বিস্মৃতির অন্তরালে " ভারতীয় নির্ভীক সাংবাদিকতার জনক ” — হরিশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়
প্রসূন কাঞ্জিলাল
আজ এমন এক রাজপথ ধরে হেঁটে চলা,যার নামকরণ এমন এক ব্যক্তিত্বের নামে করা হয়েছে, তাকে খুব বেশী সহনাগরিক যে প্রকৃতপক্ষেই চেনেন না, সেকথা বলাই বাহুল্য। রাস্তাটি দক্ষিণ কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোড । উনিশ শতকের 'বাংলার নবজাগরণের' একজন বিস্মৃত ব্যক্তিত্ব, হরিশচন্দ্র মুখার্জি কলকাতা-ভিত্তিক ইংরেজি সাপ্তাহিক 'দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট'- এর শক্তিশালী সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর আজীবন সংগ্রাম, বিশেষ করে 'নীল বিদ্রোহ'-এর সময় নিপীড়িত কৃষকদের প্রতি তাঁর দৃঢ় সমর্থন তাঁর মহত্ত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সেই কবেই বলে গেছেন --‘ বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি ', বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতির প্রতি
তাদের উদাসীনতা ও অবজ্ঞার প্রতি ইঙ্গিত করে’- একথা তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনা ও বক্তৃতায় তা তুলে ধরেছেন। তাই এই অঞ্চলের বহু মানুষকে জিজ্ঞাসা করে সদুত্তর পাওয়া দূরের কথা কেউ কেউ এও হয়ত বলবেন যে মহারাজা হরিশচন্দ্রের নাম অনুযায়ী এই নাম। তবে একটি ৮ - ৯ বছর বয়সি ছেলের কাছে উত্তরটা পেয়ে ভালো লাগলো। সে মিষ্টি কণ্ঠে গড়গড় করে বলে চললো --
“উনি একজন সাংবাদিক, হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় লিখতেন এবং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লিখতেন —কিছুটা দূরেই ওনার নামে একটা পার্ক আছে - হরিশ পার্ক, আমরা সেখানে খেলা করি আর পাবেন একটা স্মৃতিস্তম্ভ ওটা পড়েই এই সব জেনেছি।“
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা সেই
স্মৃতিস্তম্ভের দিকে যা অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় কালের প্রতীক হিসাবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। কলকাতার মানুষ উত্তরে এ.জে.সি বোস রোড থেকে হাজরা রোড পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তাটির সম্পর্কে জানেন। সেই রাস্তাই হলো হরিশ মুখার্জি রোড বা এইচ এম রোড। মিত্র ইনস্টিটিউশন, মহারাষ্ট্র নিবাস, এস এস কে এম হাসপাতাল, সম্ভ কুটিয়া গুরুদ্বার, গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং হরিশ পার্ক হলো এই
রাস্তার কিছু উল্লেখযোগ্য স্থান।
এই রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছিল প্রাদেশিক সরকারের দ্বারা তৎকালীন কলিকাতা পৌরসভার উদ্যোগে হরিশ চন্দ্র মুখার্জির নামে, তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৪৮ বছর পর ১লা অক্টোবর, ১৯১৩ সালে যা আগে পরিচিত ছিল -- "বেড়িয়াপাড়া রোড" নামে ! তিনি ছিলেন এক নির্ভীক সাংবাদিক, নীলচাষিদের পক্ষে সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছিলেন এবং শাসক ব্রিটিশদের পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছিলেন।
ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নিজের
কলমকেই। ইংরেজি ভাষা দিয়েই জব্দ করেছিলেন প্রতাপশালী ইংরেজদের। তার কলম দিয়ে যেন আগুন ঝরত। আজকের বাঙালি, তাকে চেনা তো দূর, তাঁর নামও
শুনেছে কিনা সন্দেহ। তিনি হলেন নির্ভীক সাংবাদিক ও হিন্দু প্যাট্রিয়টের সম্পাদক (১৮৫৩ - ১৮৮৪)। গতবছর ২০২৪ এ আমরা নিঃশব্দে পোরিয়ে এলাম তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ।
🍂
হরিশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ২৪ শে জুলাই, ১৮২৪ , বর্তমান
কলকাতা শহরের ভবানীপুরে। যদিও সেই সময় ভবানীপুর কলকাতার অংশ বলে বিবেচিত হতো না। তাঁর পিতা ছিলেন রামধন মুখোপাধ্যায়। রামধনের বাড়ি ছিল বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার শ্রীধরপুর গ্রামে। রামধনের চার স্ত্রীর মধ্যে হরিশ চন্দ্রের মা রুক্মিণী ছিলেন সবচেয়ে ছোট। হরিশ চন্দ্র তাঁর মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর এক দাদা ছিলেন হারাণ চন্দ্র।
হরিশ চন্দ্রের জন্মের ছয় মাসের মধ্যেই তাঁর পিতা রামধন মারা যান। হরিশ চন্দ্রের মা রুক্মিনীদেবী কখনও স্বামীর গৃহে থাকেননি। তিনি তাঁর মাতামহের বাড়িতেই থাকতেন।
সেখানেই হারাণ চন্দ্র এবং হরিশ চন্দ্রের জন্ম হয়। হরিশ চন্দ্রের ছোটবেলা অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছিল।
স্কুলে পড়ার সময়েই হরিশ চন্দ্রকে মায়ের অনুরোধে বিয়ে করতে হয়েছিল। স্ত্রী ছিলেন মোক্ষদাসুন্দরী, উত্তরপাড়ার গোবিন্দচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা।
মোক্ষদাসুন্দরীর গর্ভে হরিশচন্দ্রের দুটি সন্তান হয়েছিল। প্রথমটি মেয়ে যার জন্মের কয়েকদিন পরই মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় সন্তান হয় একটি ছেলে। ছেলেটির জন্মের ১৫ দিনের মধ্যেই
মোক্ষদাসুন্দরীর মৃত্যু হয়। শিশুপুত্রের রক্ষণাবেক্ষনের জন্য হরিশ চন্দ্র দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ভগবতী। ভগবতী দরিদ্র পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তিনি সুন্দরী ছিলেন না এবং শিক্ষাদীক্ষাও বিশেষ ছিল না। যে পুত্রসন্তানটিকে দেখাশোনা করবার জন্য হরিশ চন্দ্র দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সে মাত্র তিন বছর বয়েসেই কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানের মৃত্যুতে হরিশ চন্দ্র মানসিকভাবে কাতর হয়ে পড়েন এবং মদ্যপান আরম্ভ করেন। এই মদ্যপানই
