জ্বলদর্চি

ইতু পূজা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৫৭

ইতু পূজা

ভাস্করব্রত পতি 

"করিলে ইতুর পূজা বন্ধ্যা নাম যায়। 
সময়েতে বিভা হয় তাহার মায়ায়।।
করিলে ইতুর পূজা দুঃখ হয় দূর। 
ধনে পুত্রে পৌত্রে বাড়ে সুখের সংসার।।"

ইতু পূজা আসলে সূর্যদেবের ঘট পূজা। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "অগ্রহায়ণ মাসে প্রতি রবিবার শষ্যসম্পত্তি কামনায় ক্ষুদ্র মৃন্ময় ঘটে এই পূজা করিতে হয়। ইহার নাম ইতুর ঘট বা ইতু। ঘটের মধ্যে মাটি ধান্য ছোলা মটর প্রভৃতি রবিশষ্য থাকে। সংক্রান্তিতে ঘটবিসর্জন হয়। মিত্র অগ্রহায়ণের আদিত্য। এই হেতু ঐ মাসে ইতুপূজা হয়। মার্গশীর্ষে তপেন্ মিত্রঃ"। আদিত্য হল অদিতির পুত্র। তথা সূর্য। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে। এই অবস্থানে সূর্যের নাম মিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ড. স্বপন কুমার ঠাকুর উল্লেখ করেছেন, "এই আদিত্য থেকে ইতু শব্দটি এসেছে। শাক্তধর্মের প্রভাবে ইতু ক্রমশ দেবীতে পরিণত হয়েছেন। সূর্যদেবতা থেকে ইতু শষ্যদেবী লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এইকারণে তিনি ইতুলক্ষ্মী নামে রাঢ়বাংলায় পূজিত"।

হরিবংশমতে দ্বাদশ দেবতার নামের একটি হল 'মিত্র'। বারোটি নাম হল ধাতা, অর্য্যমা, মিত্র, বরুণ, অংশ, ভগ, বিবস্বান, ইন্দ্র, পুষা, পর্জ্জন্য, ত্বষ্টা এবং বিষ্ণু। ত্বষ্টার কন্যা সংজ্ঞা সূর্যতেজ সহ্য করতে না পারায়, ত্বষ্টা সূর্যকে ১২ টি খণ্ডে ভাগ করেন। দ্বাদশ মাসে এই দ্বাদশ আদিত্যের উদ্ভব হয় (শব্দকল্পদ্রুম)। মাঘে অরুণ, ফাল্গুনে সূর্য, চৈত্রে বেদজ্ঞ, বৈশাখে তপন, জ্যৈষ্ঠে ইন্দ্র, আষাঢ়ে রবি, শ্রাবণে গভস্তি, ভাদ্রে যম, আশ্বিনে হিরণ্যরেতাং, কার্তিকে দিবাকর এবং অগ্রহায়ণে চিত্র (মিত্র)। 
সংস্কৃত মিত্র > প্রাকৃত মিত্ত > বাংলা মিতু > ইতু

