই ভেবে সে একদিন রাত্রিবেলা ঘরের আলো বন্ধ করে ঘরের ভেতর বসে থাকে। আর প্রতিদিনের মতো বামন জুতো দিতে আসে। ঠিক তখনই রামু বাইরে বেরিয়ে আসে। 

বামনকে দেখে রামু বলে-“এ কী আপনি এখানে?”

তখন বামন লোকটি বলে-“তাহলে তুমি দেখেই ফেললে, হে হে হে। আসলে আমি হলাম ভগবানের দূত। সেদিন আমি তোমার সততার পরীক্ষা নিতে এসেছিলাম। আর তুমি সেই পরীক্ষায় সফল হয়েছ। তাই আমি রোজ এসে তোমাকে নতুন নতুন জুতো দিয়ে যাই। আর তুমি যদি সবসময় সৎ পথে থাক, তাহলে এর পরেও দিয়ে যাব।”

এই শুনে রামু বলে-“আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, অনেক।”

এরপর বামন লোকটি সেখান থেকে চলে যায়। আর রামুও সেই জুতো বিক্রি করতে থাকে। আশেপাশের গ্ৰাম এমনকি শহর থেকেও লোকজন এসে রামুর কাছ থেকে জুতো কিনে নিয়ে যায়। 

কিন্তু এই ব্যাপারটা একদমই ভালো লাগে না সামুর। সে মনে মনে ভাবে-“না না এটা তো ঠিক হচ্ছে না। রামুর নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এত ভালো জুতো রামু বানাচ্ছে কী করে? না্ আজ রাতে একবার দেখতে হচ্ছে তো ব্যাপারটা কী?”

এরপর সামু ওইদিন রাত্রিবেলা রামুর বাড়ি যায়। আর একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে থাকে আসল ব্যাপারটা কী? ঠিক তখনই প্রতিদিনের মতো বামন রামুকে জুতো দিতে আসে। 

বামন লোককে দেখে সামু বলে-“এ কী এ তো জাদুকর বামন বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা এই রহস্য তাহলে। তাই বলি রামু এত ভালো জুতো বানাতে শিখল কী করে। না না আর দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। আমাকে এই বামনকেই ধরতে হবে। তাহলে আমারও রামুর মতো সুন্দর সুন্দর জুতো তৈরি হবে। আর সেগুলো আমি বাজারে বিক্রি করব। হা হা হা।”

এই বলে সামু একটা দড়ি নিয়ে বামনকে বেঁধে ফেলে। এদিকে রামু ঠিক সেই সময় ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। 

এইসব দেখে রামু সামুকে বলে-“এ কী সামু দাদা, এ তুমি কী করলে?”

তখন সামু বলে-“কেন তুই একাই কী এই বেঁটের কাছ থেকে ভালো ভালো জুতো নিবি নাকি, আমিও নেব। এইভাবে বেঁধে রেখেই নেব। যখন যেমন জুতো চাইব তখন সেরকম জুতো দেবে।”

রামু তখন বলে-“না দাদা না, তুমি এরকম করো না। এতে তোমারই বিপদ হবে।”

সামু বলে-“হা হা হা, এই বেঁটে আমার আর কী করতে পারবে। এ তো বেঁটে, হা হা হা।”

তখন বামন বলে-“বটে, এই কথা। তাহলে এবার তুই দেখ আমি কী করতে পারি?”

এই বলে বামন বেঁটে থেকে অনেক লম্বা হয়ে যায়। আর সামুকে তার উপযুক্ত শাস্তি দেয়। অতি লোভের শাস্তি ভোগ করে সামু। চিরকালের মতো হাঁটাচলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। আর এদিকে রামু হয়ে উঠে গ্ৰামের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। 

এরপর রামু ও রামুর বউ সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে থাকে।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments