জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প— ২৬৩কোরিয়া (এশিয়া)কাঠুরিয়ার বাঘ ভাই/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোক গল্প— ২৬৩

কোরিয়া (এশিয়া)

কাঠুরিয়ার বাঘ ভাই


চিন্ময় দাশ


অনেক কাল আগের কথা। তখনও কোরিয়া ভাগ হয়ে, উত্তর দক্ষিণ দু’টুকরো হয়নি। একটাই দেশ ছিল কোরিয়া। সেখানে এক গ্রামে থাকে এক কাঠুরিয়া। সকাল হলে ঘাড়ে কুড়ুল নিয়ে, বনের দিকে রওনা দেয় লোকটা। সব দিনের কাজ এটাই। এভাবেই পেট চলে তার। দুজনের সংসার। বুড়ো মা আছে বাড়িতে।

একদিন ভালো গাছের খোঁজে, পাহাড়ে চড়ে পড়েছে। পাহাড়টার মাথায় পৌঁছেছে, হঠাৎই দেখে, সামনে সাক্ষাৎ যম! বিশাল চেহারার এক বাঘ। 

ভয়ানক ভয় পেয়ে গেল লোকটা। আজকেই জীবন শেষ। এই রাহুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না আর। তবুও লোকটা মনে মনে ভাবল, মারা তো পড়বোই। একটু বুদ্ধি খাটিয়ে দেখা যাক। যদি বেঁচে যাই।

বাঘও দেখেছে কাঠুরিয়াকে। নিশ্চয়ই এবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। তার আগেই কাঠুরিয়া করল কী, বাঘের দিকে খানিকটা এগিয়ে গেল গটগট করে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। দু’হাত জড়ো করে, লম্বা একটা পেন্নাম ঢুকে দিল বাঘকে।

বলল—আরে, বাঘদাদা যে! কোথায় ছিলে তুমি এত দিন? কতদিন খুঁজছি আমি তোমাকে। পাহাড়ে পাহাড়ে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াই। 

মানুষটার এমন কাণ্ড দেখে, বাঘ তো ঘাবড়ে গিয়েছে। হতভম্ব হয়ে বুঝতেই পারছে না, ব্যাপারটা কী হলো? এসব কথা কেন বলছে?

বাঘ বলল—বলছোটা কী হে? মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না আমার। একটু খুলে বলো, বাপু। 

কাঠুরিয়া বলল-- তুমি চিনতে পারছ না আমাকে? আমি তো তোমার ভাই। মায়ের কথায়, প্রতিদিন এইভাবে পাহাড়ে পাহাড়ে খুঁজে বেড়াই তোমাকে। কপাল ভালো আজ। কতদিন বাদে তোমার দেখা পেয়ে গেলাম।

বাঘের তো আকাশ থেকে পড়বার অবস্থা। অবাক হয়ে বলল-- আমি তোমার ভাই!  মানে কী একথার? 

কাঠুরিয়া বলল-- তোমাকেই বা দোষ দিই কী করে? তোমার কি আর মনে পড়বার কথা? সেই কোন ছোটবেলায় তোমাকে বাঘে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে মা কত খুঁজেছে তোমাকে। কোথাও পায়নি। আমি বড় হতে, খোঁজার দায় পড়েছে এবার আমার ওপর। তোমাকে খুঁজে মায়ের কাছে হাজির করা।

বাঘ বলল-- বলছোটা কী? আমি তোমার ভাই? আমি মানুষ ছিলাম?

কাঠুরিয়া বলল-- মা তো আমাকে তাই বলেছে। গাঁয়ের লোকেরাও বলে। কতদিন ধরে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। চলো, ঘরে চলো। তোমার কথা ভেবে ভেবে মায়ের শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারে না। তুমি ঘরে চলো।

🍂

বাঘ বলল—বাড়ি কোথায় তোমার? মানে, আমাদের বাড়িটা ঠিক কোথায় বল তো?

কাঠুরিয়া তাকে বাড়ির সাতসতেরো বলে বোঝাতে লাগল। বাঘের মনে এবার খানিকটা বিশ্বাস হয়েছে। বাঘ বলল-- না রে, ভাই। আমার এই চেহারা নিয়ে, মায়ের কাছে যাওয়াটা ঠিক হবে না। দেখলেই তো ভয়ে ভিরমি খেয়ে যাবে। তার চেয়ে, মাকে গিয়ে জানাবে, আমি বেঁচে আছি। ভালোই আছি। 

কাঠুরিয়া তো মনে মনে ভারি খুশি। এ যাত্রা বড্ড বাঁচা গেল। মুখে সে কথা বলা যাবে না। সে দুঃখের ভাব করে বলল—একটি বার যাবে না তুমি? 