মূলতঃ অগ্রহায়ণ মাসে ক্ষেত্রব্রত এবং বউঠাকুরাণী ব্রতের পরের দিন বা রবিবার ইতু পূজা করা হয়। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইতু পূজা করে অগ্রহায়ণের সংক্রান্তিতে পুকুর, নদী কিংবা কোনো জলাশয়ে বিসর্জন দিতে হয়। এসময় ইতুকে দেওয়া হয় এসকা বা আসকে পিঠা। কোথাও কোথাও কার্তিক সংক্রান্তিতে ইতু পূজা হয়। এর স্থানীয় নাম 'ইরতি'। সধবা নারীরাই এই ব্রত পালন করেন। মাটির হাঁড়িতে ইতু পাতা হয়। তাতে নানা ধরনের গাছ গাছালি ও গাঁদা ফুল দিয়ে Decorate করা হয়। ড. শীলা বসাক উল্লেখ করেছেন, "বাড়ির কুমারী ও সধবা মহিলারাই ইতুপুজো করে। তবে সন্তানবতী বিধবারাও এই ব্রত ইচ্ছা করলে পালন করতে পারে। ব্রতিনীদের কাছে ইতু লক্ষ্মীস্বরূপা। এই ব্রত পালন করলে ধনলাভ, পুত্রলাভ, দুঃখমোচন ও স্বর্গবাস হয়"। এই ব্রত পালন করলে ব্রতীনি মেয়েদের ভালো ঘরে বিয়ে ও উত্তম পাত্র লাভ হয় বলে বিশ্বাস।
'দাশরথী রায়ের পাঁচালী'তে পাই, "ঘন্টা নেড়ে দুর্গোৎসব, ইতুপূজোতে ঢাক"। যাইহোক, ইতু পূজার উপকরণ কি কি? হুগলীর গৃহবধূ শ্রীমতী মায়া মুখোপাধ্যায় নিজেই প্রতি বছর নিয়ম মেনে ইতু পূজা উদযাপন করেন বাড়িতে। তিনি জানান, সিঁদুর, ফুল, দূর্বা, তিল, হরিতকি, বেলপাতা, ধূপ, শেঁয়াকূল, দীপ, ফল এবং নৈবেদ্য ছাড়াও ইতুপূজায় লাগে মাটির সরা, ঘট এবং নানারকম শস্য দানা। লাল সাদা রঙে সাজানো মাটির ঘটটিতে দেওয়া হয় গোবর মেশানো মাটি। সেই মাটিতে বোনা হয় বীজ। এরপর কচি চারাগাছ অঙ্কুরিত হলে ধরে নেওয়া হয় তা সংসারের সুখ সমৃদ্ধি আসন্ন। ইতুর ঘটের গায়ে আঁকা হয় পুতুলি। ভেতরে দেওয়া হয় নানা রকমের শস্যদানা, দূর্বা এবং ফুল। খড় পাকিয়ে গোল গোল বিঁড়াতে বসানো হয় ইতুর সরা। এবার ঐ সরাতে দেওয়া হয় মাটি। মাটির সরায় জল ঢালবার সময় বলা হয় -- 
"তুলসী তুলসী নারায়ণ, 
তুমি তুলসী বিন্দাবন। 
তোমার শিরে ঢালি জল, 
অন্তিম কালে দিয়ো স্থল।।"
এছাড়াও কোথাও কোথাও অন্যভাবে বলা হয় -- 
"ইতু ইতু ব্রাম্ভণ
তুমি ইতু নারায়ণ।
তোমার শিরে ঢালি জল
অন্তিম কালে দিয়ে বল।
ইতু দেন বর।
ধনধান্যে পুত্র পৌত্রে বাড়ুক তাঁদের ঘর।
কাঠিকুটি কুড়াতে গেলাম, 
ইতুর কথা শুনে এলাম।
একথা শুনলে কি হয়?
নির্ধনের ধন হয়,
অপুত্রের পুত্র হয়,
অশরণের শরণ হয়,
অন্ধের চোখ হয়, 
আইবুড়োর বিয়ে হয়,
অন্তিম কালে স্বর্গে যায়।।"

মাটি পূর্ণ সরার মাঝেই ঘট স্থাপন করা হয়। আর অন্য অংশে থাকে কলমী, সরিষা, শুষনীর মূলসহ শাক। এছাড়া ধানের বীজ, মানকচুর মূলের সাথে ছোলা, মটর, মুগ, তিল, যব সহ আট রকমের শস্যের বীজও ছড়ানোর রীতি রয়েছে। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে ব্রতীনিরা উপবাসে থাকে। এরপর ঠাকুরকে 'সাধ' দিয়ে নিজেরা খায়। নানারকম পিঠে পুলি বানিয়ে সাধ দেওয়া হয়। এই সাধ দেওয়ার সময় তাঁরা বলে --
"চাল ক'টা দুই রাঁদ গো সখি, 
ভাত ক'টা দুই খাই। 
কুড়ির চুবড়ি মাথায় করে ছুতোর বাড়ি যাই৷ 
ও ছুতোর ভাই, ও ছুতোর ভাই, বাড়িতে আছ? 
আমার এঁথেল সাধ খাবে গো, ভালো চিঁড়ে চাই।।" (হুগলী)
প্রবন্ধকার পম্পা মণ্ডল এই সাধ দেওয়ার সময়কার কিঞ্চিত ভিন্ন একটি ছড়ার উদাহরণ দিয়েছেন --
"চালকটা দিয়ে রাঁধল সখী
ভাত কটা দিয়ে খাই,
কড়ির চুপড়ি মাথায় করে
গয়লাবাড়ি যাই।
গয়লাভাই গয়লাভাই
ঘরে আছো ভাই?
আমার ইতু সাধ খাবে
ভালো দুধ চাই"।

