গুচ্ছ কবিতা
ঋদ্ধি সাহা
প্রেমের অন্তর্লিখন
অলস বিকেলের হাওয়ায় হঠাৎ তোমার ছায়া ভেসে এলে,
আমি বুঝলাম—প্রেম কখনো ফিরে আসে, কখনো ফুরোয় না।
দূরের রেলগাড়ির শব্দে যে কাঁপন ওঠে,
তা হয়তো তোমারই অনুচ্চারিত ডাক।
মলিন শহরের ভিড়ে আমি একা নই,
আমার পাশে লেগে থাকে তোমার ফেলে যাওয়া উষ্ণতা।
ঝরে পড়া পাতা যেমন জানায় ঋতুর বদল,
তেমনি তোমাকে মনে পড়লে সময় বদলায় নিঃশব্দে।
সন্ধ্যার আকাশে একটি মেঘ হঠাৎ গাঢ় নীল হয়,
সেই নীলেই মিশে থাকে আমার গোপন আকুলতা।
জলের ওপর আলো পড়লে যেমন নতুন মানচিত্র আঁকে,
তোমার স্মৃতি তেমনি আমার ভিতর নতুন পথ খুলে দেয়।
প্রেমের কোনো সীমানা নেই, নেই শেষ দৃশ্য,
আছে শুধু ভাঙা-গড়ার নিরন্তর অভিমুখ।
তাই আমি রোজ নিজেকে আবার নতুন করে গড়ি,
তোমার অদৃশ্য আলোর দিকে তাকিয়ে।
রাত্রির রথচক্র
অন্ধকার ভোরের আগে শহর জেগে ওঠে নিঃশব্দে
কারখানার চিমনিতে লুকানো মানুষের দীর্ঘশ্বাস
পাতাল রেলের গহ্বরে হারিয়ে যায় স্বপ্নের সিঁড়ি
রাস্তার ধুলোয় মাখামাখি শিশুর নীল শৈশব
গলিপথের বাতাসে ভাসে দগ্ধ কাঁচা রুটির গন্ধ
বৃদ্ধ ভিখারির কাঁপা হাতে কেঁদে ওঠে রোদ্দুর
ছিন্ন পত্রিকার কোণে গুটিয়ে থাকা খবর
যেন সমাজের ক্ষতচিহ্ন, অক্ষরে অক্ষরে ফাটল
বহুতলের জানালায় দপদপে নিঃসঙ্গ আলো
বুকের ভেতর ভাঙা স্বপ্নের চাবুকের আঘাত
পান্থশালার টেবিলে জমে থাকা কাঁচা নীরবতা
গৃহহীন যুবকের চোখে অগ্নিদীপ্ত আকাঙ্ক্ষা
মহল্লার পুরোনো দেওয়ালে লেখা ভাঙা স্লোগান
যেন শূন্যতার বুকে ফেটে ওঠা প্রতিবাদ
সন্ধ্যার শেষে শহর আবার নিজের ক্ষত ঢাকে
রাত্রির রথচক্রে গড়াতে থাকে অনাদৃত মানুষের দিনের গল্প।
নগর-অন্তরালের আগুন
নগরের বুকের ভিতর জ্বলে এক অনাদি আগুন,
যেখানে ইটের ফাঁকে ফোটা স্বপ্নেরা ধোঁয়ার মতো ওঠে।
মানুষেরা হাঁটে—মুখে আলো, চোখে অন্ধকারের বিস্ময়,
সেখানে পথের ধারে সময় বসে থাকে ভাঙা পাথরের মতো।
বৃষ্টির জল নামে—কিন্তু দাহ মুছতে পারে না,
কারণ এই শহর নিজের ক্ষতই নিজে লালন করে।
অটল দালানগুলো দাঁড়িয়ে থাকে প্রহরীর মতো—
তবু ভিতরে শুনি ভাঙনের ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে আর্তনাদ।
এক কোণে শিশিরের মতো নরম একটুখানি আশা জন্মায়,
যেন ধূসর ছাদের উপর ফুটে থাকা একমাত্র ঘাসের রেখা।
কিন্তু লোভের লোহার নখর সেদিকেও ধেয়ে যায়—
আর সবুজের পাঁজর চিরে ফেলে লাম্পট্য নগরসভ্যতা।
তবু মানুষ থামে না—তার রক্তে পুরোনো বিদ্রোহের দাহ,
আর অন্ধকারের ভিতর সে খুঁজে ফেরে নিজের আলোকছায়া।
শেষে শহরের অন্তঃস্থলে জেগে ওঠে এক নীরব ডাক—
যা বলে, “ভাঙনেও জন্ম নেয় নতুন শহর, নতুন মানুষ,
আর আগুনের গর্ভেই তৈরি হয় প্রথম অঙ্কুর।”
🍂
অরণ্যপ্রান্তে জ্বলে ওঠা নক্ষত্রের দিগন্ত
নিভে যাওয়া পথের ধুলোয় সন্ধ্যার রক্তিম গন্ধ ভাসে—
অশ্বত্থের ছায়ায় লুকিয়ে থাকে পুরনো দিনের কালিমা।
বনপাখির ডাকে হঠাৎ কেঁপে ওঠে মাটির অন্তর্গত স্মৃতি,
অর্ধচন্দ্র ঝুলে থাকে আকাশের নীরব কপালজুড়ে।
শুশুনের গর্ত থেকে উঠে আসে অদৃশ্য কোনো হাহাকার,
তারার দেহে লেগে থাকা অদ্ভুত পেঁচানো আলোর মতো।
জলাভূমিতে মাথা তোলে কুয়াশা—মৃত সাপের শান্ত নিঃশ্বাসে,
ভেসে আসে দূর নদীর ডাকে অপরূপ বিরহের শিহরণ।
কঞ্চিপাতার ডগায় থমকে থাকে শিশিরের নীল শপথ,
যেন অচেনা কোনো দেবতার গোপন আঙুলের স্পর্শ।
গাঢ় কালো রাত জুড়ে মিশে যায় পরিত্যক্ত গৃহের শব্দ,
স্মৃতিহীন প্রতিধ্বনির মতন ভেসে আসে জ্যোৎস্নার ধূলিকণা।
বাতাসের ভাঙা ডানায় অচেনা আঘাতের নকশা আঁকা,
নীরবতা ফুঁড়ে উঠে দাঁড়ায় অপরূপ কোনো ক্লান্ত উত্তাপ।
শেষ প্রহরে পাহাড়ের কণ্ঠে বাজে কর্কশ এক অনুরণন—
সেই সুরে লুকিয়ে থাকে জন্মানো সব অশরীর অভিমান।
অগ্নিবীজের নীরবতা
প্রান্তরের বুক চিরে যে আলো ওঠে, তার ভেতরই প্রথম দগ্ধ হয় স্বপ্ন।
এক ফোঁটা বাতাসের কাঁপুনিতে ছাইয়ের নিচে জেগে থাকে অব্যক্ত ইতিহাস।
ভাঙা পাথরের গায়ে হাত রাখলে বোঝা যায়, ক্ষতই পৃথিবীর প্রাচীনতম লেখা।
জলস্রোতের বুকে ভেসে থাকা ডালের মতো প্রতিটি সিদ্ধান্তই ভাসমান সত্য।
রাতের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে দেখি, অন্ধকার আসলে কেবল এক পুনর্জন্মের ঘর।
নক্ষত্রেরা দূরের আগুন, তবু তাদের আলোতে মানুষের অন্তর্লোকের মানচিত্র আঁকা।
অপরিচিতের দৃষ্টিতেও কোনো অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি লুকিয়ে থাকে, স্পর্শহীন অথচ সত্য।
যে শব্দ উচ্চারণ হয় না, তারাই চুপিচুপি বদলে দেয় জগতের ভরকেন্দ্র।
ভাষার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বোঝা যায়—
প্রতিটি বাক্যই ক্ষুধার্ত; তাকে পূর্ণ করতে হয় আত্মার অগ্নিস্রোত দিয়ে।
মাটির গভীরে নেমে থাকা শেকড়েরা শেখায়, থিতিয়ে থাকাই সবসময় স্থিরতা নয়।
নির্বাক পাখিদের ডানায় লেগে থাকে অনুচ্চারিত দিনের গোপন উষ্ণতা।
আমি যখন নিজেকে ছুঁই, দেখি বিস্মৃত করে রাখা এক জ্বলন্ত লণ্ঠন।
মানুষের ভিতরই লুকানো থাকে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের নরম ছায়া।
আর প্রতিটি ছায়ার মধ্যেই জন্ম নেয় আরেকটি আলোর অভিসার।
1 Comments
ভালো লাগলো ।আরো কবিতা আসুক।
ReplyDelete