পরবর্তীকালে তাঁর নিজের মৃত্যুর কারণও হয়, যদিও মৃত্যুর কিছুমাস আগে তিনি কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং চিকিৎসায় জীবন ফিরে পান কিন্তু যক্ষ্মা রোগ তাঁর শরীরে বাসা বাঁধে এবং এই মারণ রোগেই তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যায়।
ভারতীয় সাংবাদিকতাকে নির্ভীক হতে তিনিই প্রথম পথ দেখিয়েছিলেন। নিজের মূল্যবোধের সঙ্গে কখনো আপোষ করেননি। অথচ তাঁর ছোটবেলাটা এতটুকুও সহজ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছিলেন — ভবানীপুর ইউনিয়ন স্কুলে ভর্তি
হয়েছিলেন এবং তাঁর মেধার প্রতি শিক্ষকেরা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁকে কোনো বেতন দিতে হতো না। মাত্র ৭ বছর বয়সে পরিচয় দিলেন নিজের প্রখর বুদ্ধিমত্তার। ভবানীপুর ইউনিয়ন স্কুলে বিনা বেতনে পড়াশোনা করার সুযোগ করে নিলেন তিনি। স্কুলে এক শ্বেতাঙ্গ, ভারতীয়দের দেখলেই গালাগালি করত। হরিশ দেখতে দেখতে একদিন স্কুল চত্বরেই বেদম প্রহার করলেন তাকে। রেভারেন্ড পিফার্ড সেবার আগলে নিলেও,হরিশ্চন্দ্র আর বেশিদিন চালাতে পারলেন না পড়াশোনা। খালি পেটে তো আর বিদ্যা অর্জন করা যায় না।
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বেরিয়ে পড়লেন জীবিকার সন্ধানে। পড়াশোনা অসম্পূর্ণই থেকে গেল।
এমন ছেলেকে কে আর চাকরি দেবে ? পেটে যেটুকু বিদ্যে ছিল তাই সম্বল করে হাতে তুলে নিলেন দোয়াত আর কলম। তা নিয়েই রোজ বসে পড়তেন ডাকঘরের
সামনে। নামমাত্র পারিশ্রমিকে, সুন্দর হাতের লেখা ও নির্ভুল ইংরেজিতে চিঠিপত্র, দরখাস্ত, ফর্ম পূরণ করে দিতেন। তাই দিয়ে কোনওমতে কয়েক বছর সংসার চালালেন। ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল একদিন। নিজগুণে ডাকঘর থেকে উঠে এসে চাকরি পেলেন নেটিভ রাইটারের। 'মেসার্স টুল্লাহ এন্ড কোম্পানি' নামক ছোট্ট এক ফার্মে, মাসিক আট টাকা মাইনেয় তিনি কাজ করতে শুরু করেছিলেন। কাজে যোগ দিয়ে বুঝলেন, শ্বেতাঙ্গ ও নেটিভদের মধ্যে বেতন ও পদমর্যাদায় বিস্তর ফারাক। প্রাপ্য মর্যাদা ও পারিশ্রমিক থেকে নিজের দেশেই বঞ্চিত দেশীয় লোকেরা।তিনি প্রতিবাদ জানালেন। ফলস্বরূপ, চাকরিটা আর করা হলো না তাঁর। কয়েক মাসের মধ্যেই অবশ্য আবার একটি চাকরি জুটিয়ে নিলেন। এবার তাঁর কর্মস্থল হলো মিলিটারি অডিটর জেনারেলের অফিসে। এখানে এসে তিনি বুঝলেন, এখনো বিদ্যার কদর আছে। তবে তা ইংরেজি বিদ্যার। ভালোভাবে ইংরেজি আয়ত্ত করতে পারলেই তাকে ইংরেজরাও সমীহ করতে বাধ্য হবে। সারাদিন কাজ করে বাকি সময় তিনি কাটাতে লাগলেন ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরীতে। কোনো কোনো দিন হয়তো পেটে একটি দানাও জুটতো না! তবু তাঁর বই পড়া চাই। ইংরেজি ভাষায় কিছুটা ব্যুৎপত্তি লাভ করার পর, তিনি পড়তে শুরু করলেন অর্থনীতি থেকে দর্শন, ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান বিভিন্ন গ্রন্থ। পোশাক পরিচ্ছদের হুঁশ নেই, খাবার দাবারের হুঁশ নেই —তাঁর শুধু নেশা বই পড়া।
সংগ্রামের প্রথম দিকে, তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য বিল, চিঠি, আবেদনপত্র লিখতেন এবং বাংলা নথিপত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করতেন। তাঁর প্রথম পূর্ণকালীন চাকরি ছিল মেসার্স টুল্লুহ অ্যান্ড কোম্পানিতে বিল-লেখকের। মুখার্জি প্রায় দশ বছর ধরে সেখানে মাসিক ১০ টাকা বেতনে কাজ করেছিলেন। তারপর, ১৮৪৭ বা ১৮৪৮ সালে, তিনি মিলিটারি অডিটর জেনারেলের অফিসে কেরানির চাকরি পান। অডিটর জেনারেল কর্নেল চ্যাম্পনিস এবং তার ডেপুটি কর্নেল গোল্ডি, উভয়েই মুখার্জির প্রতি অনুরাগী ছিলেন, তাঁর নিষ্ঠা এবং কাজের নীতির জন্য। তিনি ঘন ঘন পদোন্নতি উপভোগ করতেন, তার মাসিক বেতন ২৫ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছিল - যা সেই সময়ের জন্য বেশ মোটা অঙ্কের ছিল।
কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সংক্ষিপ্ত কিন্তু ঘটনাবহুল কর্মজীবনই তাঁকে বাংলায় ঘরে ঘরে পরিচিত করে তুলেছিল - কেবল ব্রিটিশ আমলা ও প্রশাসক বা ব্রিটিশপন্থী বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই নয়, বংশ পরম্পরায় ঔপনিবেশিক শোষণের সবচেয়ে খারাপ পরিণতির মুখোমুখি বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। বাংলার কৃষকদের জন্য তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতায় এত কিছু করার পরেও, কোম্পানির শাসনামলে উপজাতীয় বিদ্রোহকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে মুখার্জিকে অন্তত কিছু মহলে সমালোচনা করা হয়েছে। গবেষক অশোক চট্টোপাধ্যায় যেমন উল্লেখ করেছেন, সংবাদপত্রটি সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ হিসেবে নিপীড়নকে স্বীকৃতি দিলেও, বিদ্রোহের 'রিং লিডারদের' জন্য সর্বোচ্চ স্তরের শাস্তির পক্ষে ছিল।
চট্টোপাধ্যায় এমনকি দাবি করেছেন যে ব্রিটিশরা অশান্তি দমনের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে মুখার্জি স্বস্তি বোধ করেছিলেন। যদিও এই মনোভাবটি সরকার-পন্থী বলে মনে হয় না, এটি রেনেসাঁ যুগের শহুরে অভিজাতদের সাধারণ মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করে, যাদের গ্রামীণ দুর্দশার সাথে কোনও সম্পর্ক ছিল না। চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যগুলি উপনিবেশ-পরবর্তী তাত্ত্বিক এবং উপ-ঐতিহাসিকদের দ্বারা এই বুদ্ধিজীবীদের রাজনীতির অবমাননাকে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত করে।
