মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৮৬
ড. প্রণব সাহু ( অধ্যাপক, ভূ-পরিবেশ বিজ্ঞানী, ঝাড়গ্রাম)
ভাস্করব্রত পতি
রাষ্ট্রপুঞ্জের Sustainable Development Goals প্রকল্পের ১৩ নম্বর পরিকল্পনার (Climate change and environment management) বাস্তবায়নে মুখ্য বিজ্ঞানী হিসেবে নিযুক্ত হন ঝাড়গ্রামের অধ্যাপক ড. প্রণব সাহু। এজন্য তাঁকে যেতে হয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম পিছিয়ে পড়া দেশ পশ্চিম আফ্রিকার গিনিতে। সেখানকার বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এবং গ্রামীণ উন্নয়ন নিয়ে সদর্থক কাজের পূঙ্খানুপুঙ্খ ধারার বিশ্লেষণে গিনিতে ছিলেন ২০২৪ এর ১১ ই অক্টোবর থেকে ১৪ ই নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৩৫ দিন। এরপর তাঁর সেই কাজের রিপোর্ট গিনি সরকার এবং International Chamber of Commerce থেকে প্রশংসা করা হয়েছে। গিনির মানুষের উন্নয়নে তাঁর দেখানো পথই অনুসৃত হচ্ছে। মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল থেকে আফ্রিকার গিনি -- দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের এক সেতুবন্ধ তৈরি করে দিয়েছেন তিনি।
ড. মৌসম মজুমদারের সাথে ড. প্রণব সাহু
পরিবেশ গবেষণা করা, আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ২০০৭ এ গঠন করেন Tropical Institution of Earth and Environmental Research নামে একটি সংগঠন। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক সুদীপ দের উদ্যোগে এই সংস্থা পরিবেশ গবেষণা, বনভূমি পুনঃস্থাপন, বৃক্ষরোপণ, জল সংরক্ষণ, খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীল গ্রামীণ উন্নয়নের নানা কাজের ওপর জোর দেয়। তারই ফলশ্রুতিতে ঝাড়গ্রাম জুড়ে নানা কর্মসূচি নিয়েছেন ড. প্রণব সাহু। এই কাজের অন্যতম 'গ্রীন ক্যাম্পাস' প্রকল্প।
তাঁর তৈরি 'ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট অব আর্থ "অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ' সংগঠন ঝাড়গ্রামের জামবনি ব্লকের জামডহরি গ্রামকে দত্তক নিয়ে গ্রামটির আদল বদলে দিয়েছে। এখানকার জনজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির ৬৮ টি পরিবারের ৩৪২ জন বাসিন্দার প্রতিদিনের গতানুগতিক ধারার এবং ম্যাড়মেড়ে জীবন জীবিকার পরিবর্তন ঘটাতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এই গ্রাম এখন জঙ্গলমহলের বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলা যায়। এখানে প্রশিক্ষন দিয়ে বাসিন্দাদের মাধ্যমে মাছচাষ, মাশরুম চাষ, হাঁস মুরগি পালন, সয়াবিন দুধ তৈরির কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। গ্রামের নার্সারিতে বিভিন্ন বাগান তৈরি হয়েছে। সেখানে আম, সফেদা, মিষ্টি ভুট্টা, আনারস লাগানো হয়েছে। এছাড়াও জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের পরিচিত শালপাতা, বাবুই ঘাস, বাঁশ থেকে নানা হস্তশিল্প তৈরির দিকে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে জামডহরি হয়ে উঠেছে গ্রামীণ পর্যটনের সফল নিদর্শন। ইকো টুরিজমের ক্ষেত্র হিসেবে এখানকার ১৫ জনকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মূলত দারিদ্রতা দূরিকরণ, শূন্য ক্ষুধা, সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিতে জামডহরী গ্রাম এখন তাঁর পাখির চোখ।
মায়ের সাথে....