বাঘ বলল— না, ভাই। আমার যাওয়াটা একেবারেই ঠিক হবে না। তবে, তোমার হয়রানিটা গেল। পাহাড়ে পাহাড়ে আর খুঁজে বেড়াতে হবে না। মাঝে মাঝে চলে এসো এখানে।  দেখা হয়ে যাবে দু’ভাইয়ের। আর, একটা কথা দাও আমাকে। মায়ের যত্ন করবে তুমি। কোন অযত্ন যেন মায়ের না হয়।

কাঠুরিয়া বলল—সে তুমি ভেবো না। কোন অযত্ন হবে না মায়ের। কিন্তু মা যে কতদিন ধরে অপেক্ষা করে বসে আছে তোমার জন্য। 

বাঘ বলল—ভাইটি, আমাকে মাফ করো। আমি খুবই লজ্জিত। বুঝতে পারছি, মা আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু আমি তার কাছে যেতে পারছি না। আসলে এই চেহারায় মায়ের কাছে যাওয়াটা আমার ঠিক হবে না। বুড়োমানুষ, সামনে আস্ত একটা বাঘ দেখলে, প্রথমেই তো চমকে যাবে। তাতে বিপদ হয়ে যেতে পারে। তুমি ঘরে যাও। সব কথা বুঝিয়ে বলবে মাকে। বলবে, বেঁচে আছি আমি।

কাঠুরিয়া এবার সরে পড়তে পারলে বাঁচে। বড় জোর বাঁচা গেছে। ভাগ্যিস মাথা খাটিয়েছিলাম। না হলে এক্ষুনি শয়তানটার পেটে যেতে হতো। 

বাঘ বাড়িতে যাচ্ছে না, দুঃখের ভাব করে কাঠুরিয়া বলল-- কী আর করা যাবে? মাকে গিয়ে তাই বলি। আর, তুমিও দাদা ভালো থেকো। সাবধানে থেকো। চারদিকে শিকারীদের যা উৎপাত।

বাঘেরও গলা বেশ ভার। সে বলল—ভেবো না, আমিও খোঁজ রাখব তোমাদের। 

বাঘদাদাকে বিদায় জানিয়ে, কোনরকমে পায়ে পায়ে সরে পড়ল কাঠুরিয়া। সারাদিন নিজের কাজ সেরে, কাঠের বোঝা গাড়ি চাপিয়ে, বাড়ি এসে হাজির হলো।

পরের দিন সকাল হয়েছে। যেমনটি ঘর থেকে বের হয়, কুড়ুল ঘাড়ে চাপিয়ে উঠোনে নেমেছে, তখন এক কান্ড! অবাক হয়ে দ্যাখে, উঠোনে একটা বুনো শুয়োর দাঁড়িয়ে আছে। হোলটা কী? বুনো শুয়োরের তো গাঁয়ে ঢোকার কথা নয়। তাছাড়া, এলই যদি, পালাচ্ছে না তো। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।

সেদিন আর বনে গেল না কাঠুরিয়া। কুড়ুল নামিয়ে শুকর জবাই করতে বসল। 

মা ছেলেতে ভালই খাওয়া-দাওয়া হলো ক’দিন। এমনটা খুব কমই হয়। কাজের শেষে হাটে যায় কাঠুরিয়া। সেদিনের কাঠ বেচে যা পয়সা হাতে আসে, তাই দিয়ে জিনিসপত্র কিনে আনে। তাতেই সংসার চলে আস্ত একটা শুকর পেয়ে গিয়ে, দারুন লাভ হয়েছে তাদের। দিনকয় পেট ভরে মাংস খেয়েছে মা ছেলে মিলে।

মাংসটা সবে ফুরিয়েছে। পরের দিন ভোর হতেই দ্যাখে, উঠোনে তিনটে খরগোশ হাজির। পাহাড়ের খরগোশ। বেশ নাদুস-নুদুস চেহারা। অনেকখানি মাংস হবে তিনটাতে। 

ক’টা দিন আবার বেশ ভালই কাটলো তাদের। 

মজার ব্যাপার হলো, এভাবেই নিয়মিত মাংসের জোগান পেয়ে যেতে লাগলো কাঠুরিয়া। 

এবার লোকটা বেশ বুঝতে পারল, এই সবই তার বাঘদাদার কাজ। রাত্তিরে আসে। মায়ের ভোজের জন্য নিয়মিত মাংসের ব্যবস্থা করে রেখে যায়।

