জ্বলদর্চি

সুখেন্দুবিকাশ সিংহ (অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, সংগ্রাহক, মহিষাদল) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৮১
সুখেন্দুবিকাশ সিংহ (অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, সংগ্রাহক, মহিষাদল) 

ভাস্করব্রত পতি

তখন তিনি খুব ছোট। বাবার সঙ্গে বেড়াতে বেরোতেন কাছেপিঠে। কখনও গেঁওখালির রূপনারায়ণ নদের পাড়ে হলদি, হুগলীর সংযোগস্থল এলাকায়। আবার কখনও হলদিয়া উপকূল এলাকায়। বাবার সঙ্গে পাখি শিকারে অংশ নিতেন। তখন দেখতে পেতেন নদী দিয়ে চলে যাচ্ছে নানা ধরনের জাহাজ। নানা আকারের জাহাজ। 

সে এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য। পাড়ে দাঁড়িয়ে সেইসব জাহাজ দেখতে দেখতে হারিয়ে যেতেন অচিন দেশের মহল্লায়। ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে উড়ু উড়ু মন জাহাজের মাস্তুলে চেপে হারিয়ে যেত আফ্রিকা থেকে অ্যান্টার্কটিকায়। আইসল্যান্ড থেকে গ্রীনল্যান্ড, সুদান থেকে জাপান কিংবা মালয়েশিয়া থেকে রাশিয়া -- ছুটে পালাতো মনের যাবতীয় কিছু। কিন্তু তিনি আটকে থাকতেন নদীর পাড়ে বুনো ঘাসের আড়ালে থাকা রাস্তায়। 

সুখেন্দুবিকাশ সিংহ। বয়স তখন মাত্র বারো কি তেরো। রঙিন ভাবনার মিশেলে আটকে থাকা বয়স। একটার পর একটা জাহাজ চোখের সামনে দিয়ে আসছে আর যাচ্ছে। জাহাজের মাথায় উড়ছে তাদের দেশের জাতীয় পতাকা। এক অনাস্বাদিত দৃশ্যসুখ। এইসব রকমারি জাহাজ নবীন কিশোরের মন আন্দোলিত করতে থাকলো অচিরেই। আলোড়িত হতে থাকলো হৃদয়। সাইবেরিয়ান পাখিদের মতো তিনিও যেন ছুটতে লাগলেন জাহাজের পিছু পিছু। না, সশরীরে বিদেশ বিভুঁইয়ে তো যাওয়ার উপায় নেই তাঁর। ব্যার্থ মনোরম শুধুই তাকিয়ে থাকা। 
সংগৃহীত পটচিত্র দেখাচ্ছেন সুখেন্দুবিকাশ সিংহ

হলদিয়া বন্দরে প্রতিদিন আসছে কত জাহাজ। পতপত করে উড়ছে বিচিত্র সব জাতীয় পতাকা। চোখ আটকে গেল সেদিকেই। সেইসব পতাকার আকৃতি, নকশা, ছবি আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলো কিশোর সুখেন্দুর মননে চিন্তনে আর স্বপনে। পতাকার গায়ে কত ধরনের ছবি। কত ধরনের ভাষা। সেসব তাঁকে মোহিত করে তুললো ধীরে ধীরে। 

এবার তিনি জানতে চাইলেন ঐসব পতাকা কোন দেশের। পতাকার গায়ে কিসের ছবি? কি ভাষায় লেখা আঁকিবুকি? একটা কিশোরসুলভ চেষ্টা পেয়ে বসলো মনের গভীরে। তিনি ভাবলেন, ঐসব পতাকা যে দেশের পরিচয়বাহী নিশানা, সেইসব দেশে হয়তো তাঁর কখনো যাওয়ার সুযোগ জুটবে না। কিন্তু সেইসব দেশকে তো তাঁর বাড়ির চৌহদ্দিতেই আনা যেতে পারে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। লেগে পড়লেন অদম্য উৎসাহে। 

