গল্প ধারাবাহিক
কুয়াশা যখন
পর্ব ৮
বাসুদেব গুপ্ত
একটু আলোর ঝলকানি
স্বপন চায়ের দোকানে বসে। সকাল থেকে কিছু খায়নি, ঊষা হাসপাতালে, বাচ্চার পাশে। OPD-তে ওড়না বিছিয়ে পড়ে আছে, দরকার হলে ডাকবে। চায়ের দোকান ফাঁকা। স্বপনের পর প্রথম খদ্দের এল, রহিম। তার বাইকটা জলের মধ্যে ঢেউ কেটে ছোট নৌকার মতো এসে থামল। ওকে দেখেই হাত নাড়ল, —“কী স্বপনদা, এখন ৯টা, অফিস যাচ্ছো না? বৃষ্টি হয়েছে তাই ছুটি নাকি?”
—“ধুর, ছুটি নয়। ছাঁটাই হয়েছি। কিছু করার নেই, বসে আছি। এমনি। তোর ডেলিভারি কেমন চলছে?”
—“চলছে। ও পান্ডে ভাই, তাড়াতাড়ি এক কাপ চা দাও মালাই দিয়ে। আর একটা বিস্কুট। ১৫ মিনিটে পৌঁছাতে হবে। অন্যদিক ১০ মিনিট, আজ বৃষ্টির জন্য ১৫। কোম্পানি ভাই খুব দয়ালু ।”
—“সাবধানে চালাস, লেক সাইড রোডে একটা ম্যানহোল খোলা। কোনো খুঁটি ছুঁবিনা, কারেন্ট থাকতে পারে। তোর কী অর্ডার এটা?” রহিম চা কাপ থেকে সসারে ঢেলে চুমুক দিল, হুস হুস করে ফুঁ দিয়ে শেষ করল। বাইক স্টার্ট দিল। —“মাস্টার্ড সিড, বেগুন, লিপস্টিক আর ইলিশ মাছ—কি কম্বো! বা-ই” বলে রহিমের বাইক এবার মোটর বোটের মত, বড় বড় ঢেউ তুলে উধাও।
স্বপন চন্দনকে দুবার ফোন করল। কোনো উত্তর নেই। চন্দন অফিস কল নিতে চায় না, বেশি ফোন করলে বিরক্ত হয়। দুপুর ১টায় অবশেষে চন্দনের ফোন এল। স্বপন তখন পান্তা ভাত আর পেঁয়াজ খেয়ে ঢুলছিল। ঊষা ফেরেনি।
—“স্বপন, কিছু করতে পারব না, দুঃখিত। হিকোমা বলেছে, পুরনো কর্মীদের কন্ট্রাক্টে নেবে না। এতে অ্যাডমিন সমস্যা হবে।”
—“তাহলে আমার কী হবে? এত কিছু কিনলাম? কোম্পানীর নাম এপ্লাই করলাম।”
—“বলেছিলাম, হিকোমা অনুমতি না দিলে কিছু করিস না।”
—“কীভাবে করব না, খেতে হবে, পরিবার আছে।”
স্বপন প্রায় কাঁদো কাঁদো।
—“এটাই, এখন আর ফোন করিস না, অনেক অ্যাকাউন্টের কাজ, CA-র কাছে যেতে হবে, খুব চাপ। নিজের যত্ন নিস। ভালো থাকিস। ”
শেষের ‘ভালো থাকিস’ শুনে স্বপনের মাথায় একটা বোমা ফাটার শব্দ হল। মনে হল ফোন্টাকেই পায়ের নীচে মাড়িয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলি। ঊষা ফিরেছে, আয়েশাকে নিয়ে। দরজায় কোন খিল নেই। স্বপন চুপ করে এক কোণে বসে ভাবতে লাগল।
🍂
বিকেলে বৃষ্টিটা ধরে এল। স্বপন চলল হার্ডওয়্যার শপে কেনা জিনিস ফেরত দিতে। দোকানদার বাদল, চেনা লোক, স্বপন প্রায়ই দেয়াল রঙ করতে, টিনের ছাদ ঠিক করতে ওর কাছ থেকে জিনিস কেনে। বাদল সবসময়ই গম্ভীর, হয়তো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা।
—“বাদলদা, ব্যবসা চৌপাট, অর্ডার বাতিল। সব ফেরত দিতে হবে।”
—“তুই কি পাগল? আমি অ্যামাজন নাকি? রিটার্ন করলেই হল। আজ সারাদিনে মাত্র দুজন কাস্টমার, সন্ধ্যায় এখনও বউনি হয়নি, টাকা ফেরত দিতে পারব না।”
—“বউনি সন্ধ্যায়ও হয় জানতাম না। নাও না গো ফিরিয়ে। ফেরত দিলে সেই টাকায় ছোটগুলোর মুখে খাবার জুটবে। অনেক টাকা খরচ করেছি। কী খারাপ দিন যাচ্ছে।”