হুগলী জেলার বিভিন্ন এলাকায় ইতুপূজার ছড়ায় শোনা যায় -- 
"সুজনি কলমি লহ লহ করে। 
রাজার বেটা পক্ষী মারে।।
মারতক পক্ষ শুকোক বিল।
সোনার কৌটো রূপোর খিল।।
ছোটো মরায়ে পা দিয়ে বড়ো মরায়ে হাত দিয়ে
কিব রছ রাই ধানে বসে।
আমার জল তুলসী লাও নেমে এসে।।"
বিখ্যাত প্রবন্ধকার তথা আজকাল পত্রিকার খ্যাতনামা সাংবাদিক দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় (দে. মু.) তাঁর বাড়িতে গৃহিণীর ইতু পূজার যাবতীয় জোগাড়ের আয়োজন করে দেন ফিবছর। এই মডার্ণ দুনিয়াতেও একেলে গৃহবধূ ভুলে যাননি মা মাসিদের থেকে শেখা এই মেয়েলী লোকাচারটি। তাই নিয়ম করে পালন করেন ইতু পূজার রকমসকম। আসলে দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় এই সংস্কৃতিটি টিকিয়ে রাখতে চান অন্তর দিয়ে। গর্বিত মনে সেই তথ্য তুলেও ধরেন এলিট সমাজের সামনে। না, তাঁর কোনো লজ্জা নেই বাংলার এহেন লৌকিক উৎসবটির উপচার পালনে। তিনি অকপটে জানিয়েছেন গৃহিণী শ্রীমতী মায়া মুখোপাধ্যায়ের ইতু পূজা পালনের রীতি নীতি -- "প্রত্যেক পুজোর মতন ইতু পুজোতেও খাওয়া দাওয়ার বিধিনিষেধ আছে। দুপুরে সিদ্ধ ভাত আর রাত্রিবেলা ময়দা (পরোটা কিংবা লুচি) খাওয়ার নিয়ম। দিনের মধ্যে একবার ভাত খেতে হয়। অনেক বাড়িতেই ইতু পুজোর বিসর্জনের দিন পিঠেপুলি, পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে ‌যায়। কোথাও কোথাও ইতু পুজো ঘিরেই হয় নতুন ধানের উৎসব নবান্ন। সেদিন নতুন গুড় ও চাল দুধ দিয়ে পরমান্ন তৈরি করে নিবেদন করা হয়। ইতু লক্ষ্মীর কৃপার ফলে সবরকম সংকট ও বিপদ থেকে মুক্তি লাভ হয় এবং ধন, ধান্য, সৌভাগ্য ও স্বর্গ সুখ প্রাপ্তি হয়"।

