জ্বলদর্চি

স্পর্শ /কমলিকা ভট্টাচার্য

স্পর্শ

কমলিকা ভট্টাচার্য


একটা জরুরি কাজে নিশাকে হঠাৎ হায়দ্রাবাদ যেতে হবে। অফিস থেকে সরাসরি রেলস্টেশন চলে যাবে, অফিসে একটা জরুরি কাজ আছে, সেটা না সারলে নয়।
বাড়িতে থাকলে অরিত্র পৌঁছে দিত।


ব্যাঙ্গালোর থেকে সন্ধ্যে ৭:৩০ ট্রেন,
বিকেল ৫:৩০-এ অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছে, কারণ ব্যাঙ্গালোরের ট্র্যাফিক পেরিয়ে স্টেশন পৌঁছতে ঘণ্টা দুই লাগতেই পারে, যদিও রাস্তা মাত্র মিনিট চল্লিশের।
কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়!

নিশা যখন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছল, ট্রেন তখন জাস্ট চলতে শুরু করেছে।
নিশা দৌড়ে সামনের কামরায় উঠতে চেষ্টা করতেই একটা হাত এগিয়ে এলো, একঝটকায় নিশাকে ট্রেনে তুলে নিল।
নয় নয় করে বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, তাই দৌড়ে  বেশ একটু হাঁপ ধরে গিয়েছিল।
নিশা ছেলেটির মুখের দিকে না তাকিয়েই  হালকা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ ,তারপর তাড়াতাড়ি কামরার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, ভাগ্যবশত সে নিজের কোচেই উঠেছে।
নিজের সিটে বসে নিশা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

অরিত্রকে ফোন করে জানিয়ে দিল সে ট্রেনে বসে গেছে। কিন্তু এইভাবে ছুটে ট্রেন ধরেছে বললে সে রাগ করবে, তাই সেকথা চেপে গেল।
অরিত্র জানালো, সে অফিস থেকে ফিরছে, এখন জ্যামে আটকে, বাড়ি ঢুকতে ন’টা বেজে যাবে।
নিশা বলল, ফ্রিজ থেকে খাবার বার করে গরম করে যেন সে খেয়ে নেয়।
নিশাও অফিস থেকে বেরোনোর সময় ক্যান্টিন থেকে রুটি-সবজি প্যাক করে নিয়েছিল।

সবে এখন আটটা বাজে। ফোনটাকে ব্যাগের মধ্যে রেখে নিশা একবার চোখ বুলিয়ে নিল। চারপাশের বাকি যাত্রীদের দিকে।
তার উল্টো দিকের সিটে একটি বয়স্ক ভদ্রমহিলা, প্রায় সত্তর বছর তো হবেই, সঙ্গে মেয়ে — সেও প্রায় পঞ্চাশোর্ধ ।
বাকিরা সবাই পুরুষ যাত্রী, প্রত্যেকে নিজের নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত।কামরা জুড়ে নিরবতা আর মোবাইলের নীল আলো।
🍂

সত্যি, এই মোবাইলের যুগে কেউ আর কারও সঙ্গে কথা বলে না।
নিশার মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কোথাও ঘুরতে গেলে ট্রেনের কয়েক ঘণ্টার জার্নিতে আশপাশের যাত্রীদের সঙ্গে এমনভাবে যেন আত্মীয়তা গড়ে উঠত — গল্প করে সময় কেটে যেত।
আর এখন? কেউ কারও সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, মুখ তুলে তাকায়ও না।

নিশার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই অবশ্য সামনের বয়স্ক মহিলা হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
— "আকেলে যা রাহি হো?"

নিশা মৃদু হেসে বলল,
— "হ্যাঁ আন্টি, জরুরি কাম হ্যায়।"

এদিকে ভদ্রমহিলার মেয়ে দেখে মনে হয় অবিবাহিত এবং মাকে নিয়ে খুব বিরক্ত মনে হয়। তাই চোখের ইশারায় মাকে চুপ করতে বলল।
সবকিছু চোখে পড়লেও নিশা কিছু দেখেনি, এমন ভাব করে জানলার বাইরে তাকাল আর অবাক হয়ে ভাবতে থাকল —
 যখন তারা ছোট ছিল, তখন তাদের নানা দুষ্টুমিতেও মা কখনো এইভাবে বিরক্ত হননি। বরং হাসিমুখে  সব দুষ্টুমি সহ্য করতেন।
নিশা ভাবতে থাকে — বয়স হলে মানুষ তো বাচ্চাদের মতোই হয়ে যায়। তাদের সঙ্গেও ধৈর্য ও ভালোবাসা নিয়ে ব্যবহার করতে হয়।
কিন্তু আজকাল মানুষ নিজের কাজের হতাশায় ডুবে থাকে যে বৃদ্ধ মা-বাবার দেখাশোনা কিছুটা দায়সারা গোছের।

নিশার ছোটবেলায় বাবা মারা গেছেন। মা আছেন।
এদিকে শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেই মারা গেছেন।
নিশা মাকে একবার ফোন করে, কিন্তু ট্রেনে সিগন্যাল না থাকায় ফোন লাগে না।

রাত সাড়ে নটার দিকে খাবার খেয়ে নেয়।
এত তাড়াতাড়ি শোবার অভ্যাস নেই, কিন্তু ট্রেনে উপায় নেই, তাই শুয়ে পড়ে সে।
ক্লান্ত শরীর ঘুমিয়ে পড়ে ...