—“১০০ টাকা নিয়ে যা। কাল দুপুরে আয়। দেখি কতটা ফেরত দিতে পারি। কিছু তো কাটবই। এই কাপড়গুলো ফেরত নেব না, সব ভিজে গেছে। আর ক্লিনিঙ্গ লিকুইডটা তো আনিস নি”
-ওটা জলে ধুয়ে গেছে। ধরা পড়া মুখ করে হাসল স্বপন। আপাতত ১০০ টাকা নিয়ে ফিরল। দু পেগ আর একবাটি চাট হয়েও কিছু থাকবে।
দিন যাচ্ছে কিন্তু বৃষ্টি যাচ্ছে না। বৃষ্টি যেন অবাঞ্ছিত কুটুম, বেড়াতে এসে আর যেতে চাইছে না। স্বপন ভাবল রহিমের সঙ্গে কথা বলি। রহিমের প্রথম চাকরি চাইনীজ রেস্টুরেন্ট নিং শিনে ওয়েটার। স্বপনের খুব চেনা ছিল সবাই, কতবার অফিসের লাঞ্চ পার্টির জন্য চাইনীজ অর্ডার আসত নিং শিন থেকে। স্বপন অনেক বলার পর ওর কথায় রহিমকে নিয়েছিল, রহিমও ওর মান রেখেছিল। রহিমকে বলে যদি ডেলিভারি কম্পানিতে কিছু হয়। কিন্তু রহিমের কাছে যেতে দ্বিধা হয় স্বপনের। যেন ও ছোট হয়ে যাবে ওর কাছে। কিন্তু ক্ষুধার কোনো দয়া নেই। রহিম মুসলমান, দেশের নেতারা সারাক্ষণ তাদের তাড়িয়ে দেবার বা সংহার করার কথা বলে। রোজ সন্ধ্যেয় টিভির দাদা দিদিরা তালি বাজায়। কিন্তু স্বপনের ওসব ভাবলে চলে না। গরীব মানুষের কি ধর্ম আছে? ওর নিজের বৌ ঊষাই যে আসলে রেহানা, মুসলিম, সেটাই বা কজন জানে?
স্বপন সেই কবে থেকে রহিমকে চেনে। স্কুলের ক্লাস শেষ হতেই ওরা দৌড়ত স্টেডিয়ামের গায়ে লাগা ফুটবল ক্লাসে। দুজনে ফুটবল খেলত একসাথে। রহিমের পেনাল্টি কিক ছিল দারুণ, আর স্বপন ছিল গোলরক্ষক। একবার এক কান্ড হল। রহিম বলল আজ ও মারাদোনার মত কিক মারবে, দেখি কে আটকায়। রহিমের পা বলে, স্বপন গোলে। চোখের পলক ফেলতেই রহিমের কিক সরাসরি এসে লাগল ওর মুখে। মাথাটা ঘুরে গেল, স্বপন পড়ে গেল সেন্স হারিয়ে। সবাই বলেছিল, রহিম নাকি ছুটে এসে ওকে ধরে কাঁদতে শুরু করেছিল।
কোচের কয়েক দফা জলের ঝাপটা দেওয়ার পর স্বপন যখন উঠে দাঁড়াল, তখন দেখল রহিমের মুখটা—কাঁচুমাচু, চোখে মিনতি, হাত দুটো জোড় করা, যেন ও কোন বড় অপরাধ করে ফেলে ক্ষমা চাইছে।
“আমি আর পেনাল্টি কিক মারব না। কোনদিন মারব না। স্বপনদা, তুমি আমাকে এবারের মত মাফ করে দাও, প্লীজ। আমার গুনা হয়ে গেছে, মাফ করে দাও প্লীজ প্লীজ।”
স্বপন একটু ঠিক হতে রহিম ওকে ওদের পাড়ার ডাক্তার কাকার কাছে নিয়ে গেল, সেখানে চেক টেক করে রহিমের বাড়িতে। সেখানে রহিমের মা গরম মুসুর ডালের শোরবা পাঠিয়ে দিল কাঁচের বাটিতে। স্বপনের মা নেই, শোরবা খেয়ে না এই যত্ন পেয়ে, চাঙ্গা হয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ে।
তবে রহিম সত্যিই সেই দিনের পর থেকে ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিয়েছিল। কারা ওর দাদাকে হুমকি দিয়েছিল, যদি আবার কোনো হিন্দু ছেলেকে আঘাত করে, তবে কিন্তু বিলা হতে পারে।
-ক্রমশঃ-
2 Comments
ভালো লাগছে।চলুক।💚
ReplyDelete❤️Thank you.
Delete