ইতুর ব্রত কাহিনীতে উঠে আসে ইতুর পূজার রোমাঞ্চকর কাহিনী। অন্যান্য ব্রতকাহিনীর মতো এখানেও শোনা যায় ইতুকে অবহেলা করার প্রতিফল। এখানে শোনা যায় দরিদ্র ব্রাহ্মণ এবং তাঁদের দুই মেয়ে উমনো ঝুমনোর কাহিনী। এই ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করে চাল ঘি যোগাড় করেছে নিজের পিঠে খাওয়ার ইচ্ছে পূরণের জন্য। কিন্তু বামনিকে জানিয়ে দিয়েছে যে এই পিঠে যেন উমনো ঝুমনোকে একটিও না দেওয়া হয়। তবু সে স্ত্রীকে বিশ্বাস করতে পারলোনা। তাই রান্নাঘরের পেছনে বসে পিঠে গুনতে লাগলো। তাওয়ায় ছ্যাঁক করে আওয়াজ হয় আর গুনে রাখার জন্য দড়িতে গিঁট দেয় বামুন। এদিকে সুযোগ বুঝে উমনো ঝুমনোকে দুটো পিঠে খাওয়ায় মা। সেই অপরাধে তাঁদের পিসিবাড়ি রেখে আসার নামে বনে ছেড়ে চলে আসে তাঁদের বাবা। এখানে উমনো ঝুমনো বাঘের গর্জন শুনতে পায়। ঘোর বিপদে পড়ে তাঁরা। সেসময় ইতুপুজো করার পরামর্শ পায় একটা গ্রামের মধ্যে গিয়ে। সেই মতো তাঁরা ইতু পূজা করে। এবং ইতুর বরে রাজার মতো ঐশ্বর্যের মালিক হয়। বাড়ি ফিরে আসে দুই বোন। বাবা মা অবাক হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর মদ্রদেশের এক রাজপুত্র ও কোটালপুত্র তাঁদের দুই বোন উমনো ও ঝুমনোকে বিয়ে করে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উমনো আর ইতুপুজো করলনা। ফলে মদ্রদেশে দারুন কষ্ট নেমে আসে। রাজপুত্র একেবারেই ভিখিরি হয়ে পড়ে। সেখানে ঝুমনো দারুনভাবে সংসারে ঐশ্বর্য আনে। এরপর অবশ্য এই ঝুমনোর ইচ্ছায় উমনো ফের ইতু পূজা শুরু করে। প্রনামের সময় মন্ত্র হিসেবে বলা হয় --
"তুলসী তুলসী, মাধব লতা।
কও গো তুলসী কিষ্ণকথা।।
কৃষ্ণের কথা শুনলুম কানে। 
শতেক পরণাম তুলসীর চরণে।।"
ইতু পূজার ফলে উমনো সবকিছুই ফিরে পায় ইতু দেবীর কল্যানে। আর তখন থেকেই দেশশুদ্ধ সবাই ইতুর পূজা করে আনন্দে বসবাস করতে লাগলো।
ড. স্বপন কুমার ঠাকুর ইতুর বর্ণনায় লিখেছেন - "কাকভোরে বাড়ির উঠোন নিকিয়ে চুকিয়ে তকতকে। রাঙামাটির গোলা দিয়ে মেড়ুলির সজ্জা। চারপাশে দুধসাদা বাহারি আলপনা। শঙ্খলতা খুন্তিলতা চালতেলতার চিত্তির। লক্ষ্মীর প্যাঁজ। আর ফুলকারি নক্সা। শিশিরভেজা তুলসিতলা। ওখানেই পাতা হয়েছে ইতুর আটন। একটা মাটির সরা বা মালসায় একতাল মাটি। তাতে ধান, কচু, মান বা হলুদগাছ। পাঁচ কলাই ছড়ানো অংকুর। কোথাও বা খাড়া কঞ্চির উপরে ঝুলছে ধানের শিস। একখান পিদিম জ্বলছে। কিম্বা মোমবাতির নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। ইতুর ঘটে সিঁদুর দিয়ে পুতুল আঁকা। ঘটের কানায় জড়ানো কলমি আর শুশুনির দল দাম। বাড়ির গিন্নিরা সকালেই চান করে ছালের কাপড় পরে রেডি। ইতুর পুজো নিয়ে যাবে বামুনবাড়ি। পুজোর শেষে গোল হয়ে শুনতে বসবে ব্রতকথা। চাল কলা আর সিধে নিয়ে বামুনগিন্নী সুর করে বলবে ইতু ব্রতকথা"। 

ইতু পূজা আসলে শষ্যপূজা। পূর্ববঙ্গের কৃষিজীবী মানুষজনের কাছে ইতুর ব্রত পরিচিত 'চুঙ্গির ব্রত' বা 'চুঙির ব্রত' নামে। এখানে ঘটের পরিবর্তে চোঙ বা চুঙী বা চুঙ্গী ব্যবহৃত হয়। নলখাগড়ার গাছ ব্যবহার করা হয় চোঙ হিসেবে। এই চোঙের মধ্যে ২১ টি দূর্বা এবং ২১ টি আলোচাল রেখে তা দুধ দিয়ে ধুইয়ে সূর্যের কাছে নিবেদন করা হয়। ইতু পূজার ছড়াতে তাই মেলে সেই লক্ষ্মীরই গুনগান --
"ইতু তুমি লক্ষ্মী ইতু তুমি নারায়ণ। 
বছরান্তে ঘরে এসো পূজিব মা রাঙা চরণ।।"

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments