জ্বলদর্চি

ওকড়া/ ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৯৬
ওকড়া

 ভাস্করব্রত পতি


রাস্তার পাশে, ধানজমির আলে বহুল পরিমাণে জন্মায় ওকড়া। বর্ষার শেষে বেড়ে ওঠে। শীতকাল জুড়ে এর দাপাদাপি। চোরকাঁটার মতো এদের একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার পদ্ধতি। গরু ছাগল মাঠে ঘাস খেতে গেলে তাদের গায়ের লোমে আটকে অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই এরা বংশবিস্তার করে থাকে। ছোটবেলায় গ্রামের ছেলে মেয়েরা গোপনে শুকনো ওকড়া ফল ছুঁড়ে দিত অন্যের মাথার চুলে। সেই চুলে জড়িয়ে যেত ওকড়া ফল। তখন বেশ মজা লাগতো।
ওকড়ার ফুল

ওকড়াকে সংস্কৃতে ইৎকট, উচ্ছটা বলে। ছোটা ধাতুরা, বনওকড়া, শাঁখাহুলি, ঘাগরা নামেও পরিচিত। তেলুগুতে বলে মারুলা মাতঙ্গি। এছাড়াও একে বলে Cyberian Cocklebur, Noogoora Bur, Common Cocklebur, Donkeybur, Donkey Burr, Heartleaf, Rough Cocklebur, Large Cocklebur, Woolgarie Bur, Clotbur ইত্যাদি। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Xanthium strumarium। এটি Asteraceae পরিবারের। এছাড়াও ওকড়ার আরও যেসব প্রজাতির দেখা মেলে, তা হল --
Xanthium canadense
Xanthium chinense
Xanthium glabratum

এই বন্য গুল্মের কথা মেলে চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে (অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী সম্পাদিত, ৪১৪ চৈতন্যাব্দ)। কৃত্তিবাসী রামায়ণে পাই, "ওকড়া ধুতুরা যে... বিল্বপাত"। বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে এটিকে একপ্রকার শাক হিসেবে উল্লেখ করে লেখা হয়েছে 'ওকরা বাথুয়া'। কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ক্ষেমানন্দ দাসের মনসার ভাসানতেও ওকড়ার কথা উল্লিখিত হয়েছে। উত্তর আমেরিকা, চিন এদের আদি বাসভূমি হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় ভালোই দেখা যায়। ভারত ছাড়াও মালয়েশিয়া, বাংলাদেশে জন্মায়। 
ওকড়ার ফল

ওকড়া গাছ প্রায় ৩০ - ৪০ সেমি লম্বা হয়। একবর্ষজীবি গাছ। ঝোপের মতো। পাতাগুলি একক এবং একান্তর। ডিম্বাকার সভংগ পাতার উপরিভাগ খরখরে। পুষ্পমঞ্জরী মুণ্ডক এবং দ্বিপুস্পক। অর্থাৎ পুংপুষ্প এবং স্ত্রীপুষ্প আলাদা আলাদা গাছে জন্মায়। ফলগুলি বেশ বৈশিষ্ট্য পূর্ণ। গায়ে কাঁটা কাঁটা রোঁয়া থাকে। যার ফলে খুব সহজেই অন্যের দেহে আটকে গিয়ে অন্যত্র বিস্তার লাভ করতে পারে। সেখানে অঙ্কুরিত হয়ে নতুন চারাগাছ জন্মায়। এমনকি এই ফল জলেও ভাসতে সক্ষম। 
ওকড়ার ফুল ফল ও পাতা

এই গাছের উপকারী গুণ তেমন নেই। বরং নানা ধরনের এলার্জির সৃষ্টি করে। ওকড়া ফুলের রেণু শ্বাস প্রশ্বাস এবং ত্বকের রোগের সৃষ্টি করে। এই গাছের বিভিন্ন অংশে Hydroquinine, Choline, Carboxyatratyloside সহ নানা বিষাক্ত অ্যালকালয়েড থাকে। গবাদি পশুর খাদ্য নয়। তারাও জানে যে এটি একটি বিষাক্ত গাছ। গ্রামের লোকজন জমি থেকে ওকড়া গাছ কেটে এনে শুকনো করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। তবে কিছু লোকচিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হয়। একে বলে আঢাসিসি। আসলে এই আগাছাটি সাধারণ রোগ হেমিক্রেনিয়ার নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। 

২০০৭ সালে বাংলাদেশের সিলেটে এক বন্যার প্রভাবে প্রচণ্ড দুরবস্থার মধ্যে পড়ে সেখানকার মানুষ। তখন তাঁরা না খেতে পেয়ে এই ওকড়া গাছকে 'ঘাগরা শাক' হিসেবে খেয়েছিল খিদে মেটানোর জন্য। সেবার এই ঘটনায় বিষক্রিয়ার দরুন মোট ১৯ জনের মৃত্যু হয়। আরও ৭৬ জন গুরুতর অসুস্থ হয় লাগাতার বমি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হয়ে।
🍂

Post a Comment

0 Comments