উল্লেখ্য, হরিশ মুখার্জি একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন এবং অন্যদের মতো তিনিও ভারতীয় উপমহাদেশে পশ্চিমাদের আধুনিক উপাদান এবং জাঁকজমক দ্বারা অভিভূত হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই, ব্রিটিশ-মুক্ত ভারত দাবি করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল, এবং তাও উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। বরং তিনি ব্রিটিশদের 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দেওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। আরও উল্লেখযোগ্য যে, সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন তা পূর্ণকালীন সাংবাদিক হিসেবে তার প্রথম বছরেই করেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে তার অবস্থান পরিবর্তিত হয়। তিনি এই ধরনের লাইন লিখেছিলেন : "আমরা যা চাই তা হল বিদ্যমান কাউন্সিলে একটি ছোট স্বাধীন উপাদানের প্রবর্তন নয়, বরং একটি ভারতীয় সংসদ।"
কৃষকদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা যদি সত্যিকার অর্থে অকৃত্রিম না হতো, তাহলে বিদ্যা ভুনির রচনায় তাদের বিলাপ কখনও প্রতিধ্বনিত হতো না। মুখার্জি তাঁর সমসাময়িকদের থেকে আলাদা ছিলেন তাঁর নিজস্ব সময়ের সংশ্লেষণ। একজন আগ্রহী পাঠক হিসেবে, তিনি মেটক্যাফ হলে অবস্থিত কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরিতে অফিসের পরে প্রতিদিন প্রায় ২-৩ ঘন্টা সময় কাটাতেন, ব্রিটেন থেকে আমদানি করা ম্যাগাজিন এবং বই পড়তেন।
তাঁর সৎ ভাই রাজ কিশোর মুখার্জি একবার দাবি করেছিলেন, তিনি মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে 'এডিনবার্গ রিভিউ'-এর ৭৫ টি খণ্ড পড়ে শেষ করেছেন। এই অধ্যয়ন পর্বগুলি তাঁকে পশ্চিমা সভ্যতা, সামাজিক অবকাঠামো এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে অবহিত করেছিল। এই অনুশীলনের সাথে যুক্ত হয়েছিল সমসাময়িকতার উপর তাঁর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ।
কলকাতার একজন প্রবীণ শিক্ষক এবং গবেষক দিলীপ কুমার মজুমদার, যিনি হরিশ মুখার্জির উপর কয়েকটি বই লিখেছেন, তিনি উল্লেখ করেছেন, “ এইতাঁর হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের মতো অভিজাতত্ব ছিল না, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো প্রতিভাবান শিক্ষাগত উৎকর্ষও ছিল না, এবং সেই কারণেই সম্ভবত ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা নয়, তাঁর সমসাময়িকরাও তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে আলোচনা থেকে বাদ দিয়েছেন। আপনি তাঁর একটি প্রতিকৃতিও খুঁজে পাবেন না। যদিও ১৮৬৩ সালে একজন পার্সি অধ্যাপক একটি ইংরেজি জীবনী লিখেছিলেন, তার মৃত্যুর সাতাশ বছর পরে ১৮৮৮ সালে প্রথম বাংলা জীবনী প্রকাশিত হয়েছিল! এবং, জীবনীকার কে ছিলেন ? নিশ্চিত রামগোপাল সান্যাল। তবুও, তিনি যে চিহ্ন রেখে গেছেন তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না, তাই না ? "
"হ্যাঁ, তারও সীমাবদ্ধতা ছিল। তিনি ক্যানিংয়ের 'দয়া'র পিছনে আসল কারণ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং তাকে সমর্থন করে চলেছিলেন। কিন্তু, অন্যরা যা দেখতে পায়নি, তা তিনি সহজেই দেখতে পেতেন। উদাহরণস্বরূপ নীল চাষের কথাই ধরুন। ঠাকুররা এটিকে একটি লাভজনক ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে দেখেছিলেন, অন্যদিকে হরিশ এটিকে কেবল 'সংগঠিত প্রতারণা এবং নিপীড়ন' বলে অভিহিত করেছিলেন। তাই, তাকে উপনিবেশবাদী-পন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা অন্যায্য হবে। এবং, এই বছরগুলিতে ভারতীয় মূলধারার মিডিয়া কতটা হ্রাস পেয়েছে তা বিবেচনা করে, হরিশের জীবন এবং কাজগুলি পুনর্বিবেচনা করা আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়,"
ক্রমে অবস্থা ফিরল তাঁর। বিলেতে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত নানা রকম পত্রপত্রিকা, বই, সংবাদপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করায় তাঁর নতুন উপলব্ধি হলো। ব্রিটিশ জাতির ইতিহাস,
তাদের রীতিনীতি, রাজ্যশাসন প্রণালী ও আরও অনেক কিছুর সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা এলো হরিশের মধ্যে। এই জাতির ইতিহাস জানতে গিয়ে অবাক হলেন হরিশ। তিনি বুঝলেন ‘স্বাধীনতা' নিয়ে কিন্তু ইংরেজরা ভীষণ ভাবে সচেতন। নিজেদের সন্তানদের এরা ভীষণভাবে স্বাধীনচেতা করে তোলে। প্রতি মুহূর্তে তাদের স্বাধীনতার শিক্ষা দেয়। অথচ সেই ইংরেজই অন্য জাতিকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে রাখে। ইংরেজদের রচনা পাঠ করেই হরিশের স্বাধীনতাবোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।
প্রতিজ্ঞা করলেন, এই দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন তিনি। অস্ত্র হিসেবে বেছে নিলেন তাঁর কলমকে। বন্ধু গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাছে জানতে পারলেন শীঘ্রই
নতুন একটি সংবাদপত্র আসতে চলেছে। নাম 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট'। নিয়মিত কলমও ধরলেন সেখানে।
'দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট' কে শুরু করেছিলেন তা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে মুখার্জির আমলে সাপ্তাহিকটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তিনি কখনও এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। বেশিরভাগ গবেষকের দাবি অনুসারে, বড়বাজারের ব্যবসায়ী মধুসূদন রায় ১৮৫৩ সালের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন :দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট' এবং সাপ্তাহিকটি পরিচালনার জন্য তিন ভাই, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ( বিখ্যাত নাট্যকারের নন ), শ্রীনাথ ঘোষ এবং ক্ষেত্রনাথ ঘোষের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।