ঝাড়গ্রামের রামকৃষ্ণ মিশনের বাসুতীর্থ ওয়াল গার্ডেনে 'বাসুতীর্থ ইনোভেটিভ রেন ওয়াটার হার্ভেস্টিং থ্রি আর মডেল' বানানোর কৃতিত্ব তাঁর। এখানেই ভূগর্ভস্থ জলের অনুসন্ধান ইউনিট গড়েছেন জলশক্তি মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মাটির চরিত্র জানার তাঁর হুগলীর শ্রীরামপুর কলেজে বিভিন্ন গাছের কিউ আর কোড প্রতিস্থাপন করেছিলেন প্রথম। এরপর ঝাড়গ্রামের সেবাভারতী মহাবিদ্যালয়ে করেছেন। ভূপৃষ্ঠের জল সংরক্ষনের মডেলও তিনি বানিয়েছেন নিজস্ব ভাবনা এবং নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতাকে পাথেয় করে।
রামকৃষ্ণ মিশনের গ্রিন ক্যাম্পাস প্রোজেক্টের চিফ কনসালটেন্ট এবং এসকর্ট হয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্রতী তিনি। আই আই টি খড়গপুরের মেটেরিয়াল সায়েন্স বিভাগের এয়ার কোয়ালিটি যন্ত্র নির্মাণে এক্সটারনাল এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করছেন। সাসটেইনেবল টুরিজম (ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি) এর কনসালটেন্ট পদেও তিনি রয়েছেন। চিল্কিগড় ডুলুং নদী, কনকদুর্গার অরণ্যের বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন জামডহরি গ্রামে
১৯৭৩ এর ২৬ শে নভেম্বর সবংয়ের বেলকি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ড. প্রণব সাহু। বাবা অশ্বিনী সাহু এবং মা ছবি সাহু। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বাবার মৃত্যুর পর জীবন যখন অথৈ জলে, তখন ব্যবহারিক শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁর মা'ই হয়ে ওঠেন জীবনের চলার পথের পথপ্রদর্শক। বর্ধিষ্ণু পরিবারের এই মহিলাই অধ্যাপক তথা ভূ পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. প্রণব সাহুর উত্তরণের সোপানরূপে নিজিকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর এই উত্তরনের মূলে এই অশীতিপর মহিলার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সবংয়ের বেলকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরুতে। এরপর চাঁদকুড়ি ইউনিয়ন হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক, বসন্তপুর ঝাড়েশ্বর বাণীভবন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে হলদিয়া গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে (১৯৯৬) ভূগোলে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৯৮ তে কানপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করে ১৯৯৯-২০০০ পর্যন্ত সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। পাঁশকুড়া বনমালী কলেজ থেকে ২০০০ সালে বি এড ডিগ্রি পাওয়ার পর ২০০১ এ ময়না মুদিবাড় বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠে ভূগোলের শিক্ষক হিসেবে এস এস সি থেকে নিযুক্ত হন। ফের পরীক্ষা দিয়ে ২০০৩ এ খড়গপুর তালবাগিচা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন।
২০০৩-২০০৪ পর্যন্ত রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি করতে শুরু করেন শিক্ষকতার পাশাপাশি। গবেষণার বিষয় ছিল "Late Holosin Geomorphological Changes and their Impact on Environment around the Dadanpatrabarh to Sankarpur Coastal area at PURBA Medinipur, West Bengal"। আজ থেকে ছয় হাজার বছর আগে কাঁথির কাছে অবস্থান ছিল সমুদ্রের। সমুদ্রের এই অবস্থানের পটপরিবর্তন নিয়েই তাঁর গবেষণার মূল উপজীব্য বিষয়। ২০১০ এ ঝাড়গ্রামের সেবাভারতী মহাবিদ্যালয়ে ভূগোলের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব নেন। প্রায় ১৫ বছর ধরে এখানে বিভাগীয় প্রধান হয়ে দায়িত্ব সহকারে কাজ করে চলেছেন।
