জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা/কমলিকা ভট্টাচার্য

গুচ্ছ কবিতা

কমলিকা ভট্টাচার্য


উল্টো

আমার আলো ডাকে অন্ধকার
তোমার আঁধারে জন্মে জ্যোতি
আমার হাসি ভাঙে বারবার
তোমার কান্নায় শক্ত মতি।

আমার তাপে ফাটে মাটি
তোমার শীতে আগুন জাগে,
আমার পথে থামে গতি
তোমার থামায় দিগন্ত লাগে।

আমার স্বপ্নে জং ধরা
তোমার জাগরণে রোদ,
আমার বিশ্বাস ভেঙে পড়া
তোমার ভাঙনেই গড়া বোধ।

আমার শব্দে জমে নীরবতা
তোমার চুপে গান ফোটে,
আমার ভয়েই দৈন্যতা
তোমার সাহসেই ভোর ওঠে।

আমার প্রেম হিসেব বিহীন
তোমার ছোঁয়ায় অঙ্ক হারায়,
আমার থাকা ফাঁকা জমীন 
তোমার শূন্যই পূর্ণতা ছড়ায়।

আমি ডুবে খুঁজি তলদেশ
তুমি ভেসে পাও তীর,
আমার শেষেই শুধু শেষ
তোমার শুরুতেই ভবিষ্যৎ স্থির।

আমি নিভে যাই প্রদীপ হয়ে
তুমি আঁধারেই দাও দিশা,
আমার হারানো পথ বেয়ে
তোমার পাওয়াতেই ফেরে নিশা।


খুলে দাও জানলা

খুলে দাও জানলা—
একটু খুলে রাখো
পাখিটা খাঁচার আগল
কখন যে আলগা করে, কে জানে।

সে ডানা ঝাপটায়,
ঠোঁটে ঠোঁটে টকটক—
বন্ধ জানলার ভিভরে জমে থাকা জল
নাড়িয়ে দেয়।

একটা পাতা মুখে করে আনে সে,
যদি ঘর বাঁধে—
কিন্তু পাতা পড়ে থাকে
বন্ধ জানলার বাইরে।

পাখিটা যে উড়তে চায়।

শেষবার সে উড়বার স্বপ্ন দেখেছিল
এই ঘরের ভিতর—
এক কবির খাতার পাতায়।

তারপর সে ফিরে যায়,
সত্যিকারের খাঁচায়—
মিথ্যে কবিতায় নয়।

🍂

একটি তার

সব তার ছিঁড়ে গেলে শব্দ  শিখে নেয় নীরবতা,
দিন আর রাতের মধ্যে ফারাক নয় খালি সমতা।
অর্থ ঝরে যায় বাক্যের খোলস চেঁচে,
থাকে শুধু থাকা—নিজের দায় নিয়ে বেঁচে।

বিশ্বাস মানে অভ্যাস—অন্ধকারে হাঁটা,
আলো কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, কেবল ঘটনা।
শ্বাস চলে, তাই জীবন চলে—
কারণ-প্রমাণ জীবনকে কেউ দেয়নি বলে।

সত্য কোনো পতাকা নয়, তোলা-নামানো যায় না,
সে থাকে ক্ষয়ের ভিতর,বয়ে বেড়ানো যাতনা।
হার আর জয়—দুটোই মানুষের মাপ,
সময়ের কাছে দুটোরই সমান ভ্রান্তি ছাপ।

প্রকৃতি সাক্ষী নয়, নয় সে অভিযুক্ত,
তবু মানুষ পারেনা ভাগ্যদোষের দোহাই থেকে হতে মুক্ত ।
তবু ধ্বংসের ধ্বনির তলায় চাপা পড়ে থাকে
একটি স্পন্দন—নামহীন, পিছু করে ফেরে তাকে।

সবশেষে, যখন প্রশ্ন নিজেকেই প্রশ্ন করে,
কলম থামে না—থামে শুধু দাবি উত্তরে।
সব তার ছিঁড়েও একটি তার রয়ে যায়—
যা লেখার নয়, তবু লিখতে বাধ্য করে,মন জুড়ে ছায়।


প্রস্তুতি

তোমার কাছে এলে
আমার ভেতরের ঋতু বদলে যায়—
শুকনো দিনগুলো হঠাৎ
জল চিনে নিতে শেখে।

আমি আগুনে ঝাপ দিই না
শুধু আগুন ছুঁই
আর দেখি কোন তাপে
নিজেকে আলোকিত করা যায়।

অনেক আগেই তুমি
আমার অদেখা ঘরে ঢুকে পড়েছ—
যেখানে আলো থাকে কম,
কিন্তু শ্বাস রাখার জায়গা আছে।

আমি নিজের শরীরকে
মানচিত্রের মতো ভাঁজ করি,
যেন একদিন
তুমি পথ চিনে পৌঁছাতে পারো।

যদি কখনো আমার নীরবতার উপর
তোমার পা পড়ে,
জেনো—
ওটা অপেক্ষা নয়, প্রস্তুতি।

Post a Comment

2 Comments