প্রথমে, সংবাদপত্রটির অফিস ছিল উত্তর কলকাতায়, যেখানে গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ছিলেন সম্পাদক। হরিশ্চন্দ্র ঠিক কখন এর সাথে যুক্ত হন তা জানা যায়নি, তবে বেশ কয়েকটি সূত্র অনুসারে, তিনি অবশেষে ১৮৫৫ সালে মালিকানা অর্জন করেন। ততক্ষণে, তিনি 'হিন্দু ইন্টেলিজেন্সার' (ডিরোজিয়ান কাশী প্রসাদ ঘোষ সম্পাদিত) এবং 'দ্য ইংলিশম্যান' সহ শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি সাপ্তাহিক এবং দৈনিক পত্রিকায় তার কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত করে তার দক্ষতা প্রমাণ করেছিলেন এবং এমনকি কব হুরি ('দ্য ইংলিশম্যান'-এর সম্পাদক) এর মতো সম্পাদকদের কাছ থেকেও প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।
প্রায় একই সময়ে, তিনি 'ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন'-এর সদস্য হন, যা দেশের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে একটি, যা সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ছিল। যদিও এটি জমিদার এবং অভিজাতদের সমাবেশ ছিল, মুখার্জি ছিলেন এর সবচেয়ে সক্রিয় সদস্যদের একজন এবং তার রাজনৈতিক পরিচর্যা মূলত " বি আই এ" -এর সাথে তার যোগাযোগের জন্য দায়ী ছিল।
এরপর, পত্রিকার অফিসটি ভবানীপুরে স্থানান্তরিত হয়। হরিশচন্দ্র তাঁর মাসিক বেতনের প্রায় পুরোটাই পত্রিকাটি পরিচালনা করতে ব্যয় করতেন। যেহেতু তিনি একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন, তাই তার ভাই হারানকে অফিসিয়াল স্বত্বাধিকারী করা হয়, অন্যদিকে হরিশ্চন্দ্র ১৮৬১ সালে ৩৭ বছর বয়সে তার অকাল মৃত্যু পর্যন্ত টানা ছয় বছর এর একমাত্র সম্পাদক ছিলেন।
হিন্দু প্যাট্রিয়ট ১৮৫৯ সালের ১২ মে পর্যন্ত প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে প্রকাশিত হত যা ২১ মে ১৮৫৯ থেকে, এটি প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় প্রকাশিত হতে শুরু করে; ( ১৮৯২ সালে, সংবাদপত্রটি দৈনিক হয়ে ওঠে), এটি ছিল একটি ৮ পৃষ্ঠার সংবাদপত্র যা বিভিন্ন ধরণের সংবাদ, নিবন্ধ, সম্পাদকের কাছে চিঠি, বই পর্যালোচনা এবং বিজ্ঞাপন প্রকাশ করত।
কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সীমিত সংখ্যক মাইক্রো-ফিল্মড কপি দেখার সময়, একটি আকর্ষণীয় বিষয় নজর কেড়েছে তা হল কোনও বাইলাইনের অনুপস্থিতি। রাম গোপাল ঘোষ, কিশোরী চাঁদ মিত্র, রাজেন্দ্র লাল মিত্র, দ্বারকা নাথ মিত্র প্রমুখ অন্যান্য বিশিষ্ট চিন্তাবিদরাও সংবাদপত্রে অবদান রেখেছিলেন, নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, যিনি ১৯১০ সালে 'সিলেকশনস ফ্রম দ্য রাইটিংস অফ হুরিশ চন্দ্র মুখার্জি কম্পাইলড ফ্রম দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট' সম্পাদনা ও সংকলন করেছিলেন।
প্রকৃত সাহস থেকে শুরু করে গভীর অন্তর্দৃষ্টি, বিষয়গুলির সরাসরি সমাধান থেকে শুরু করে লেখার সংক্ষিপ্ততা - হরিশের প্রবন্ধগুলিতে ভারতে রাজনৈতিক প্রতিবেদনকে একটি নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়ার সবকিছুই ছিল।
হরিশ্চন্দ্র ইংরেজদের নির্লজ্জ মানসিকতা প্রকাশ করে যেতে লাগলেন তাঁর ব্যক্তিত্বের সাবলীল ভঙ্গিতে। মাত্র তিন মাসের মাথায় পুরো সংবাদপত্রটির সম্পাদনার
দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর কাঁধে।
আঠারো শতকে, নীলচাষিদের নীল চাষ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, যার বিনিময়ে তারা খুব একটা কিছু পেত না। ধীরে ধীরে নিপীড়ন এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে অবশেষে দরিদ্র কৃষকরা বিদ্রোহ করে এবং নীল চাষ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
কোনও দ্বিধা ছাড়াই, হরিশচন্দ্র আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন করেন এবং ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট' সংবাদপত্রে ভারতীয় কৃষকদের উপর নীলকরদের অত্যাচার ও নির্যাতনের
কথা প্রকাশ করতে শুরু করেন। এটি দীনবন্ধু মিত্রকে তার বিখ্যাত নাটক ‘নীল দর্পণ’ লিখতে অনুপ্রাণিত করে এবং এই সমস্ত বিষয় একত্রিত হয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে এক বিরাট প্রতিবাদের জন্ম দেয় এবং তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট'-এর মুখ বন্ধ করার চেষ্টায় তারা একটি মামলাও দায়ের করে। তবে মামলাটি ব্যর্থ হয়, কারণ ভবানীপুর তখন ইংরেজ সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ারের বাইরে ছিল। এর ফলে সরকার "নীল তদন্ত কমিশন" গঠন করতে বাধ্য হয়, যা আসলে সমস্যার সমাধান
করেনি, বরং নীলকর মালিকদের স্বৈরাচারী আচরণের উপর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। ব্রিটিশ অফিসের এক সামান্য কেরানী তর্ক, যুক্তি আর তথ্যের ধারে-ভারে
একের পর এক সরাসরি আক্রমণ হানলো লর্ড ডালহৌসি ও কোম্পানির নির্লজ্জ সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতিকে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন চলছিল নীলকর সাহেবদের অত্যাচার। আইনকে বুড়ো আঙুলের ডগায় নিয়ে গিয়েছিলেন নীলকর সাহেব ও ম্যাজিস্ট্রেটরা। অথচ কারোর প্রশ্ন করার এতটুকু সাহস ছিল না। একের পর এক চাষিরা নীলকর প্রভুদের নিঃশর্ত দাসে পরিণত হচ্ছিল। চোখের সামনে ঘরের মা বোনেদের বিবস্ত্র করে চাবুক মারা হচ্ছিল। বাংলায় গ্রামে গ্রামে চাষিদের বাড়িঘর, ধানক্ষেত একে একে সমস্ত কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেওয়া হচ্ছিল। নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতো না। কারণ মফস্বলের আদালতে শ্বেতাঙ্গদের নামে মামলা মোকদ্দমা করা যেত না। এত নির্মম অত্যাচার চলছিল, অথচ দেশের রাজধানী কলকাতায় কারো কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না। বাবুরা তখন সাহেবদের তৈলমর্দনে ব্যস্ত। হরিশচন্দ্র রুখে দাঁড়ালেন। অগ্নিগর্ভ ভাষায় তুলে আনতে লাগলেন বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের চাষিদের দুঃখ দুর্দশার কথা। কলম চালানোর পাশাপাশি স্বয়ং যোগাযোগ রাখতে শুরু করলেন প্রত্যন্ত গ্রামের চাষিদের সাথে। তাদের দুঃখের কথা নিজ মুখে শুনলেন। নিজের সর্বস্ব সহায়-সম্বল দিয়ে অর্থসংস্থান করে যেতে থাকলেন। এই বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখতে সব রকম চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। দেশকে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন হরিশ। বাংলার ঘরে ঘরে, মা বোনেদের করুণ পরিণতি নির্ভীক চিত্তে তুলে আনলেন সকলের সামনে। নদিয়া, যশোর, পাবনা, রাজশাহী, ফরিদপুরের টুকরো টুকরো কাহিনী জোগাড় করে তাদের বাঁধলেন এক সূত্রে। নেতৃত্বহীন গরিব চাষিদের বিপ্লব এক জায়গা থেকে সংগঠিত হলো। লাখ লাখ অভাগা চাষি তাঁকে
