কমলিকা ভট্টাচার্য
নীলা সারাদিনের কাজ সেরে তার ঘর লাগোয়া ছোট্ট ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় রোজ রাতে, ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগে।
এক মুহূর্তের জন্য যেন পুরো দিন থেমে যায়।
বারান্দাটা, নীলার একান্ত গোপন প্রেমিকের মতো, সারা দিন অপেক্ষায় থাকে তার জন্য। দিনের ব্যস্ততা, আলো-আঁধারি, মানুষের পদচারণা শেষে যখন নীলা এসে দাঁড়ায়, তখন বারান্দার বুক ভরে ওঠে নিঃশব্দ ভালোবাসায়।
সে জানে, তার পক্ষে নীলাকে ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব নয়, কথা বলা তো দূর, একটা নিঃশ্বাস ফেলার সাহসও যেন নিষিদ্ধ। তবুও, জানালার ফাঁক দিয়ে সে তাকিয়ে থাকে যদি নীলার এক ঝলক দেখা যায়।
বারান্দার বড় সাধ হয়, নীলার ক্লান্ত শরীর যখন দুপুরে বিছানায় সেই শরীরে একটু শান্তির ছোঁয়া দিতে হালকা করে, তাই সে বাতাসকে বলে, “যাও, ছুঁয়ে এসো” বাতাস যায়, গাছের পাতার ফাঁক গলে পাতার নিচের জলকণার শীতলতা নীলার গালে এসে ফিসফিসিয়ে পড়ে।
নীলা তখন হালকা করে বলে ওঠে— “আহ!”
এই একটি শব্দে বারান্দার ভিতরে জন্মায় অদ্ভুত তৃপ্তি, যেন যুগ যুগের কাঙ্ক্ষিত প্রেম মুঠোয় ধরা পড়েছে।
নীলা নিজের ব্যাপারে বড় উদাসীন। ঠিকমতো সময়ে খায় না, বিশ্রামও নেয় না। বারান্দা ব্যথিত হয়ে পাশে দাঁড়ানো দেয়ালকে বলে, "কিছু একটা করো!"
সে তখন পাশের বাড়ির রান্নাঘরের গন্ধ চুরি করে নিয়ে আসে বাতাসে ভাসিয়ে, যদি নীলার মনে পড়ে— খাওয়ার সময় হয়েছে।
🍂
কখনো বাড়িতে রাগারাগী হলে, বারান্দা বুঝে ফেলে, আজ নীলার মনের আকাশে মেঘ জমে আছে।
তখন সে নীলার গাছদের বলে,
—“আজ একটু বেশি ফুল দাও, একটু বেশি সবুজ হও, একটু বেশি ভালোবাসা ঢালো তোমাদের পাতায়।”
নীলা যখন হাসে সেই রঙিন ফুল দেখে, সেই হাসির টুকরোগুলো যেন ঝরে পড়ে বারান্দার বুকে।
সেই হাসি বারান্দা ধরে রাখে, বুকের গভীরে, সমস্ত রাত।
নীলা যখন পর্দার আড়ালে জামাকাপড় বদলায়, তখন সে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে— হালকা আলোয় ছায়ার মত নীলার শরীরের প্রতিচ্ছবি বারান্দার কল্পনার গভীরে ছড়িয়ে পড়ে।
সে অপেক্ষা করে, কখন পর্দা সরে যাবে, আর সে দেখবে নীলা আজ কোন রঙে নিজেকে সাজিয়েছে।
নীলার রঙে রঙে বারান্দার পৃথিবী বদলে যায়।
সকালের রোদ যখন বারান্দাকে ছুঁয়ে যায়, সে সেই উষ্ণতা ধরে রাখে।
নীলা যখন ফুল তুলতে আসে, তার পায়ে আলতো চুমু দেয় সেই রোদের উত্তাপ।
চুলের কোণ থেকে ঝরে পড়ে দুই ফোঁটা জল— বারান্দা নিঃশব্দে সেই জলের ছোঁয়া শুষে নেয় নিজের বুকের গভীরে।
এই-ই তার প্রেমিকাকে ছুঁয়ে থাকার একমাত্র উপায়।
বিকেলে জামাকাপড় তুলতে এলে নীলার মুখে পড়ন্ত রোদের লালিমা পড়ে।
বারান্দা অপলক তাকিয়ে থাকে, চোখ দিয়ে চেনে সেই মুখ—
চুল যখন উড়ে এসে পড়ে নীলার চোখে, তার ইচ্ছে হয় চুল সরিয়ে কানের পাশে ঠোঁট রাখে,
নীরব ভালোবাসার মতো।
নীলা তাড়াহুড়ো করে চলে যায়, প্রায়ই হোঁচট খায় চৌকাঠে।
বারান্দা বলে ওঠে—
—“দেখে চলো, লাগলো না তো?”
কিন্তু সে জানে, নীলা শুনতে পায় না।
উদাসীনতাই তার অভ্যাস।
চৌকাঠের উপর সে অভিমান করে থাকে দিনের পর দিন।
তারপর সন্ধ্যে নামে।
নীলা আসে তুলসী তলায় প্রদীপ দেখাতে।
সন্ধ্যার আলোয় সে হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ এক নারী, যেন পূর্ণিমার আলোয় ভিজে যাওয়া কোনও মন্দিরের গায়ে আঁকা দেবী।
প্রদীপের আলোয় যখন নীলার মুখ ঝিকমিক করে ওঠে, সেই পবিত্র আলো ছড়িয়ে পড়ে বারান্দার প্রতিটি কোণে।
রাত বাড়ে।
নীলা আসে আবার।
এবার সে আর কারোর না, শুধু বারান্দার—
সেই তার একান্ত প্রেমিক।
নীলা বলতে থাকে তার সারাদিনের সুখ-দুঃখ, ছোট ছোট ঘটনার গল্প।
বারান্দা শোনে, কোনো কথা বলে না— শুধু হাওয়ায় জড়িয়ে ধরে নীলাকে।
চাঁদের আলো বদলায়, আকাশে মেঘের নকশা ঘুরে যায়,
তেমনই বদলায় নীলার মুখের অভিব্যক্তি।
বারান্দা তা পড়ে ফেলে নির্ভুল প্রেমিকের মতো।
রাত গাঢ় হয়।
বারান্দা রেখে দেয় তার স্বপ্নগুলো নিজের কাছে।
এই একান্ত পাওয়াটুকু—
আর সুন্দর করে নিজের হাতে সাজিয়ে দেয় নীলার মন
তারপর ফিরত পাঠায় তাকে অন্দরমহলে...
তারাদের আলো পুষ্পবৃষ্টি হয়ে ঝরে বারান্দার বুকে....
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
5 Comments
আহা!! গল্প কবিতা না স্বগোতক্তি তা সঠিকভাবে বলা যায় না। ভালো লাগল।
ReplyDeleteমন ভালো হলো। ধন্যবাদ।
Deleteমন ভালো হলো। ধন্যবাদ
Delete❤️
ReplyDelete💚
Delete