হঠাৎ নিশার  মনে হয় কেউ তার পা দুটো জড়িয়ে শুয়েছে।
নিশা ধপ করে উঠে বসে,
বিরক্ত হয়ে বলল,
— "কৌন হো ভাই? ইধার কিউ শোয়ে  হো?"

চিৎকার করতে ছেলেটি নিশার মুখের উপর আঙুল দিয়ে বলল—
— "চু..প... চু...প।"

নিশা খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে কিছু বলতে যাবে, ছেলেটি আবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করল —
— "আ... দ..."

কিন্তু কথা গুলো এত জড়ানো যে কিছু ঠিক করে বোঝা গেল না।
ট্রেনের ভিতরের অল্প আলোয় মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না, তবে ছেলেটির বয়স বছর কুড়ি-একুশ হবে।
নিশা ভয়ে চিৎকার করবে, আবার ছেলেটি ইশারা করে বলল,"চুপ..চুপ"
ছেলেটি অস্পষ্ট গোঙানির মতো আওয়াজ করে আবার কিছু বলল —
— "আ... দ...নী..."

তারপর সে নিজের আঙুল দিয়ে নিশার গালে হাত বুলিয়ে বলল,
— "সু ন দ র।"

নিশা চমকে উঠে,সারা শরীরে কাঁটা দেয় ... তবু স্পর্শটা খুব চেনা।

ততক্ষণে পাশের বার্থের দুই একজন উঠে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগল,
— "কি হয়েছে ম্যাডাম? ডিস্টার্ব করছে নাকি?"

ঠিক সেই সময় দরজা ঠেলে এক ভদ্রলোক এসে ছেলেটির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।
যাওয়ার আগে বললেন,
— "ম্যাডাম, I am sorry"

ছেলেটি যেতে যেতে অস্পষ্ট স্বরে আবার বলছিল —
— "আ... দ... রি..নী..."

মুখটা ভালোভাবে দেখা না গেলেও, ছেলেটির পোশাক দেখে নিশা বুঝতে পারল —
এই ছেলেটিই তাকে ট্রেনে হাত বাড়িয়ে তুলেছিল।

এইরকম একটি ঘটনায় এতটাই আচম্বিত নিশা যে সে কি করবে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।
কামরায় আবার আলো নিভে যায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু নিশার মনে ঝড়।

নিশার ঘুম আসে না, বসার উপায় নেই — মিডল বার্থে লোক।
নিশা উপুড় হয়ে শুয়ে জানলার বাইরে তাকায়।
ট্রেন ছুটে চলেছে — গ্রাম, মাঠ, নদী পেরিয়ে — ঘন অন্ধকারের মধ্যে মাঝে মাঝে এক ফালি আলোয় ধরা দিচ্ছে পৃথিবী।

নিশার মনের  আকাশেও সেই পুরোনো স্মৃতির ঝলকানি, সেই আলোয় ভেসে উঠছে আবছা একটা মুখ।
প্রায় ১৫বছর আগের কথা — একটা বাচ্চা, যাকে স্কুলে সামলাতে পারে না কেউ।
নিশার প্রথম দিন স্পেশাল শিশুদের স্কুলে।
আয়ারা বাচ্চাটিকে ধরতে তাড়া করে, বছর পাঁচের ছেলেটি নিশাকে জড়িয়ে তার পিছনে লুকোয়।
ইশারায় নিশা আয়াদের দূরে যেতে বলে, তারপর ছেলেটির হাত ধরে তাকে সামনে টেনে হাঁটু গেড়ে বসে স্নেহভরে জিজ্ঞাসা করে —
— "তোমার নাম?"

ছেলেটি নিশার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর একটা আঙুল নিশার গালে বুলিয়ে বলে —
— "সু ন দ র।"

তারপর নিজের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে —
— "আ... দ... র... চ।"

আয়া বলে —
— "ওর নাম আদর্শ, খুব নটি।"

ছেলেটি নিশাকে জড়িয়ে ধরে বলে —
— "আ... দ... রি... নী।"

নিশা মাথা নাড়ে। সে জানে, অটিস্টিক বাচ্চারা স্পর্শেই চিনে নেয় তাদের কাছের, ভালো লাগার মানুষদের।


নিশা সব মনে পড়ে অবাক হয় — একটা অটিস্টিক শিশু, আজ থেকে ১৫ বছরের আগের একটি স্পর্শ আজও মনে রেখেছে।
নিশার চোখের কোণে জল এসে জমে।
সে ভাবে উঠে আদর — মানে আদর্শ — কে খুঁজতে যাবে অন্য কামরায়।

ঠিক সেই সময় ট্রেন একটা স্টেশনে থামে।
নিশা জানলা দিয়ে দেখে আদরকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে তার বাবা।
আদর তখনও ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে — তার চোখ খুঁজছে তার আদরিণী টিচারকে।

নিশা জানলা দিয়ে হাত নাড়ে। সে জানে, আদর তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
মনে মনে বলে —
— "ক্ষমা করিস আমাকে। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একজন মানুষ হয়েও তোর আদরিণী টিচার তোকে চিনতে পারেনি।"

নিশা ট্রেনের কাঁচের জানলা স্পর্শ করে আদরকে ছুঁতে চায়।
ট্রেন স্টেশন ছাড়ে।
আদরের মুখ ধীরে ধীরে লোকের ভিড়ে মিলিয়ে যায়...

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments

  1. Sensitive exploration of bonding that crosses all boundaries. Will wait for more.

    ReplyDelete