ভগবানের মর্যাদা দিলেন। দীনবন্ধু মিত্র 'নীল-দর্পণ' নিয়ে দেখা করতে এলেন হরিশচন্দ্রের সঙ্গে। বাংলার ইতিহাসে সঞ্চার হলো এক নতুন বিপ্লবের।
১৮৫৩ সালে তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনে যোগদান করেছিলেন এবং রাজনীতি নেতৃত্ব, ইতিহাস, আইনে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। হরিশচন্দ্রের সাথে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকার নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছিল ভারতের প্রথম জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র।
'হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকাটির জন্যই মাত্র আট বছরের মধ্যে হরিশচন্দ্রের খ্যাতি প্রায় সারা ভারতে
ছড়িয়েছিল এমনকি ইউরোপের শিক্ষিত সমাজেও তাঁর নাম প্রচারিত হয়েছিল।হরিশচন্দ্র এই কাগজে বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ মারফত বৈদেশিক সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থা
করেন এবং তিনি পত্রিকাটিকে একটি আধুনিক পত্রিকায় পরিণত করেন। তবুও ১৮৫৭
খ্রিস্টাব্দের শেষ অবধি এই পত্রিকা চালাতে হরিশচন্দ্রকে আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন
হতে হয়। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকার প্রথম থেকেই হরিশচন্দ্র সমাজের নিম্নতম শ্রেণির মানুষের
অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই শুরু করেন। তিনি সাধারণ মানুষের উপরে পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হন। বাংলার চাষিদের উপরে নীলকরদের অত্যাচার বন্ধের
জন্য তিনি বাংলার উচ্চশ্রেণির মানুষদের এগিয়ে আসতে বলেন।১৮৫৬ থেকে ১৮৬০ –এই স্বল্প সময়সীমার মধ্যে সমকালীন প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক , সামাজিক সমস্যা নিয়ে ব্যক্ত করেছেন তাঁর মতামত;চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত , সিপাহি বিদ্রোহ , ব্ল্যাক অ্যাক্ট আন্দোলন , রায়তদের সমস্যা , চাকুরির ক্ষেত্রে বিভাজননীতি ইত্যাদি নিয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ ; সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করেছেন নীলকরদের এবং সাহায্য করেছেন তাঁদের দ্বারা অত্যাচারিত রায়তদের। তিনি তৎকালীন
সরকারের আমদানি-রপ্তানি নীতিরও তীব্র সমালোচনা করেন। ভারত থেকে চাল,
চিনি, তৈলবীজের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রপ্তানি করে মদ প্রভৃতি বিলাসদ্রব্য
আমদানির বিরোধিতা করেন। হরিশচন্দ্র বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বহুবিবাহ নিরোধ নিয়েও বহু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রস্তাব
পুস্তকাকারে প্রকাশের সাথে সাথে এ বিষয়ে জনমত গঠনে সহায়তা করেন।
বিধবা পুনর্বিবাহ আইনের প্রতি সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে, তাঁর ছয় বছরের সম্পাদকীয় কার্যকালের সাথে কিছু অভূতপূর্ব ঘটনার মিল ছিল যা ভবিষ্যতের ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে রূপ দেবে - সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫), আওধের অধিগ্রহণ (১৮৫৬), বিধবা পুনর্বিবাহ আইন পাস (১৮৫৬), ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ এবং পরবর্তীকালে ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬২)।
বিধবা পুনর্বিবাহ আইন পাসের খবর প্রকাশিত হয় ২৪ জুলাই, ১৮৫৬ । সেই সময়ের বেশিরভাগ শহুরে সংবাদপত্রের মতো, দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট বিধবা পুনর্বিবাহ আইন, নারী শিক্ষা এবং অন্যান্য সামাজিক সংস্কারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল। লর্ড ডালহৌসির প্রবর্তিত 'বিলুপ্তির মতবাদ' নীতির বিরুদ্ধে এটিই প্রথম তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশ করেছিল। হরিশ্চন্দ্র তাঁর অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ প্রবন্ধ 'অ্যানেক্সেশন অফ ওউড'-এ এই ধরণের সর্বগ্রাসী মনোভাবের বৈষম্য এবং নিষ্ঠুরতা বেশ নির্মমভাবে প্রকাশ করেছিলেন। লর্ড ডালহৌসি তাঁর লেখায় যন্ত্রণাদায়কভাবে বিরক্ত বোধ করেছিলেন বলে জানা গেছে।
এরপর, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়টের কর্মজীবনে এক নতুন প্রস্থান ঘটে। নীতির প্রতি অনুগত একজন সত্যিকারের সাংবাদিকের মতো, হরিশ্চন্দ্র , সুবাদার হাদায়ত আলীর লেখার জবাবে, যথাযথ যুক্তি এবং ব্যাখ্যা দিয়ে 'বিদ্রোহের কারণ' খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
হরিশ্চন্দ্রের মতে, "বিদ্রোহের বিস্তারকে সাধারণ বিদ্রোহে রূপান্তরিত করার একটি কারণকে স্বাভাবিকভাবেই উপেক্ষা করে" - আফগান যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত, আওধের অধিগ্রহণ, গরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে মেশানো কার্তুজ এবং জমিদার অভিজাতদের জমা দেওয়া।