ঘটনাটা কিন্তু সত্যিই। প্রতি রাতেই বাঘ একবার করে আসে কাঠুরিয়ার বাড়ি। একটা চক্কর মেরে, রাতে রাতেই আবার ফিরে চলে যায়। সামনা সামনি আসতে পারে না। কিন্তু ছেলে হয়ে মায়ের জন্য যতটুকু দায়, সাধ্যমত সেটা সেরে রেখে যায়।

এভাবেই চলেছে অনেক দিন। নিয়মিতই বনের পশু কাঠুরিয়ার উঠোনে হাজির থাকতো। বছর তিনেক যাওয়ার পর, একদিন মা মারা গেল কাঠুরিয়ার। মায়ের কাজকর্ম শেষ হতে দিন কয় লাগলো। সব কাজ সেরে কাঠুরিয়ার মনে হল, বাঘদাদা তার দায়িত্ব পালন করেছে। এবার আমার দায়িত্ব আমার পালন করা উচিত।

আবার পাহাড়ে চড়ল কাঠুরিয়া। মা মারা গেছে, সে খবর বাঘকে দিতে হবে। সেদিন কাঁধে কুড়ুল নাই। খালি হাতে গিয়েছে ওপরে। চুড়ায় পৌঁছে, সেদিন অন্য দৃশ্য। অন্য কিছু দেখলো কাঠুরিয়া। চার-চারটে বাঘের বাচ্চা একটা জায়গায় জড়ো হয়ে বসে আছে।

একটু থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে কাঠুরিয়া। বাচ্চাগুলোও তাকে দেখেছে। তারাই বলে উঠলো-- তুমি তাহলে আমাদের কাকামশাই! 

এবার কাঠুরিয়ার অবাক হওয়ার পালা। সে বলল-- মানে? তোমরা কারা? 

বাচ্চাগুলো বলল-- চিনতে পারছ না? আমরা তো তোমার বাঘদাদার ছেলেমেয়ে। তোমার কথা বাবা আমাদের সব বলে গিয়েছে। 

কাঠুরিয়া বলল-- বলে গিয়েছে মানে? কোথায় গেছে তোমাদের বাবা? 

বাচ্চাগুলো বলল-- সে আর বলো না গো। ভারী কষ্টের ব্যাপার। যেদিন বাবা তোমাদের বাড়ি থেকে দেখে এলো ঠাকুমা মারা গেছে, ভারী মন খারাপ হয়েছিল তার। সেই যে শুয়ে ছিল, আর ওঠেনি। দু’দিন আগে মারা গেছে আমাদের বাবা।

সবই শুনছে কাঠুরিয়া, আর বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাচ্ছে। এমনটা হতে পারে, সে ভাবতেও পারছে না। নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য, বানিয়ে বানিয়ে কতগুলো মিথ্যে কথা বলেছিল একটা বাঘকে। তার সমস্ত কথা বিশ্বাস করে ফেলেছিল সে। তারপরে মায়ের জন্য যা একটি ছেলের করা দরকার, সমস্ত কর্তব্য সে পালন করে গেছে। এবং মায়ের মৃত্যু দেখে, নিজেও মারা পড়েছে মনের দুঃখে। এমনটা হতে পারে কখনো, বিশ্বাস হতে চাইছে না।

কাঠুরিয়া বলল-- তোমরা এখানে কী করছ? 

বাচ্চাগুলো বলল-- তোমার জন্য আজ দু’দিন অপেক্ষা করে বসে আছি। বাবা আমাদের বলে গেছে তোমাকে জানাতে। তোমার তো বনে জঙ্গলে কাঠ কাটার কাজ। নিশ্চিন্তে আসতে পারো তুমি। এখানে তোমার যাতে কোনরকম কোন বিপদ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার কথা আমাদের বলে গেছে বাবা। চিরদিন তোমার সুবিধা অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখব আমরা। কোন চিন্তা করো না তুমি। 

কাঠুরিয়া তো শুনে বেশ খুশি। ভবিষ্যতেও তার বিপদ থেকে বাঁচার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। বাচ্চাগুলোকে বলল—তোমরা তো এখনও বেশ ছোটই। সাবধানে থেকো কিন্তু। কিছু অসুবিধা হলেই আমাকে জানিও। আর, আমিও শিকারীদের বুঝিয়ে বলে দেব, তোমরা আমারই ভায়ের ছেলেপুলে। কোন ক্ষতি যেন না করে।  

কথাগুলো বলেই বাড়ির পথ ধরল কাঠুরিয়া।


Post a Comment

0 Comments