একটা বিরল শখ পেয়ে বসেছিল মেদিনীপুরের মহিষাদলের কাঁকুড়দা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুখেন্দুবিকাশ সিংহের মনের গভীরে। সেই শখকে বাস্তবায়িত করতে সারা বিশ্বের প্রায় ১৮৮ টি দেশের জাতীয় পতাকা রেখেছেন তাঁর বিরল সংগ্রহশালায়। এইসব দেশের জাতীয় পতাকার প্রতিরূপ তাঁর হাতের নাগালে। 

তাঁর পতাকা সংগ্রহের যাত্রা শুরু ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। এই সময়কালে তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস কিংবা ম্যাজেলান কিংবা মার্কো পোলোর বাঙালি সংস্করণ। মহিষাদলের বুকে বসে তিনি আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, ইজরাইল, অষ্ট্রেলিয়া, মঙ্গোলিয়া, নাইজেরিয়াকে স্থাপন করেছিলেন চার কুঠুরির মধ্যে। সে এক চিত্তাকর্ষক যাত্রা। সিগাল পাখিদের মতো মন ছোটাতেন ভারত মহাসাগর থেকে ক্যাস্পিয়ান সাগর, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে লোহিত সাগরের নীল জলরাশিতে। 

সেসময় তাঁর পাশে থেকে তাঁর স্বপ্নিল ভাবনাকে সঠিকপথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন করালি ভৌমিক, সুনীল মাইতি, নারায়ণচন্দ্র সিংহরা। যোগ্য সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। তখন সারাবিশ্ব তাঁর হাতের মুঠোয়। ফলে আমাজনের গভীর অরণ্যে যে পতাকা উড়তে পারে, তা উড়ছে সুখেন্দুবিকাশের কক্ষে। কালাহারি মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকাময় জমিতে যে পতাকা উড়তে পারে, তা উড়ছে কাকুড়দা গ্রামে। 
সংগৃহীত মুদ্রা দেখাচ্ছেন

এরকম নেশা যে কারও হতে পারে, কেউ ভাবতেও পারেনা। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন। একসাথে এত দেশের জাতীয় পতাকার সম্ভার দেখতে প্রায়ই ভিড় জমাতো স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা। আসলে বিভিন্ন দেশের পরিচয় জানা, চেনা এবং অন্যদের চেনানোর বিরল আন্তর্জাতিক ভাবনা তাঁকে আক্রমণ করেছিল। সেই আক্রমণ তিনি সাদরে মাথা পেতে নিয়েছেন। 

শুধু পতাকা সংগ্রহ নয়, ঐ পতাকা যে দেশের, সেই দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল জানার অদম্য চেষ্টা করে গিয়েছেন। ছোট থেকে বড় -- বিশ্বের প্রায় সব দেশের পতাকা তাঁর জিম্মায়। এই পতাকার অবয়ব জানতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, রেডিও এবং টিভির পর্দায় চোখ রাখতেন। দাঁড়িয়ে থাকতেন জাহাজ যাওয়ার পথে চোখ মেলে। 

কিন্তু জাহাজ হয়তো প্রবল গতিবেগে ভেসে চলেছে, তখন পতাকার সঠিক অবয়ব বুঝতে পারতেন না। সারাটা দিনই নষ্ট। আবার অন্যদিন। অসম্ভব ধৈর্য্য আর চূড়ান্ত অধ্যবসায় তাঁকে তাঁর অভীষ্ট পূরনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাঁর পতাকার সম্ভার নিয়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রদর্শনীও করেছেন। আজ তাঁর সংগ্রহে রয়েছে অসংখ্য মুদ্রা এবং বিভিন্ন পটচিত্র। এরকম বিচিত্র খেয়ালের মানুষ আজ মেদিনীপুরের গর্ব।
🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. Kamalika BhattacharyaNovember 06, 2025

    মেদিনীপুরের মানুষ রতন সুখেন্দুবিকাশ সিংহ মহাশয়কে এবং লেখক ভাস্করব্রত পতি দুজনকেই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
    ভালো থাকবেন।

    ReplyDelete