শেষ কারণ সম্পর্কে তার বোধগম্যতা তাকে বুঝতে সাহায্য করেছিল যে বিদ্রোহটি একটি 'ভারতীয় বিদ্রোহে' পরিণত হয়েছে। বিদ্রোহের সময় তিনি বিদ্রোহী এবং ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা ও নৃশংসতার নিন্দা করেছিলেন, ভারতের তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের 'সহনশীলতা' নীতিকে সমর্থন করেছিলেন এবং এমনকি '১৮৫৮ সালের সনদ'কে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
কিন্তু, সেই সময়ের ইংরেজি-শিক্ষিত স্থানীয় শ্রেণীর মধ্যে (যারা মূলত বিদ্রোহের নিন্দা করেছিল), মুখার্জিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিদ্রোহের সুদূরপ্রসারী চিহ্নটি বুঝতে পেরেছিলেন: "আমরা ধারণা করি, ইতিহাস ১৮৫৭ সালের মহান ভারতীয় বিদ্রোহের ঘটনাগুলির প্রতি সমসাময়িকরা যা দেখেছেন তার থেকে একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নেবে।"
হরিশচন্দ্র ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টে’র সম্পাদকরূপে স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে বহু সংবাদ ও প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি পত্রিকাতে পতিতা সমস্যা এবং সরকারি শিক্ষানীতি নিয়েও
আলোচনা করেন।
তিনি সংস্কৃত ভাষার প্রসার এবং মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা করেন। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টে'র সম্পাদকীয়তে প্রাচীন বাংলার সাহিত্যের উল্লেখ ও উদ্ধৃতি
থেকে প্রমাণিত হয় যে বাংলা ভাষার প্রতি হরিশচন্দ্রের অনুরাগ ছিল। সেই সময় যে সব বাংলা বই প্রকাশিত হত তার সমালোচনা ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টে’ প্রকাশিত হত। হরিশচন্দ্রের সম্পাদনায় আন্তর্জাতিক খবরও ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টে’ প্রকাশিত হত। এতে ব্যবসা বাণিজ্য বাজারদর প্রভৃতিও থাকত। সেই সময় দেশীয় পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন খুব কম প্রকাশিত হত ।
কিন্তু ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টে’ দেশি বিদেশি ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’
ধীরে ধীরে বিদেশি পরিচালিত পত্রিকাগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল।
১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়। ক্রমবর্ধমান সরকারি খাজনার
চাপ, জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের শোষনের ফলে তারা খুব অসুবিধার মধ্যে
পড়েছিল। সাঁওতালরা সংঘবদ্ধ ও সশস্ত্র হয়ে বহু দারোগা ও মহাজনদের হত্যা করেছিল।
তাদের দমন করতে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী আসে এবং সাঁওতালদের হাতে বহু ব্রিটিশ
সেনা প্রাণ হারায়। এই বিদ্রোহের নেতা সিধু ও কানুকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল। পনেরো থেকে পঁচিশ হাজার সাঁওতাল এই বিদ্রোহে মারা যায়। এই সাঁওতাল
বিদ্রোহের খবর কলকাতায় পৌঁছোনোর পর ইউরোপীয় সংবাদপত্রগুলি সরকারকে
কঠোরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করার পক্ষে রায় দিয়েছিল। কিন্তু হরিশচন্দ্র এই মত দেন
যে কঠোর শোষণের ফলেই সাঁওতালরা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি উপদ্রুত
অঞ্চলে সামরিক শাসন জারিরও তীব্র বিরোধিতা করেন। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ ছাড়া সেসময়
কোনো সংবাদপত্রই সাঁওতাল বিদ্রোহের বিদ্রোহীদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায়নি।
কিন্তু একমাত্র হরিশচন্দ্র তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে এবং সরকারের কড়া সমালোচনা করে সাহসের পরিচয় দেন।
'প্ল্যান্টার্স পোর্ট্রেটস' শিরোনামের আরেকটি প্রবন্ধে, তিনি 'নীলকুঠি' (প্ল্যান্টার্স ম্যানশন) - এ নির্মিত জেলখানার ভয়াবহ বিবরণ এবং গ্রামবাসীদের শারীরিক শাস্তির মাত্রা সম্পর্কে কথা বলেছেন। এমনকি তিনি প্লান্টার্স এবং দুর্নীতিবাজ ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে অবৈধ লেনদেনের বিষয়টিও উন্মোচন করেছেন, যা অপরাধীদের এত বছর ধরে নিরাপদে রেখেছিল।
কৃষকদের স্বার্থে তাঁর অক্লান্ত নিষ্ঠা তাঁকে তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু করে তুলেছিল। তাঁর ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্রটি কৃষকদের মুখপত্র হয়ে ওঠে, যারা বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা কখনও জানত না। বিপ্লবের সময়, অনেক কৃষক আশ্রয় এবং পরামর্শের জন্য তাঁর ভবানীপুরের বাড়িতে আসতেন। তাদের জন্য দরজা সর্বদা খোলা ছিল।
অনেক বোঝানোর পর, ব্রিটিশ সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে হরিশ্চন্দ্রকে তাঁর সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তলব করা হয়। ঘটনাগুলির তার বিস্তারিত প্রতিবেদন কেবল প্রশাসনের জন্যই অস্বস্তিকর নয়, বরং তার নিজের জন্যও মারাত্মক হয়ে ওঠে।
হরিশচন্দ্র চিরকাল অমানুষিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত ছিলেন। রাতে কয়েক ঘণ্টা ছাড়া সারাদিন তিনি কর্মব্যস্ত থাকতেন। নীলবিদ্রোহের সূচনাকাল থেকে তাঁর এই ঘুমের সময়েও টানাটানি পড়ে। সারাদিন অফিসের কাজ সেরে তারপর বাড়িতে গ্রামের প্রজাদের অভাব অভিযোগ শুনতে হত এবং তাদের পরামর্শ এবং অন্যান্য সাহায্য করতে হত। এরপর গভীর রাত্রিতে তাঁকে জেগে ‘হিন্দু পেট্রিয়টে'র কাজও করতে হত।
গুরুতর পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার পরেও তিনি কখনও অফিস কামাই করতেন না। তার বরাবর হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট রোগ ছিল, তারপর রোজ তার জ্বর হতে লাগল। এই সময় হরিশচন্দ্রের বন্ধু রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র