নানা সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছেন কাজের স্বার্থে। রাষ্ট্রপুঞ্জের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইউ এন ভল্যান্টারি পিস অ্যান্ড প্রোগ্রামের সদস্য রয়েছেন। Global Forum for Sustainable Rural Development এরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি। বিহার ঝাড়খণ্ড অ্যাসোসিয়েশন অফ জিওগ্রাফার সংগঠনের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুকের তাম্রলিপ্ত ইউনিভার্সাল হেরিটেজ অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে চলেছেন।
কচিকাঁচাদের সাথে
তিনি তাঁর কাজের জন্য পেয়েছেন ন্যাশনাল এক্সিলেন্সি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫, ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক রিসার্চ এক্সিলেন্সি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পুরস্কার। Tamralipta Royal Dynasty নিয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম 'হেরিটেজ তাম্রলিপ্ত পিকক ডায়নাস্টি অ্যান্ড ইটস জার্নি' বানানোর জন্য ইউনেস্কোর দক্ষিণ কোরিয়া শাখা এবং তাম্রলিপ্ত রাজপরিবারের পক্ষ থেকে প্রশংসামূলক স্মারক সম্মান পেয়েছেন। বিশ্বের মোট ১১ টি দেশে এই ফিল্মটি প্রদর্শিত হয়েছে। ময়না গড় রাজবাড়ি নিয়ে আরেকটি ফিল্ম বানিয়ে ইণ্ডিয়ান পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট থেকেও স্মারক সম্মান পেয়েছেন। আলো ট্রাস্ট থেকে আন্তর্জাতিক 'বঙ্গরত্ন সম্মান' এবং আন্তর্জাতিক 'রবীন্দ্র সম্মান' পেয়েছেন।
এ পর্যন্ত লিখেছেন একটিই বই - Late Holosin Coastal and Environment (২০১৯)। বিভিন্ন জার্নালে লিখেছেন ২০ টি আর্টিকেল। সব মিলিয়ে ৮০ টি পেপার প্রেজেন্টেশন করেছেন পরিবেশ, উন্নয়ন নিয়ে। ইতিমধ্যে থিম সং লিখেছেন ঝাড়গ্রাম শহর নিয়ে (২০২১), বিবেকানন্দ ফুটবল কাপ (২০২২), রামকৃষ্ণ মিশন বিবেক রথ, পূর্বাশা ক্লাব, ভূগোল বিভাগ নিয়ে। ২০২২ থেকে ঝাড়গ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগের অতিথি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। শিক্ষা বিষয়ক প্রশাসনিক কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে।
তিনি চেয়েছেন নবগঠিত ঝাড়গ্রাম জেলার বিভিন্ন কোনে পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে। তিনি বিশ্বাস করেন, ঝাড়গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। তাঁর এই ভাবনার বাস্তবায়নে গত ২০১৮ সালে ঝাড়গ্রাম জেলা পরিকল্পনা দফতরকে এই গ্রামীণ পর্যটনের বিকাশে 'হোম স্টে' বানানোর উদ্যোগ নিতে প্রস্তাব দেন। এর মাধ্যমেই এখানকার গ্রামোন্নয়ন সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন। যার ফলশ্রুতিতে আজ ঝাড়গ্রাম এলাকার বিভিন্ন প্রত্যন্ত স্পটে রয়েছে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রায় ১০২ টি হোম স্টে। এই কৃতিত্ব প্রণব সাহুর।
ঝাড়গ্রামের সবুজ শালপাতা থেকে পরিবেশবন্ধব কয়লা বা বায়ো চারকোল বা বায়োচার তৈরির কাজ শুরু করেছেন। এই পরিবেশবান্ধব কয়লা নিয়ন্ত্রণ করবে পরিবেশ দূষণ। শালপতরি থেকে বায়োচার তৈরির এই ভাবনার বাস্তবায়ন করে নিদর্শন গড়েছেন তিনি। বিখ্যাত প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সহযোগী গবেষণা সংস্থার মুখ্য পরিবেশ বিজ্ঞানী হিসেবে এই দুর্দান্ত আবিষ্কার করেছেন।
0 Comments