রমাপ্রসাদ রায় তাঁকে জোর করে উত্তর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। এখানে কলকাতা শহরের সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক ডা. এডোয়ার্ড গুডিভ এবং ডা. নীলমাধব মুখোপাধ্যায় তাঁর চিকিৎসা করেন। তাঁর রোগ ক্ষয়কাশ বা যক্ষ্মা বলে ধরা পড়ে। হরিশচন্দ্র বুঝতে পারেন যে তাঁর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। তিনি তখন
ভবানীপুরে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। এত অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি ‘হিন্দু পেট্রিয়টে'র কাজ থেকে ছুটি নেননি। যত দিন পেরেছেন তিনি 'হিন্দু পেট্রিয়টে'র
সম্পাদকীয় লিখে গেছেন। তিনি ১৮৫৯-৬০ সালের নীল বিদ্রোহকেও এই পত্রিকার মাধ্যমে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গোরা' উপন্যাসে মহিম , গোরার কথা বলতে গিয়ে “হরিশ মুখুজ্জে দি সেকেন্ড” বলে বিঁধতে ছাড়েনি। গোরা বা মহিম কাল্পনিক চরিত্র হলেও রক্তমাংসে গড়া হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় যে রবীন্দ্র যুগেও অনেকটাই প্রভাব বিস্তার
করেছিলেন সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস ঊনবিংশ শতকের আটের দশকে লেখা।
১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে হরিশচন্দ্র যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত সেই সময় তাঁরই সমসাময়িক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মেদিনীপুরে বসবাসকারী বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন,
“শুনেছি পেট্রিয়টের বেচারা হরিশ মৃত্যু শয্যায়। এটা বড়োই বেদনাদায়ক সংবাদ। বর্তমানে
জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের উপর তাঁরই প্রভাব সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়েছে। আশা করি তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। তিনি মারা গেলে দেশের খুব ক্ষতি হবে, যদিও এই ক্ষতি আমাদের সাহিত্যে হবে না, হরিশ 'ফিরিঙ্গি' ইংরেজি লেখেন।
আমাদের দেশে মানসিক চিন্তার ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতার ধারা প্রবাহিত হয়েছে সেই ধারাটি ব্যাহত হবে।”
অবশেষে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুন শুক্রবার সকাল সাড়ে নটার সময়ে মাত্র ৩৭ বছর বয়েসে হরিশচন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর তিন মিনিট আগেও হরিশচন্দ্র জ্বরের ঘোরে চিৎকার করে ওঠেন —“ওরে পেট্রিয়ট মেশিনে ওঠাস নে,
প্রুফটা আর একবার আমাকে দিয়ে দেখিয়ে তবে ছাপিস।” এটাই হরিশ্চন্দ্রের মুখের শেষ কথা। হিন্দু পেট্রিয়টের চিন্তা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর মনে ছিল।
১৮৬০ সালে, কচিকাটা (বর্তমানে বাংলাদেশের ফিরোজপুর জেলায়) বাগানের দুষ্ট ব্যবস্থাপক আর্চিবল্ড হিলস মুখার্জির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করেন। হিলস গ্রামের এক মহিলা হারোমনি দাসীকে অপহরণ করে ধর্ষণ করেছিলেন এবং পুরো ঘটনাটি হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হরিশ আদালতের মামলায় হেরে যান এবং অবশেষে অর্থহীন অবস্থায় মারা যান।
মুখার্জির মৃত্যুর পর হিলস্ একটি ডিক্রি পেতে সফল হন এবং তার শোকাহত মা এবং বিধবা স্ত্রীকেও রেহাই দেননি। কালীপ্রসন্ন সিংহ, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ এবং অন্যান্যদের প্রচেষ্টার জন্য, ভবানীপুরের তাদের বাড়িটি অল্পের জন্য বাজেয়াপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। দুঃখজনকভাবে লক্ষণীয় যে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, যার জন্য হরিশ্চন্দ্র এত কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন, তারা দুর্দশাগ্রস্ত এই মহিলাদের পাশেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করেনি।
অতঃপর,১৮৬১ সালের ১২ জুলাই ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাগৃহে এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয় ।এই সভায় হরিশের ‘স্মরণার্থ চিহ্ন স্থাপন করা’ সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় ।কালীকৃষ্ণ দেব বাহাদুর , সত্যচরণ ঘোষাল , রমাপ্রসাদ রায় , প্যারীচাঁদ মিত্র , কিশোরীচাঁদ মিত্র, দিগম্বর মিত্র , জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতিদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে আন্তরিক ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ ।
কালীপ্রসন্ন সিংহ হরিশচন্দ্রের স্মৃতিরক্ষা তহবিলে ৫ হাজার টাকা দান করলেন। হরিশস্মৃতি মন্দির স্থাপনের জন্য তিনি তাঁর সুকিয়া স্ট্রিটের ২ বিঘা জমি দান করার অঙ্গীকার করলেন। আর তিনি রচনা করলেন এক অসাধারণ পুস্তিকা : ‘হিন্দু পেট্রিয়ট সম্পাদক মৃত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্মরণার্থ কোন বিশেষ চিহ্ন স্থাপন জন্য বঙ্গবাসিদেগের প্রতি নিবেদন’। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে হরিশের স্মৃতিমন্দির স্থাপনের কাজ বিলম্বিত হতেই থাকে । শেষে হরিশচন্দ্র ফাণ্ডের ১০,৫০০ টাকা ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান সভার গৃহনির্মাণে ব্যয় হয় । এর কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে রামগোপাল সান্যাল বলেছেন , ‘ The truth of the matter is that some of the influential members of the Association , who had contributed handsomely to the fund , contrived in collusion with BabuKristo Das Pal , to appropriate the entire fund to the erection of the building of the Association.’
১৮৬১ সালের ৩ অক্টোবর ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এ প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে হরিশ মুখার্জীর জীবনী রচনা করবেন শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় । কিন্তু কেন শেষ পর্যন্ত সে জীবনী রচিতও প্রকাশিত হল না , তার কারণ অজ্ঞাত । ১৮৬৩ সালে হরিশের প্রথম জীবনী গ্রন্থ যিনি রচনা করেন , তিনি বাঙালি নন , মুম্বাইএর এলফিনস্টোন কলেজের পার্শি অধ্যাপক ফ্রামজি বোমানজি । তাঁর বই এর নাম : ‘ Lights and Shades of the East or a Study of the Life of Baboo Hurish Chunder Mookerjee and Passing Thoughts of India and its People , their Present and Future .’ পরবর্তীকালে দেশে ও বিদেশে এই বইএর নানা সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে , যা প্রমাণ করে বাংলার বাইরে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ ও হরিশ মুখার্জী সম্বন্ধে ইতিহাসমনস্ক মানুষের কৌতূহল আছে । বাংলা ভাষায় হরিশ জীবনীর প্রথম প্রকাশ ১৮৮৭ সালে । লেখক রামগোপাল সান্যাল । ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত হয় রামগোপাল সান্যালের ‘A General Biography of Bengal Celebrities—both Living and Dead .’ এই বইতে হরিশ মুখার্জী সহ আট জন খ্যাতনামা ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনী আছে । ফ্রামজি বোমানজি বা রামগোপাল সান্যাল , এঁরা কেউই হরিশচন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্ত তুলে ধরতে পারেন নি , পারা সম্ভবও ছিল না । হরিশের জীবনসম্পর্কিত তথ্য –চিঠিপত্র , দলিলদস্তাবেজ , তাঁর অন্তরঙ্গদের স্মৃতিচারণা – কোন কিছুই পাওয়া যায় না ।
১৯১০ সালে ধর্মতলা স্ট্রিটের দ্য চেরি প্রেস থেকে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় : ‘Selections from the Writings of Hurrish Chunder Mookerjee.’ এই সংকলনগ্রন্থের ভূমিকায় নরেশচন্দ্র বলেছেন যে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার দুটি খণ্ড থেকে রাজা প্যারীমোহন মুখার্জীর সহায়তায় হরিশের রচনা সংকলিত হয়েছে । উক্ত পত্রিকায় লেখকদের নাম থাকত না এবং পত্রিকায় রামগোপাল ঘোষ , কিশোরীচাঁদ মিত্র , রাজেন্দ্রলাল মিত্র ,গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখরা লিখতেন ; রচনারীতির বিচার করে হরিশের রচনা সনাক্ত করা হয়েছে ।হরিশচন্দ্রের জীবনী রচনা যে দুরূহ সে কথা বলতে গিয়ে আক্ষেপ করে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন যে,”হরিশের বাল্য ও কর্মজীবনের যথাযথ তথ্য পাওয়া যায় না , তাঁর কোন ছবি পাওয়া যায় না , সন্ধান পাওয়া যায় না তাঁর বাসগৃহের । উত্তরসূরীরা ভবানীপুরে তাঁর নামে একটি রাস্তা ও একটি পার্ক তৈরি করে তাঁদের কর্তব্য সমাধা করেছেন…ভবানীপুরের হরিশ পার্কে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে , কিন্তু কোন প্রতিকৃতি নেই ।“
তাঁর রচিত পুস্তিকায় কালীপ্রসন্ন সিংহ বললেন, --- ”হরিশচন্দ্রের মৃত্যুতে ভারতভূমি যত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তত ক্ষতি জলপ্লাবন, দুর্ভিক্ষ ও বিদ্রোহে হয়নি।“
রামমোহন, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে হরিশচন্দ্রের তুলনা করে তিনি বলেছেন,- -- “ তিনি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করিয়া ইহার যত উন্নতি সাধন করিয়াছেন, সতীদাহ নিবারণে রাজা রামমোহন রায়, বিধবাবিবাহ প্রচলনে বিদ্যাসাগরও তত উপকার সাধন করিতে পারেন নাই।“
আপাতভাবে কালীপ্রসন্নের এই কথাকে অত্যুক্তি মনে হতেও পারে; কিন্তু যদি আমরা রাজনৈতিক সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক ভাবনার দিক থেকে বিচার করি, তাহলে মনে হবে কালীপ্রসন্নের বক্তব্য সঠিক। দরিদ্র রায়টদের জন্য, নীলকরপীড়িত কৃষকদের জন্য, স্বাধিকারপ্রমত্ত শ্বেতাঙ্গ শাসকদের গতিকে রোধ করার জন্য হরিশচন্দ্র আজীবন কাজ করে গেছেন।
নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা, সংসার যিনি ত্যাগ করেছিলেন, সেই হরিশচন্দ্রের কাছে দেশবাসীর অসীম ঋণ। কালীপ্রসন্ন তাঁর পুস্তিকায় নানাভাবে দেশবাসীকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। তিনি আকুলভাবে বলেছেন :---
“ যদি আমাদের রামমোহন রায়ের নিকট, বিদ্যাসাগরের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বিধেয় হয়, তাহা হইলে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নিকট শতগুণে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। “
স্বাধীনতাপূর্ব যুগে,ভারতীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এক গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রেখে গিয়েছেন। পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, তিনি নির্ভীক মনোভাব নিয়ে সাংবাদিকতা করে গিয়েছিলেন।জয়তু হরিশ চন্দ্র ।।
তথ্যঋণ :----
১. সেই সময় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২. হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হিন্দু পেট্রিয়ট — গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্ত
৩. রাখে হরিশ মারে কে - স্বপন মুখোপাধ্যায়
৪. নাটক — হে সময় উত্তাল সময় — মহাবীর মুখোপাধ্যায়-
৫. হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জীবনী – রামগোপাল সান্যাল
0 Comments